টুকলিফাই মারাই আমাদের কাজ, চুরা ছেঁচা দেয়াই আমাদের লক্ষ্য।
সেনা বাহিনী বিডিয়ারে গিয়ে কি করে দেখেন !!!!
পারভেজ খান, উত্তরাঞ্চল সীমান্ত এলাকা থেকে ফিরে
সেলিম ও রাহাত জানাল, তারা দুজনই একসময় ছিনতাইকারী ছিল। ধরা পড়লে গণধোলাই খেয়ে মরতে হতে পারে, এ আশঙ্কায় পুলিশের হাত ধরে বছর পাঁচেক হলো চোরাচালানের লাইনম্যানের কাজ শুরু করেছে। এখন দুজন মিলে ঢাকার উত্তরখানে বাড়ি করেছে দুটি। ওই বাড়ি ভাড়া দিয়ে রেখেছে।
সেখান থেকে আসে মাসে নব্বই হাজার টাকা। দিনাজপুরে রাইস মিল করেছে দুজনে মিলে। সেখান থেকেও ভালো আয় আসে। এত কিছুর পরও প্রতিদিনের নগদ প্রাপ্তির লোভে এখনো তারা চোরাকারবারের লাইনম্যানের কাজ করে চলেছে।
কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে, উত্তরাঞ্চলের সীমান্ত এলাকার যেকোনো লোককে জিজ্ঞেস করলে শোনা যাবে প্রায় এক সুর_আয়-ইনকাম এখন ভালো না।
চোরাচালান আগের চেয়ে অনেক কমে গেছে। নেই বললেই চলে। অথচ সীমান্ত এলাকার মাটিতে এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকলেই দেখা যাবে প্রকাশ্যে চলছে চোরাচালান। কারো কোনো বাধা নেই। বিএসএফ,
বিডিআর, পুলিশ_সবার সামনে দিয়েই আনা-নেওয়া হচ্ছে চোরাই পণ্য।
রাত-দিন ২৪ ঘণ্টা অবাধে মালামাল এপার-ওপার হচ্ছে।
বখরার রেট : চাল প্রতিকেজি এক টাকা, লবণ প্রতিকেজি এক টাকা, চিনি কেজি এক টাকা, পেঁয়াজ এক টাকা, ডাল এক টাকা, জিরা প্রতিকেজি দুই টাকা, এলাচ দুই টাকা, শাড়ি বা থ্রিপিস প্রতিটি কাপড় ভেদে পাঁচ থেকে ২০ টাকা, ২০ হাজার টাকার প্রসাধনী ২০০ টাকা, মোটরসাইকেল প্রতিটি এক হাজার টাকা, আর ফেনসিডিল প্রতি বোতল ১০ টাকা ও ইয়াবা ট্যাবলেট প্রতিটি তিন টাকা_জয়পুরহাট ও দিনাজপুরের সীমান্ত এলাকায় চোরাইপথে ওপার থেকে এসব পণ্য এপারে আনলে থানা-পুলিশ, ডিবি, র্যাব, বিডিআর আর জিআরপি থানা-পুলিশকে পৃথক স্লিপের মাধ্যমে এই দরেই টাকা দিতে হয়। মাঝে-মধ্যে অবশ্য এই দর ওঠা-নামাও করে। করলেও তবে এই বাজারের আরেক নাম হচ্ছে কালোবাজার। দুই জেলার কয়েকটি সীমান্ত এলাকা ঘুরে চোরাকারবারিসহ বিভিন্ন সূত্রের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে।
আসে-যায় : ভারত থেকে চোরাচালান হয়ে এখন বাংলাদেশে আসছে ভেজাল ও নকল সার (পটাশ ও ডিএপি), কাপড়, চিনি, গরম মসলা, চাল, পেঁয়াজ, লবণ, চিনি, ধান ও পাটের বীজ, ডাল, নতুন ও চোরাই মোটরসাইকেল, কসমেটিকস, ইমিটেশনের গয়না, গার্মেন্ট সামগ্রী, যৌন উত্তেজক বড়ি, নেশার ইনজেকশন, ইয়াবা ও ফেনসিডিল। অন্যদিকে বাংলাদেশ থেকে ভারতে পাচার হয়ে যাচ্ছে সিমেন্ট, মাছের পোনা, তামা, পিতল, বৈদ্যুতিক ট্রান্সফর্মার, ইলিশ মাছ, বেনসন সিগারেট, সুপারি, গার্মেন্টসামগ্রী (বিশেষ করে জিনসের) ইট ও পাট। আর এসব মালামাল পারাপার করতে হলে দুপারেই আইনশৃঙ্খলা রাক্ষাকারীদের ওপরে উলি্লখিত হারে টাকা দিতে হয়। এই টাকা আদায় করার জন্য আছে লাইনম্যান ও কালেক্টর।
পালাক্রমে লাইনম্যান : কালের কণ্ঠের অনুসন্ধানে জানা গেছে, জয়পুরহাট শহরে পুলিশ, বিডিআর ও র্যাবের লাইনম্যান হিসেবে কাজ করছে দুই শতাধিক বেকার ও বিপথগামী তরুণ ও যুবক।
তাদের কাজই হচ্ছে চোরাচালানিদের ওপর সার্বক্ষণিক নজর রাখা, তাদের কাছ থেকে যথাযথ কমিশন নিয়ে সেভাবে দেখভাল করা আর নিরাপদে রাস্তা পার করে দেওয়া। এদের রয়েছে বিশাল নেটওয়ার্ক। দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা এরা পালাক্রমে দায়িত্ব পালন করে অতি সতর্কতার সঙ্গে। ফলে কোনো চোরাকারবারির পক্ষেই সম্ভব হয়ে ওঠে না পুলিশ, র্যাব বা বিডিআরের চোখ ফাঁকি দিয়ে মালামাল এপার-ওপার করা। আর কেউ চেষ্টা চালিয়ে ধরা পড়লে চোরাচালানের পুরো পণ্যই গায়েব হয়ে যাবে।
অনুসন্ধানে জয়পুরহাটে চোরাচালানের নেটওয়ার্ক পরিচালনাকারী লাইনম্যানদের নেতা হিসেবে যাদের নাম পাওয়া গেছে, তারা হলো_তুহিন, ইসলাম, ফিরোজ, বিপ্লব, কালু, বাবু, শান্ত, সাগর, মাসুদ, নয়ন, ভাতিজা ফায়জুল, মান্নান, সেলিম, রাহাত, রোজ, রাজ, ফরিদ, ময়না, কুসুম, আনিসুর ও নয়ন কমিশনার।
পুলিশের স্লিপ, র্যাব-বিডিআরের নগদ : লাইনম্যান সেলিম ও রাহাত এ প্রতিবেদককে আরো জানায়, জয়পুরহাট সদর এলাকা থেকে ডিবি, সদর থানা, কালাই থানা, আক্কেলপুর থানা, ক্ষেতলাল, পাঁচবিবি থানাসহ বগুড়া সদর ও শিবগঞ্জ থানার লাইনম্যানরা চোরাচালানিদের কাছ থেকে টাকা উঠিয়ে তাদের হাতে পৃথক স্লিপ ধরিয়ে দেয়। পথে তল্লাশিতে পড়লে ওই স্লিপ দেখালে ছেড়ে দেওয়া হয়। র্যাব ও বিডিআর কোনো স্লিপ দেয় না। তারা নগদ টাকা নিয়ে ইশারায় ছেড়ে দেয়।
বিডিআরকে টাকা দিতে হয় ঘাট (প্রবেশপথ) ও চেকপোস্টে পৃথকভাবে। লাইনম্যানরাই এই টাকা তুলে তাদের হাতে উঠিয়ে দেয়। আর হিলি থেকে টাকা ওঠানো হয় হাকিমপুর, বিরামপুর, ফুলবাড়ী ও গোবিন্দগঞ্জ থানার।
অবিশ্বাস্য আয় : স্থানীয় কয়েকজন লাইনম্যান ও চোরাচালানির কাছ থেকে জানা গেছে, জয়পুরহাট ও হিলি এলাকা এখন চোরাচালানের স্বর্গরাজ্য। অবিশ্বাস্য মনে হলেও জানা গেছে, শুধু হাকিমপুর, পাঁচবিবি ও জয়পুরহাট সদর থানার প্রতিদিনের আয় সাত লাখ টাকা।
এ ছাড়াও জয়পুরহাট ও হিলির আশপাশের ২৪টি পয়েন্ট থেকে প্রতিদিন বিডিআর পাঁচ লাখ, ডিবি দুই লাখ, আক্কেলপুর, কালাই, ক্ষেতলাল, বিরামপুর, ফুলবাড়ী, শিবগঞ্জ ও গোবিন্দগঞ্জ থানা দেড় লাখ টাকা করে, র্যাব দেড় লাখ, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর আড়াই লাখ ও জিআরপি থানা এক লাখ টাকা করে পাচ্ছে। এ ছাড়া স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবশালী কিছু ব্যক্তিকেও প্রতি মাসে নিয়মিত টাকা দিতে হয়।
লাইনম্যানরা জানায়, তারা একেকজন একেক সংস্থার হয়ে কাজ করে। একজন দুই সংস্থার কাজ করতে পারে না। সব ঘাটে জমা দেওয়ার পর একজন লাইনম্যানের প্রতিদিন চার-পাঁচ হাজার টাকা করে থাকে।
আর বড় চালান হলে আয়ের পরিমাণ বেড়ে যায়। বিশেষ করে হেরোইন, ইয়াবা বা ফেনসিডিলের বড় চালান হলে মোটা অঙ্কের টাকা থাকে। এসব চালানে কোনো স্লিপ দেওয়া হয় না। এই লাইনম্যানের কাজ পেতে অনেক সময় বড় বড় চোরাচালানিকে অগ্রিম হিসেবে মোটা অঙ্কের টাকা জামানত দিতে হয়।
জরুরি ক্লিয়ারেন্স : লাইনম্যানরা আরো জানায়, তাদের প্রত্যেকের কাছে মোবাইল ফোন আছে।
চোরাচালানিরা মালামাল এপার-ওপার করার আগে তাদের কাছে লাইন ক্লিয়ারেন্স চায়। এ সময় তারা বিডিআর, বিএসএফ, পুলিশসহ সবার সঙ্গে কথা বলে তাদের সম্মতি নিয়েই লাইন ক্লিয়ারেন্স দেয়। তাদের কাছ থেকে ক্লিয়ারেন্স না নিয়ে কেউ মালামাল আনা-নেওয়া করলে তার দায়িত্ব লাইনম্যানদের নয়। আর তাদের ক্লিয়ারেন্সের পরও যদি কোনো মালামাল আটক হয়, তা ছাড়িয়ে আনার দায়িত্বও লাইনম্যানদের। এ ক্ষেত্রে চোরাচালানির কাছ থেকে কোনো টাকা নেওয়া হয় না।
ওই মালামালের ক্রেতা বা মহাজনরাই এই টাকা দিয়ে থাকে। এসব ক্ষেত্রে স্থানীয় রাজনৈতিক দলের কয়েকজন নেতাও তাদের সরাসরি সহায়তা করেন বলে লাইনম্যানরা জানায়।
র্যাবসহ স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, সীমান্ত এলাকায় চোরাচালান নতুন কিছু নয়। দেশ বিভক্ত হওয়ার পর থেকেই এটা চলে আসছে। তবে এখন তুলনামূলক বেশি এবং যে যাই বলুক, দিন দিন ক্রমেই চোরাচালান বাড়ছে।
আর এত অল্পসংখ্যক পুলিশ ও বিডিআরের পক্ষে এই চোরাচালান রোধ করা সম্ভব নয়।
কর্তৃপক্ষের প্রত্যয় : জয়পুরহাটের পুলিশ সুপার মোজাম্মেল হক এ ব্যাপারে গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, তিনি মাত্র কিছুদিন আগে এখানে যোগ দিয়েছেন। তার কাছে মনে হয়েছে, শুধু আইন দিয়ে এই চোরাচালান বন্ধ করা সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন জনগণের সম্পৃক্ততা আর জনসচেতনতা বাড়ানো। তাই আইন প্রয়োগের পাশাপাশি তিনি এ ব্যাপারেও জোরালো ভূমিকা রাখার উদ্যোগ নিয়ে আজ থেকেই কাজ শুরু করবেন বলে জানান।
পুলিশের বিরুদ্ধে লাইনম্যানদের মাধ্যমে স্লিপ দিয়ে টাকা নেওয়ার অভিযোগের ব্যাপারে পুলিশ সুপার বলেন, 'আগেই বলেছি, আমি এখানে নতুন। এরপরও বলছি, পুলিশের বিরুদ্ধে এরকম অপরাধের কোনো প্রমাণ পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে কঠোরতর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। '
জয়পুরহাটের জেলা প্রশাসক অশোক কুমার বিশ্বাস গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, চোরাচালান রোধে আজ থেকে জয়পুরহাটে বিশেষ টাস্কফোর্সের অভিযান শুরু হবে। এজন্য প্রয়োজন সব শ্রেণীর মানুষের সহযোগিতা।
চোরাচালান আর মাদক প্রতিরোধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কঠোর সমালোচনা করে ডিসি বলেন, 'তাদের দায়িত্ব পালনের ধরন আর কর্মকাণ্ডে আমি ক্ষুব্ধ।
এ ব্যাপারে তাদের সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আমি কথা বলব। '
বিডিআরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. রফিকুল ইসলাম গতকাল কালের কণ্ঠকে জানান, সীমান্তে চোরাচালান রোধ বিডিআরের দ্বিতীয় দায়িত্ব। চেষ্টা করা হচ্ছে এটা রোধের। বর্তমানে সীমান্ত এলাকায় গড়ে প্রতি ৯ কিলোমিটারে মাত্র একটি করে বিওপি (বর্ডার আউট পোস্ট)। নতুন করে এর সংখ্যা বাড়ানোর প্রক্রিয়া চলছে।
এটি হলে চোরাচালান কমে আসবে।
বিডিআরের সঙ্গে চোরাচালান আর লাইনম্যানদের সম্পৃক্ততার অভিযোগের ব্যাপারে মহাপরিচালক বলেন, কিছু কিছু অসৎ সদস্য আছে, যাদের কারণে বিডিআরের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়। তাদের ওপরও নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। আর যারা ধরা পড়ছে তাদের বিরুদ্ধেও আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে তিনি জানান।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।