সৎ ভাবে উপার্জিত এক টাকা অসৎ ভাবে উপার্জিত কোটি টাকার চাইতেও অনেক মূল্যমান
শিমুল গাছ লাগানোর জন্য আলাদা কোনো আবাদি জমির দরকার হয় না। এ গাছ লাগাতেও কোনো খরচ হয় না। বীজ থেকে প্রাকৃতিকভাবে এর গাছ হয়ে থাকে। এর ডাল মাটিতে পুঁতে দিলেও শিকড় গজিয়ে গাছ হয়। এ গাছ সহজে বেড়ে ওঠে।
কোনো সার-কীটনাশক লাগে না। শুধু দরকার একটু পরিচর্যা। আর এতেই শিমুল গাছ বড় হয়ে উঠলে হওয়া যায় প্রচুর লাভবান। সাধারণত একটি গাছ থেকে প্রতি সিজনে ১০ থেকে ১৫ কেজি তুলা পাওয়া যায়। তবে একটি সুস্থ-সবল পূর্ণবয়স্ক প্রকাণ্ড গাছ থেকে সঠিকভাবে তুলা সংগ্রহ করতে পারলে প্রতি সিজনে প্রায় ৩৫ থেকে ৪০ কেজি তুলা পাওয়া যেতে পারে।
গড়ে ১২০ টাকা কেজি দরে যার বাজারমূল্য দাঁড়ায় ৪২০০ থেকে ৪৮০০ টাকা। এছাড়া এর কলার খোসা ও ডাল-পালা জ্বালানি হিসেবে বিক্রি করেও আয় হতে পারে। আর গ্রামীণ পরিবেশে একটি বাড়িতে একোণা-সেকোণায় অনায়াসে ৫/৬টি গাছ রোপণ করা যায়। যার থেকে ৪/৫ হাজার টাকা বিনা পুঁজিতে এবং সামান্য শ্রমের বিনিময়ে আয় করা সম্ভব। তবে গাছ বিশাল আকৃতির না হলেও ৫/৬টি গাছ থেকে ২০/২৫ হাজার টাকা আয় করা সম্ভব।
এছাড়া গাছের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন পরিত্যক্ত জায়গাও বেছে নেয়া যেতে পারে। করা যেতে পারে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে শিমুল গাছ রোপণের কাজ।
এক সময় শিমুল ফুটে রক্তিম আভা ছড়াত। জানান দিত বসন্ত এসেছে। গ্রাম-গঞ্জের পথে-প্রান্তরে, মাঠে-ঘাটে, বাড়ির এপাশ-ওপাশে রক্তরাঙা ফুল ফুটে উঠত।
প্রকৃতিও ভরে উঠত অনাবিল সৌন্দর্যে। আজ সবই অতীত। সবই ইতিহাস। এখন আর তেমন একটা চোখে পড়ে না শিমুল গাছ। চোখে পড়ে না শিমুল ফুল।
এখনও যথেষ্ট গুরুত্ব থাকা সত্ত্বেও দিন দিন কমে যাচ্ছে শিমুল গাছের সংখ্যা। প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে বহুবিধ ব্যবহারের মূল্যবান এই গাছটি।
শিমুল গাছের কথা এলে এসে যায় শিমুল তুলার কথা। যে তুলার নরম তুলতুলে বালিশ-তোশক মাথার আরামের পাশাপাশি দেহে দেয় বিরাম। এখন আর সে তুলার বালিশ মাথায় জোটে না।
আর তোশক তো উধাও। একদিকে বিলুপ্ত হচ্ছে শিমুল গাছ, অন্যদিকে দুষ্প্রাপ্য হচ্ছে শিমুল তুলা। আর সেখানে দাপটের সঙ্গে রাজত্ব করছে গার্মেন্টের তুলা। তবে শিমুল তুলা যে একেবারে নেই তা নয়। রয়েছে কিছুটা।
দাম আকাশছোঁয়া। ফলে সাধ থাকলেও সাধ্য হয় না অনেকেরই শিমুল তুলার নরম তুলতুলে বালিশে মাথা ডুবোতে। অথচ এক সময় এবাড়ি-ওবাড়ি বিনে পয়সায় শিমুল তুলা দেয়া-নেয়া হতো।
সাধারণত চৈত্রে শিমুল তুলা সংগ্রহ করতে হয়। ফাল্গুনে ফোটে ফুল।
আর এই ফুলের ভেতরে হয় কলা। ফুল ফুটে ঝরে পড়ে। কলা গাছে থেকে হয় পরিপকস্ফ। আর এই কলা ফেটে বের হয় তুলা। তবে কলা গাছ থেকে সংগ্রহ করা কিছুটা কঠিন।
কেননা গাছের কাণ্ড জুড়ে থাকে সুঁচালো কাঁটা। ফলে সঠিক সময় কলা সংগ্রহ না করায় তা গাছেই শুকিয়ে ফেটে যায় এবং তুলা বাতাসে উড়ে যায়। সঠিক সময়ে সংগ্রহের অভাবে অনেক তুলাই নষ্ট হয়ে যায়। তবে চৈত্রের শেষের দিকে যখন দু’একটা কলা গাছেই ফেটে যেতে থাকে, তখনই কলা পাড়ার ব্যবস্থা করতে হয়। ফলে তুলা বাতাসে উড়ে গিয়ে নষ্ট হতে পারে না।
শিমুল গাছ ৪০ থেকে ৫০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। ডাল-পালাও থাকে প্রচুর। কাণ্ডে কাঁটা থাকলেও কৌশলে কলা সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। সাধারণত মই বা বাঁশের খুঁটি বেয়ে কাঁটা এড়িয়ে গাছের উপরে উঠে তারপর কুটার সাহায্যে কলা পাড়তে হয়। এরপর কলা রোদে শুকোতে দিলে ফেটে তুলা বের হতে থাকে।
কলা চিরেও তুলা বের করা হয়ে থাকে। তারপর কলার খোসাগুলো তুলা থেকে হাতের সাহায্যে আলাদা করে নিতে হয়। তুলা রোদে কিছুক্ষণ শুকিয়ে নিতে হয়। এতে তুলার মান ভালো হয়। আর এসব কাজ করতে হয় সুকৌশলে নেট বা জালে ঢাকা দিয়ে, যাতে তুলা বাতাসে উড়ে যেতে না পারে।
শুধু তুলা নয়, এ গাছের আরও অনেক কিছুই নানাভাবে ব্যবহৃত হয়েছে, এখনও হচ্ছে। এক সময় রক্তবর্ণ এই শিমুল ফুল প্রাকৃতিক লাল রং তৈরিতে ব্যবহৃত হতো। কবিরাজি ওষুধ তৈরিতেও শিমুল ফুল এবং ছোট গাছের শিকড় ব্যবহার হতো অনেক। এখনও হয়, তবে খুবই কম। কেননা কবিরাজ কমে গেছে।
কমে গেছে কবিরাজি ওষুধ।
কাঠের ক্ষেত্রে শিমুল কাঠ খুব একটা মজবুত নয়। তবে এর ব্যবহার বহুবিধ। সোজা, নরম ও দাম কম হওয়ায় বিল্ডিংয়ের সাটারিং হিসেবে শিমুল কাঠ ব্যাপক ব্যবহৃত হয়। দিয়াশলাইয়ের কাঠি তৈরিতে ও বিভিন্ন ব্রাশের হাতল তৈরিতে শিমুল একটি উত্কৃষ্ট কাঠ হিসেবে বিবেচিত হয়।
এছাড়া চকি, চেয়ার, টেবিলজাতীয় হালকা কম দামি ফার্নিচারও এই কাঠ দিয়ে তৈরি করা যায়। এর কলার খোসা জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ডাল-পালাও প্রচুর থাকে বিধায় এগুলোও জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার হয়।
প্রয়োজনে ভরা এই শিমুল গাছটি এক সময় গ্রাম-বাংলার প্রায় প্রতিটি বাড়িতে একাধিক দেখা যেত। এছাড়া রাস্তার ধার, পুকুরের পাড়, রেললাইনের পাশ, জমির আইলসহ বিভিন্ন পরিত্যক্ত জায়গায় প্রচুর দেখা যেত এই গাছ।
এনমকি শহরাঞ্চলেও ছিল অনেক শিমুল গাছ। আজ সে দৃশ্য পাল্টে গেছে। গ্রামের দু’একটা বাড়িতে দু’একটা শিমুল গাছ দেখা গেলেও এমন অনেক গ্রাম রয়েছে যেখানে এ গাছ চোখেই পড়ে না। আর শহরাঞ্চলে শিমুল গাছের কথা তো ভাবাই যায় না। শহরের বর্তমান প্রজন্মের অনেকে শিমুল গাছ বা ফুল চিনেই না।
মূলত বাড়ছে মানুষ, বসতবাড়ি। হচ্ছে নগরায়ন-শিল্পায়ন। কমছে শিমুল গাছ। বিশেষ করে শিমুল গাছের গুরুত্ব সম্পর্কে অজ্ঞতা, ম্যাচ ফ্যাক্টরির একটি গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামাল হিসেবে এবং বিল্ডিং নির্মাণের সাটারিংয়ের কাজে এর বহুল ব্যবহারের ফলে দিন দিন বিনাশ হচ্ছে এই গাছ। সর্বোপরি মানুষের অবহেলা ও অসচেতনতার কারণে এমনকি অনেকে এর চারাকে আগাছা ভেবে উপড়ে ফেলার কারণে শিমুল গাছের সংখ্যা অনেক কমে গেছে এবং প্রায় হারিয়েই যেতে বসেছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।