দীর্ঘ এক বছর পর গ্রামের বাড়িতে গেলাম ঈদ করতে। ভালই কাটছিল আমার সময়। বাইরে মাঝে মাঝে বৃষ্টির রিম ঝিম শব্দ, বন্ধু বান্ধবের হাক ডাক "আছিস নাকি বাসায়"। জমিয়ে আড্ডা, রাত করে ঘরে ফেরা। বউয়ের ভেংচি, মায়ের বকুনি।
এতো রাতে কোথায় থাকিস? রাজ্যের কাজ ফেলে নিজেকে অতীতে নিয়ে যাবার ক্ষুদ্র প্রায়াস। ঈদের দিন শুধু সালাম আর সালামি। আগে যেখানে জনসংখ্যা ছিল হাতে গোনা ৬/৭ জন এখন প্রত্যেকের ঘরে দুইজন একজন করে নতুন মেহমান! হরেক রকম গল্প, কার বাচ্চা কি করে, কে কাকে কেমনে খাওয়ায় ইত্যাদি।
ঈদের দু'দিন পর দল বেঁধে কয়েটি গ্রাম ঘুরব। চিটাগাং থেকে আমার ছোট শ্যালক তার বউ বাচ্চাকেও নিয়ে এসেছে।
ঝটপট করে সবাইকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছি রেডি হবার জন্য। রাতের বেলায় কিছু না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। বাগেরহাটের ঐতিহ্যবাহি পিঠা "সেয়াই পিঠা" রান্না ঘর থেকে আমাকে ডাকছিল। সকালে একটা বড়সড় টান দিব এটাই ছিল নেয়াত।
ছোট বোন বাথরুম দখল করে রেখেছে।
বাধ্য হয়ে পুকুরে গেলাম গোসল সারতে। বাচ্চা দুটোকেও খাওয়ানোয় ব্যস্ত আমার গিন্নি। দীর্ঘ দিন পুকুরে ডুব মেরে গোসল করি না। প্রচন্ড পিচ্ছিল সিঁড়ি গুলো, আস্তে আস্তে নীচে নেমে ভুস করে মাথাটা পানির নীচে ডুবিয়ে দিলাম। ঝটপট সাবান দিয়ে নিজেকে ফ্রেস করে তৈরী হতে হবে।
সবাই প্রায় রেডি হয়ে গেছে, বাকি হলাম আমি। লুঙ্গিটা পরে এক পা স্যান্ডেলে ঢুকাতে গিয়েই পিছনের পা স্যাৎ করে সরে গেল। আমার ৬৫ কেজি ওজনের শরীরটা কিছুতেই আমি কন্ট্রোল করতে পারলাম না। ডান দিকে ধপাস করে পড়ে গেলাম। দুর্ভাগ্য আমার, ঘর ভর্তি আনন্দ আর কোলাহল নিমিষেই আত্মচিৎকারে গমগম করে উঠল।
আমার ডান হারে বাহু এবং সোল্ডারের জয়েন্ট এক ইঞ্চি নীচে নেমে ঠিক বগলের ভিতর ঢুকে গেছে!! তীব্র ব্যথায় আমি পুকুর থেকে উঠতে পারছিলাম না। শুধু "মা-গো" বলে একটা চিৎকার দিলাম। বুঝতে পারলাম আমার হাত হয় ভেঙ্গে গেছে আর না হয় বড় ধরনের কোন ক্ষতি হয়েছে। ডান হাত ভাঁজ করার কোন উপায় ছিল না, সকলে আমাকে পুকুর থেকে জাপটে ধরে উঠিয়ে নিল, আমি তীব্র ব্যাথায় জ্ঞান হারালাম। জ্ঞান ফিরে বারান্দায় ইতিমধ্যে অনেক সোরগোল টের পেলাম।
বাবা গেছে ভ্যান আনতে কিন্তু পাচ্ছে না! আমি নিশ্বাস নেবার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছি কারন আমার বুকের খাঁচাও চরম ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। মা-কে শুধু বলতে শুনলাম "ও বাবা তুই এমন করতেছিস কেন? তোরা কে কোথায় আছিস তাড়াতাড়ি আমার ছেলেকে হাসপাতালে নে, দেখ ওর চোখ উল্টে যাচ্ছে। আমি আবার জ্ঞান হারালাম। ভিজা লুঙ্গিটা কে-যেন বদলে দিল। আমাদের ঘর থেকে পাকা রাস্তা ১০০ গড়ের মত হবে।
তিন চারজন আমাকে ধরে নিয়ে চলল, এত ব্যাথা আমি আমার লাইফে সহ্য করি নাই। দাঁতে দাঁত চেপে ভ্যানে পিছনে বসলাম। হাসপাতাল ২ কিলোমিটার দুরে, এর মাঝে আবার একটা নদীও আছে। খালি গায়ে এবং খালি পায়ে আমি যন্ত্রনা চেপে হাসপাতালে পৌঁছলাম। আমার আশ পাশে ৩০/৪০ জনের ভীড় জমে গেছে।
সবাই হতবাক কারন গতকাল সন্ধায় যে ছেলেটা সবার সাথে মজা করে হাসতে হাসতে বাড়িতে গেল আজ তার এই দশা?
বেডে বসতে পারছি না কারন হাত আমার উঁচুকরে ধরে রাখা, একটুও নড়ানো যাচ্ছে না। ডাক্তার নাই, ডিউটিতে কয়েকজন ছোকরা গোছের ছেলে দেখলাম। ওরা ভয়ে আমার কাছে না এসে চোখ বড় বড় করে শুধু দেখছে। ব্যাথা কমানোর জন্য একটা ইনজেকশন দেওয়া হল, কিন্তু কোন কাজই হল না। মনে হচ্ছিল এই ডাক্তার নামধারী তিন চারজন মনে হয় নার্স বা প্যারা মেডিকেলের ছাত্র।
কোন এক বুদ্ধিমান বলল, ডাক্তার আসার আগে এক্সরেটা করে নিতে। আর একজন বলল হাসপাতালের এক্সরে মেশিন ভাল না। আপনারা বাগেরহাট থানার সামনে থেকে এক্সরে করে নিয়ে আসেন। এত যন্ত্রনা শরীরে তার পরেও মুখ না খুলে পারলাম না। বললাম "এক্সরে কেনার টাকা কি লুট হয়ে গেছে না-কি?" এর পর একজন বলল ভাই আসেন এক্সরে মেশিন এখানে আছে।
আমার জন্য কোন হুইল চেয়ার বরাদ্দ হল না, কারন সেখানে না-কি আগে টিকিট কিনে স্যাংশন লেটার নিয়ে হুইল চেয়ার বরাদ্দ নিতে হয়। আল্লাহ আমাকে সুস্থ রাখলে একটা চটকানা মারতাম এই ব্যাটার থোবড়ার উপর যা ওর আমরন মনে থাকত। ব্যাটা মানুষ মরে যায় আর তোরা আছিস টিকিট আর স্যাংশন লেটার নিয়ে?
মেশিন রুমে দাঁড়ালাম ডান হাত বাই ডিফল্ট ৯০ ডিগ্রি সোজা করে। উনি একটা ফ্লিম ব্যবহার করল, এবার বলল হাত শরীরের সাথে লাগাতে। ডাক্তারের না-কি দুই এ্যঙ্গেল থেকে দুইটা ছবি লাগে, তা-না হলে উনি ট্রিটমেন্ট করেন না।
আমি ওনাকে বললাম "ভাই আমি যদি ডান হাতটাকে শরীরের পাশে লাগাতে পারতাম তাহলে হাসপাতালে আসতাম না" তার পরেও ওনার একই কথা, হাত সোজা করতেই হবে। এবার একটু ইংরেজীতে হাল্কা করে ঝাড়লাম সাথে যোগ করলাম "আপনার মাথায় কি কোন বুদ্ধি জ্ঞান আছে? না-কি শুধু সুইচ টেপাই আপনার কাজ!" এর পর উনি নরম সুরে বলল, না মানে একটা রিপোর্টেও হয় তবে দুইটা হলে ভাল হয় আর কি।
এতক্ষনে বে-আক্কেলের আক্কেল হল। যথারীতি একটা কেবিন নিলাম যার টয়লেট ছিল আগাগোড়া মল দ্বারা পূর্ণ। হাসপাতালের পাবলিক মনে হয় টয়লেটের কোথায় বসে কাম সারতে হয় জানে না।
একজন বুয়াকে টাকা দিলাম পরিষ্কার করার জন্য। দীর্ঘ দিনের শুকনা মল ভিজিয়ে নরম করতে ৪০ মিনিট লাগল, অবশেষে তার প্রচেষ্টা সফল হল।
অবশেষে অর্থোপেডিকের ডাক্তার এলেন, তিনি বললেন তার নিজস্ব প্রচেষ্টায় এটাকে ঠিক করে দিবেন। আমার ভয় হতে লাগল, কারন আমি শুনেছি ওনারা কোন পেইন কিলার ব্যবহার না করে রোগীকে যন্ত্রনা দিযে চিকিৎসা করান। আমার আইডিয়াটাই সঠিক হল যখন ওটি রুমে আমাকে নিয়ে গরু জবাই করার মতো হাত-পা বেঁধে ফেলা হল।
ডাক্তার একজনকে বললেন আমার মাথা আর ডান হাতের সোল্ডার চেপে ধরার জন্য।
ডাক্তার সাহেব তার কেরামতি শুরু করলেন, আমার নিঃশ্বাস তখন নাকের আগায়। দ্বিতীয়বার উনি আবার সজোরে চাপ দিলেন হাড্ডিটাকে যায়গায় আনার জন্য। আমার সেই অনুভুতির কথা এখানে লিখে বোঝাতে পারব না। শুধু ডাক্তারকে বললাম, স্যার আই হ্যাবটু এলিভ, আই ওয়ানা ব্যাক মাই ফ্যামিলি, প্লিজ স্টপ ইওর একটিভিটিস, আই উইল ডাই ইফ ইউ ডু ইট এগেইন।
আই ক্যান্ট ব্রেথিং, প্লিজ গিভ মি ওক্সিজেন।
আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম, কেউ আমার মুখে পানির ছিটা দিচ্ছিল, কানের কাছে অনেক কথা, ডাক্তার সাহেব আমাকে দ্রুত খুলনা নিয়ে যাবার পরামর্শ দিলেন।
ইসলামি হসপিটাল খুলনা। ওটি রুমে আমি, স্যালাইন চলছে। এনেস্থেশিয়া করার জন্য কেউ একজন এসেছেন।
আমাকে নাম জিজ্ঞেসা করলেন, কি করি, কোথায় থাকি ইত্যাদি। কিছুক্ষন পরে কেউ একজন আমাকে ডাকলেন, "ভাই ওঠেন, আপনার হাত ঠিক হয়ে গেছে, ভাই শুনতে পাচ্ছেন? এই-যে চোখ মেলেন"
আমি মাত্র ১০ মিনিট অজ্ঞান ছিলাম, কিছুই টের পাইনি। এই হল আমার লাইফে দ্বিতীয়বার হসপিটালাইজড হওয়া। প্রথমবার ছিল ২০/২৫ দিন আগে চায়নায়।
আল্লাহর কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া যে, আমার কোন হাড় ভাঙ্গে নাই।
শুধু লিগামেন্টগুলো ছিড়ে গেছে যা জোড়া লাগবে যদি আমি ব্লগ লেখা বন্ধ করি। হাত আমার ফিক্স করা তার পরেও এতবড় একটা লেখা দিলাম। আমার জন্য দোয়া করবেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।