আজিজের সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয়েছিল টিনশেড হলে, আমরা যখন রুমমেট হিসাবে একইসাথে উঠলাম তখন।
নতুন নতুন সবাই সবার বন্ধু, কারো সাথে কারো কোন বিবাদ নাই, সবার ভেতরেই তখন নতুন হলে ওঠার আনন্দ।
আজিজ ছিল বেশ চটপটে আর আমোদপ্রিয়, সময় পেলেই বন্ধুদের সাথে রাত জেগে তাস খেলত, আমি খেলা জানিনা, কখনো কখনো ওদের সাথে বসে শেখার চেষ্টা করতাম।
আজিজ সম্পর্কে স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে সবার আগে এই কথাগুলোই আমার মনে ভেসে ওঠে। প্রায় একবছর আমরা একসাথে ছিলাম, কখনো ওর সাথে মনোমালিন্যটুকু হয়েছে এমনটাও মনে পড়েনা ।
নতুন এলোটের সময় আমরা উঠলাম শহীদুল হলে আর আজিজ উঠল জিয়া হলে। আমরা দুইজন দুই সেকশনের বিধায় তেমন আর যোগাযোগ হতনা। কালেভদ্রে সামনা সামনি দেখা হলে আজিজ হাঁক ছেঁড়ে বলত, কী রে বাবু ভাল আছিস ? আমি মাথা ঝাঁকিয়ে বলতাম হুঁ।
দেখতে দেখতে এক বছর পেরিয়ে গেল। শহীদুল হল ছেড়ে আমরা জিয়া হলে উঠলাম।
আজিজেরা যে ব্লকে থাকত আমরাও সে ব্লকে উঠলাম। আমরা ০৭ এর একটি বড় অংশ এখানে একসাথে থাকি। এই যে বর্ণনাটুকু করলাম, এরই মাঝে কেটে গেছে প্রায় চারটি বছর, আমরা এখন শেষ বর্ষের ছাত্র হয়েছি। প্রথম বর্ষের আজিজ আর সেই অচেনামুখ আজিজ নাই, ক্যাম্পাসের অনেকেই তাকে চেনে, রাজনীতির একজন সক্রিয় কর্মী সে। সে অন্য কথা, আজিজ রাজনীতি করে, ক্ষমতাধরদের সাথে তার চলাফেরা, এ জন্য তাকে আলাদা সমীহ করে চলতে হবে এমনটা কখনো আমার মনে হয় নি।
আজিজ আমার প্রাক্তন রুমমেট, আজিজ আমার সহপাঠী, সে আমার ঘরের মানুষ, আমি আর আট-দশজন বন্ধুর মতই তাকে দেখতাম।
একই ফ্লোরে থাকতাম বলে দিনে বহুবার তার সাথে দেখা হত, আবার মাঝে মাঝে আমাদের রুমে এসে ইন্টারনেটে ক্রিকইনফো ওয়েবপেজে সময় ব্যয় করত ও। বেশিরভাগ সময়ই আজিজ হন্তদন্ত হয়ে চলত যেন তার খুবই তাড়া আছে। সবসময়ই দূর থেকে দেখেই আমাকে আদুরে গলায় জিজ্ঞাসা করত, কেমন আছো বাবু ? আমি একটু হেসে বলতাম “ভাল”। এর বেশি কিছু বলার সুযোগ হতনা, ততক্ষণে আমাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া সারা।
একদিন রাত একটার দিকে আজিজ এসে আমার কম্পিউটারে নেট ব্রাউজ করা শুরু করল, আমাকে বলল, বন্ধু ১৫ মিনিটের মধ্যেই কাজ শেষ করব।
আমি মশারি খাটিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। দশ মিনিট , পনের মিনিট এভাবে একঘন্টা কেটে যায়, আজিজ যায় না, আমি কিছুটা বিরক্ত হয়ে বললাম, কাল ৮ টা থেকে ক্লাস, তাড়াতাড়ি ঘুমাতে হবে , পিসি বন্ধ কর। আজিজ ভ্রুক্ষেপ করলনা, ডান পা ঝাঁকাচ্ছে আর একমনে মনিটরের দিকে তাকিয়ে আছে।
আমি এবার বেশ খানিকটা বিরক্তির সুরে বললাম, “ এই আজিজ ওঠ....আরে ওঠনারে ভাই”।
রাত আড়াইটা বাজতে চলল, আজিজ অনড়। আমি আর ধৈর্য ধরে থাকতে পারলাম না, রাগের চোটে ল্যানের তার খুলে দিয়ে বললাম “ নে এখন ভাল করে নেট ব্রাউজ কর”। পাশাপাশি শংকাও হল, এই বুঝি উঠে এসে কিল দেয়।
কিন্তু না খানিকক্ষণ কটমট করেতাকিয়ে থাকবার পর আর্দ্রকন্ঠে আজিজ বলে উঠল, “ তোর পিসি ক্ষয়ে গেল না ? একটু ব্রাউজ করলে কী হবে ?” আমি বললাম, কাল এসে সারাদিন যতক্ষণ খুশি কাজ করিস। আজিজ কোন কথা না বলেই চলে গেল, আমি ঘুমালাম।
সেই যে গেল আর কোনদিনও আমার পিসিতে বসে নি, আমার অনুশোচনা হয়েছে, ইস কেন ওকে তুলে দিলাম!
এই ঘটনাটা ছোট্ট, আজিজ মনেও রাখেনি, আমিও ভুলে গেছি প্রায়। পরে যতবার দেখা হয়েছে আজিজ স্বভাব সুলভভাবেই আমার সাথে কুশল বিনিময় করেছে। একই সাথে থাকি, বারবার কুশল বিনিময়ের মাজেজা কী ? এটাই হচ্ছে ব্যাতিক্রম, একমাত্র আজিজই আমাকে যখন তখন কুশল জিজ্ঞাসা করত। আমি কখনো ঝামেলায় পড়েছি, আমাকে সাহায্য করবার প্রচ্ছন্ন ইচ্ছা ব্যক্ত করেছে ও ; কারো সাথে ঝামেলা বাধিয়েছে, আমি মাঝখানে গিয়ে আজিজকে জোর করে টেনে সরে নিয়ে গেছি, কাজে বাধা দেওয়ার জন্য সে আমাকে কখনো ভর্ৎসনা করেনি, আমি জোর খাটিয়ে বলতে পেরেছি, “ এই আজিজ থেমে যা, অনেক হয়েছে”। আমি আজিজের উপর জোর খাটাতে পেরেছি , কারন ও আমার সতীর্থ বন্ধু।
আমার চোখে এই ছিল আজিজ, তার অন্য দিকও ছিল হয়তো কিন্তু আজ তা স্মর্তব্য নয়।
মানুষ যদি তার ভবিষ্যতের কথা জানত তবে কী হত ? কিছুই না, নিয়তির কোন পরিবর্তন ঘটানো যায় না, যা অবশ্যই ঘটবে তাই লেখা থাকে মানুষের ভাগ্যলিপিতে । আজিজও পারেনি, নির্মমতম অধ্যায় ঘটে গেছে তার জীবনে।
আজিজ যখন হাসপাতালে তখন তাকে দেখতে গিয়েছিলাম। একজনের দুই পায়ের হাড় ফেটে গেছে, আজিজের শরীরে অনেকগুলো সেলাই দিতে হয়েছে, আর মাথার ক্ষতে ব্যান্ডেজ করা ।
আমার বিশ্বাসই হচ্ছিলনা এক সহপাঠি অন্যজনকে এভাবে নির্মম প্রহার করতে পারে।
দুঃখ করা ছাড়া আর কিছুই করার ছিলনা। পরের দিনই দেখি হায়েনারা আবার ক্লাসে এসে ক্লাস করছে। এও সম্ভব ! সব সম্ভবের এই দেশে সবই সম্ভব। ড্রাকুলাদের সাথে আমরা ক্লাস করলাম চারদিন, সবকিছুই চলল স্বাভাবিকভাবে, ক্লাস, ক্লাস পরীক্ষা, ফাইল লিখনের কেরাণিগিরিটা সবই।
শুধু আজিজের দিন আর চলল না, থেমে গেল তার সব কিছু। আজিজ মারা গেছে !! রাত তিনটার দিকে সবেমাত্র শুয়েছি কিছুক্ষন পরেই ফিসফাস শব্দে তন্দ্রা ছুটে গেল, যেন নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আমরা সবাই ঘুম থেকে ধড়ফড় করে উঠলাম। তারপরের কথা সবারই জানা, ঢুলুঢুলু চোখে আমরা রওনা দিলাম মহাবিদায় জানাতে , সহপাঠির অকাল মহাযাত্রায়।
মানিকগঞ্জে জীবনে প্রথম মর্গ দেখলাম।
সেখানে শুয়ে আছে সদা চঞ্চল ক্রিকেটপ্রেমি আজিজ। প্রথম ওকে দেখে বিশ্বাসই হচ্ছিল না যে, ডাকলে ও আর উঠবে না। মনে হচ্ছিল ও তো শুয়ে আছে , নিদ্রাভঙ্গ করলে আবার জেগে উঠবে।
“এই আজিজ ওঠনা.....আরে উঠনারে ভাই”। গায়ে হাত বোলালাম, হিমশীতল সে শরীর, কোন সাড়া এলনা, আজিজ উঠল না।
কয়েকজন হাউমাউ করে কেঁদে উঠল, ভেবেছিলাম আমি বোধহয় কাঁদতে পারবনা, কিন্তু ওই বন্ধ চোখদুটো দেখে আমার চোখের জল আর বন্ধ থাকল না। আমি আর কিছুই অনুধাবন করতে পারলাম না , বোকার মত আমার ভেতরের মানুষটা আবার বলে উঠল, “ আই আজিজ ওঠনা.... আরে ওঠনারে ভাই”। কোথাও কোন সাড়া নেই কিন্তু আমি আমার প্রত্যেকটা কোষ দিয়ে অনুধাবন করলাম যেন আজিজ আমাকে বলছে “ আমি আর কোনদিনও উঠব নারে বাবু , আমার সে শক্তি নাই, আমার ঠান্ডা শরীরে প্রাণহীন হয়ে গেছে, ওরা আমার সব রক্ত শুষে নিয়েছে”।
অভিমানি আজিজ উঠলনা, আমরা এক এক করে সবাই বের হয়ে আসলাম ।
কতক্ষণ কেটে গেল ! কত স্মৃতি মনের ভেতর ভেসে উঠতে লাগল ।
মর্গে এরপরে কী ঘটল তা আর বর্ণনা করতে পারবনা। জুমার নামাজ পড়ে আজিজকে নিয়ে আমরা গ্রামের বাড়ি রওনা হলাম।
গ্রামের বাড়িতে যে মাতম চলছিল তা কলম দিয়ে লিখে প্রকাশ করা যাবে না, সে পরিবেশ যে দেখেছে সে জানে, সন্তান মারা গেলে বাবা মার কী অবস্থা হয়।
আজিজের মা আমাদের কয়েকজনকে জড়িয়ে ধরে বিলাপ করতে লাগলেন। তাঁকে স্বান্তনা দেবার কোন ভাষা ছিলনা।
সেসব সবারই জানা, পুত্রশোক করবার জুতসই বর্ণনা হয় না, এটা কেবল অনুভবের।
আজিজকে শেষ গোসল করানো হল, কাফনে জড়িয়ে চোখে সুরমা লাগিয়ে দেয়া হল। কাল থেকে কালান্তরে প্রবেশের এই বুঝি মহাসজ্জা! সে সজ্জা সবাইকে কাঁদালো, আমি বাঁশঝাড়ের পাশে চলৎহীন হয়ে বসে পড়লাম, অশ্রুবাষ্প আমার দুচোখকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে, কোন কিছু দেখবার ক্ষমতা আর রইলনা, মনে হল আমি আবার আজিজকে বলছি, “ এই আজিজ ওঠনা.... আরে ওঠনারে ভাই”।
আজিজ যেন বললে, “ নারে বাবু, আমি আর উঠবনা কোনদিনও, ওই যে দেখ মা কাঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলে তুলেছে, ঠোঁট শুকে সাদা হয়ে গেছে, আধো বন্ধ করা চোখের নিচের চামড়া কুঁচকে গেছে; সমস্ত শক্তি দিয়ে আমাকে ডাকছে ‘ সোনা মানিক আমার কই যাস ? একবার মা বলে ডাক, ফিরে আয় বাপ আমার’ ; মা বলছে আর কোনদিনও আমাকে বকবেনা, শুনতে পাচ্ছিস বাবু ?”
আমি বললাম , পাচ্ছিরে।
আজিজ ফের বললে, ওই যে আব্বার বুক থেকে বারবার দীর্ঘশ্বাস পড়ছে আর বলছে, ‘আহ ! কী হল রে আমার কলিজার টুকরার’ ইস ! খোকা একবার ফিরে আয় ; আব্বা ভালমত কাঁদতেও পারছেনা।
আর ভাইয়া দেখ কেমন বিবর্ণ হয়ে গেছে। আমার বিদায় বেলাতে কতজন কাঁদছে, তবু আমি ফিরতে পারব নারে; আমার আর পেছনে ফেরার উপায় নাই, যাদের ফেরার উপায় আছে তাদের গিয়ে ফিরে আসতে বল।
আমি বুঝতে পারলাম না।
আজিজ ফের বললে, “ বাবু তুই পারবি ওদের ফেরাতে ? ওরা বোঝেনা, আগুন নিয়ে খেলতে নেই, সাপুড়ের মৃত্যু যে সাপের কামড়েই ! কেউ ওদের ফিরিয়ে আনুক; যারা উগ্রবাদি, যারা ছাত্ররাজনীতির নামে মারামারি করে, সমাজ -রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল করে তোলে, ক্রমাগত বিবেক বুদ্ধি হারিয়ে যারা পশুতে রূপান্তরিত হয় আর তুচ্ছ কারণে সহপাঠী, বড় ভাইদের পিটিয়ে হত্যা করে ,তাদের থামাক কেউ। ওদের ফিরে আসতে বল।
ওদেরও মা- বাবা আছে, সেই মা-বাবারাও কাঁদতে জানে, ছেলের কিছু হলে তাঁরা বুক চাপড়ে কাঁদবে, সেদিন কিন্তু ফেরার রাস্তা থাকবে না।
“ ওরা কত মেধাবী, রক্তের কত তেজ, কিন্তু বুদ্ধুরা নিজের রক্তের মূল্যই বোঝেনা। ওদের রক্ত অনেক দামি, ওরা চাইলেই বিষাক্ত সাপে কাটা মূমুর্ষ সমাজটাকে বাঁচিয়ে তুলতে পারে। ওরা তা না করে নেশা করে, নেশার ঘোরে দিনদিন তারা ঘুমিয়ে পড়ছে। যা ওদের জেগে উঠতে বল, সময় যে বেশি নেই , দেরি হলে একদিন সবাই ঘুমিয়ে যাবে, শত ডাকাডাকি আর অশ্রুপাত করলেও জেগে উঠবে না, যা তাড়াতাড়ি ওদের ফিরিয়ে আন, মানুষের জন্য, সমাজের জন্য, দেশের জন্য।
আমি মুগ্ধ হয়ে সে আপ্তবাক্য শুনলাম। আরে আজিজ তুই এত কথা শিখলি কোথা থেকে ?
আজিজ বললে, স্কুলে থাকতে স্কুলের গুরুত্ব বোঝা যায় না, স্কুল ছাড়লে সব স্মৃতি মনে পড়ে , তার গুরুত্ব অনুধাবন করা যায়; তেমনি জীবন দিয়ে জীবনের মূল্য বুঝেছি, জীবন নদীর এ পাড়ে এসে ওপারের গুরুত্ব অনুধাবন করেছি।
আমি মোহগ্রস্ত হয়ে সে কথা শুনছি। হঠাৎ কার ডাকে যেন আমার তন্দ্রাচ্ছন্নতা কেটে গেল। এতক্ষণ আমি কল্পনায় আজিজের সাথে কথা বলছিলাম।
দাঁড়িয়ে দেখি লাশ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আমি পেছন পেছন চলতে লাগলাম। খানিক্ষণ পরে জানাজা হল। জানা শেষে সবাই কবরের পাড়ে গেলাম। কাফনে মোড়ানো আজিজকে কয়েকজন ধরাধরি করে কবরে নামালেন।
আমার পাগল মন আবার বলে উঠল, এই আজিজ যাসনা... ওঠ.......ওঠরে ভাই....আরে ওঠ না।
অনেকদিন পেরিয়ে গেল, আর কোন সাড়া পেলাম না।
এফ এইচ রিগ্যান
২৫ শে চৈত্র, ১৪১৮ ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।