প্রতিহিংসার রাজনীতি, রাজনীতির প্রতিপক্ষ
ফকির ইলিয়াস
========================================
বাংলাদেশে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা আবার বেশ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। নাটোরে একজন নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যানকে সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যা করেছে। এই উপজেলা চেয়ারম্যান স্থানীয় বিএনপি নেতা ছিলেন। বিএনপি অভিযোগ করছে, আওয়ামী লীগ সমর্থকরা এই হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে। এ নিয়ে আবার উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে দেশের রাজনীতি।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন, কারা এই হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে তা ভিডিও ফুটেজে দেখে চিহ্নিত করা হবে। দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হবে।
এই ঘটনার পর নাটোরে হরতাল পালিত হয়েছে। বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া নাটোর সফর করেছেন। সন্দেহ নেই, এই ঘটনা প্রধান বিরোধীদলের হাতে সরকারবিরোধী একটি ইস্যু তুলে দিয়েছে।
দেশে সরকারিদলের সমর্থকরা আসলে কী চাইছে? এমন একটি প্রশ্ন ঘুরে-ফিরে আসছে বারবার। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান একটি সেমিনারে বলেছেন, দেশ এখন বাজিকরদের হাতে। তিনি আরও খোলাসা করে বলেছেন, টেন্ডারবাজ, চাঁদাবাজ, মুনাফাবাজ, সন্ত্রাসবাজ- এসব বাজিকররা এখন দেশের অন্যতম বিধাতা।
তার এই উষ্মা প্রকাশ দেশের ভবিষ্যতের জন্য, দেশের শান্তিকামী মানুষের জন্য তীব্র শঙ্কার কারণ তো বটেই। কারণ দেশের মানুষ এমন বাজিকরদের হাতে জিম্মি হওয়ার জন্য মহাজোট সরকারকে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দেননি।
এটা খুবই পরিতাপের কথা, বাংলাদেশের বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের প্রধান শরিক দল আওয়ামী লীগ তাদের পেটোয়া বাহিনীকে শায়েস্তা করতে পারছে না। এসব বাহিনীর সদস্য/সদস্যারা আনন্দে ধরাকে সরা জ্ঞান করে দলের সভাপতি শেখ হাসিনার জন্মদিন পালন উপলক্ষেও ঢাকায় সমাবেশে নিজেরাই চুলোচুলি করেছে। তাদের বিরুদ্ধে সংগঠন কঠিন কোন ব্যবস্থা নিয়েছে বলে কোন খবর মানুষের চোখে পড়েনি। পাবনার ঘটনার পর আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের আদালতে আত্মসমর্পণের প্রধান নেপথ্য উদ্দেশ্য ছিল তারা সরকারি মদতে পার পেয়ে যাবে। সে ঘটনার কি সুরাহা হয় তাও দেখার বিষয়।
সব মিলিয়ে সরকারি দলের কিছু অতিসুবিধাবাদীরা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বেশ নগ্ন আচরণ শুরু করেছে। এই চলমান অবস্থা সরকারের জন্য অশনিসংকেত বহন করছে নিঃসন্দেহে।
বিরোধীদলীয় নেত্রীর নাটোর সফরকালে সিরাজগঞ্জে চলন্ত ট্রেনে হামলা করা হয়েছে। বিএনপি বলেছে, ট্রেন মিছিলের ওপর তুলে দেয়া হয়েছে। আর সরকার বলছে, ট্রেনের ওপর হামলা করা হয়েছে।
এতে ছজন নিহত হয়েছেন। এটা গোটা জাতির জন্য অত্যন্ত দুঃসংবাদ। খালেদা জিয়া বলেছেন, আর স্মরণসভা, জানাজা নয়-এবার প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। এজন্য তিনি ছাত্রদলকে আন্দোলনমুখী হওয়ারও অনুরোধ জানিয়েছেন।
সিরাজগঞ্জে ট্রেনে হামলা করা হয়েছে এমন দাবি করেছেন স্বয়ং যোগাযোগ মন্ত্রীও।
তিনি বলেছেন, দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হবে।
অন্যদিকে পত্রপত্রিকায় খবর বেরিয়েছে, নাটোর সফরের সময় প্রধান বিরোধীদলীয় নেত্রীর গতিবিধি লক্ষ্য রাখার জন্য প্রধানমন্ত্রী নাকি নির্দেশ দিয়েছেন। বিষয়টি বেশ হাস্যকর তো বটেই। কারণ কোন রাজনীতিকের গতিবিধি লক্ষ্য রেখে তার কর্মপরিকল্পনা সম্পর্কে স্বচ্ছ কোন ধারণা পাওয়া কখনোই যায় না। গতিবিধি লক্ষ্য রাখা এক ধরনের সেন্সর কিংবা বিধি-নিষেধের আওতায় পড়ে।
বাংলাদেশের সামরিক শাসকরা এক সময় শেখ হাসিনার কর্মকান্ডের ওপরও নজরদারি রাখত। সে বিষয়টি হয়তো শেখ হাসিনা এখন ভুলে গেছেন।
দেশপ্রেম এমন একটি শক্তি, যা বলে-ধরে কাউকে করানো যায় না। যারা এই রাষ্ট্রটির মহান মুক্তিসংগ্রামে অংশ নিয়েছিলেন তাদের চেতনা ছিল সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থ। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে সেই চেতনাটিতে জং ধরেছে বলেই নীতিবান রাজনীতিকের সংখ্যা দিনে দিনে শুধুই কমছে।
বাংলাদেশ জাতীয়বাদী দল (বিএনপি) প্রকৃতপক্ষে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালন করে কি না তা প্রমাণের একটি মোক্ষম সময় ছিল একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিষয়ে তাদের অবস্থান পরিষ্কার করা। বেগম জিয়া তা করেননি। এখনো করছেন না। এর নেপথ্য উদ্দেশ্য প্রমাণ করছে, তাদের কাছে দেশপ্রেম নয়, রাষ্ট্রক্ষমতাই প্রধান বিষয়। প্রতিরোধের নামে বেগম জিয়া তবে কি আলবদর-রাজাকার মুক্তির আন্দোলনের ডাকই দিতে চাইছেন?
এখানে একটি বিষয় খুব ঘনিষ্ঠভাবে লক্ষণীয়, দুর্বলেরাই সব সময় রাজনৈতিক প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়।
তারা নিজেদের ঘৃণ্যতম মতবাদ মানুষের ওপর চাপাতে না পারলে, শেষ পর্যন্ত মারমুখো হয়ে ওঠে। বাংলাদেশে ভাড়াটে পেটোয়া বাহিনী আমদানি করে প্রতিপক্ষের ওপর হামলা করার এমন ঘটনাবলি দীর্ঘদিন থেকেই চলে আসছে।
মনে রাখা দরকার রাজনৈতিক মতের প্রতিপক্ষ থাকে। কিন্তু প্রকৃত রাজনীতির কোন প্রতিপক্ষ নেই। কারণ রাজনীতির মূল আদর্শ হচ্ছে মানুষের কল্যাণের জন্য।
এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার একটি কথা প্রণিধানযোগ্য। তিনি সম্প্র্রতি বলেছেন, রিপাবলিকান রাজনীতিকরা আমার দল, সরকার কিংবা আদর্শের সঙ্গে দ্বিমত করতেই পারেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সার্বিক উন্নয়নে আমাদের সহযোগী তাদের হতেই হবে।
আসছে মধ্যবর্তী নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্র ডেমোক্রেটিক পার্টির কিছুটা ভরাডুবি হতে পারে এমন আশঙ্কা থেকে কথাগুলো বলেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।
দলকে নয়, রাষ্ট্রকে ভালোবাসা একজন প্রকৃত রাজনীতিকের দর্শন হওয়া উচিত।
বাংলাদেশে সেই সংস্কৃতি গড়ে ওঠা এখনো থেকে গেছে অনেকটা সদূর স্বপ্নকল্পনার মতো। বাংলাদেশের রাষ্ট্রইতিহাসে এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে, সৃজনশীল অনেক রাজনীতিক বারবারই ভোটের রাজনীতিতে পরাজিত হয়েছেন কালো টাকার মালিক, পেশিবাজ, দুর্নীতিপরায়ণ রাজনীতিবিদদের কাছে। পুরো জীবন গণমানুষের রাজনীতি করেও এমপি হতে পারেননি, এমন রাজনীতিকও খুঁজে পাওয়া যাবে এই দেশে অনেক। এর কারণ কী? কারণ হচ্ছে এই দেশে রাজনীতির প্রতিপক্ষ হয়েই দাঁড়িয়েছে অসাধুতা, কপটতা, লাম্পট্য, নীতিহীনতা। ফলে মানুষের স্বপ্নের বাংলাদেশ সব সময়ই থেকে গেছে একটি গোষ্ঠীর কাছে জিম্মি।
এই জিম্মিকাররা এখন আরও বলীয়ান হয়েছে। তাদের হাতে নতুনভাবে এসেছে ঢাল হিসেবে ইলেকট্রনিক মিডিয়া কিংবা প্রিন্ট মিডিয়ার কৃপায় এখন তারা নিজেদের অপকর্ম ঢাকতে কোটি কোটি টাকা খরচ করে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতাসীনের আনুকূল্য পেতে উৎসাহী হচ্ছে। দীর্ঘতর হচ্ছে মানুষের পরাজয়। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা দূর করতে হলে রাষ্ট্রের মানুষকে রুখে দাঁড়াতে হবে। সংকীর্ণ দলীয় রাজনীতির বলি এভাবে হতে পারে না সাধারণ মানুষ।
----------------------------------------------------------------------
দৈনিক সংবাদ/ ঢাকা/ ১৫ অক্টোবর ২০১০ শুক্রবার
ছবি- ট্রেসি লেভেট
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।