অবসরের আড্ডা!!!
আজিজের বিদায় ও 'সুড়ঙ্গের শেষ প্রান-ের আলো'
অনেক রক্তক্ষয়, মানুষের অসহনীয় নিদারুণ দুর্ভোগ, দেশের অর্থনীতির শত শত কোটি টাকা ক্ষতি করে অবশেষে ক্লান--বিষণ্ন এমএ আজিজ মাথা নিচু করে নির্বাচন কমিশন সচিবালয় ত্যাগ করলেন মঙ্গলবার পড়ন- বিকালে। জাতির বুকের ওপর থেকে জগদ্দল পাথরটি সরে গেল। এমএ আজিজ 90 দিনের ছুটি নিয়েছেন। রাষ্ট্রপতিকে তিনি তার সিদ্ধান-ের কথা অবহিত করেছেন। বুধবার গভীর রাতে জাতির উদ্দেশে ভাষণে রাষ্ট্রপতি আজিজের দীর্ঘ ছুটিতে যাওয়ার কথা ঘোষণা করলেও সংকট কাটেনি বলেই মনে হচ্ছে।
আমি সজ্ঞানে এমএ আজিজের নামের আগে 'বিচারপতি' শব্দটি ব্যবহার করছি না। আপন আচরণ, উচ্চারণ, ঔদ্ধত্যে জনগণের প্রতিপক্ষ হিসেবে নিজেকে দাঁড় করিয়ে এমএ আজিজ 'বিচারপতি' সম্বোধনের যোগ্যতা হারিয়েছেন। ইতিহাসের কলংকিত নামগুলোর তালিকায় একেবারে ওপরের দিকে তার নামটি সংযোজিত হয়ে গেল।
এমএ আজিজের এই করুণ পরিণতির জন্য অন্য কেউ নয়, তিনি নিজেই দায়ী। নেমেসিস তাকে তাড়া করেছে শুরু থেকেই।
ভাগ্য বদলানোর শক্তি কখনও তিনি অর্জন করতে পারেননি। প্রধান নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই তিনি একের পর এক অনৈতিক, অযৌক্তিক কাজ করেছেন। অসংলগ্ন, অপ্রয়োজনীয় ও মারাত্দকভাবে অন্যায় কথাবার্তা বলেছেন। ভোটার তালিকার ব্যাপারে আওয়ামী লীগের বক্তব্যকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা, বিদেশী প্রতিনিধিদের এড়াতে অসুস্থতার ভান করে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া, একক সিদ্ধান-ে নতুন ভোটার তালিকা প্রণয়ন, দুই নির্বাচন কমিশনারকে ঠুঁটো জগন্নাথ করে আপন খেয়াল-খুশিমতো ইসি পরিচালনা, পছন্দমতো দু'জন নতুন নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ না করা পর্যন- দীর্ঘদিন যাবৎ নির্বাচন কমিশনের কোন বৈঠক না ডাকা_ এসব নানা অঘটনই তার মেয়াদকালকে কলংকিত করেছে। এমএ আজিজ মিথ্যা কথা বলে সাংবিধানিক পদের মর্যাদা ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছেন।
উপদেষ্টা হাসান মশহুদ চৌধুরী তার সঙ্গে দেখা করলেও তিনি দেখা করেননি বলে মিথ্যাচার করেছেন। হাসান মশহুদ জাতির সামনে তাকে মিথ্যাবাদী প্রতিপন্ন করেছেন। আজিজ জেনেশুনেই শপথ ভঙ্গ করেছেন। বিএনপির যে শীর্ষ নেতারা সংবিধান সমুন্নত রাখার কথা বলে সিইসির জন্য কুম্ভীরাশ্রু বর্ষণ করেছেন, তাদের অনেকেই তখন এই লোকটির হাত থেকে জাতিকে পরিত্রাণ পাওয়ার কথা প্রকাশ্যেই বলতেন। রাজনীতির অন্ধ স্বার্থে তারা এখন উল্টোরথে চড়েছেন।
90 দিন ছুটি ভোগের পর এমএ আজিজ শেরেবাংলা নগরে তার সচিবালয়ে আবার ফিরে এসে দায়িত্বভার গ্রহণ করবেন বলে আমার মনে হয় না। এত অপমান ও নিগ্রহের পর অভিশপ্ত আসনে আজিজের আবার উপবেশন সম্ভব নয়। আমি তো বললাম 'সুস্থ' লোকের কথা। তাই এই অনুমান সঠিক প্রমাণিত না হলে আমি আশ্চর্য হব না। গতকাল একাধিক সংবাদপত্রে এই মর্মে সংবাদ ছাপা হয়েছিল যে, আজিজের পরিবার ছুটি নয়, পদত্যাগ করার জন্য তাকে পরামর্শ দিয়েছে।
বিশেষ করে তার স্ত্রী চাচ্ছিলেন না তিনি ভবিষ্যতে আর একদিনের জন্যও সিইসির দায়িত্ব পালন করুন। আগামীতে 14 দল ক্ষমতায় এলে তাকে চরম অপমানের মধ্যে বিদায় নিতে হতে পারে। এমএ আজিজ তার পরিবারের সদস্যদের পরামর্শ শোনেননি। এটাই তার মহাদোষ। তিনি কারও কথা শুনতে চান না।
কারও যুক্তি আমলে নেন না, সম্ভবত আপন অন-রাত্দাকেও ধমক দেন। সমগ্র জাতিকে যিনি অবলীলায় অবজ্ঞা করেন, তিনি নিরীহ স্ত্রীর সকাতর অনুনয় শুনবেন না_ সেটাই তো স্বাভাবিক। আমার জন্মস্থান বরিশালে। এমএ আজিজের বাড়ি থেকে খুব একটা দূরে নয়। অনেকেই বরিশালের আঞ্চলিক ভাষায় আমাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন_ আপনি তো জানেন, বরিশালের লোকজনের 'ঘাড় এট্টু ত্যাড়া, ওনারডা দেহি পুরাপুরিই ত্যাড়া।
ভাইজান, বরিশালের মানইজ্জত শ্যাষ। '
আমি তাদের বলি, বরিশালের কথা ভেবে লাভ কি! তার জন্য তো সারাদেশের মানইজ্জত 'শ্যাষ'।
ছুটিতে গিয়ে কী করতে পারেন এমএ আজিজ? দেশবাসীর প্রতি ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে তিনি মনটা হালকা করতে, সব দুঃখ-বেদনা ভুলতে সিঙ্গাপুর, কুয়ালালামপুর, হংকং_ নিদেনপক্ষে কলকাতা যেতে পারেন। এ 'মন-ব্য' লেখার খসড়া নিয়ে যখন ভাবছি তখনই চোখে পড়ল 'ইন্টারন্যাশনাল হেরাল্ড ট্রিবিউন'-এর গতকালের প্রথম পাতার একটি খবর : 'আউট অব অফিস, বাট নট আউট অব সাইট'। খবরটিতে থাইল্যান্ডের ক্ষমতাচু্যত প্রধানমন্ত্রী থাকসিনের নির্বাসনের দিনলিপি রয়েছে।
খবরটির সঙ্গে প্রকাশিত একটি ছবির ক্যাপশন, থাকসিন যেখানেই যান মিডিয়া তার পিছু ছাড়ছে না। খবরটিতে বলা হয়েছে, ক্ষমতাচু্যত থাই প্রধানমন্ত্রী চীন, হংকং, বালি ঘুরে বেড়াচ্ছেন আর চুটিয়ে কেনাকাটা করছেন। শীত আসছে, তাই ব্লেজার কেনার দিকে তার বেশি ঝোঁক। এমএ আজিজ তার সুদীর্ঘ ছুটিতে থাকসিনের মতো ঘুরে বেড়াতে পারেন। কেনাকাটা করতে পারেন।
দুঃস্বপ্নের দিনগুলোর কথা ভোলার চেষ্টা করতে পারেন।
সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার এই দুঃস্বপ্নের দিনগুলোর কথা হয়তো ভুলে যাবেন। কিন' আমরা? দেশের 14 কোটি মানুষ? সর্বনাশের দিনগুলোর কথা আমরা সহজে ভুলতে পারব না। এক ব্যক্তির অন্যায় জেদ একটি দেশের কত ক্ষতি করতে পারে তা এমএ আজিজ দেখিয়ে দিলেন। যুগান-রের শেষের পাতায় শীর্ষস্থানীয় কয়েকটি দৈনিকের সেরা কাটর্ুনিস্টদের 8টি কার্টুন ছাপা হয়েছে আজ।
কাটর্ুনিস্টদের তুলিতে আজিজের বিরুদ্ধে ঘৃণা এবং নিন্দা নান্দনিক হয়ে ফুটে উঠেছে।
14 দলের দাবির মধ্যে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের কথা রয়েছে। এর এক নম্বর এজেন্ডা সিইসি এমএ আজিজের অপসারণ। নির্বাচন কমিশনার বিএনপির অতিবিশ্বস- সম জাকারিয়ার অপসারণও তাদের দাবি। আওয়ামী লীগ নেতা ওবায়দুল কাদের বলেছেন, আজিজকে ছুটি দিয়ে সম জাকারিয়াকে বহাল রাখা মানে ভালুকের মুখ থেকে বাঘের মুখে পড়া।
'এই রয়েল বেঙ্গল টাইগারটি'কে 14 দল আগেই শনাক্ত করলেও এ ব্যাপারে সম্প্রতি জোর গলায় তেমন কিছু বলেনি তারা। শেষ বিচারে 14 দল মনে করছে, জাকারিয়াকে রেখে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। তাই রাজনীতির আকাশ থেকে রাজনীতির কালো মেঘ পুরোপুরি দূর হয়েছে বলে হচ্ছে না। সুষ্ঠু ও সবার জন্য গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের স্বার্থে একটি সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন খুবই জরুরি_ মানুষ এ সত্য রক্তের বিনিময়ে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তাই ভবিষ্যতে কোন নীলনকশা বাস-বায়নের সর্বনাশা পথ অনুসরণে কেউ সাহস পাবে না।
সিইসি হিসেবে এমএ আজিজের কীর্তিকথা সবাই জানেন। তিনি বিচারপতি থাকাকালেও নজিরবিহীন একাধিক ঘটনার জন্ম দিয়েছেন। কিছুটা ব্যক্তিগত হলেও ঘটনার উল্লেখ অপ্রাসঙ্গিক হবে না। 2003 সালের জানুয়ারি মাসে সম্ভবত 8 কিংবা 9 তারিখ। এমএ আজিজ তখন সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি।
সুয়োমোটো মানহানি মামলায় ডেইলি স্টার, প্রথম আলো, যুগান-র সম্পাদক ও প্রকাশক অভিযুক্ত। নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনার পরও সব সিনিয়র আইনজীবীর মতামত অগ্রাহ্য করে (অভিযুক্তরা ক্ষমা চাইতে চাননি। সিনিয়র আইনজীবীদের পরামর্শে শেষ পর্যন- তারা রাজি হন) বিচারপতি আজিজ যুগান-র সম্পাদককে তিন মাসের কারাদণ্ড ও প্রকাশক সালমা ইসলামকে 5 হাজার টাকা জরিমানা করেন। ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম বেঞ্চে বসেছিলেন। চিৎকার করে আঙুল তুলে ধমক দিয়ে তিনি মাহফুজ আনামকে দাঁড়াতে বলেন এবং দীর্ঘক্ষণ দাঁড় করিয়ে রাখেন।
বিচারকের চেয়ারে বসে তিনি ইত্তেফাকের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক রাহাত খানসহ একাধিক সিনিয়র সাংবাদিকের চরিত্র হনন করতে থাকেন। তার আচরণ দেখে শীর্ষ আইনজীবী রফিকুল হক, মইনুল হোসেন, রোকনউদ্দিন মাহমুদ, এটর্নি জেনারেল হাসান আরিফ, সাবেক এটর্নি জেনারেল মাহমুদুল ইসলামসহ শতাধিক আইনজীবী স-ম্ভিত হয়ে পড়েন। তাদের ঐক্যবদ্ধ অবস্থানের কারণে বিচারপতি এমএ আজিজ শেষ পর্যন- প্রদত্ত রায় বাতিল করেন।
আমাদের দুর্ভাগ্য_ শুধু সিইসি নন, রাষ্ট্রপতি এবং প্রধান উপদেষ্টা নিজেও দারুণভাবে বিতর্কিত হয়ে পড়েছেন। তার কাজকর্ম এবং নানা উচ্চারণ গত 22 দিনে রাজনৈতিক সংকটকে জটিল করে তুলেছে।
অসুস্থ এবং বয়োবৃদ্ধ রাষ্ট্রপতি প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব আপন স্কন্ধে নিয়ে সবকিছু তালগোল পাকিয়ে ফেলেছেন। মেঘে মেঘে অনেক বেলা হয়েছে। প্রতিটি মুহূর্ত এখন এক-একটি দিনের মতোই মূল্যবান। জাতির সামনে যখন অসীম গাঢ় অন্ধকার, তখন উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যবৃন্দ ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করছেন। তারা নিস্পৃহ থেকে নিজেদের মধ্যে হা-হুতাশ করলে, মনস-াপ করলে গণতন্ত্র অন্ধকার গলিতে হারিয়ে যেত।
তথ্য উপদেষ্টা মাহবুবুল আলম সেক্ষেত্রে 'সুড়ঙ্গের শেষ প্রান-ে আলোর রেখা' দেখার সুযোগ পেতেন না। তারা জাতির এই ঘনঘোর দুঃসময়ে জনগণের প্রত্যাশার পাশে এসে দাঁড়িয়ে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টার নিদ্রাভঙ্গ করতে সমর্থ হয়েছেন। তারা নিরুদ্বেগে সত্য কথা বলেছেন। রাষ্ট্রপতিকে জানিয়ে দিয়েছেন, এভাবে দেশ চললে তাদের উপদেষ্টা থাকা অর্থহীন। তাদের এই দৃঢ় ভূমিকায় কোন কোন মহল খুশি হয়নি।
একাধিক উপদেষ্টাকে 'ষড়যন্ত্রকারী'র অপবাদও হজম করতে হয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি, আগামী দিনগুলোতেও এই দশ উপদেষ্টা এমন কঠোর কঠিন অবস্থান নিয়ে নির্দলীয় ও নিরপেক্ষভাবে ভূমিকা পালন করে যাবেন। অনেক উপদেষ্টাই এখন আস্থাশীল। তারা মনে করেন, রাজনৈতিক দল ও জনগণের সমর্থন নিয়ে সময়ের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও অর্পিত গুরুদায়িত্ব পালনে তারা সমর্থ হবেন।
একথা বেদনাদায়ক হলেও সত্য যে, দলীয় মনোনয়নে নিযুক্ত রাষ্ট্রপতির ওপর মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস দারুণভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে।
তিনি এ আস্থা আর পুনরুদ্ধারে সক্ষম নাও হতে পারেন। সেক্ষেত্রে আমাদের একমাত্র ভরসা দশ উপদেষ্টার সম্মিলিত উদ্যোগের ওপর। বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে দুর্যোগময় দিনে সবচেয়ে দুর্বল একটি সরকারের ওপর নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে। এই দায়িত্ব সুচারুরূপে পালন করা কঠিন। তবুও আমরা আশা করব, উপদেষ্টা পরিষদের যৌথ নেতৃত্বে অসাধ্য সাধন হোক।
এ প্রসঙ্গে আমরা পটিয়ায় এলডিপি কমর্ীদের ওপর বিএনপি ক্যাডারদের সশস্ত্র হামলার ঘটনার প্রতি উপদেষ্টা পরিষদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। এ ধরনের সংঘর্ষ-হাঙ্গামা শক্ত হাতে মোকাবেলা করতে হবে। তাই আমরা মনে করি, আইন-শৃঙ্খলা সংক্রান- কমিটির প্রধানের দায়িত্ব প্রধান উপদেষ্টা নিজের কাঁধ থেকে নামিয়ে সাবেক আইজি উপদেষ্টা আজিজুল হকের ওপর অর্পণ করবেন। তাতে প্রধান উপদেষ্টার ভারও কিঞ্চিৎ লাঘব হবে। সিইসির বিদায় কোন একপক্ষের জয় এবং অন্যপক্ষের পরাজয় নয়।
গণআন্দোলনের মুখে এমএ আজিজ সরে যেতে বাধ্য হয়েছেন। তাই এ বিজয় জনগণের, গণতন্ত্রের নিশানবরদার 14 কোটি মানুষের। আমাদের প্রত্যাশা, এ বিজয় মুকুট 'সূর্যরাগে ঝলমল' হয়ে উঠবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।