সমকালের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নৈতিক বিধিবিধান
ফকির ইলিয়াস
=========================================
যানবাহন চালানোর সময় মোবাইল ফোন ব্যবহারে বাংলাদেশে আইনের কড়াকড়ি আরোপ করা হচ্ছে। জরিমানা এমনকি জেল পর্যন্ত দেয়া হতে পারে। এ সংবাদটি রাষ্ট্রের জন্য একটি ইতিবাচক দিক। কারণ গাড়ি কিংবা মোটরসাইকেল চালানোর সময় ফোনে কথা বলার ঝুঁকি দুর্ঘটনার সহায়ক হতে পারে সর্বাংশে। তাই এ বিষয়ে বিশেষ কড়াকড়ি আরোপের মাধ্যমে সরকার সমকালীন বিবর্তনের পথেই এগিয়েছে।
ফোনে কথা বলতে বলতে রাস্তা পারাপার হওয়া কিংবা গাড়ি চালাতে গিয়ে কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলার ঝুঁকিটি এখন গোটা বিশ্বে একটি আলোচিত বিষয়। এর সঙ্গে রয়েছে অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটতে হাঁটতে টেক্সট মেসেজিং বা এসএমএস করার প্রবণতাটিও। একটি জরিপে সম্প্রতি দেখা গেছে, ইউরোপ-আমেরিকার ৭০ শতাংশ তরুণ-তরুণী ফোনে কথা বলার চেয়ে টেক্সট মেসেজিংকেই বেশি প্রাধান্য দেয়। এর প্রধান কারণটি হচ্ছে, ফোনে কথা বললে পাশের কেউ শুনে ফেলার আশঙ্কা থাকে। তাছাড়া শব্দ দূষণ, কোলাহল সৃষ্টির সম্ভাবনাও থাকে।
তাই ক্রমাগত মেসেজিংকেই বেছে নেয় বিশেষ করে টিনএজরা।
যার ফলে টেক্সট মেসেজ করার সময় রাস্তা পারাপার হতে গিয়ে ২০০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ৫ শতাধিক ব্যক্তি প্রাণ হারিয়েছেন বলে সমীক্ষায় জানা গেছে। এ অবস্থা রোধে যুক্তরাষ্ট্রে ইতোমধ্যে আইনও প্রণীত হয়েছে। ট্রাক ড্রাইভাররা যারা হেভি লোড নিয়ে গাড়ি চালান, তাদের ক্ষেত্রে ৫০০ ডলার পর্যন্ত জরিমানার বিধান করা হয়েছে নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যে। কোন কোন অঙ্গরাজ্যে এর চেয়েও বেশি কড়াকড়ি রয়েছে।
এ লেখাটি যখন লিখছি তখন আমার চোখ যুক্তরাষ্ট্রের একটি দৈনিকের প্রধান শিরোনামের দিকে। 'আমেরিকা ডিক্লেয়ার ওয়ার অন সাইবার ক্রাইমস' পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, সাইবার ক্রাইমের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ২০০৭ সালে ২৩৯ মিলিয়ন ডলার, ২০০৮ সালে ২৬৫ মিলিয়ন ডলার, ২০০৯ সালে ৫৬০ মিলিয়ন ডলার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অর্থাৎ ক্রিমিনালরা হাতিয়ে নিয়েছে এ পরিমাণ অর্থ। পেন্টাগন জানিয়েছে, আমাদের পরবর্তী যুদ্ধক্ষেত্রের নাম সাইবার স্পেস। বিশেষজ্ঞদের মতে, ইন্টারনেট সিক্যুরিটি মনিটরিং অত্যন্ত জোরালো করা না গেলে হ্যাকাররা আরও বেশি হামলে পড়তে পারে।
এ হামলা নিরোধে পেন্টাগন একটি কমান্ড ইতোমধ্যে গঠন করেছে। জেনারেল কিথ আলেকজান্ডারের নেতৃত্বে গঠিত এ কমান্ডের নাম দেয়া হয়েছে 'ইউনাইটেড স্টেটস সাইবার কমান্ড'। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এ কমান্ড ভবিষ্যতে ইলেকট্রনিক ভোটিং সিস্টেম, নিউক্লিয়ার প্ল্যান্ট নেটওয়ার্ক এবং সাধারণ মানুষের পরিবহন পথের নিশ্চয়তা ও নিরাপত্তা বিধান করবে।
এখানে যে বিষয়টি লক্ষণীয় তা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র বাস্তবতার সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে এমন একটি কমান্ড খুব দ্রুতই গঠন করতে পেরেছে। এ জন্য কোন জনবিতর্ক, মিডিয়ায় ওপেন ডিসকাশন কিংবা রাজনৈতিক বিরোধিতার মুখোমুখিও যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে হতে হয়নি।
এ জন্য তারা আন্তর্জাতিক কোন মতের তোয়াক্কাও করেনি। জাতীয় স্বার্থে এমন গঠনমূলক সিদ্ধান্ত হতেই পারে এবং তা হওয়া উচিত সব বিতর্ককে পাশ কাটিয়েই।
দুই.
বাংলাদেশে শিল্প পুলিশ তাদের যাত্রা শুরু করেছে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ক্রমে বাংলাদেশে পর্যটন পুলিশ, শিক্ষাঙ্গনের নিরাপত্তা রক্ষার জন্য শিক্ষা পুলিশ গঠন করা হবে। এমন রাষ্ট্রীয় ভাবনাকে আমি অত্যন্ত ইতিবাচক বলেই মনে করি।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের স্কুল-কলেজে নিয়মানুবর্তিতা রক্ষার জন্য শিক্ষা পুলিশ রয়েছে। হাসপাতালগুলোতে রয়েছে হসপিটাল পুলিশ। তারা প্রত্যেকেই স্থানীয় পুলিশ বিভাগের এক একটি সাবসিডিয়ারি ডিভিশন। প্রায় ১৫ কোটিরও বেশি মানুষের দেশ বাংলাদেশে এমন ব্যবস্থার প্রবর্তন এখন সময়ের দাবি। ভেবে অবাক হতে হয়, বাংলাদেশে বহু ব্যস্ততম ট্রাফিক পুলিশ বিভাগেও এখন পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সাধিত হয়নি।
অনেক তর্ক-বিতর্ক পেরিয়ে র্যাব তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যাপক উদ্যমী হওয়ার পর রাষ্ট্রের মানুষ এর সুফলই বেশি ভোগ করছেন। যদিও বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- মাঝে মাঝে তীব্র বিতর্কের সৃষ্টি করেছে।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ আইন, বিধিবিধান প্রতিটি রাষ্ট্রের জন্যই এখন জরুরি ভিত্তিতে ভাবনার বিষয়। অতি সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রগামী বিমানে পার্সেল বোমা ধরা পড়ার পর ইউপিএস, ফেডারেল এক্সপ্রেস, ডিএইচএল প্রভৃতি কুরিয়ার সার্ভিসের গতি-প্রকৃতি নিয়ন্ত্রণে আইনের কথাও ভাবছে যুক্তরাষ্ট্র সরকার। যুক্তরাষ্ট্র সরকার, বিমানগুলোর সম্মিলিত সংস্থা এবং এভিয়েশন অথরিটিস মিলে এ বিষয়ে সহসাই নতুন আইন প্রণয়ন করবে বলে যুক্তরাষ্ট্রের মিডিয়াগুলো আগাম খবর দিয়েছে।
অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, বিধি-নিষেধের ধকল মিডিয়াকেও স্পর্শ করতে শুরু করেছে। সম্প্রতি ডেনমার্কের পার্লামেন্টের তৃতীয় বৃহত্তম দল ডেনিশ পিপলস পার্টির নেতা পিয়া কাজের্সগাড এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, আল জাজিরা এবং আল আরাবিয়া টিভি চ্যানেলগুলো ইউরোপে নিষিদ্ধ হওয়া দরকার। তিনি বলেছেন, এসব চ্যানেল ইউরোপীয় সমাজ ব্যবস্থার প্রতি ক্রমে বিষোদগার করে যাচ্ছে। নবীন প্রজন্মকে পাশ্চাত্যের সমাজ ও সংস্কৃতিকে ঘৃণা করতে শেখাচ্ছে।
স্যাটেলাইট প্রযুক্তির এ যুগে কোন দেশে মিডিয়া বন্ধ করা যাবে কিনা কিংবা বন্ধ করা উচিত কিনা, তা নিয়ে বিতর্ক চলতেই পারে।
তবে মিডিয়ার খ-চিত্রগুলো দেখে কোন সমাজে যদি ভায়োলেন্স বেড়ে যায় বা কেউ যদি অপরাধ প্রবণতাকে মদত দেয় তবে সে দিকটি সমাজ নির্মাতা, সমাজ সংস্কারকদের ভেবে দেখতে হবে।
বাংলাদেশে সাইবার ক্রাইম ক্রমেই বাড়ছে। আগামী এক দশকে তা আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। বিশ্বের অগ্রযাত্রার সঙ্গে তাল মিলিয়ে তাই সাইবার ক্রাইম প্রোটেকশন স্কোয়াড গঠন করাটি খুবই দরকারি বিষয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় সাধন করে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক মন্ত্রণালয় এ বিষয়টি জরুরি ভিত্তিতে ভাবা শুরু করতে পারে।
মনে রাখা দরকার, এক দশক আগেও বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোতে এটিএম কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, পিনকোড ব্যবহারের ব্যাপক প্রচলন ছিল না। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এর দ্রুত প্রসার ঘটছে। তাই ইলেকট্রনিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার নিরাপত্তা বিধানেও সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।
আরেকটি সংবাদ যুক্তরাষ্ট্রে এ সময় বেশ আলোচিত হচ্ছে। এখানের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাইবার প্রতিরোধক শিক্ষা প্রদানের বিষয়টি যুক্ত হচ্ছে।
ন্যাশনাল ক্রাইম প্রিভেনশন কাউন্সিল জানিয়েছে, এইডস যেমন সংক্রামক ব্যাধি, সাইবার আক্রমণও ঠিক তেমনি একটি প্রাত্যহিক বিষয়। শিক্ষার্থীদের এ বিষয়ে সচেতন হয়ে এর অপকারিতা বোধগম্য হওয়া জরুরি। তাই সেশন হিসেবে এ শিক্ষা প্রদান করার কথা ভাবছে সরকার ও বোর্ড অফ এডুকেশন। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল কমিউনিকেশন্স কমিশন বলেছে, তারা সরকারকে এ বিষয়ে পর্যাপ্ত ফান্ড বরাদ্দের অনুরোধ করেছে। যাতে স্কুল শিক্ষার্থীরা ফেসবুক কিংবা মাইস্পেসের মতো সোস্যাল নেটওয়ার্কের নেতিবাচক দিকগুলো সহজে পরখ করতে পারে।
মনে রাখা দরকার, ডিজিটাল বাংলাদেশে স্কুল পর্যায়ে শুধু কম্পিউটার পৌঁছালেই চলবে না, এর সদ্ব্যবহারও শিখাতে হবে হাতে-কলমে।
নিউইয়র্ক, ৩ নভেম্বর ২০১০
----------------------------------------------------------------------
দৈনিক সংবাদ / ঢাকা / ৫ নভেম্বর ২০১০ শুক্রবার
ছবি- ইসাবেল
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।