ড. মা হ বু ব হা সা ন
উপসম্পাদকীয়, দৈনিক আমারদেশ,৩১ অক্টোবর।
কে সত্য কথা বলছেন তা আমরা জানি না। কারণ, কার কথা বিশ্বাস করব, আর কার করব না, তা নিয়ে আমরা দ্বিধায় আছি। আওয়ামী লীগ নেত্রী ও সংসদ উপনেতা সাজেদা চৌধুরী বলেছেন, ‘বেগম খালেদা জিয়ার বাড়ি নিয়ে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী যে বক্তব্য দিয়েছেন তার মাধ্যমে সেনাবাহিনীকে উসকে দেয়া হয়েছে। ’ সাজেদা চৌধুরীর অভিযোগ কিংবা সাকা চৌধুরীর অভিযোগ দুই পক্ষের দৃষ্টিকোণ ‘পয়েন্ট অব ভিউ’ থেকে সত্য বলেই বিবেচিত হবে।
দুই পক্ষই সত্য কিংবা দুই পক্ষই মিথ্যা। মাঝামাঝি বলে যে স্ট্যান্ডার্ডটিকে সামাজিক মানুষ অনুমোদন করে, সেটা নাকি অপরচুনিস্টদের দখলে। সুবিধাবাদীদের দখলে চলে গেছে গোটা বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ। এটা সুবিধাবাদী বিধায় নিজেদের মত-পথকে আওয়ামী কভার আর বিএনপি কভারের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে চোখে নির্মোহ কালো চশমা পরেছেন। তারা আজ অন্ধদের মতো বেশি দেখেন চোখে, অথবা গ্রিক ত্রিকালদর্শী টাইরেসিয়াসের মতো ভবিষ্যত্ বক্তায় নিজেদের পারদর্শী বিবেচনা করেন।
এভাবে একদল বুদ্ধি বিক্রি করে চলেছেন আওয়ামী নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের কাছে আওয়ামীপন্থী হিসেবে, অন্যদল বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের বিরোধী রাজনৈতিক পক্ষে। কিন্তু দলের দিক থেকে এটাকে যথার্থ হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। বলা হবে, তারা স্বাধীনভাবেই মতামত দিয়ে থাকেন। হ্যাঁ, এটা ঠিক, তারা স্বাধীনভাবেই মত প্রকাশ করেন, তবে সেই মতো ‘বিচার মানি, কিন্তু তাল গাছটা আমার’ এ ধরনের স্বাধীনতা। জাতীয় সংসদে অভিযোগ উঠেছিল সাংবাদিকরা নিউজ ফেব্রিকেশন করে।
তাদের জবাবদিহিতা নেয়া উচিত বলেও দাবি জানানো হয়েছে। আমরা এর প্রতিবাদ জানিয়েছি। কারণ সাংবাদিকরা নিউজ ফেব্রিকেট করে না। নিউজ লেখার ক্ষেত্রে সাংবাদিকের ভাষা-জ্ঞানের ঘাটতির ফলে অনেক সময়ই মিস এন্টারপ্রেইট হয়ে থাকে। আবার নিউজের তথ্য-ঘাটতির ফলেও এমনটা হতে পারে।
এসব সত্ত্বেও নিউজের রাজনৈতিক ও সামাজিক মেরিট হয়তো কমে যায়, কিন্তু তা মিথ্যায় পরিণত হয় না। জাতীয় সংসদে অভিযোগ উত্থাপনের পর বলা হয়েছিল সাংবাদিকরা সংসদে উপস্থিত হয়ে জবাবদিহি করবে। এই ঘোষণার পর মাননীয় স্পিকার, মন্ত্রী-এমপি মহোদয়রা আর কোনো উচ্চবাচ্য করেননি। এর কারণ, সাংবাদিকদের জবাবদিহি নিতে গেলে সবার আগে তাদের জবাবদিহি করতে হবে। তারা জবাবদিহি করতে বাধ্য।
কিন্তু মাননীয়রা সেই জবাবদিহিতায় উত্সাহী নন। তারা তদবির-বিজনেসে যতটা পারদর্শী, নিজেদের স্বার্থ হাসিলে যতটা তত্পর, নিজেদের ব্যবসা-বাণিজ্য গোছাতে যতটা সময় তারা ব্যয় করেন, তার ২০% যদি জনগণের সেবার লক্ষ্যে ব্যয় করতেন এবং সংসদে এসে তার কাজের ফিরিস্তি দিতেন, তাহলেও এ-দেশের উন্নয়নের গতি আজকের মতো শ্লথ হতো না। তবে এই সত্য আজকের ক্ষমতাসীনরা মেনে নেবেন না। তারা বলবেন, তারা যা করে চলেছেন, তা গত ৩৮ বছরে হয়নি। এমন কথার মধ্যে যে নিজেদের শাসনকালও আছে সেটা তাদের মনে থাকে না।
এই মিথ্যাচারের কারণেই কোনো সত্ মানুষই রাজনীতিকদের বক্তব্য নিয়ে মাতোয়ারা হয় না। মাতোয়ারা হয় কেবল পলিটিক্যাল এলিমেন্ট, যারা রাজনীতি করেন ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধারের জন্য। তাদের লক্ষ্য নেতা হওয়া, এমপি হওয়া, মন্ত্রী হওয়া। আর এই ‘হওয়া’র প্রতিযোগিতা করতে গিয়েই যত প্রতিযোগিতা, যত হানাহানি, যত অন্যায়, অপরাধ করা, দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়া এবং শেষাবধি কারাগার থেকে বিজয়মালা গলায় পরে বেরিয়ে আসা। এই কথাগুলো এ-টু জেড সত্য, তবে দু-চারজন রাজনীতিকের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম আছে।
সেটা আমাদের সামাজিক মানুষেরা বেশ বোঝেন। এ জন্য খালেদা জিয়া আর শেখ হাসিনা যখন কোনো বিষয় সম্পর্কে কথা বলেন, তখন তারা আশা করেন, তারা সামাজিক ও রাজনৈতিক যুক্তিবাদী হবেন। দুর্ভাগ্যজনক হলো যখন যিনি ক্ষমতার মসনদে বসেন, তখন তাদের যুক্তিবাদিতা শীতকালের গাছগাছালির পাতার মতো হলুদ হয়ে ঝরে পড়ে।
আমি কয়েকটি সংবাদ শিরোনাম তুলে দিচ্ছি। ‘সেনাবাহিনীকে উসকানি দেয়া হচ্ছে : সাজেদা/দেশ সংঘাতের মুখোমুখি’, ‘বাংলাদেশ মাইনরিটি ওয়াচের অভিযোগ—সংখ্যালঘুদের ওপর আওয়ামী নিপীড়ন’, ‘দেশ আজ সন্ত্রাসীদের হাতে বন্দি—খালেদা’, ‘স্বার্থ হাসিলের মামলায় ফরমায়েশি তদন্ত নিয়ে ব্যস্ত সিআইডি’—এরকম অসংখ্য নিউজ শিরোনাম আমি তুলে আনতে পারি এখানে।
তাতে মনে হবে, আমি সরকারের বিরোধিতায় এগুলো তুলে আনছি। না, সে লক্ষ্যে আমি তুলে আনিনি। দেশের সার্বিক পরিস্থিতি কেমন, তা বোঝার জন্য রাজনীতিকদের এসব শিরোনামের অন্তর্নিহিত কারণ উদ্ধার করা উচিত। কারণ, সংবাদপত্র কোনো সরকারের বিরোধী পক্ষ নয়। সরকারের কোথায় কোথায় ফল্ট তা জানিয়ে দেয়া মিডিয়ার দায়িত্ব।
সেই ফল্টগুলো যদি সরকার মেরামত করে, তাহলে দেশের উন্নতি হতে বাধ্য। আর যদি মনে করে এগুলো সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য করা হচ্ছে, তাহলে সেই সরকারের পায়ে ‘কুড়ালের’ কোপ পড়বে, এতে কোনো ভুল নেই। দেশকে সংঘাতের মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে বিরোধী দল এটা যে সরকার ভাবে, তারা ভুল করছে। ক্ষমতার অপব্যবহারের ফলেই যে দেশের স্বাভাবিক পরিস্থিতি নস্যাত্ হয়ে যায়, সেটা মানতে হবে। আমি প্রথমেই বলেছি, একেকজনের রাজনৈতিক পারসপেকটিভ থেকে ‘সত্য’ এর রূপ একেক রকম।
এজন্য সাজেদা চৌধুরীর সত্য আর সাকা চৌধুরীর সত্য এক রকম নয়।
২. আমাদের দেশের সংখ্যালঘু সমপ্রদায়ের লোকেরা মনে করে, তারা বিএনপি দ্বারা নির্যাতিত, নিপীড়িত ইত্যাদি, ইত্যাদি। তাদের অভিযোগ বিএনপি সামপ্রদায়িক দল। মেয়র সাদেক হোসেন খোকা তার মেয়র জীবনে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে হিন্দু সমপ্রদায়ের দুর্গোত্সবের অনুষ্ঠানে যান; যাতে কোনো সমস্যা-সংকটের সৃষ্টি না হতে পারে, তা নিশ্চিত করে চলেছেন। এরপরও বিএনপির ওপর দোষ চাপানো হচ্ছে সংখ্যালঘুদের রাজনৈতিক-সামাজিক স্বভাব।
মেয়র খোকা যেন বিএনপির নেতা নন, তিনি যেন অসমপ্রদায়িক নন। স্বাধীনতার পরপরই তো বিএনপির জন্ম হয়নি, তখন কেন সংখ্যালঘুরা নির্যাতিত হয়েছিল? হাজার হাজার হিন্দু পরিবার দেশ ছেড়ে চলে গেছে সে-সময়, তার জন্য দায়ী কে? দেশের সব গ্রাম-শহরের মানুষেরাই জানে কারা হিন্দুদের জমি-বাড়ি দখল করেছে। আজও যে সংখ্যালঘুরা নির্যাতিত ও নিপীড়িত হচ্ছে তার জন্য কি বর্তমান মহাজোট সরকারের লোকেরা দায়ী নয়? এখনও কি বিএনপির লোকেরা সংখ্যালঘুদের ঘর-বাড়ি-জমি-জিরেত দখল করে নিচ্ছে? আর তা নির্বিকার চিত্তে মেনে নিচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামি মহাজোট? হিন্দুরা সব সময়ই বিএনপিকে তাদের শত্রু মনে করে এসেছে। তারা বিএনপিকে রাজাকারদের দল মনে করে। ছিয়ানব্বই সালের নির্বাচনে রাজাকারের দল হিসেবে চিহ্নিত জামায়াতে ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে ক্ষমতা দখলের আন্দোলন করেছিল আওয়ামী জোট, সেটা হিন্দু সমপ্রদায়ের লোকেরা মেনে নিয়েছিল কেমন করে? আর এবার বাংলাদেশ মাইনরিটি ওয়াচ নামের একটি সংগঠন অভিযোগ করেছে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরও সংখ্যালঘু তথা হিন্দুদের ওপর নির্যাতন থেমে নেই।
‘এই সংগঠনটি ২০০৯ সালের জুন থেকে ২০১০ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নিপীড়নের কিছু পরিসংখ্যান পেশ করেছে সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে। সে পরিসংখ্যান অনুযায়ী গত এক বছর ১ মাসে ১০০ জন সংখ্যালঘু হত্যা, ১২০০ জনকে দৈহিক নির্যাতন, ২০৫ সংখ্যালঘু মহিলাকে ধর্ষণ, ২০৫০টি সংখ্যালঘু পরিবারকে বাস্তুভিটা থেকে উচ্ছেদ, ১০০টি মন্দির ও ধর্মীয় স্থান ধ্বংস, ৩০৬ জনকে জোর করে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করা, ১৭ জন হিন্দুকে কারাগারে পাঠনো হয়েছে, যারা সীমান্ত অতিক্রম করে অবৈধভাবে ভারতে যাচ্ছিল। সংগঠনটি মানিকগঞ্জের অর্চনা রানী নামের এক যুবতীকে গণধর্ষণ, নড়াইলে বিউটি বিশ্বাস নামের ছয় বছরের এক শিশুকে ধর্ষণ, চিটাগাংয়ের সীতাকুণ্ডে আওয়ামী ক্যাডারদের হাতে কয়েকটি হিন্দু জেলে পরিবারকে বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার নির্দেশ সংক্রান্ত তথ্য দিয়েছে। এসব ঘটনা কি প্রমাণ দেয় না, হিন্দুরা বিএনপির আমলে নয়, আওয়ামী আমলেই বেশি নির্যাতিত হয়েছে। সে কারণেই কি বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যার পর যারা ক্ষমতায় বসেছিল, সেই আওয়ামী লিগের মন্ত্রিসভায় ছিলেন মনোরঞ্জন ধরসহ সব আওয়ামী হিন্দু নেতা? একজন আওয়ামী নেতাও তো টুঁ শব্দ করেননি সেদিন।
এমনকি আজকের আওয়ামী প্রেসিডিয়াম সদস্য তত্কালের একটি বিরোধী দলের সংসদ সদস্য ও আওয়ামী বিরোধী নেতা সুরঞ্জিত্ সেনগুপ্তও টুঁ শব্দ করেননি কেন, সে প্রশ্নকি একবারও মনে হয় না তাদের? হিন্দুরা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে না গিয়ে তাদের সঙ্গে গা-মিলিয়ে থাকে এ কারণে যে, যাতে তারা হিন্দুদের ওপর ঝাঁপিয়ে না পড়ে। ভয় থেকেই তারা আওয়ামী লীগের সমর্থকে পরিণত হয়েছে।
কয়েক দিন আগে ফার্মগেটে দুজন সাংবাদিককে পুলিশ বেধড়ক পিটিয়েছে। সাংবাদিক শোনার পরও যখন পুলিশ পেটায়, তখন বুঝতে বাকি থাকে না যে সরকারের সায় আছে বলেই পুলিশ এই নির্মম অন্যায় করতে পারে। আর সাংবাদিক দুজনই সংখ্যালঘু সমপ্রদায়ের লোক।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আর সংখ্যালঘু সমপ্রদায়ের দুজন সাংবাদিক কেন পুলিশি নির্যাতনের শিকার হবে? সরকার আর হিন্দু সমপ্রদায়ের লোক তো সমার্থক হওয়ার কথা! তবে কি ওই দুই পুলিশ বিএনপি সমর্থক? বিএনপি সমর্থক কোনো পুলিশ অফিসারকে তো পুলিশি প্রশাসনে, ফিল্ডে রাখা হয়নি। উচ্চপদস্থ অন্তত তিনজন পুলিশ অফিসারকে পেছনে ফেলে দিয়ে হাসান মাহমুদ খোন্দকারকে আইজিপি করা হয়েছে, যা আওয়ামী লীগের সামপ্রদায়িক মানসিকতারই বহিঃপ্রকাশ বলে ধরা যায়। আমরা জানি, এর কোনো জবাব সরকারের হাতে নেই। এভাবে আওয়ামী লীগ সংখ্যালঘুদের ওপর অন্যায়-অত্যাচার করছে, অথচ দুর্নাম হচ্ছে বিএনপির। এই অপসংস্কৃতির মূল উচ্ছেদ করা না গেলে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর থেকে ক্ষমতাবান ও জোতদার শ্রেণীর নির্যাতন-নিপীড়ন বন্ধ করা যাবে না।
মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখার ভিত গড়ে উঠবে না। আমরা চাই সরকার, রাজনৈতিক দলগুলো মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখতে শিখুক, হিন্দু, মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান হিসেবে নয়।
২৭.১০.১০/নিউইয়র্ক
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।