প্রতিটা জন্মদিন শুরু হয় অদ্ভুত একটা অনুভূতি নিয়ে। দিনটা আর সব দিনের সাথে মেলাতে পারিনা। মনের মধ্যেই ফিলিংসটা ওভাবে আসেনা। নিজেকে দিনটা থেকে আলাদা মনে হয়, নাকি দিনটাকে নিজের থেকে আলাদা, ভাবতে থাকি......
চিন্তার রাজ্যে ভিড় করে অতীতের ‘জন্মদিন’গুলো......কিছু বিষেশত্ব খুঁজে পাইনা......স্কুলের দিনগুলোতে রাতের বেলা বাবা-মা-ভাই এর দলবাঁধা শুভেচ্ছা জ্ঞাপন ছাড়া আর কিছু খুঁজে পাইনা...বন্ধুরা স্মৃতিতে আসেনা। কারণ সে সময়টা কাটতো ছুটিতে।
তাই আমার জন্মদিনটা ৫/৬ দিন পর আর বলার মত টপিক থাকতোনা। স্কুলে যেদিন কারো জন্মদিন থাকতো, সে সবার জন্য চকোলেট নিয়ে যেতো, সবাই তাকে সামনে দাঁড় করিয়ে গাইতাম, ‘হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ...’ । আমি লোভাতুর হয়ে ভাবতাম, আমার কেন এই অভিজ্ঞতা হয়না???...খুব লোভ হতো, আমিও সামনে দাঁড়াবো, সবাই আমার উদ্দেশ্য গাইবে......কিন্তু জন্মদিন চলে যাবার ৫/৬ দিন পর জন্মদিনের প্রসংগ আনাটাই আদিখ্যেতা মনে হতো......তাই, লোভ করেও তা সংবরণ করতে হতো......আর মনে মনে ভাবতাম, ‘কেন আমার জন্মদিনটা জানুয়ারি মাসেই হতে হলো???...আর হলোই যদি, তবে এমন দিনে কেন হলো যেদিন স্কুল বন্ধ থাকে???...
এই ভাবতে ভাবতে স্কুল পার করে কলেজে এলাম। স্কুল জীবনের শেষ দুইটা বছরে কিছু বান্ধবীস্থানীয় মানুষজন উইশ করতো স্কুল খুললে, এটা-সেটা গিফট দিতো...এইটুকুই ছিলো আনন্দ......কলেজে উঠবার পর খুশি হলাম এই ভেবে যে এখানে জানুয়ারিতেও ক্লাস হয়। সুতরাং এবার জন্মদিনে সবাইকে জানানো যাবে, ‘আজ আমার জন্মদিন’...সবাই উইশ এর জোয়ারে ভাসিয়ে দেবে আমাকে......একদিনের জন্য হলেও সবাই আমাকে ‘পাত্তা’ দেবে...
কিন্তু কলেজ এ ২ জানুয়ারি ক্লাস হয়না।
শীতের ছুটি থাকে। ৭ তারিখ পর্যন্ত...জন্মদিন আবারো হারিয়ে যায়। সীমিত কিছু মানুষের কাছ থেকে শুভেচ্ছা পাই...যারা কোনো একসময় জেনেছিলো......
আর আমি ভাবি...হলোই বা...ভার্সিটিতে উঠে নেই...তারপর ক্লাস খোলা থাকবেই...তখন দেখা যাবে...
ভার্সিটিতে ভর্তি হই...ডিপার্টমেন্ট এ কয়েকজন বান্ধবীস্থানীয় পাই। ফিল্ম সোসাইটিতে গিয়ে দেখি সেখানে জন্মদিনে সবাই চাঁদা তুলে বার্থ ডে গার্ল/বয় এর জন্য কেক আনে, সবাই মিলে মজা করে ‘জন্মদিন’ পালন করে......আমি ব্যাপক খুশি হই...ব্বাহ!...এখানে তাহলে আমার জন্মদিনটাও এভাবে পালন হতে যাচ্ছে...আই উইল বি আ স্পেশাল ওয়ান অ্যাট লাস্ট......ডিসেম্বরে শীতকালীন ছুটির নোটিশ পাই......জানুয়ারির ৭ তারিখ পর্যন্ত......ভার্সিটি বন্ধ তাই ডিপার্টমেন্ট এর মানুষজন ও নাই, ফিল্ম সোসাইটিও প্রায় নির্জন...
কিছু কিছু মানুষের কাছ থেকে উইশ পাই...এক্টাই ব্যাপার ঘটে, স্কুলে যেমন ৩/৪ জন, কলেজে ৮/১০ জন উইশ করতো, সেইটা এখাণে ১৫/২০ জন হয়.........তারপর আরেকটু বাড়ে......৪০/৫০ জনে গিয়ে ঠেকে...কারণ ততদিনে হাই ফাইভ আর ফেসবুক এর মেম্বার আমি...ওখানে জন্মদিন বিজ্ঞাপিত হয় হোম পেজ এ...কারও ভুলে যাবার, না জানার উপায় নাই.........।
অতঃপর ২২ তম জন্মদিন আসে।
আগের দিন বন্ধুকে বলেছি জন্মদিনে তাকে পাশে চাই। সে দীর্ঘশ্বাস দেয়, কিন্তু আশ্বাস দেয়না। বুঝি সে আসবেনা। সকাল থেকেই বিষন্নতা ভর করে। আমিই চলে যাই তার ক্যাম্পাসে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। দিন পার করে বাড়ি ফিরি। মা’র সাথে ঝগড়া হয়। অভিমানে বাড়ি থেকে বের হয়ে যাই। সাতটার বাসে উঠে চলে যাই আবারো জাহাঙ্গীরনগর।
বন্ধু কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায়। গেটের সামনে থেকেই আমাকে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে রওয়ানা হয় । ঢাকার পথে বাস নেই!...একটা মুড়ির টিন পাওয়া যায়। ওটা গাবতলী যাবে। ওটায় উঠি।
মানুষের ভারে বাস চলতে পারেনা। মানুষের শ্বাসে গরম হয়ে আসে বাসের পরিবেশ। বন্ধু চুপ করে বসে থাকে। এক-দুই বার বলে, ‘মাথা গরম করে এমন পাগলামি করলে হয়?’...আমি চুপ থাকি। নিজের অবস্থান বুঝতে চেষ্টা করি।
নিজে মাথা গরম করে এখন আরেকজনকে ভেজালে জড়ালাম...অনুতাপ হতে থাকে। তার দিকে তাকাতে পারিনা। সে হয়তো বোঝে আমার চোখ-মুখ-দেহের ভঙ্গিতে। আমার সাথে সে সহজ হয়। তার বাড়ি থেকে পালানোর গল্প বলতে বলতে আমায় সহজ করে।
...বাসা থেকে ফোনের পর ফোন আসে। মা ফোন দেয়, ভাই ফোন দেয়, খালা ফোন দেয়......আমি কারো ফোন ধরিনা......ছোটো ভাইয়ের ফোন ধরি ঢাকা পৌছে। ‘বাড়ি আয় তুই, মা কাঁদতেসে...’ তার কণ্ঠে রাগ স্পষ্ট হয়। বন্ধু আমাকে বাড়ির গেট পর্যন্ত দিয়ে যায়। রাত ১১টায়...
২৩ তম জন্মদিন আসে।
অফিসে দেখি জন্মদিনে চাঁদা তুলে কেক কাটা হয়। আমি ভাবি, সেদিন আমিও অফিসে থাকলে আমারও এরকম একটা সেলিব্রেশন হবে তাহলে!...ক্যালেন্ডারের পাতায় দেখি ২ জানুয়ারি শুক্রবার...অফিস বন্ধ......খোলা থাকলে আমার জন্য কেক কাটা হতো কিনা তা আর জানা হয় না......
রাত বারোটা বাজতে না বাজতেই মোবাইলটা ব্যস্ত হয়ে যায়। ঘনিষ্ঠ-পরিচিতেরা ফোন আর মেসেজে অস্থির করে তোলে ওয়ারিদ নাম্বারটাকে। মোটোরোলা এল-৭ এর চার্জ ফুরাতে থাকে দ্রুত। ফোন রেখে একটু অবসর পেতেই চিরায়ত নিয়মে মা-আব্বু-ভাই দলবেঁধে হাজির হয় ঘরে।
সবার মত তারাও শুভেচ্ছা জানিয়ে যায়। মা হাতে একটা লাল প্যাকেট ধরিয়ে দেয়, সেটা খুলে বের হয় ‘কাকাবাবু সমগ্র-৫’। আমি বই পাওয়ার আনন্দে ছোট শিশুর মত আনন্দে উদ্বেল হই। আব্বু এক হাজার টাকা দেয়, ইচ্ছে মত কিছু কিনে নেয়ার জন্য। আমি মনে মনে ভাবি ৫০০ টাকার বই আর ৫০০ টাকার ডিভিডি কিনবো।
ভাই রাতে কিছু বলেনা। সকালে ঘুম ভেঙ্গে ওঠার সাথে সাথেই সে হাতে এক গোছা ফুল ধরিয়ে দেয়। সকাল সকাল উঠে নাকি বাইরে গিয়েছিল হাঁটতে, আসার সময় নিয়ে এসেছে। আমি তাকে ধন্যবাদ দেই। অনেক দিন পর ছোটো ভাইটার প্রতি গভীর ভালোবাসা অনুভব করি...সকাল সকাল প্রাচ্যনাটের রিহার্সেলে যাই......যেতে যেতে ভাবি, নোবেল ভাই হয়তো দেখা হলে উইশ করবে, আর আমি সবাইকে শুনিয়ে ‘থ্যাঙ্ক্যু’ বলবো, তাতে এক-দুইজন জানতে চাইবে কি জন্য ধন্যবাদ দেয়া...আমি লজ্জামাখা অভিব্যক্তি এনে হাসবো, নোবেল ভাই বলবে ‘আজ প্রজ্ঞার জন্মদিন’...সবাই আমাকে উইশ করবে...কিংবা স্বপ্ন তো জানেই আমার জন্মদিন...ও হয়তো আমাকে উইশ করবে।
... তখন বাকিরা জানবে......
রিহার্সেলে যাই......নোবেল ভাই আসেনা......স্বপ্ন আসে দেরি করে......ওর সাথে কথা হয়না......বন্ধু কাল কথা দিয়েছে সন্ধ্যায় দেখা করবে। তাকে বলি সাড়ে ছ’টায় শাহবাগ থাকতে। বের হতে দেরি হয় রিহার্সেল শেষে...আমি ঘড়ি দেখি আর অস্থির হই...ভাবি, বন্ধু অনিক বুঝি চলে এসেছে...সাড়ে ছ’টা বাজলো বলে...এর মধ্যে নোবেল ভাই আসে। পাশে বসে। আমি তাকে বলি, ‘যেতে হবে’...সে অপেক্ষা করতে বলে।
আমি কানে কানে বলেই ফেলি, ‘আজ আমার জন্মদিন, বন্ধু অপেক্ষা করছে’...নোবেল ভাই অবিশ্বাসী দৃষ্টিতে তাকায়, হাসে, বলে, ‘ আপনার জন্মদিন তো কালকে!’ আমি বলি, ‘না তো!...আজকেই!’...তারপর আবার রুবেল ভাইদের কথার দিকে মন যায়। আমি কথা শুনতে শুনতেই বিষন্ন হই, ভাবি, ‘নোবেল ভাই আমার জন্মদিনটা ভুল জানলো!...’ ...রিহার্সেল রুম থেকে বের হবার পর নোবেল ভাই এর সাথে আবার কথা হয়। সে বলে, ‘ফেসবুকে তো আমাড় প্রোফাইলে নোটিফিকেশনে দেখলাম আপনার জন্মদিন কালকে...আমি তো আজ়কে তাই অবাকই হচ্ছিলাম...সবাই আজকে কেন আপনার ওয়ালে উইশ করছে!...’...আমি হাসি। সেই হাসির আড়ালে থাকে চাপা বিষন্নতা......। বন্ধুকে ফোন দেই, শুনি সে ভার্সিটি এলাকায় পৌঁছে গেছে।
আমি কারো সাথে আর কথা না বলে রওয়ানা দেই। তাড়াতাড়ি করে পৌঁছাই টিএসসি। বন্ধুকে বসিয়ে রাখছি ভাবতে ভাবতে অস্থির হই। বন্ধুর সাথে দেখা হয়। সে আমায় একটা গোলাপ দেয়।
হলুদ গোলাপ। আমার পরনেও হলুদ...। আমি হাসি। সেও হাসে...। বন্ধুর সাথে ঘন্টা দুই সময় কাটে...দিনের সবচেয়ে সুন্দর সময়।
বাসায় ফিরি। দেখি মা জন্মদিন উপলক্ষে চাইনিজ রেঁধেছে। কেক বানিয়েছে...। খাওয়া-দাওয়া করি...
ফেসবুকে বসি...ফেসবুক আমাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়েছে......প্রায় ৭০/৮০ টার মত ওয়াল পোস্ট দেখি সারা প্রোফাইল পেজ জুড়ে। বিভিন্ন মানুষজন উইশ করেছে।
আমি গুনে কুল পাইনা কয়টা ওয়াল পোস্ট...ভাবি, ফেসবুকে ৬৩০ জন বন্ধু যার তার জন্য এইটা আর অস্বাভাবিক কি?......
জন্মদিনটা এবারের মত শেষ হয়। আমি ভাবতে থাকি, এবারো দিনটা ‘আমার দিন’ ভাবতে পারলাম না। সকাল থেকে নিজের দিনে যা ইচ্ছে তাই করতে পারলাম না...কিংবা সেই ছোটোবেলার কল্পনার মতো করে কেউ সারপ্রাইজ পার্টি দিলোনা। আমাকে নিয়ে, আমার জন্মদিন নিয়ে মানুষজন মেতে উঠলোনা...। আর আমারো ভাবা হলোনা, “বাহ! জন্মদিন ব্যাপারটা তো বেশ ভালো!!...’’ আমি আবারো দেখার অপেক্ষায় থাকি, আগামী জন্মদিনটা কী হয়...!!!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।