নিজকে নিয়ে উদাস আমি, পরকে নিয়ে কখন ভাবি...
বৃষ্টির মাস। ইলিশ মাছের পেটের মত ফুলে আছে ধলির বিল। বিল পেরুলেই তুলসিপাতা বন। একাশি, ইউকেলিপ্টাস, বেত, কড়ই আরো কত কত গাছ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে শতবর্ষী ঐতিহ্যবাহী এ বন। স্থানে স্থানে পরগাছাদের ভয় ধরানো ঝোপ।
মধুলতা গ্রামে একটাই বন। যেন বিশাল বালিয়াড়ির মাঝে বি¯তৃত মহিরুহ। ঘ্রাণ ছড়ানো নির্মল হাওয়া আর পাতায় পাতায় সবুজের চাষ। কি যে আনন্দের। দুপুর পেরুনোর আগেই হাতের কাজ সারে কবি।
ভেলায় পাড় হয় ধলির বিল। তারপর দুইচারটা সোনা রঙা ফসলি জমিন। পেরুলেই তুলসিপাতা বন। কবির আগমন পথে যেন নিশ্চুপ চেয়ে থাকে একাশি, ইউকেলিপ্টাস। দীর্ঘ ছয়মাসের যাতায়াত।
এতটুকু সখ্যতা তো গড়ে ওঠতেই পারে। দুধকাচা ধানী জমিনের সরু আল পেরোয় কবি। তাকে দেখে আড়মোড়া ভাঙে সবুজের পাহাড়। কবির অসহায় বিকেলটা সতেজ-সজীব হয়ে ওঠে।
আজমত কাকা কাঁধে রাখে কবির।
হাতের কলমটা টেবিলে রেখে পেছনে ফিরে ও। কাকাকে দেখে মনে মনে ভাবে, ভালই হলো। সময়টা একদম বাজে কাটছিল। ক’দিন বাদে রেজাল্ট বেরুবে। পাশ-ফেলের চিন্তা মাথায় তেলাপোকার মত ঘুরঘুর করছে।
বোরিং লাগছিল। কাকার সঙ্গে সময়টা সে ইনজয় করে। কাছের বন্ধুদের মধ্যে আজমত কাকাই শ্রেষ্ঠ তার। আজমত কাকা বয়সী মানুষ। চুল দাড়ি সাদা।
ছোটবেলা থেকেই তাকে দেখে আসছে কবি। বয়েসের সঙ্গে মিল রেখে উপযোগী কথাবার্তাই হয় তার সঙ্গে। কবির মনে পড়ে ছোটবেলা একবার ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। কাকা প্রশ্ন করেছিল- বড় হয়ে কী হবিরে কবি?
বড় হয়ে ডাক্তার হব। কবি বলেছিল।
ভালো ডাক্তার তো এখন দেশে পাওয়া যায় না সব ফাকিবাজ। একগাদা টেষ্ট আর মুঠো মুঠো টাকা। তুইও নিশ্চয় এর বাইরে যাবি না?
দেখো! এমন কাজ কবির দ্বারা হবেই না। অনেকটা গর্বেই বলে কবি।
কবি যখন এইচ এসসি দেবে কাকার কথার ধরন পাল্টে।
দেয় নানান উপদেশ। ‘দেখিস কবি! বয়সটা বেশি ভাল না। সব সময় সেইভে চলবি। ’ কবি অবশ্য কাকার কোনো কথাই ফেলতে পারে না।
বিশ্ববিদ্যায়ের মাঠে কমল ছোটাছুটি করছে।
নিশ্চয় রেজাল্টের খাতায় লেটার মার্ক ওঠেছে তার। কবিও হাটে সেই পথে। হাঁপড়ের মত ওঠানামা করে বুক। কবি বুঝতে পারে না সেই ছোটবেলা থেকে দেখে আসা দপ্তরির বাজানো বেলের শব্দ তার বুকে কেন বেজে চলছে! রেজাল্ট শিটে চোখ ঘুরে কবির। অক্ষরগুলো কেন যেন তুলনায় ছোট মনে হয়।
ছোট সেই অক্ষরেই কবি খোঁজে তার রোল। ৮৯১৬৩৫। অক্ষরগুলো আরো ছোট হয়। প্রথমে কণা। তারপর বিন্দু।
তারপর...
কবির চোখে পানি।
চোখে পানি কেন? রেজাল্ট তার ভালো হয়েছে। আমজাদ কাকার একটা কথা মনে পড়ল। কখনো কখনো আনন্দের সময়ও মানুষের চোখে পানি গড়ায়। অবিকল টুপটাপ বৃষ্টির কান্নার মতো।
সাদাত ফুড প্রোডাক্ট। রাজধানীর গুলশান এক এর অখ্যাত কোম্পানি। চানাচুর, বাদাম এবং সাধারণত মসলাজাতীয় দ্রব্য সেল দিয়ে থাকে। সপ্তাহখানেক আগে একটি দৈনিকে ১০ জন সেলসম্যান চেয়ে বিজ্ঞাপন দিয়েছিল। আজ ইন্টারভিউ।
ওএমএস-এর চালের দোকানের মত চারটা বিশাল লাইনে ৬০০ প্রার্থী দাঁড়িয়ে আছে। যেন স্টাচু অব লিবার্টি। কেউ কেউ বাদাম চিবুচ্ছে। কারও মুখ আবার ফুটো বেলুনের মত চুপসে আছে। ১ নম্বর লাইনের পাঁচজনের পেছনেই আছে কবি।
এমবিবিএস পাস করে ডাক্তার হওয়ার সিদ্ধান্তই পাকা ছিল। কিন্তু এক বছর চেষ্টা করেও কোথাও চান্স পায়নি। বাবার বুকে কষ্ট। লাখ লাখ টাকা খরচা গেল। ছেলে বেকার।
বাবার মুখে হাসি ফোটাতে নিুমানের হলেও অন্তত একটা চাকরি তার চাই। সাদাত ফুড প্রোডাক্টে এইচএসসি পাশ লোক চাইলেও কবিও দরখাস্ত করেছে। কে জানে কোথাকার শামুক কোথায় ভাসে। কিন্তু দীর্ঘ একঘণ্টা চলে গেলেও কোম্পানির কারো এদিকে আসার নামগন্ধ নেই। ব্যাপার কি? ঘটনা কোনদিকে মোড় নিচ্ছে? হালকা একটা গুঞ্জন শুরু হয়।
হঠাৎ দরজার কাছে টানানো একটা নোটিশে চোখ পরে এক চাকরি প্রার্থীর। একনম্বর লাইনের আরো পাঁচ ছয়জন অনুসরণ করে তাকে। নোটিশ বোর্ডের কালো অক্ষরগুলো চরকার মতো ঘুরতে থাকে। সাথে সাথে ঘুরে কোম্পানির বিল্ডিং। আশপাশের দেয়াল।
রাজপথ। ট্রাফিকজ্যাম। তাল সামলাতে না পেরে পড়ে যায় অনেকে। লাইন ভেঙে এগিয়ে আসে আরো কয়েকজন। যাদের চোখেই ওই লাইন ভেসে ওঠে ‘অতিরিক্ত আবেদন জমা পড়ায় আমরা আপাতত ইন্টারভিউ স্থগিত রাখছি’ তারাই মাথা ঘুরে পড়ে যায়।
মধুলতা গ্রামে একটাই বাজার। গ্রামীণ পরিবেশে বেড়ে ওঠলেও ইদানীং কিছুটা শহুরে ভাব এসেছে। চাস্টল খোলা থাকে নিশুতি অবধি। আল আমান ব্যাংকের একটা শাখাও খোলা হয়েছে। আর দশটা দোকানের পাশে নতুন আরেকটি দোকান যোগ হয়।
একটু অন্যরকমই সবগুলো থেকে। দোকানের নমটাও কেমন ধাঁচের। ‘এ্যারোলিক ডায়াগনস্টিক সেন্টার। ’ অশিক্ষিতরা পড়তে পারেন না। মনে মনে গালিতে ঝাল মেটান।
কবির মনের অনেক আশা। উচ্চাশাও বলা চলে। নিজের চেম্বারে বসে দু:খ ঘুচাবে। গ্রামের মানুষদেরও আকাক্সক্ষার শেষ নেই। যাক ভালই হল।
নিজের মানুষের কাছে সেবা নিতে পারবেন। এক বিকেলে মিষ্টি বিলিয়ে শুরু হর ‘এ্যারোলিক ডায়াগনস্টিক সেন্টারে’র কার্যক্রম।
দুই মাস পরের এক বিকেল। চারটায় কবির চেম্বারে থাকার কথা থাকলেও অকারণে দেরি হয়। দুপুরে খাওয়ার পর অলসতা জাপটে ধরে।
ঘুমে তলিয়ে যায় কবি। হঠাৎ ফোনের আওয়াজ। ঘুম ভাঙে কবির। মোবাইল রিসিভ করে। ওপাশে কম্পাউন্টার।
হ্যালো স্যার! একজন মুমূর্ষু রোগী...
কি সমস্যা?
এই মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না তবে অবস্থা সূচনীয়।
ভিজিট পরিশোধ করেছে?
করেনি- রোগী মনে হচ্ছে খুব গরিব...
খরচের বেলায় সবাই গরিব। যার লাখ টাকা কোটি টাকা আছে, এদেশে সেও ফকির- কম্পাউন্টারকে বুঝায় কবি। ভিজিট পরিশোধ করে নিতে বলে ফোন রাখে। তারপর হাতের উল্টো পিঠে চোখ ডলে বিছানা ছাড়ে।
এরই মধ্যে আবার ফোন। রিসিভ করে শুনতে পায় কম্পাউন্টারের কণ্ঠ- স্যার রোগীর লোকজন আপনার সঙ্গে কথা বলতে চায়। কবি গম্ভির হয়। মেকি সুরে কথা ভেসে আসে কানে।
‘ডাক্তার সাব! দয়া কইরা তারাতরি আসেন, নাইলে রোগী বাঁচব না।
’
কবি ধমকের সুরে বলে না বাঁচলে আমার কি? টাকা পরিশোধ হয়েছে?
ওপাশের কণ্ঠটা এবার কান্নার মতো শোনায়- ‘ডাক্তার সাব রোগী গরিব মানুষ। আমরা আপন কেউ না। অবস্থা ভালা না দেইখা আপনার এহানে আনছি। তাছাড়া আমরা তো একই এলাকার, রোগী ভালা হইলে আপনার বিল মাইরা খাইব না। ’ কবি আরো উত্তেজিত হয়।
এসব আশার বাণী শুনিয়ে লাভ নেই। এমন রোগী বহু দেখছি। পরের কথা বলে আর ফেরত আসে না। ডাক্তারি পাস করতে লাখ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। এখন আপনারা যা শুরু করছেন নিজের জমি বেচে রোগী দেখতে হবে।
এ্যারোলিক ডায়াগনস্টিক সেন্টারে শোরগোল। বাজারের অনেকেই সেখানে ভিড় জমিয়েছে। একসময় কবি আসে। ততক্ষণে পেড়িয়ে গেছে বিকেল। সন্ধ্যার আলো আধারির খেলা বিরাজ করছে মধুলতা বাজারের আনাচে কানাচে।
বৃদ্ধা রোগী ভেতরে শোয়া। ব্যথায় কাতরাচ্ছেন। কবি কয়েকটা যন্ত্রপাতি নিয়ে হাত পা নাড়ে। এটা ওটা জিজ্ঞেস করে। তারপর রিপোর্ট দেয়।
স্যরি! এই রোগীর পরীক্ষার জন্য যেসব যন্ত্রপাতির দরকার সেগুলো এখানে নেই। আপনারা একে উপজেলা ক্লিনিকে নিয়ে যান। পাবলিকের শোরগোলের আওয়াজ উচ্চ হয়। রোগীর প্রতিবেশীরা কিছু না ভেবে দ্রুত রিকসা আনে। দুইজন দু’দিক ধরে রিকসায় ওঠে।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর উপজেলা ক্লিনিকে যাওয়া হয় না। ততক্ষণে বৃদ্ধের প্রাণবায়ু উড়ে গেছে খাঁচা ছেড়ে।
পরদিন মধুলতা বাজার মসজিদে বৃদ্ধার জানাজা। আগের দিনের স্থিমিত গুঞ্জন দীর্ঘ হয়। জানাজার বেশি দেরি নেই।
চাস্টলগুলো থেকে হালকা আওয়াজ ভাসে- ‘ডাক্তারের বিরুদ্ধে মামলা হইবো। গরিব মানুষ বইলাই ডাক্তার তার চিকিৎসা করে নাই। এমন বজ্জাত ডাক্তারকে মধুলতা বাজারে থাকবার দেয়া অন্যায়। ’ দুইদিন পার হয়। এসব কথা আরও চরাও হয়।
চাস্টল থেকে সবার মুখে মুখে ওঠে আসে। এক ঘটনার সঙ্গে আরো শত ঘটনা যোগ হয়। গ্রামের মুরব্বিরাও তাদের সঙ্গে ঘটা অপ্রিতিকর ঘটনাগুলো ফ্লাশ করে।
এ ঘটনায় সবচেয়ে বেশি যিনি ব্যথাগ্রস্ত হয়েছেন তিনি আজমত কাকা। এসময় তার মনে ছোটবেলার কবির সঙ্গে হওয়া ঘটনাগুলো মনে পড়ে।
একদিন নির্জনে কবিকে কাছে পেয়ে জানায় তার ক্ষোভ। কবিকে মনে করিয়ে দেয় তাদের মধ্যে হওয়া একদিনের পুরনো সংলাপ। ‘তুই একদিন বলেছিলি ডাক্তার হয়ে গরিবদের ফ্রি চিকিৎসা দিবি, কৈ তোর এসব কথা। ’ একখণ্ড কালো মেঘ ঘুরঘুর করে কবির আকাশে। কাকের ডানার মতো অন্ধকার নেমে আসে চারদিকে।
সেই অন্ধকারে কবি হারিয়ে যায় বেহুলা ভাসানের কোনো এক নিস্তব্ধ জগতে।
তুলসিপাতা বনে এখন বিকেলের বিষণœ রোদ। সেচ মৌসুম। ধলীর বিলে হাটু পানি। ফসলি জমিতে সোনালি আশ বোনা হয়েছে।
ক্ষেতের আলগুলোতে ঘাস নেই। কৃষকরা প্রতিদিনই গরুও জন্য ঘাস কেটে নিয়ে যান। মরা আল বেয়ে কবি পৌছয় তুলসিপাতা বনে। বনের গাছগুলোকে কেমন জানি অপরিচিত অপরিচিত লাগে। লাগবেই।
দীর্ঘদিন বনে আসা হয় না কবির। কয়েকটা গাছের গায়ে হাত বুলায়। তারপর একটা ইউকেলিপ্টাস গাছের সামনে দাঁড়িয়ে দীর্ঘ একটা নি:শ্বাস ছাড়ে আর মনে মনে বলে- ‘মানুষের নি:শ্বাসে ছাড়া হাইড্রোজেন যেমন গ্রহণ কর তেমনি বুকের গহিনের অপরাধবোধও যদি শুষে নিতে!’ হঠাৎ বাতাসে একসঙ্গে নড়ে ওঠে তুলসিপাতা বনের সব গাছ। এর কারণ কি ঠিক বুঝে ওঠতে পারে না কবি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।