মানুষ আমি আমার কেন পাখির মত মন....
অনেকে ঢাকা শহরের মধ্যে ট্রেন চলাচলের জন্য লেভেলক্রসিং গেট বন্ধ রাখাকে যানজটের অন্যতম প্রধান কারণ বলে চিহ্নিত করেছেন। তাঁরা অফিস টাইমের শুরু ও শেষে সকাল-বিকালে ট্রেন চলাচল বন্ধ রাখাসহ কমলাপুর রেলস্টেশনকে টঙ্গিতে বা গাজীপুরে স্থানান্তরের পরামর্শ দিয়েছেন। আমি তাঁদের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে বলতে চাই যে, এ ধরনের কোনো পদক্ষেপ হবে অবিবেচনাপ্রসূত এবং আত্মঘাতী। বরং ঢাকা শহরের মধ্যে ট্রেন চলাচল নির্বিঘ্ন ও দ্রুততর করাসহ ট্রেনসংখ্যা বৃদ্ধির কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হলে যানজট পরিস্থিতির উন্নতির প্রচেষ্টা অধিক ফলপ্রসূ হবে।
প্রথমেই বলা যায়, লেভেলক্রসিং-এ ট্রেন পাসিং-এর জন্য গেট বন্ধ করার ফলে সড়কযান চলাচলে সাময়িক (প্রতিবারে ২ থেকে ৩ মিনিট) বিরতি পড়ে সত্য, কিন্তু বিভিন্ন রোডক্রসিং ও ট্রাফিক সিগন্যালে এর চেয়ে অনেক বেশি সময় ধরে অপেক্ষায় থাকতে হয়।
অতএব রেলের জন্য যানজট তৈরি হচ্ছে_ এ ধারণা ঠিক নয়। ধরা যাক, টঙ্গি থেকে নারায়ণগঞ্জের মধ্যে রেল চলাচল বন্ধ করে রেললাইন উঠিয়ে দেয়া হলো এবং সড়কযান চলাচলের সুবিধার জন্য রেললাইনের স্থলে সড়ক নির্মাণ করা হলো। তাহলে অবস্থা এই দাঁড়াবে যে প্রতিটি রেলক্রসিং-এর জায়গায় রোডক্রসিং স্থাপিত হবে এবং অন্যান্য রোডক্রসিং বা ট্রাফিক সিগন্যালের মতো এসব নতুন ক্রসিংয়েও সড়কযান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ফলাফল হবে যথা পূর্বং তথা পরং বা তার চেয়েও খারাপ।
এবারে আসা যাক কমলাপুর স্টেশনকে স্থানান্তরের ব্যয়ের প্রশ্নে।
এটা একটা টার্মিনাল স্টেশন। কমলাপুর স্টেশন বলতে শুধু স্টেশন বিল্ডিং নয়, এর সঙ্গে আছে ইয়ার্ড, লোকোশেড, ডিজেল ওয়ার্কশপ, সিকলাইন, ওয়শ পিট, কন্টেইনার ডিপো, ডিভিশনাল হেডকোয়ার্টার অফিস, শত শত স্টাফ কোয়ার্টার ইত্যাদি। অনুমান করছি, এতে (মাত্র!) কয়েক হাজার কোটি টাকা ব্যয় হবে। কে বহন করবে এ ব্যয়? নিশ্চয়ই এই দরিদ্র দেশের জনগণ, যা তাদের ঘাড়ে চেপে বসবে বৈদেশিক ঋণের আদলে। আর এ থেকে লাভবান হবে যাঁরা সড়ক পরিবহন ব্যবসায়ে জড়িত এবং যাঁরা রেলওয়ের সোনার তুল্য জমি হাত করার আশা পোষণ করেন তাঁরা।
আর জনগণ হবে চিরস্থায়ী ভোগান্তির শিকার।
বর্তমানে ঢাকা ও ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট স্টেশন থেকে টঙ্গি রুটে আপ-ডাউনে দৈনিক ৭৮টি এবং ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে আপ-ডাউনে ২২টিসহ মোট ১০০টি যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল করে এবং এসব ট্রেনে বিভিন্ন স্টেশনের আপ-ডাউন যাত্রীসংখ্যা ১ লক্ষ (প্রায়)। কমলাপুর স্টেশনকে স্থানান্তর করা হলে এই সংখ্যক যাত্রী ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থান থেকে টঙ্গি (নতুন টার্মিনাল) পর্যন্ত যাতায়াতের জন্য বিকল্প যানবাহনের প্রয়োজন হবে। যাত্রীদের কিছুসংখ্যক বাসে, কিছু প্রাইভেট কারে ও বেবিট্যাক্সিতে যাতায়াত করবে। ধরা যাক, ৮০% বা ৮০,০০০ জন করবে বাসে যাতায়াত।
প্রতিটি বাসের যাত্রী বহন ক্ষমতা ৫০ জন করে হিসেব করলেও অতিরিক্ত আরও ১৬০০টি বাসের প্রয়োজন হবে। অবশিষ্ট ২০% যাত্রী প্রতিটি কারে/ বেবিট্যাক্সিতে গড়ে ৩ জন করে যাওয়া-আসা করলে ৬৬৬৬টি অতিরিক্ত কার/ বেবিট্যাক্সি লাগবে। ইতিমধ্যেই অতি ভারা-ক্রান্ত রোডে অতিরিক্ত আরো ৮২৬৬টি সড়ক-যান যুক্ত হলে বর্তমান যানজটের অবস্থা কী দাঁড়াবে তা সহজেই অনুমেয়। তার ওপর এই অতিরিক্ত বাস-কার সংগ্রহের ব্যয়, রক্ষণা-বেক্ষণ ও জ্বালানি ব্যয় আর পরিবেশ ও শব্দ দূষণের কথাও ভাবতে হবে। অতএব ঢাকা রেলস্টেশনকে কমলাপুর থেকে টঙ্গিতে স্থানান্তর যানজট নিরসনের কার্যকর কোনো সমাধান হতে পারে না।
যানজট নিরসনের উপায় হিসেবে সরকার কর্তৃক গঠিত টাস্কফোর্সের নির্দেশে সকাল ৮টা থেকে সাড়ে ৯টা এবং বিকেল ৫টা থেকে সাড়ে ৬টা পর্যন্ত ঢাকা স্টেশন থেকে কোনো ট্রেন ছাড়া ও ট্রেন গ্রহণের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এর ফলে যানজট নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে ঢাকা-তেজগাঁও-এর মধ্যে কয়েকটি লেভেলক্রসিং সড়কযানের জন্য খোলা রাখা হলেও ট্রেনযাত্রীদের জন্য সুবিধাজনক সময় থেকে ট্রেনের শিডিউল পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছেন রেল কর্তৃপক্ষ। এর পরেও রেলক্রসিং সংলগ্ন ক্রসরোডে ট্রাফিক পুলিশ কতর্ৃক সড়কযান নিয়ন্ত্রণ এবং এ কারণে বিলম্ব কিন্তু থেমে নেই।
ঢাকা শহরের মধ্যে ট্রেনের চলাচল নিয়ন্ত্রণ ও সীমিত করার পরিবর্তে নির্বিঘ্ন করাসহ ট্রেনসংখ্যা বাড়ালে সেটা বরং যানজট নিরসনের সহায়ক হবে। ইতিমধ্যেই ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লোকাল এবং ঢাকা-জয়দেবপুর তুরাগ এক্সপ্রেস ট্রেন-গুলো অত্যন্ত জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
৫ টাকায় নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা আর ৬ টাকায় ঢাকা-টঙ্গি ভ্রমণের এ ট্রেন সার্ভিস বাড়ানো এখন সময়ের দাবি। যানজট নিরসনের সহায়ক হিসেবে এ ধরনের ট্রেন সার্ভিস না বাড়ানোর পেছনে কোনো যুক্তিই থাকতে পারে না। কিন্তু উন্নত রেলব্যবস্থার উপযোগী অবকাঠামো নির্মাণ, বিদ্যমান অবকাঠামোর সংস্কার ও প্রয়োজনীয় রোলিং স্টক সংগ্রহ করা ছাড়া ট্রেন সার্ভিস বৃদ্ধির সুযোগ অত্যন্ত সীমিত। শহর এলাকার মধ্যে ট্রেন চলাচল নির্বিঘ্ন ও ট্রেন সংখ্যা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কিছু ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে_
১) লেভেলক্রসিংগুলোতে গ্রেড সেপারেশন ব্যবস্থা হিসেবে ওভারপাস/আন্ডারপাস নির্মাণ। এতে শহর এলাকার মধ্যে ট্রেনের গতিবেগ বাড়ানো যাবে।
২) রেললাইনের দু'পাশ বরাবর বেড়া বা দেয়াল নির্মাণ যাতে লেভেলক্রসিং ছাড়া লোকজনের পারাপার বন্ধ হয়। এতে রেললাইন পারাপারকালে অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা এড়ানোসহ ট্রেনের গতিবেগ বৃদ্ধি পাবে।
৩) ইন্টারমিডিয়েট বস্নক সিগন্যাল বা অটোমেটিক বস্নক সিগন্যাল স্থাপন করে সেকশনাল ক্যাপাসিটি বৃদ্ধির মাধ্যমে অধিক সংখ্যক ট্রেন চালানোর ব্যবস্থা গ্রহণ। এতে বিদ্যমান রেললাইনে বর্তমানের প্রায় দ্বিগুণ সংখ্যক ট্রেন চালানো যাবে। এ বিষয়ে রেলওয়ে সেক্টর ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্ট-এর আওতায় সমীক্ষা প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।
৪) ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সিঙ্গেল লাইনকে ডবল লাইন এবং ঢাকা-টঙ্গি ডবল লাইনকে চার লাইনে উন্নীতকরণ। এতে সিগন্যালিং ব্যবস্থার উন্নয়ন (অটোমেটিক বস্নক সিগন্যাল) না করেও ট্রেনসংখ্যা দ্বিগুণ করা যাবে।
৫) দূরপালস্নার ট্রেনগুলো ঢাকা থেকে পরিচালনা এবং তেজগাঁও স্টেশনকে রিমডেলিং করে সাবার্বান টার্মিনাল স্থাপন করে এখান থেকে নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা-জয়দেবপুর রুটে ঘন ঘন (প্রতি ঘণ্টায় বা ৩০ মিনিট পর পর) কমিউটার/সাবার্বান ট্রেন সার্ভিস পরিচালনা করা যেতে পারে।
৬) সাবার্বান/লোকাল সার্ভিসের জন্য বিশেষ ধরনের দ্রুত গতির ট্রেন-সেট (বগি ও ইঞ্জিন_ ডিএমইউ বা ডিজেল মাল্টিপল ইউনিট) সংগ্রহকরণ। কারণ বাংলাদেশ রেলওয়েতে এখন বগি ও ইঞ্জিনের সঙ্কট চলছে, নতুন ট্রেনের জন্য বগি ও ইঞ্জিনের সংস্থান নেই।
উলিস্নখিত ব্যবস্থাগুলো বেশ ব্যয়বহুল এবং কোনো কোনোটি সময়সাপেক্ষও বটে। কিন্তু বিগত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায় যে, যানজট থেকে মুক্তি পাওয়ার সহজ, সস্তা ও তাৎক্ষণিক কোনো উপায় নেই। ইতিপূর্বে বেশ কয়েকটি ব্যয়বহুল ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হয়েছে। তাতে পরিস্থিতির খুব একটা উন্নতি হয়েছে এমন বলা যাবে না। আরো ব্যয়বহুল ফ্লাইওভার, এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ে ইত্যাদি নির্মাণের পরিকল্পনার কথা আলোচিত হচ্ছে।
এগুলো বাস্তবায়িত হলে যানজট নিরসনের সহায়ক হবে সন্দেহ নেই। কিন্তু আমাদের পাশর্্ববর্তী দেশ ভারতসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশের উদাহরণ টেনে বলা যায়, যে কোনো মেগাসিটির গণপরিবহন মাধ্যম হিসেবে রেলওয়ের সাবার্বান/ কমিউটার সার্ভিস বা পাতাল রেল, মনোরেল ইত্যাদি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। রেলওয়ে অবকাঠামোর উন্নয়ন ব্যয়বহুল বা সময়সাপেক্ষ বলে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না।
মো. আবদুল ওয়াহাব
ঢাকা
(Click This Link)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।