১৩ নভেম্বর ২০১০ মইনুল রোডের ‘কাশিম বাজার কুঠি’ ছেড়ে খালেদা জিয়ার বের হয়ে যাওয়ার মধ্যদিয়ে স্বাধীনতার ৩৯ বছর পর বাংলাদেশে পাকিস্তানপন্থী রাজনীতির সর্বশেষ দুর্গের পতন ঘটল। বাংলাদেশ ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা পেলেও মিরপুর শত্র“ মুক্ত করতে ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাস গড়িয়ে যায়। আর খোদ ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট মুক্ত করতে লেগে গেল ২০১০ সালের নভেম্বর মাস অবধি। বস্তুত ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চেই ‘সোয়াত’ জাহাজ থেকে পাকিস্তানিদের হয়ে অস্ত্র খালাসের অ্যাসাইনমেন্ট থেকে প্রত্যাহার করে তাদের সবচেয়ে পরীক্ষিত ‘চর’ মেজর জিয়াকে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ‘প্লান্ট’ করা হয়। সে দায়িত্বের অংশ হিসেবে বঙ্গবন্ধু হত্যা, ৪ নেতা হত্যাসহ স্বাধীনতাবিরোধীদের রাজনীতিতে পুনর্বাসনের মাধ্যমে ইতিহাসের চাকা পেছনের দিকে ঘোরানোর সকল দায়িত্ব জিয়াউর রহমান সুচারুভাবে পালন করে গেছেন এ দুর্গে অবস্থান নিয়ে।
জিয়ার মৃত্যুর পর খালেদা জিয়া তার স্থলাভিসিক্ত হয়ে একই অপরাজনীতি চালিয়ে যেতে থাকেন। তাই এ পাকিস্তানি ঘাঁটিটির পতন এ দেশের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী নিশ্চয়ই আগামী বছরগুলোতে বিশেষ তাৎপর্য সহকারে ‘দিবসটি পালন করবে।
বেগম খালেদা জিয়া বাড়ি ছাড়ার আগমুহূর্ত পর্যন্ত নানাভাবে সেনাবাহিনীর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন। উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় সেনা-সদস্যরা যে ধৈর্য এবং একতার পরিচয় দিয়েছে তা বাহিনীটির পেশাদারিত্বের ক্ষেত্রে নতুন যুগের সূচনা করল।
খালেদা জিয়ার গাড়িবহর মূল ফটক ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা সেনানিবাসের আকাশে ৩০ লাখ শহীদের রক্ত ভেজা বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা পতপত করে উড়তে শুরু করে। সমগ্র এলাকার নির্মল বাতাস জাতীয় সংগীতে মুখরিত হয়ে ওঠে। সেনাবাহিনী জিয়া পরিবারের ‘জল্লাদখানা সিলগালা করে দিলেও তার ভেতর থেকে জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা লিপ্সার বলি সেনাসদস্যদের আর্তচিৎকার এখনো ভেসে আসছে। অনতিবিলম্বে বাড়িটিকে ডিনামাইট দিয়ে গুঁড়িয়ে দিয়ে ৪ দেয়ালে আটকেপড়া সৈনিকদের অতৃপ্ত আত্মাকে মুক্ত করা প্রয়োজন। বাড়িটির মাটি খুঁড়লেই পাওয়া যাবে হাজারও সৈনিকের কংকাল।
প্রতিটি শ্বেতপাথর গলে গড়িয়ে পড়ছে সেনাদের তাজা রক্ত। দার্শনিক বিবেচনায় মইনুল রোডের এ বাড়িটি বস্তুত অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা সেনা-সদস্যদের এক বিশাল ‘গণকবর’, যারা পঁচাত্তর পরবর্তীতে এ দুর্গের পতন ঘটাতে অকাতরে জীবন দিয়েছে। একশ আটষট্টি কাঠার এ জমিটি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের আরেকটি ‘বধ্যভূমি’! যা যথাযথভাবে সংরক্ষণ করে শহীদদের জন্য একটি ‘স্মৃতি জাদুঘর’ নির্মাণ করা যেতে পারে।
মইনুল রোডের বাড়ি ছাড়া নিয়ে সেনা জনসংযোগ সংস্থা থেকে বলা হয়েছে- ‘খালেদা জিয়া স্বেচ্ছায় বাড়ি ছেড়ে গেছেন’। অন্যদিকে ম্যাডাম সাদা-গোলাপি টিসু দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ‘আমাকে বাড়ি ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে’।
দুপক্ষের বক্তব্যই একাধারে ‘সত্য’ এবং ‘অসত্য’, কেননা প্রকৃতার্থে ‘আদালতের রায়ে বাধ্য হয়েই খালেদা জিয়া স্বেচ্ছায় বাড়ি ছেড়ে গেছেন’। এ প্রসঙ্গে মওদুদ আহমদ গং আদালতের রায় সম্পর্কে এবং সেদিন সকালে প্রধান বিচারপতির বাসভবন ঘুরে এসে তার ‘আশ্বাস’ নিয়ে মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন। যে সকল বিরাট আইনজীবী এতদিন বলে বেড়িয়েছেন ‘আদালতের রায় যাই হোক না কেন, ফয়সালা হবে রাজপথে’, তারা এখন আইনের দোহাই দিচ্ছেন কেন? তবে ‘জোর করে বের করে দেয়া’র অভিযোগটি ধোপে টেকে না, কেননা বেগম খালেদা জিয়া ক্যান্টনমেন্ট ছেড়েছেন নিজস্ব গাড়িবহর নিয়ে এবং নিজের ড্রাইভারের চালানো গাড়িতেই। ‘এক কাপড়ে টেনে-হিঁচড়ে বের করা’র তথ্যটিও অসত্য, কেননা সংবাদ সম্মেলনে দেশনেত্রীর পরিপাটি বেশভুষা সে ধরনের কোনো ইঙ্গিত বহন করেনি এবং তার গাড়িবহরে প্রচুর কাপড়-চোপড়ও ক্যামেরায় ধরা পড়েছে। তাছাড়া গত কয়েকদিন ধরেই তিনি বাড়ি ছাড়ার উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় মালামাল সরিয়ে নিয়েছেন, যার ভিডিও ফুটেজ সেনাবাহিনীর কাছে রয়েছে।
পরবর্তীতে সাংবাদিকরাও সে বাড়িটিতে ফেলে যাওয়া কোনো কাপড়-চোপড় খুঁজে পায়নি। কিছু প্যাক করা কার্টন দেখা গেছে, যা বাড়ি ছাড়ার প্রস্তুতিরই পরিচায়ক।
বস্তুত ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর রাষ্ট্রক্ষমতা ছাড়ার আগেই খালেদা জিয়ার বাড়ি ছাড়ার পর্ব শুরু হয়। সপরিবারে ওমরা করতে যাওয়ার সময়ই তিনি ১৩০ সুটকেস ভরে মূল্যবান জিনিসপত্র সৌদি আরবে নিয়ে যান। তারেক এবং কোকোর প্রয়োজনীয় সবকিছু ইতিমধ্যেই লন্ডন ও ব্যাংককে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।
অবশিষ্ট যা কিছু পর্যায়ক্রমে তাদের শ্বশুর বাড়িতে সরিয়ে নেয়ার তথ্যও বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছে। ম্যাডামের সরঞ্জাম ওয়ান ইলেভেন আমলেই প্যাক করা হয়েছিল, সে বাক্সগুলোই শামীম এস্কান্দরের বাড়িতে পৌঁছেছে। অতি বিলাসবহুল আসবাবপত্র অক্ষত অবস্থায় এখনো মইনুল রোডেই রয়েছে, যা মিন্টু রোডে বিরোধীদলীয় নেত্রীর বাড়িতে কিংবা তার গুলশানের দেড় বিঘার বাড়িটিতে তোলা হবে।
খালেদা জিয়া ক্যান্টনমেন্ট ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার ব্যক্তিগত সহকারীর বরাত দিয়ে তিনি অজ্ঞাত স্থানের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছেন এমন সংবাদ প্রচারিত হয়। বিভিন্ন মহলে তিনি সৌদি আরব কিংবা পাকিস্তান দূতাবাসে রাজনৈতিক আশ্রয় নিচ্ছেন এমন কানাঘুষাও শোনা যায়।
কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যে খালেদা জিয়া সকল জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে তার গুলশান কার্যালয়ে হাজির হয়ে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন। দেশনেত্রীর কঠিন সময়ে ঘুরে দাঁড়ানোর এটাই প্রথম নজির নয়। ১৯৮১ সালের পর বিএনপির প্রথম সারির সব নেতা জাতীয় পার্টিতে যোগ দিলে তিনি একক প্রচেষ্টায় দল পুনর্গঠন করেন। ১৯৯৬ সালে ১৫ ফেব্র“য়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাত্র একমাসের মাথায় ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হলেও তিনি মাঠ ছেড়ে যাননি। বিশাল জনসভার মধ্যদিয়ে পদত্যাগ ঘোষণা করে তিনি দলের নিশ্চিত বিলীন হওয়া মোকাবিলা করেন।
২০০৮ সালে দল ও দু’ পুত্রের মহাদুর্নীতির বোঝা কাঁধে নিয়ে অসুস্থ অবস্থায় দেশের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে দিন-রাত ছুটে বেরিয়ে তিনি দক্ষিণপন্থি ‘ভোটব্যাংক’ অক্ষত রাখেন।
কিন্তু উল্লিখিত প্রতিটি ক্ষেত্রে সেনাবাহিনী তখন তার সঙ্গে ছিল, যা এখন আর নেই। জিয়াউর রহমানের ‘ভাঙা সুটকেস এবং ছেঁড়া গেঞ্জির মিথ’ তখনো সৈনিকদের মধ্যে বদ্ধমূল ছিল। খালেদা জিয়ার মাথায়ও শোভা পেত ‘সেনা মাতা’র মুকুট। কিন্তু তারেক-কোকোর অবাধ দুর্নীতি সে সকল বিশ্বাসে চির ধরাতে শুরু করে।
স¤প্রতি নৃশংস বিডিআর হত্যাকাণ্ড নিয়ে তিনি যে নির্মম রাজনীতি করেছেন তাতে বেগম জিয়ার ওপর থেকে সাধারণ সৈনিকদের মন উঠে গেছে। বস্তুত খালেদা জিয়াও বুঝে ফেলেছেন যে আজকের পেশাদার সেনাবাহিনীকে আর তার ক্ষমতা দখলের কাজে ব্যবহার করা যাবে না, তাই তো তিনি ২৭ সেপ্টেম্বর সশস্ত্রবাহিনীর ইফতার পার্টিতে যোগ না দিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকাতে বৃহত্তর ঐক্য গড়ার কাজে। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী মইনুল রোডের বাড়ি নিয়ে সেনাবাহিনীকে উসকে দিয়েও কোনো ফল পাননি। পানি আজ অনেক দূর গড়িয়ে গেছে, ‘সেনা মাতা’ থেকে খালেদা জিয়া এখন হয়ে উঠেছেন একজন ভয়াবহ ‘যুদ্ধাপরাধ কন্যা’। বস্তুত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার পণ্ড করতে তিনি যাতে জওয়ানদের কোনোভাবে উসকাতে না পারেন সে কারণেও তার শেকড় উৎপাটন এ মুহুূর্তে জরুরি হয়ে পড়েছিল।
সেনা-সমবেদনা এখন খালেদা জিয়ার পক্ষে নেই। বাড়ি ছাড়ার আগে পেশাদার দায়িত্ব পালনরত সৈনিকদের তিনি যেভাবে হুমকি-ধমকি দিয়েছেন এবং ঘটনা সম্পর্কে মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছেন তাতে অবস্থার আরো অবনতি ঘটেছে। তাইতো এককালের ‘আপসহীন নেত্রী’ এবং ‘লৌহমানবী’ এখন দেশবাসীর সামনে ‘কান্না’র আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন। তার ৩৮ বছরের এ বাড়িতে থাকার এবং দীর্ঘ ৫০ বছর ক্যান্টমেন্টে অবস্থানের (মুক্তিযুদ্ধের সময়ও তিনি ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে যাননি) স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলা যায়, এ কান্না কেবল আবেগের ছিল না- এ কান্নার গভীরে ছিল সর্বৈব হার মানার সুর, সব খোয়ানোর বেদনা এবং মূল উৎপাটনের যন্ত্রণা। একসময়ের সেনা-সমর্থনপুষ্ট মহাক্ষমতাধর খালেদা জিয়ার পায়ের তলায় এখন কোনো মাটি নেই- তিনি এখন রিক্ত, নিঃস্ব, সর্বহারা!
সংবাদ সম্মেলনে ম্যাডামের আরো বেশি করে কান্না পাচ্ছিল, কেননা তিনি জানতেন সেনাবাহিনী যেকোনো মুহূূর্তে মইনুল রোডের বাড়িটি সংবাদ মাধ্যমের কাছে খুলে দেবে এবং তার অভাবনীয় বিলাসবহুল জীবনের বীভৎস দৃশ্য দেশবাসীর কাছে খোলাসা হয়ে গেলে তার আর মুখ দেখানোর উপায় থাকবে না।
বস্তুত হয়েওছে তাই- যেখানে প্রতিটি সেনাসদস্যের তেল আনতে পানতা ফুরায়, সেখানে তাদের সম্পদ কেড়ে নিয়ে তিনি গড়ে তুলেছেন এক কদর্য রাজপ্রসাদ। একজন জনদরদি (?) রাজনৈতিক নেতার বিত্ত-বৈভবে তার দলীয় নেতাকর্মীদেরও মাথা হেট হয়ে গেছে। তারাও এখন ভাবতে শুরু করেছে- খালেদা জিয়ার বিলাসের জন্য কেন তারা রাস্তায় নামবে, কেনই বা তারা জণগণের সম্পদ ধ্বংস করবে? তাইতো খালেদা জিয়ার জীবন-মরণ ইসুতেও বিএনপির খুব সামান্য নেতাকর্মীই পিকেটিংয়ে নেমেছে, যারা নেমেছে তারা তখনো বাড়িটির ভেতরের অশ্লীলতা নিজ চোখে দেখেনি।
বিশাল প্রাসাদতুল্য বাড়ি, নয়নাভিরাম ল্যান্ডস্কেপিং, রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চের উপযোগী বিশাল সাজঘর, মহারাণী খাট, ফ্লাডলাইট শ্যান্ডেলিয়ার, থরে থরে সাজানো ক্রিস্টাল ক্লিয়ার ওয়াইন গ্লাস, বাড়ি জুড়ে গায়েবি সাউন্ড সিস্টেম, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত টয়লেট, গোল্ড প্লেটেড বাথরুম ফিটিংস এবং সে সঙ্গে ৬৭ জন দাস-দাসীর বহরের ৬নং মইনুল রোডের দখলকৃত বাড়িটির সা¤প্রতিক পতন কেবল বাস্তিল দুর্গের পতনের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয় এবং ম্যাডামের জীবন-যাপনকে শুধুমাত্র ইমেলদা মার্কোসের সঙ্গেই তুলনা করা যায়, যার আরো বহু তথ্যই ক্রমান্বয়ে বেরিয়ে আসবে।
মূল লেখকের ই-মেইল:
মূল লেখা এখানে
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।