আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আজিজের পথে রাকিব

বিতর্কিত আজিজ কমিশনের পথেই হাঁটছে বর্তমান রকিব কমিশন। নবম সংসদ নির্বাচনের আগে সোয়া কোটি ভুয়া ভোটার করে বিতর্কের সৃষ্টি করেছিল বিগত আজিজ কমিশন। তেমনি বর্তমন নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে অদূরদর্শী কর্মকাণ্ড ও নানা আত্দঘাতী সিদ্ধান্তের মাধ্যমে বিতর্কের মুখে ঠেলে দিয়েছে সাংবিধানিক এই প্রতিষ্ঠানকে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এরই মধ্যে দূরত্ব তৈরি করে ফেলেছে স্বাধীন ইসি। বিশেষ করে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি বর্তমান ইসিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের 'আজ্ঞাবহ' আখ্যা দিয়েছে।

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কিছু দিন আগে বর্তমান ইসিকে 'অথর্ব' উপাধিও দিয়েছেন। কমিশনের নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে আন্দোলনে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি। এমনকি ইসি পুনর্গঠন করারও দাবি তুলছে তারা। দেশে প্রথমবারের মতো সার্চ কমিটির মাধ্যমে বর্তমান কমিশন গঠিত হলেও নানা কর্মকাণ্ডের মাধমে বিতর্কের সৃষ্টি করছে তারা। তাই রকিব কমিশনও আজিজের পথেই হাঁটছে বলে মনে করছেন নির্বাচন বিশ্লেষকরা।

দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য কমিশনকে শক্তিশালী করার কথা উঠলে বর্তমান কমিশন দিন দিন নিজের ক্ষমতা হারাতে থাকে। দশম সংসদ নির্বাচনকে সুষ্ঠু করতে যেসব প্রস্তুতি প্রয়োজন তার অস্তিত্ব খুঁজে পাচ্ছেন না নির্বাচন বিশ্লেষকরা। এমনকি দশম সংসদ নির্বাচন কোন পদ্ধতিতে হবে তা নিয়েও বর্তমান ইসি এখনো ধোঁয়াশার মধ্যে রয়েছে।

সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সরকারের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী সংসদের ৫৩ আসনের সীমানা নির্ধারণ করে বিরোধী দলের সমালোচনার মুখে পড়ে এই ইসি। একই সঙ্গে দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন করতে বিশেষভাবে নির্বাচনী আচরণবিধি ও গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধনের খসড়া নিয়েও সুশীল সমাজ ও রাজনৈতিক মহলে সমালোচনার ঝড় উঠেছে।

নির্বাচন বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বিগত আজিজ কমিশনের দুর্নাম ঘুচিয়ে নির্বাচন কমিশনকে একটি শক্তিশালী সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেন ড. শামসুল হুদার কমিশন। তারা ইসিকে শক্তিশালী করতে নানা পরিকল্পনা রেখে এলেও তা আজো বাস্তবায়ন হয়নি। বর্তমান কমিশনের নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের বিষয়ে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম. সাখাওয়াত হোসেন গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশন নিজেই নিজেকে বিতর্কিত করছে। দশম সংসদ নির্বাচন কোন পদ্ধতিতে হবে তা নিয়েও বর্তমান ইসি ধোঁয়াশার মধ্যে আছে। তিনি বলেন, আমরা ইসিকে আজিজ কমিশন থেকে টেনে তুলে একটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানে রূপ দিয়েছিলাম।

কিন্তু বর্তমান কমিশন নানা কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ইসিকে বিতর্কিত করছে। তারা আবারও কি ওইদিকেই (আজিজ কমিশন) হাঁটছে? সাবেক এই কমিশনার বলেন, বর্তমান ইসি নিজেই নিজেকে ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত করছে। এই কমিশন আগামী সংসদ নির্বাচন করতে পারবে কি না, তা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেন তিনি। সাখাওয়াত হোসেন ইসির খসড়া আচরণবিধির বিষয়ে বলেন, প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধানের মনোনীতদের (মন্ত্রী) নির্বাচনী প্রচারণা করার সুযোগ দিয়ে কমিশন আচরণবিধি করলে নির্বাচনে 'লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড' নষ্ট হবে। আর নির্বাচন হবে বৈষম্যমূলক।

তিনি বলেন, সংসদ নির্বাচনের আচরণ বিধিমালা সংশোধন করার আগে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ইসির সংলাপ করা উচিত। এ ছাড়া এ ধরনের আচরণবিধি দিয়ে নির্বাচন করলে দেশে সংকট সৃষ্টিও হতে পারে বলে মনে করেন তিনি। সাবেক এই কমিশনার বলেন, বিএনপি আরপিও প্রত্যাখ্যান করেছে। কিন্তু দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে যদি আরপিও সংশোধন করত তবে সমালোচনা হতো না।

২০০৫ সালে বিচারপতি এম এ আজিজ আদালতের বিচারকের পদে থেকেই প্রধান নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব নেওয়ায় শুরুতেই বিতর্কের মুখে পড়েন।

আর সোয়া কোটি ভুয়া ভোটার করা নিয়ে বিতর্কের কারণে পদত্যাগে বাধ হয় আজিজ কমিশন। এরপরে গঠিত হয় ড. এ টি এম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের নির্বাচন কমিশন। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে তারা মেয়াদ পূর্ণ করে বিদায় নেন। দেশে প্রথমবারের মতো সার্চ কমিটির মাধ্যমে গঠিত হয় কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের কমিশন। গত বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি দায়িত্ব নেয় এই কমিশন।

দায়িত্ব নিয়েই প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিবউদ্দীন সাংবাদিকদের বলেন, আমরা তো কেবল দায়িত্ব নিয়েছি। আমাদের সেটেল হতে সময় দিন। এরপর এরই মধ্যে কেটে গেছে প্রায় দেড় বছর। কিন্তু বিগত ইসির সাফল্য ধরে রাখা দূরের কথা তারা নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। দায়িত্ব নেওয়ার পরেই ভোটার তালিকা হালনাগাদ, সীমানা নির্ধারণ ও নির্বাচনী রোডম্যাপ নিয়ে কাজ শুরুর ঘোষণা দেয় ইসি।

প্রথমেই সাংবাদিকদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করা নিয়ে বিতর্কের সূত্রপাত ঘটান একজন কমিশনার। এরপর রাজনৈতিক দলের সঙ্গে এক দিনে সংলাপ করা এবং জামায়াত ও সিপিবিকে একই দিনে সংলাপে দাওয়াত দিয়ে সমালোচনায় পড়ে ইসি। আর প্রধান বিরোধী দলও ইসির সঙ্গে সংলাপে বসতে রাজি হয়নি। বরং প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ইসির এই সংলাপের গ্রহণযোগ্যতার বিষয়ে প্রশ্ন তোলে। কোনোরকম ফলাফল ছাড়াই শেষ পর্যন্ত শেষ হয় ইসির সংলাপ।

সংলাপের পর পরই ভোটার তালিকা হালনাগাদের অপর্যাপ্ত প্রচার-প্রচারণা ও সংসদীয় আসনের সীমানা করে সরকারের প্রেসক্রিপশনের বাইরে যেতে পারেনি ইসি। ভোটার তালিকা হালনাগাদ জানুয়ারিতে না করে মার্চে না করা নিয়ে ইসি সচিবালয়ের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে। ফলে ভোটার তালিকার বাইরে থেকে যায় অনেকে। সরকারদলীয় সম্ভাব্য প্রার্থীদের সুবিধা দিতেই ৫৩ আসনের সীমানায় পরিবর্তন আনা হয়েছে। সর্বশেষ দশম সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাচনী আচরণবিধি ও গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধন নিয়ে নতুন বিতর্কের সৃষ্টি করে নির্বাচন কমিশন।

আরপিও সংশোধনী এনে সংসদ নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ার পথ বন্ধ করা হয়েছে। এমনকি ইসির প্রার্থিতা বাতিলের ক্ষমতাও (৯১(ই) ধারা) বাদ হয়েছে আরপিও থেকে। একই সঙ্গে সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নপত্র দাখিল ও প্রার্থীর (দলীয়) প্রার্থিতা প্রত্যাহারের ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে দলের হাতে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞায় রাখা হয়নি সেনাবাহিনী মোতায়েনের বিধান। অন্যদিকে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর অধীনেই দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে আচরণবিধি করে নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী বা দলীয় প্রধান মনোনীত ২০ ব্যক্তিকে (মন্ত্রী) সারা দেশে নির্বাচনে প্রচারণা করার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে।

প্রতিটি ভোট কেন্দ্রে নিয়োগ করা হবে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। যদিও নির্বাচন কমিশন বলছে, আচরণবিধি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। আরপিও সংশোধন নিয়ে নানা বিতর্কের জন্ম দিয়েছে ইসি। সংশোধন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। তারা বলছেন, প্রার্থিতা বাতিলের ক্ষমতা না থাকলে ইসি দুর্বল হয়ে পড়বে।

ইসির ক্ষমতা বিলুপ্তির সিদ্ধান্তকে অবিশ্বাস্য হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা। প্রার্থিতা বাতিলের ক্ষমতা ইসির কাছে থাকার পরেও কমিশনের নির্দেশ প্রার্থীরা মানতে চাইতেন না। সদ্যসমাপ্ত পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ব্যাপক হারে আচরণবিধি লঙ্ঘিত হলেও কমিশন ছিল নির্বিকার। সেখানে উল্টো কমিশনের নিজের ক্ষমতা খর্ব করার প্রস্তাবের বিষয়টি খুবই আশ্চর্যজনক। ইসির বিতর্কিত কর্মকাণ্ড ছাড়াও প্রধান বিরোধী দল বিএনপির সঙ্গে ইসির দূরত্বতা বেড়েছে 'বিএনএফ' নামে একটি রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন প্রক্রিয়া নিয়ে।

জিয়ার আদর্শের অনুসারী দাবিদার এবং দলীয় প্যাড, মনোগ্রাম ইত্যাদিতে ধানের শীষের ছবি ব্যবহারকারী এ দলটির জেলা ও উপজেলা কার্যালয় সম্পর্কে সরেজমিন খবর নিয়ে নির্বাচন কর্মকর্তারা কমিশনকে জানান, নিজেদের কার্যক্রম সম্পর্কে দলটির পক্ষ থেকে কমিশনে দেওয়া তথ্যের সঙ্গে বাস্তবতার মিল নেই। নির্বাচন কর্মকর্তারা কমিশনকে জানান, ১৫টি জেলা ও ৩২টি উপজেলায় বিএনএফের অফিসের সন্ধান মিলেছে, যা নিবন্ধন পাওয়ার যোগ্য নয়। তবে কমিশন কর্মকর্তাদের প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে পুনঃতদন্তের নির্দেশ দেয়। এ জন্য বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়, কিছু সংস্থার সহযোগিতায় বিএনপির ভোট কাটতে বিএনএফ নামে একটি দলকে দাঁড় করানোর চেষ্টা চলছে। উল্লেখ্য, বিএনএফ নামে এ সংগঠন 'ধানের শীষ' প্রতীকের মতো দেখতে 'গমের শীষ' প্রতীক বরাদ্দ চায় নির্বাচন কমিশনে।

বিএনপি এই প্রতীক না দেওয়ার জন্য কমিশনকে এরই মধ্যে আনুষ্ঠানিক চিঠি দিয়েছে। এ জন্যও ইসির প্রতি বিএনপিসহ অন্য অনেক রাজনৈতিক দলের মনোভাব ইতিবাচক নয়। জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল বিষয়েও রাজনৈতিক দলের দাবির বিষয়ে ইসির কৌশলগত নীরবতাকেও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তিগুলো ভালো চোখে দেখছে না। যদিও ইসি বলছে, জামায়াত নিষিদ্ধের বিষয়ে কেবল আদালতই সিদ্ধান্ত দিতে পারেন। বিগত হুদা কমিশন বিশেষ কিছু কর্মকাণ্ডের মধ্যে নির্বাচন কমিশনকে একটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে।

এর মধ্যে ৮ কোটি ৫৮ লাখ ২০ হাজার নাগরিকের জাতীয় পরিচয়পত্র ও ছবিসহ ভোটার তালিকা তৈরি, রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা, 'না' ভোট দেওয়ার বিধান চালু (পরে তা তুলে দেওয়া হয়েছে), রাজনৈতিক সরকারের অধীনে ৪৮১ উপজেলা পরিষদের সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান, বিভিন্ন নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন ব্যবহারের প্রচলন, উপজেলা পর্যায়ে ইসির নিজস্ব ভবন (সার্ভার স্টেশন) নির্মাণ প্রকল্পের কাজ শুরু, রাজনৈতিক দলের বার্ষিক আয়-ব্যয়ের হিসাব জমা দেওয়ার বিধান চালু, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ব্যাপক সংশোধন করে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা এবং দলের গঠনতন্ত্র থেকে অঙ্গ সংগঠন ও প্রবাস শাখা বাদ দেওয়ার বিধান চালুসহ নানা সংস্কারমূলক কাজ করে বিগত হুদা কমিশন। তবে অনেক চেষ্টা করেও ডিসিসি নির্বাচন করতে পারেনি ওই কমিশন। কিন্তু বর্তমান কমিশন বিগত ইসির অনেক কাজই পরিকল্পনা থেকে বাদ দিচ্ছে। এর মধ্যে ইভিএমের ব্যবহার অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছে। নির্বাচনগুলোয় সঠিকভাবে আচরণবিধি মানার বিষয়টি গুরুত্বই দিচ্ছে না।

 

 

সোর্স: http://www.bd-pratidin.com/     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.