আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মাধবী ও ধূম্রান্ধদের গুনাহনামা

প্রকৃতিকে করো তব দাস-চে দ্য আইডল (ব্লগার নং - ৩১৩৩৯)
কুয়াশার ভেতরে কাদাখোঁচার চঞ্চুর মত ঝিরঝির চাঁদের আলো ঢুকে পড়লে আমাদের ন্যাড়া ইশকুল মাঠে ফিসফাস উঠে। বাতাসের সাথে অবাতাসের কথোপকথন। বালির বুকে সুন্দরের ঘুম ফুরিয়ে কয়েকটা কচি ঘাস জন্মায়। আমরা কেউ কেউ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ি। সুন্দর! পুনরাবৃত্তিপ্রিয় কেউ কেউ আরেকবার বলি।

সুন্দর। তারপর চোখের ভেতর বালি আর চাঁদের কৌমার্য যুবতী হয়ে উঠলে দেখা যায় ওপাশের ছনখোলায় নাকডোবানো শেয়ালিনীর শীৎকার আর শেয়ালের আর্তনাদ। আমাদের কেউ কেউ লুঙি পরে। কেউ বা পাজামা। লুঙিঅলাদের কোঁচড়ে মড়ার গন্ধ প্রকট হয়ে উঠলে আমাদের মনে পড়ে, মুহিব্যার বাপে আর নাই।

অবিন্যস্ত চুলের রুক্ষতায় অর্ধাবৃত আমাদের কানগুলো কোথাও কোন শব্দ শনাক্ত করতে পারে না এমন কি শেয়ালিনীর শীৎকারও না, তাই আমরা মনে করি মুহিব্যার বাপে বেবাক লইয়া গ্যাছে! জোছনার ভেতর আমরা এবার কুয়াশাকে ঢুকে পড়তে দেখি। আমরা জোছনা খেতে খেতে ভাবি আমাদের সারাটা দিন নিরানন্দে কাটেনি। মুহিব্যার বাপের মৃত্যুসংবাদ প্রচারের দায়িত্ব আমাদের ময়লাধিক্যে কৃষ্ণকায় ও কৃশকায় ঘাড়ে চেপে বসলে আমরা প্রথমেই পঞ্চাশ পয়সার সিগারেট কে হাতের ভাঁজে ডলে ডলে শুন্যগর্ভ করে মাদকপাতা ঠেসে দম দিয়ে নিয়েছিলাম। তারপর পালা করে মুহিব্যার বাপের মৃত্যুসংবাদকে বিশেষভাবে আখ্যায়িত করে মুহিব্যাদের ঘরে ঢুকেছিলাম। আমাদের ঘোলাটে চোখগুলো মুহিব্যার বাপের মরামুখে পিছলে পড়ে ভাঙতে ভাঙতে মুহিব্যার ভেজা গাল ছুঁয়ে মুহিব্যার বোনের গলায় গিয়ে থামে।

মুহিব্যার বোনের দোলকান্নার সম্মুখপর্যায়ে আমাদের দৃষ্টি বারবার মুহিব্যার বোনের ব্লাউজের ফাঁক গলে ভেতরে ঢুকে পড়ছিলো। আমাদের চেষ্টা ছিলো মুহিব্যার বাপের আধখোলা চোখের ভাষা বুঝে নেয়ার কিংবা মুহিব্যার ভেজাগালের ভেতর কান্নার অস্তিত্ব আবিষ্কারের কিন্তু আমরা কেবল মুহিব্যার বোনের ব্লাউজের সেলাই গুণছিলাম। মুহিব্যার বাপের মরামুখ বাঁশের মিছিল আর মাটির শ্লোগানে ঢেকে ঘরে ফিরলে মুহিব্যার বোন মুহিব্যার গলা জড়িয়ে কেঁদে উঠলে আমরা আপনাদেরকে মুহিব্যার স্থানে কল্পনা করে শিউরে উঠি আর দৌড়ে পালাই। আমাদের কেউ কেউ বাঁশঝাড়ের তলায় আবার কেউ কেউ ইশকুল লাগোয়া ভাঙাবেড়ার টয়লেটে ঢুকে চোখ বন্ধ করে মুহিব্যার বোনকে আঁকার চেষ্টা করি আর ইচ্ছেমত রঙ মাখাই। রঙ মেখে মুহিব্যার বোন আমাদের গলা জড়িয়ে শুয়ে পড়ে।

শুয়ে পড়ে আর আরো জড়িয়ে ধরে। আমরা এর বেশী আর ভাবার সুযোগ পাই না। আমরা মুহিব্যার বোনের একটা নাম রাখি। মাধবী। আমাদের চারপাশে কুয়াশা পাঁক খায় আর তার ভেতরে জোছনারা দলবলে ঢুকে পড়লে আমাদের বিভ্রম হয়।

আমরা সমস্ত কুয়াশা কে মাধবী ভেবে ভুল করি। আমাদের মধ্যকার লুঙিঅলাদের কোঁচড় থেকে মাদকপাতার সিগারেট আর পাজামাঅলাদের পকেট থেকে আগুন বেরুলে আমরা দম দেই। কুয়াশা কে তখন লাল মনে হয়। আমাদের আরো মনে হয় যে গর্ত থেকে সবক'টা শেয়াল বেরিয়ে জোছনা গিলে খায়। এই ফাঁকে আমাদের কেউ কেউ গর্তে ঢুকে পড়ে আর শেয়ালিনীদের চিৎকারে বাকিরা ছুটে পালাই।

আমরা পরদিন মুহিব্যার বোনকে দেখতে যাই আর জানতে পারি যে মুহিব্যার কোন বোন ছিলো না কখনো। আমাদের বুকের মধ্যে হাহাকার জাগে আর আমরা পরস্পরকে বলি যে মাধবী আসলে অন্য কেউ। মুহিব্যার কোন বোন নেই আর থাকলেও সে মাধবী নয়; এখানে আমরা মুহিব্যার অপরাধ আবিষ্কারে ব্যর্থ হই। আমাদের ব্যর্থতা মুহিব্যার মৃত্যুদন্ড ঘোষণা করে আর আমরা ফিরে আসি আমাদের ইশকুল মাঠে। সেখানে কোন রঙ দেখি না।

আমরা বরঙ মুহিব্যার বাপ কে মাঠের মাঝ বরাবর হেঁটে আসতে দেখি। মুহিব্যার বাপ বলে যে গতরাতে এই মাঠের বালির ভেতর একটা কয়েন হারিয়ে গেছে। আমরা প্রশ্ন করি, কয়েনের মধ্যে কোন মাধবী ছিলো কি না। আসলে আমাদের তখন মুহিব্যার ভেজা গালের কথা মনে পড়ে আর বাঁশঝাড়ের কথা মনে পড়ে। আমাদের মনে হয় যে মুহিব্যার বাপের হারানো কয়েনের মধ্যেই মুহিব্যার ভেজা গাল আর মাধবী মিশে আছে।

আমাদের মধ্যকার পাজামাঅলারা মুহিব্যাকে খুঁজতে যায় আর লুঙিঅলারা বালি সরাতে সরাতে একটা চোখ আবিষ্কার করে। আমরা এবার প্রশ্ন করি যে কয়েনটায় কোন চোখ ছিলো কি না। আসলে আমরা জানার ইচ্ছে টা ছিলো মাধবীর কোন চোখ কখনো কয়েনটার মধ্যে হারিয়ে গিয়েছিলো কি না। আমাদের চোখের ভেতর কুয়াশারা আবার পাঁক খেতে খেতে ব্লাউজের আকৃতি নিতে গেলে আমরা চোখ কচলে মুহিব্যার বাপের মাথার ভূ-সমান্তরাল দোলন পর্যবেক্ষণ করি আর আরো আরো বালি সরাতে থাকি। কৃত গর্তের ভেতর হঠাৎ মুহিব্যার বাপ হেসে উঠলে আমরা একটা মরা শেয়ালিনীর দেহাবশেষ কে উঠে আসতে দেখি যে গতরাতে প্রথমবারের মত চিৎকার করেছিলো।

আমাদের কেউ কেউ বাঁশঝাড় তলায় ছুটে যায় আর অন্যরা শেয়ালিনীর দেহে জমাট কুয়াশার ভেতর ব্লাউজ কল্পনা করে বোতাম হাতড়ে বেড়ায়। আমরা কোথাও এসময় মুহিব্যার বাপকে দেখতে পাই না আর তাই আমাদের মনে হয় যে সে তার কয়েনখানা নিয়ে নিজের গর্তে ঢুকে পড়েছে। বাঁশঝাড়অলারা ফিরে এলে আমরা মুহিব্যার বাপের কবরের মাটি রাতে থাকি আর আমাদের চোখের ভেতর মুহিব্যার গাল আরো ভিজে উঠে। কিন্তু কবরের ভেতর কোথাও মুহিব্যার বাপকে দেখা যায় না বরঙ তাকে দেখা যায় দোতলা ইশকুল ঘরের ছাদে। আমরা সেখানে উঠে দাঁড়ালে সে আবার তার গর্তের মধ্যে ঢুকে পড়ে আর মাঠের মাঝ বরাবর ইশকুলের ফরিদা ম্যাডাম কে হেঁটে যেতে দেখি যিনি অনেকদিন আগে সমুদ্র দেখতে গিয়েছিলেন কিন্তু আর ফিরে আসেন নি।

আমরা কামরুন নাহার কেও দেখি যার খুব শখ ছিলো আমাদের সাথে একটি চাঁদঅলা রাত বনেবাদাড়ে ঘুরে বেড়াবে কিন্তু বছর না ঘুরতেই মা হয়ে গিয়েছিলো। আমাদের কয়েকজন আরো একজনকে শনাক্ত করে যার নামটা আমরা স্মরণ করতে পারি না কিন্তু মনে পড়ে সে একদিন বলেছিলো মন বলে কিছুই নেই বরঙ পুরোটাই শরীরের দাবি আর আমরা প্রত্যুত্তরে অবিশ্বাসের হাসি হাসতাম আর তাই সে একের পর এক প্রমাণ সৃষ্টি করে গেছে। আমাদের হঠাৎ তাকে নিয়ে ভাবতে ইচ্ছে করে যেহেতু অনেকের মত আমাদেরও মনে হয় যে তার সন্তানটার সঠিক পিতৃত্বের দাবিদার নেই কিন্তু আমরা অন্য একজন কে নিয়ে ভাবতে থাকি যাকে দেখে আমাদের মনে হয় সে আসলে মুহিব্যার হারিয়ে যাওয়া বোন যার একটা ব্লাউজ ছিলো অথবা এখনো আছে। যদিও আমরা জানি যে মুহিব্যার কোনো বোন নেই এমনকি কোথাও কোনো মুহিব্যা বা মুহিব্যার বাপও নেই তবুও আমাদের ভাবতে ভালোই লাগে,এটাই মুহিব্যার বোন যে এইমাত্র মুহিব্যার বাপের কবরে ঢুকে পড়েছে আর যার নাম আমরা রেখেছিলাম মাধবী। আমরা মাধবীকে অনুসরণ করে কবরে ঢুকে পড়ি কিন্তু কোথাও কোন মাধবীকে দেখতে পাই না বরঙ একটা সুড়ঙ্গ আবিষ্কার করি।

আমাদের মনে হয় এই পথেই মাধবী হারিয়ে গেছে আর তাই আমরাও ঢুকে পড়ি সুড়ঙ্গে মাধবীর দেখা মেলে না। তবুও আমরা মাইলের পর মাইল আমরা হেঁটে যাই। আমাদের সঙ্গী হয় হাজার হাজার ফরিদা ম্যাডাম যারা সমুদ্রেই রয়ে যান কিংবা কামরুন নাহারদের দীর্ঘমিছিল যারা আমাদেরকে নিরবে ভালোবেসে স্বপ্ন হারায়। এমনকি অকালে পোয়াতি হয়ে উঠা নাম ভুলে যাওয়া মেয়েগুলোর পিতৃত্বহীন সন্তানেরা সার বেঁধে এগিয়ে চলে কিন্তু কেবলমাত্র মাধবীর সন্ধান মেলে না। খুঁজতে খুঁজতে আমরা হঠাৎ সুড়ঙ্গ থেকে বাইরের প্রকট আলোয় ছিটকে পড়ি আর চোখ কচলে দেখি আমাদের টেবিলে এখনো অনেকখানি মাদকপাতা অব্যবহৃত পড়ে আছে।

আমরা পরস্পর দৃষ্টিবিনিময় করি। একসময় আমরা সমস্বরে হেসে উঠি কেননা আমরা বুঝতে পারি যে আমরা তখনো ভীষণ একাকিত্বে আটকে আছি যেমনটা থাকি সবসময়, খুব একা।
 

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।