জয়তুন বসে ছিলেন পুড়ে যাওয়া তাজরিন ফ্যাশন লিমিটেড ভবনটির পেছন দিকটায়। আগুণের হাত থেকে বাচার জন্য চারতলা থেকে লাফিয়ে নামতে গিয়ে পায়ে বেশ আঘাত পেয়েছেন। জানতে চাইলাম, চার তলা থেকে লাফ দিতে গেলেন ক্যান, সিড়ি দিয়ে নামলেন না ক্যান। বললেন, পিএম(প্রডাকশন ম্যানেজার) নামতে দেয় নাই, সিড়ির মুখের কেচি গেইট(কলাপসিবল গেইট) বন্ধ করে রেখেছিলো। বলেছিলো, আরে কিছু হবে না, নীচ তলায় আগুণ লাগছে, আপনারা আপনাদের কাজ করেন।
পিএম এর একটাই চিন্তা- প্রতি লাইন থেকে ঘন্টায় ২০০ পিছ মাল ডেলিভারি দিতে হবে।
এরপর সিড়ি দিয়ে ধোয়া উঠে আসতে দেখা গেলে জয়তুনদেরকে যখন গেইট খুলে নীচে যেতে দেওয়া হয়, তারা তিন তলার বেশি নামতে পারেন নি। নীচ তলার গোডাউন থেকে উঠে আসা আগুন আর ধোয়ায় ততক্ষণে সিড়িপথ নরকে পরিণত হয়েছে। প্রতিটি ফ্লোরে তিনটি করে সিড়ি থাকলেও, ফায়ার এক্সিট বলতে যা বোঝায়(ভবনের বাইরে দিকের সিড়ি) তা ছিল না, সকল সিড়িই ভবনের ভেতরেই গিয়ে নেমেছে। ফলে জয়তুন কয়েকজন শ্রমিকের চেষ্টায় ভাঙা জানালা দিয়ে, এক পুরুষ শ্রমিকের সহায়তায় নীচে লাফ দিতে বাধ্য হয়।
তার মতো আরো অনেকেই লাফ দিয়েছে, কেউ বেচেছে কেউ মরেছে। আর যারা সে সুযোগ পায়নি তারা আক্ষরিক অর্থেই পুড়ে কয়লা হয়েছে।
ছবি: পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়া শ্রমিক(মানুষ?)
নরকের সিড়ি: তাজরিন গার্মেন্টস এ আগুন লাগে প্রথমে নীচ তলার ‘গোডাউন’ এ রাখা বিপুল পরিমাণ সিনথেটিক সূতার স্তুপে। সম্ভবত ঠিক পাশেই অবস্থিত জেনারেটর রুম থেকে শর্ট সার্টিক বা অন্য কোন উপায়ে সে আগুণের সূত্রপাত। জেনারেটর রুমের পাশেই নীচতলার পুরো ফ্লোরকে ‘গোডাউন’ বা ‘স্টোর রুম’ বানিয়ে সেখানে সূতার মতো দাহ্য পদার্থ রাখা একটা অপরাধ।
ছবি: বামে জেনারেটর রুম ডানে গোডাউনের জানালা
তারচেয়ে ভয়াবহ অপরাধ হলো এমন একটা স্থানকে দাহ্য পদার্থ রাখার গোডাউন বানানো যেস্থানটিতে ভবনের সবগুলোর সিড়ির এসে মিশেছে! ফলে গোডাউন জুড়ে আগুণ ছড়িয়ে যাবার পর যারাই সিড়ি দিয়ে নেমে এসেছে, তারা একেবারে জ্বলন্ত নরকের মধ্যে এসে পড়েছে।
ছবি: গোডাউনের মধ্যে নেমে আসা সিড়ি, দুপাশে পুড়ে যাওয়া সুতা
একেবারে প্রথম ধাক্কায় আগুণ লাগার সাথে সাথে, আগুণ ছড়িয়ে পড়ার আগেই যারা নামতে পেরেছে, কেবল তাদের পক্ষেই এই নরক অতিক্রম করে মূল প্রবেশ পথ দিয়ে বের হয়ে যাওয়া সম্ভব হয়েছে কিন্তু মালিকের নির্দেশ মোতাবেক যেহেতু বাইডিফল্ট প্রতিটা ফ্লোরের কলাপসিবল গেইট সব সময় বন্ধ থাকে এবং যেহেতু প্রডাকশন ঠিক রাখার চাপ ও মালামালের নিরাপত্তার অযুহাতে পিএম ও সিকিউরিটি গার্ডরা আগুন লাগার পরও বেশির ভাগ ফ্লোরেই সেই গেইট খোলেনি(দুই একটা ক্ষেত্রে খুললেও ততক্ষণে দেরী হয়ে গেছে) সেহেতু বহু শ্রমিক সময় মতো সিড়ি দিয়ে নামতে পারে নি, ফলে সিড়ি দিয়ে উঠে আসা ধোয়ায় দম বন্ধ হয়ে, আগুণে পুড়ে কয়লা হতে হয়েছে তাদেরকে।
কাটা তালা- গেইট বন্ধ করে রাখার প্রমাণ:
গেইট বন্ধ করে রেখে পুড়িয়ে মারার যে অভিযোগ জয়তুন বা অন্য শ্রমিকরা করেছেন, তা যে কতটা সত্য তা গেইটে ঝুলন্ত তালাগুলো পরীক্ষা করেই বোঝা গেল। প্রায় প্রতিটি গেইটেরই তালা কাটা অবস্থায় ঝুলছে। কলাপসিবল গেইট তালাবন্ধ অবস্থায় পাওয়া গেছে বলেই আগুণ নেভানোর কাজে আসা ফায়ার ব্রিগেডের কর্মীদেরকে গেইটের তালা কেটে তারপর ভেতরে ঢুকতে হয়েছে।
ছবি: বিভিন্ন ফ্লোরে কলাপসিবল গেইটের তালা কাটা
শ্রমিকদের বাচার লড়াই:
বেচে থাকার জন্য, ন্যূনতম মজুরী আর শ্রমের-ঘামের মর্যাদার জন্য যে শ্রমিকদেরকে প্রতিনিয়ত মালিক-পুলিশ-র্যাব-মাস্তানদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়েছে, আগুনের নরক থেকে বাচার জন্য সেই শ্রমিকরা যে কি ভীষণ লড়াই করেছেন তার স্বাক্ষ্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তাজরিন ফ্যাশন লিমিটিডের প্রতিটি ফ্লোরেই। কলাপসিবল গেইট দিয়ে বের হতে না পেরে কিংবা বের হতে পারলেও ধোয়া আর আগুণে নরক হয়ে ওঠা সিড়ি দিয়ে নামতে বা উপরে উঠতে না পেরে শ্রমিকরা বাচার আশায় জানালার কাচ, লোহার গ্রিল, এক্সস্ট ফ্যান ইত্যাদি ভেঙে, বাকিয়ে নানান ভাবে চেষ্টা করেছেন। যারা পেরেছেন তারা ভাঙা জানালা কিংবা বাকানো লোহার গ্রিলের ফাক দিয়ে নীচের টিনের চাল, পাশ্ববর্তী ভবনের ছাদে লাফিয়ে , কেউ বা নির্মাধীন ভবনটির এক পাশের বাশের মাচা বেয়ে নীচে নামার চেষ্টা করেছেন।
ছবি: এই জানালা দিয়ে তারা নীচে লাফিয়ে পড়েছেন, ছড়ানো ছিটানো স্যান্ডেল
ছবি: শ্রমিকরা এই টিনের চালের উপর লাফিয়ে পড়ে
প্রতিটি ফ্লোরে ৬টি করে প্রোডাকশন লাইনের প্রতিটিতে অন্তত: ৬০ জন করে শ্রমিকের বসার ব্যাবস্থা দেখে গেছে। এ হিসেবে আগুণ লাগার সময় প্রতিটা ফ্লোরে ৩৬০ জন করে ৮ তলা ভবনে অন্তত: ২,৮৮০ জন শ্রমিক কাজ করার কথা।
আমরা জানিনা, এত বিপুল সংখ্যক শ্রমিকেরা ঠিক কত জন এভাবে লাফিয়ে পড়ে, মাচা বেয়ে কিংবা সিড়ির ধোয়া আর আগুণ অতিক্রম করে বাচতে পেরেছেন। আনুষ্ঠানিক ভাবে উদ্ধার কার্যক্রম সমাপ্ত হওয়ার পর সরকারি ভাবে ১১০ টি লাশ পাওয়ার কথা স্বীকার হলেও অনেক মানুষ এখনও তাদের নিখোজ স্বজনদের খুজে ফিরছেন।
গার্মেন্টস না লাশের কারখানা?
এবার তাজরীন ফ্যাশনে আগুন লেগেছে, এর আগে হামীম গার্মেন্টস এ লেগেছিল, তার আগে গরীব এন্ড গরীব গার্মেন্টস, তারও আগে কেটিএসএ..। এরকম লাগেই, লাগতেই থাকে। কলকারখানায় পণ্যের পাশাপাশি বিষাক্ত বর্জ্য উৎপাদনের মতোই আগুনে পুড়ে কিংবা ধোয়ায় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে শ্রমিকের লাশ হওয়াটা আমাদের কাছে ইতিমধ্যেই খুব স্বাভাবিক ঘটনার মতো হয়ে গেছে এবং সেই সাথে বোধহয় "নেসেসারি ইভিল" হয়ে উঠেছে- কারখানায় পণ্য উৎপাদন করতে চাইলে যেমন বর্জ্য উৎপাদন অবশ্যম্ভাবি! ভাবটা এমন, যেন কারখানা থাকলে, হাজার হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে চাইলে এই সব একটু আধটু তো সইতে হবেই! বিভিন্ন সময় ভবন ধ্বসে ও অগ্নিকান্ডে গার্মেন্টসেক্টরেই ১৫০০'র বেশি শ্রমিক নিহত হয়েছে।
আহত হয়েছে হাজার হাজার। তারা পঙ্গুত্বের যন্ত্রণা নিয়ে বেচে আছে। কিন্তু এই সমস্ত মৃত্যুর জন্য দায়ী মালিকদের আজ পর্যন্ত কাউকে শাস্তি দেয়া হয়নি। যে মুনাফা সর্বোচ্চ করণ ম্যাকানিজম এবং মালিক শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষাকারী শাসক শ্রেণীর সরকারের নজরদারি ও রেগুলেশনের ঘাটতির কারণে এই ধরণের ঘটনা বারবার ঘটছে তার কোন পরিবর্তনও হচ্ছে না।
তাই মালিকের মুনাফা সর্বোচ্চ করণের জন্য যে ধরণের ম্যাকানিজম তাজরিন গার্মেন্টস এ চালু ছিল, তাতে এরকম লাশ উৎপাদিত হওয়ারই কথা:
১) তাড়াহুড়া করে নির্মিত ভবনটিতে কোন ফায়ার এস্কেপ বা ভবনের বাইরের দিকের বিকল্প সিড়ি ছিল না।
এটা কি অর্থ বাচানোর জন্য করা হয়নি নাকি ডিজাইনের ত্রুটি? আর্কিটেক্ট বা ইঞ্জিয়ারের ডিজাইনের সমস্যা? এ ভবনে গার্মেন্টস চালু করা অনুমতি দিল কে? এতবড় একটা অবহেলা সরকারি তদারকি সংস্থাগুলোর চোখে পড়ল না কেন? কারখানা পরিদর্শক দলের কাজ কি তাহলে?
২)সূতার মতো দাহ্য পদার্থ রাখার জন্য গোডাউন বানানো হয়েছে এমন একটি স্থানকে যেখানে ভবনের সবগুলো সিড়ির এসে মিশেছে। কত অর্থ বাচানোর জন্য মালিক আলাদা গোডাউন বা স্টোররুমের বদলে সবসময়ই নীচতলার ফাকা স্থানকে গোডাউন হিসেবে ব্যাবহার করে? সরকারি তদারকি সংস্থাই বা কেন এরকম একটি বিষয় দেখল না?
৩) জেনারেটর রুমের অবস্থান কেমন করে ভবনের সিড়িমুখে থাকতে পারে যেখানে আবার সূতার মতো দাহ্য পদার্থ স্তুপ করে রাখা হয়? জেনারটের থেকে আগুনের সূত্রপাত হওয়া অস্বাভাবিক কিছু না, তাহলে প্রবেশ পথ থেকে নিরাপদ দূরত্বে কেন জেনারটর রুম স্থাপন করা হলো না? এর দায় কার?
৪) বাই ডিফল্ট প্রতিটা ফ্লোরের কলাপসিবল গেইট বন্ধ করে রাখা। ভেতরে শ্রমিকরা কাজ করার সময় গেইট বন্ধ করে রাখা হবে কেন? কিসের তাড়নায় মালামালের নিরাপত্তা শ্রমিকের নিরাপত্তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে?
৫) আগুণ লাগার পরও গেইট খুলে না দেয়া। এ কেমন শিল্প যেখানে প্রডাকশন ম্যানেজারের কাছে শ্রমিকের নিরাপত্তার চেয়ে ঘন্টা প্রতি প্রডাকশন রেট ঠিক রাখাই মুখ্য ব্যাপার? প্রতিটি অগ্নিকান্ডের সময়ই এই গেইট বন্ধ রাখা এবং সময় মতো খুলে না দেয়ার বিষয়টি উঠে এসেছে কিন্তু কোন প্রতিকার হয় নি। আর কত শ্রমিক পুড়ে কয়লা হলে গেট গুলো সবসময় খোলা থাকবে?
৬) ভবনটি এমন একটি এলাকায় অবস্থিত যার আশ পাশে কোন পানির উৎস নেই, যেখানে বড় গাড়ি চলাচলের মতো প্রশস্ত রাস্তা নেই।
যে কারণে মাত্র ৬ কিমি দূর থেকে ফায়ারব্রিগেডকে ঘটনা স্থলে পৌছতে এবং আগুণ নেভাতে অনেক বেগ পেতে হয়েছে। হাজার হাজার শ্রমিকের কর্মস্থলের ন্যূনতম নিরাপত্তার আয়োজন না থাকার এই দায় কার?
বাংলাদেশের কয়টা গার্মেন্টস উপরোক্ত মুনাফা সর্বোচ্চ করণ ও অবহেলার ম্যাকানিজমের বাইরে? তাজরিন ফ্যাশনের মতো কালকে যে আরেকটা গার্মেন্টস এ আগুণ লেগে একই রকম ঘটনা ঘটবে না তার নিশ্চয়তা কি?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।