আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

তোমায় কিছু দেব বলে চায় যে আমার মন... নাইবা তোমার থাকল প্রয়োজন।

. আমার নাইবা হলো পারে যাওয়া...
অনেকদিন ধরেই সুনামগঞ্জ যাওয়ার শখ ছিলো। কিন্তু যাওয়া হয়নি। ইদানিং শখটা ভালো করেই মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। হাওরে যাবো, হাওরে যাব্‌ বলে রীতিমত ঘ্যানঘ্যান শুরু করে দিয়েছিলাম। যা কিনা আমার স্বভাব বিরুদ্ধ।

তাও আবার টাঙ্গুয়ার হাওর। কুম্ভকর্ণ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে খোঁজ-খবর নেয়া শুরু করেছিলো। কিন্তু যেসব খবর পেয়েছি তাতে হাওরে যাওয়ার শখ অনেকটাই স্তিমিত হয়ে গিয়েছিলো। তাহিরপুর যাওয়ার যেসব বর্ননা শুনলাম তাতে করে মনে হলো, ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি। নিজেই বললাম থাক! টাঙ্গুয়ার হাওর দেখার দরকার নেই, অন্য হাওর দেখবো।

কিন্তু সুনামগঞ্জ আমি যাবোই। বাউল সম্রাট আব্দুল করিমকে যিনি আমার সাথে পরিচিত করিয়ে দিয়েছিলেন সেই ভদ্রলোক আমার মতই ছিটগ্রস্ত। উনি হঠাৎ ঈদের আগে আমার বাসায় এলেন। কথায় কথায় বলেছিলাম, সুনামগঞ্জ যেতে চাই। শুনেই তো উনি এক পায়ে খাড়া।

চল চল... পারলে আমায় তক্ষুনি নিয়ে যান। বললাম ঈদের পরে চলুন যাই। ঠিক হল ঈদের পরদিন যাবো। আমার খুব প্রিয় একজন মানুষের জন্য আমার সুনামগঞ্জ যাওয়ার তাড়া। সুনামগঞ্জে তাঁর বাপ-দাদার বাড়ী।

চল্লিশ বছর উনি সেখানে যাননি। সেই সুদুর হাওয়াই দ্বীপ থেকে প্রায়ই উনার দীর্ঘশ্বাষ আমায় ছুয়ে যায়। কত কত স্মৃতি, কত ছবি সব আমার মনের খাতায় ছাপ ফেলে ছবি হয়ে ফুটে আছে। স্থির করেছি এবারকার জন্মদিনে উনার শৈশবের কিছু স্মৃতি উনাকে উপহার দেবো। অনেক দিন লেখালেখির জগত থেকে দূরে সরে ছিলেম।

এই আপুটা আমায় আদর, স্নেহে, শাষনে আবার লেখালেখির জগতে ফিরিয়ে এনেছেন। উনার উৎসাহেই আমার এই ব্লগে লেখা। কিন্তু উনাকে আমি আজও চাক্ষুস দেখিনি। চার বছর আগে ফেসবুকে পরিচয়। কিন্তু উনি উনার অতুলনীয় ব্যবহারে আমাকে এতো আপন করে নিয়েছেন যে আমি উনাকে অন্তর-চোক্ষে সব সময় দেখি।

এমনিতেই আমি মানুষকে খুশী করতে পারার মধ্যে যে অপার আনন্দ ও সুখ আছে সেটা উপভোগ করার সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইনা। আমার সাধ্যের মধ্যে যতটুকু কুলোয় আমি মানুষকে আনন্দ, সুখ, খুশী দিতে চাই। যখন সফল হই দেবার আনন্দে নিজেই আত্মহারা হয়ে যাই। আর যখন পারিনা, মনটা ভার হয়ে যায়। মনে হয় কেন পারিনা।

ঈদের পরদিন ভোরে প্রচন্ড মাথা ব্যাথা নিয়ে ঘুম ভাংলো। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেলো। ইস! বোধহয় যেতে পারবোনা। ঘরম সেক, ওষুধ খেয়ে ব্যাথাটাকে কিছুটা কব্জা করলাম। কুম্ভকর্ণ অবশ্য বেঁকে বসেছিলো।

না, না, যাওয়ার দরকার নেই। এই মাথা ব্যাথা নিয়ে কি ভাবে যাবে? রেষ্ট নাও। যদিও সে ভালো করেই আমার জেদ জানে। কোন কথা না বলে তৈরী হয়েছি। বলেছি, তুমি যদি যেতে চাও? তবে চলো, নাহলে আমি একাই যাবো।

চুপচাপ তৈরী হয়ে নিলো। সুনামগঞ্জের পথে রওনা হলাম। আগেই ঠিক করে নিলাম প্রথমেই যাবো আলীমাবাগে। রানা আপুর দাদাবাড়ী। আলোকিত ব্যক্তিত্ব মুনাওওর আলীর বাড়ী।

মিনিষ্টার বাড়ী বলে যেটা পরিচিত। ভারত বিভাগ পুর্ব আসামের স্বনামধন্য মন্ত্রী, ততকালীন ব্যতিক্রমী সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার অনন্য রুপকার ও পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ববঙ্গের আইন পরিষদের প্রথম স্পীকার মুনাওওর আলী। যার মাতা আলীমুন্নেসার নামানুসারে সে পাড়ার নামকরন হয়েছে আলীমাবাগ। আমার স্বামী ঘোষনা করলেন, উনি গাড়ীতেই বসে থাকবেন। আমি নেমে বাইরে থেকে ছবি টবি যা তোলার তা যেন তুলি।

চুপ করে থাকলাম। সময় হলে দেখা যাবে কি করি। তবে চুপচাপ শুধু বাড়ীর বাইরে থেকে ঘুরে আসার বান্দা যে আমি নই তা উনিও ভাল করেই জানেন। সুনামগঞ্জের প্রবেশদ্বারে সুদৃশ্য তোরন অকাল প্রয়াত জোছনা পাগল চেয়ারম্যান মুমিনুল মউজ উদ্দিনের স্মৃতি বহন করে দাঁড়িয়ে আছে। হাসন রাজার প্রপৌ্ত্র পূর্নিমা রাতে পৌ্রসভার বাতী নিভিয়ে দিতেন।

তাঁর জোছনা প্রীতির কারনে জনগন তাঁকে জোছনা পাগল বলত। আজ তিনি নেই। অকালেই কোন জোছনায় মিলিয়ে গিয়েছেন। ঈদের পর পর, তাই রাস্তাঘাট ফাঁকা, দোকানপাট বন্ধ। রাস্তায় মানুষকে জিজ্ঞেস করে আলীমাবাগের সামনে এলাম।

মনোরম সুদৃশ্য বাংলো। সামনে অনেকটা খালি জায়গা। ছোট একটা গেট। দুপাশে কিছু ফুলের গাছ। বাংলোর সামনে প্রসস্ত বারান্দায় একটি টেবিল ঘিরে কিছু চেয়ার সাজানো।

মাঝখানের চেয়ারে সোম্য-দর্শন একজন বৃদ্ধ বসে আছেন। বার্ধক্য, অসুস্থতা তাঁকে কাবু করলেও সম্ভ্রান্ত ভাব চেহারায় ঠিকই আছে। গেট খুলে ভিতরে ঢুকলাম। বুকটা দুরুদুরু করে উঠল। যারা এখানে থাকেন তারা আমার এভাবে আসাটা কি ভাবে নেবেন, বা ছবি তুলতে দিতে সম্মতি দিবেন কিনা তা ভেবে উদ্বিগ্ন ছিলাম।

বৃদ্ধের সামনে গিয়ে নিজের পরিচয় দিয়ে উনার পরিচয় জানতে চাইলাম। জানলাম উনি মুনাওওর আলীর পুত্র মুশাররফ মনসুর আলী। ঘরের ভিতর থেকে উনার আরও তিন ভাই বেরিয়ে এলেন। কুম্ভকর্ণকে জোর করে গাড়ী থেকে নামিয়ে আনলেন। রানা আপুর কথা বলে ছবি তুলতে চাইলে উনারা সানন্দে সম্মতি দিলেন।

বাড়ীর ভিতরে গিয়ে মহিলাদের সাথে পরিচিত হলাম। সবাই আন্তরিক ভাবে আমায় গ্রহন করলেন। তাদের ব্যবহারে মনেই হলনা আমার সাথে এই প্রথম দেখা। হাতে তৈরী খাবার বা নাসতা দিয়ে মেহমান আপ্যায়নের একটা আলাদা মর্যাদা, আন্তরিকতা আছে। এটা ছিলো আগে অভিজাত পরিবারের ঐতিহ্য।

এই ঐতিহ্যের ধারা আলী পরিবারে এখনো চালু আছে তার প্রমান পেলাম নাস্তার টেবিলে। জোহরের আজান পড়ে যেতেই আমরা বিদায় চাইলাম। হাসন রাজার বাড়ী ও মিউজিয়ম দেখতে যাবো। দুপুরের খাবার না খেয়ে কিছুতেই আসতে দিবেননা উনারা। অনেক করে বুঝিয়ে আবার আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিদায় নিলাম।

শৈশবের স্মৃতি উপহার পেয়ে আমার বন্ধুর মানসিক অবস্থা বর্ননা না করলেও নিশ্চয় সবাই অনুমান করতে পারছেন। আর বন্ধুর জন্য কিছু করতে পেরে আমি নিজেও অনেক অনেক বেশী আনন্দিত ও সুখী। *** উঠোনের এই বড়ই গাছের তলায় এখনো কি শিশু রানার পায়ের ছাপ আঁকা আছে? *** সে বাড়ীর কয়েকজন সদস্যের সাথে আমার কুম্ভকর্ন ( চেয়ারের পিছনে দাঁড়ানো )
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।