জীবনের এত গভীরে প্রবেশ করে কি লাভ, জীবনটা হউক হুমায়ুন আহমেদের সাহিত্যের মত !
বেগম খালেদা জিয়া দ্বিতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় টঙ্গীতে ৮০ মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুকেন্দ্র উদ্বোধন করেছিলেন। কিন্তু সেটি চালু হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যায়। তারপর কয়েকদফা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে যন্ত্রটির ত্রুটি ও অন্যান্য অসুবিধা দূর করলে কেন্দ্রটি থেকে নিয়মিত বিদ্যুত্ উত্পাদন শুরু হয়। সেই টঙ্গী বিদ্যুকেন্দ্র এখনও চালুই আছে।
তবে দেশের অপর প্রধান দল আওয়ামী লীগ ওই বিদ্যুকেন্দ্র নিয়ে সে সময় বেগম জিয়া ও বিএনপির সমালোচনা করেছিল তো বটেই, আজও ঠাট্টা-মশকরা করে।
টঙ্গী বিদ্যুকেন্দ্র উত্পাদনে যাওয়া নিয়ে সমস্যা দেখা দিলে আওয়ামী লীগ বলে, যন্ত্রটি বিএনপির দুর্নীতি ও অযোগ্যতার প্রমাণ। কিন্তু ওই কেন্দ্রে কিছুদিন পর থেকেই বিদ্যুত্ উত্পাদন হয়ে চলেছে সে কথাটি তারা বলে না। মনে পড়ছে, অল্প কিছুদিন আগেও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিদ্যুত্ ঘাটতি সমস্যা নিয়ে ২০০১-২০০৮-এর বিএনপি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে দায়ী করে বক্তৃতা করছিলেন। তাতে তিনি বলেন, বিএনপি আমলে শুধু টঙ্গী বিদ্যুকেন্দ্রটি স্থাপন করা হয় আর সেটি উদ্বোধন করে বেগম জিয়া ঢাকার পথে টঙ্গী ব্রিজ পার হতে না হতে সেটি বন্ধ হয়ে যায়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের প্রচারকুশলীদের সঙ্গে ভাগ্য এখন এক পরিহাসময় খেলা খেলছে।
যদিও যে দুটি অঘটনের দরুন এমনটি মনে হচ্ছে তা আমাদের জন্য দুর্ভোগের। এর একটি হলো, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রামের শিকলবাহায় ৮ সেপ্টেম্বর যে বিদ্যুকেন্দ্রটি উদ্বোধন করেন তা কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বন্ধ হয়ে যায়। তখন কেউ কেউ বলেন, যান্ত্রিক ত্রুটির জন্য নতুন বিদ্যুকেন্দ্রটি বন্ধ করতে হয়েছে। আবার কেউ বলেন, নতুন বিদ্যুকেন্দ্র নিয়মিতভাবে চালু করার আগে ‘টিউনিং’ করে নিতে হয় কিন্তু শিকলবাহা পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্টটির বেলায় সেই কাজটি করা হয়নি। আর সরকারের পক্ষ থেকে প্রচার করা হয়, গ্যাসের অভাবে বিদ্যুকেন্দ্রটি বন্ধ করে দিতে হয়েছে।
পিকিং প্ল্যান্টটি অবশেষে চালু করা হয়েছে। তবে তার পার্শ্ববর্তী পুরনো বিদ্যুত্ উত্পাদন যন্ত্রটি বন্ধ রাখা হয়েছে, সম্ভবত সেটির জন্য যে গ্যাস ব্যবহার করা হতো তা-ই দিয়ে নতুনটি চালু রাখা হচ্ছে। তবে কথা হলো, শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হয়ে এমন একটা বিদ্যুকেন্দ্র চালু করলেন যা তিনি উদ্বোধন করার পরপরই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল একাধিকবার।
কিছুদিন আগে সিদ্ধিরগঞ্জেও একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেখানে একটি নতুন বিদ্যুত্ উত্পাদন কেন্দ্র উদ্বোধন করেন।
সেদিন কয়েকটি পত্রিকায় ছোট করে খবর প্রকাশ হয়েছিল যে সিদ্ধিরগঞ্জের পাশে রূপগঞ্জে অবস্থিত বহু টেক্সটাইল মিলে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দিয়ে সেই গ্যাস দিয়ে সিদ্ধিরগঞ্জে নতুন বিদ্যুকেন্দ্রটি উদ্বোধন করা হয়। দিনকয়েক পর বন্ধ কল-কারখানার মালিক ও শ্রমিকদের বিক্ষোভের মুখে সেসব মিলে আবার গ্যাস সরবরাহ শুরু হয় কিন্তু তখন নতুন বিদ্যুকেন্দ্রটি বন্ধ রাখতে হয়। অতঃপর ভারতে তৈরি এই বিদ্যুত্ উত্পাদন যন্ত্রটি কয়েকবার চালু করলেও তা প্রায়ই বন্ধ হয়ে যায়। রক্ষণাবেক্ষণের অজুহাতে বিদ্যুকেন্দ্রটি এখন আবার বন্ধ আছে। উল্লেখ্য, ভারত হেভি ইলেকট্রিক নামে একটি প্রতিষ্ঠান গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় এই বিদ্যুকেন্দ্র নির্মাণের ঠিকাদারি পায়।
তাহলে বাস্তব ঘটনা হলো, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বর্তমান দায়িত্ব পালনকালে এমন দুটি বিদ্যুকেন্দ্র উদ্বোধন করেছেন, যেগুলো তার কড়স্পর্শে চালু হওয়ার অল্প পরই বন্ধ হয়ে যায়। অন্যদিকে বেগম জিয়া তার গত মেয়াদে এ ধরনের বিদ্যুকেন্দ্র উদ্বোধন করেছিলেন একটি। অর্থাত্ অঘটন বেশি ঘটেছে শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে। তাই বিএনপি যদি এখন বলে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ যেভাবে বেগম জিয়া এবং বিএনপির সমালোচনা করছেন তা ছাঁকনি সুচের ছিদ্রান্বেষণ করার মতো হাস্যকর ব্যাপার, তাহলে তাদের খুব দোষ দেয়া যাবে কি?
কোনো সরকার ও ক্ষমতাসীন দল দেশে প্রকৃতপক্ষে কী ঘটেছে এবং ঘটছে তা যদি না দেখতে পায় তাহলে সেটি অবশ্যই সে দেশের জন্য দুর্ভাগ্যের বিষয়। আর তারা যদি প্রকৃত ঘটনা দেখেও সজ্ঞানে তা না দেখার ভান করেন, তাহলে সেটি ওই দেশের মানুষের জন্য খুবই বিপদের কথা হয়ে দাঁড়ায়।
আর শেষ পর্যন্ত তা হয়ে যেতে পারে আত্মঘাতী। কারণ কোনো না কোনো সময় জনগণ একটি ব্যর্থ অথবা বাজে সরকারকে প্রত্যাখ্যান করবেই। বিদেশের সার্টিফিকেটও মিলবে না তার। মাত্র দিনকয়েক আগে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের যে গ্লোবাল কমপিটিটিভনেস রিপোর্ট ২০১০-২০১১ প্রকাশিত হয়েছে, তাতে গত বছরের পরিস্থিতির নিরিখে বাংলাদেশের অবস্থান এক মাত্রা নেমে গেছে। সেই প্রতিবেদনে বাংলাদেশের বিভিন্ন দুর্বলতার মধ্যে ব্যাপক দুর্নীতির কথাও উল্লেখ করা হয়েছে বলে পত্রপত্রিকায় দেখলাম।
অর্থাত্ সরকার বদল হলেও দুর্নীতি দূর হয়নি।
দুর্নীতি বলতে যদি কেবল উৎকোচ আদায়, গ্রহণ, ক্ষমতার অপব্যবহার করে আইন ও নীতি ভঙ্গ করে কাউকে সরকারি টাকা (অর্থাৎ জনগণ প্রদত্ত কর) পাইয়ে দেয়া এবং স্বজনপ্রীতি হয় তাহলে আওয়ামী লীগ সরকারের বর্তমান আমলে তার মাত্রা কত উঁচু ও কতদূর পর্যন্ত প্রসারিত তা জানতে ভবিষ্যতে ক্ষমতার হাতবদলের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। তবে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, জমি দখল, ব্যবসা দখল, ভর্তি-বাণিজ্য ও চাকরি-বাণিজ্যের যেসব নমুনা জনগণ প্রতিদিন দেখছেন সেগুলোকেও যদি আমরা দুর্নীতির মধ্যে ধরি তাহলে একথা বিনা দ্বিধায় বলা যায়, দেশ দুর্নীতি ও অপরাধের মধ্যে ডুবে রয়েছে।
ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা ও ক্ষমতাসীন মহাজোটের নেতৃস্থানীয় সংসদ সদস্য রাশেদ খান মেনন উজিরপুরে গত শনিবার এ সম্পর্কে এক সভায় বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগ একটি বুর্জোয়া দল। এই দলের অনেক নেতাকর্মী চারদলীয় জোট সরকারের মতো চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি করছে।
এছাড়া সিন্ডিকেটের কারণে বিভিন্ন পণ্যসামগ্রীর দাম হু হু করে বাড়ছে। দিন দিন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য গরিব মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। ’ জনগণ গত পৌনে দু’বছর ধরে যা দেখছেন ও সহ্য করছেন, পত্রপত্রিকায় ক্ষমতাসীনদের দ্বারা সংঘটিত যেসব অপরাধ ও অপকর্মের খবর প্রকাশিত হয়েছে এবং আমরা যেসব অন্যায়-অত্যাচার নিয়ে লেখালেখি করে মৃদু প্রতিবাদ করার চেষ্টা করে আসছি বামপন্থী নেতা রাশেদ খান মেনন তার কিয়দংশের উল্লেখ করেছেন মাত্র। হয়তোবা অদূর ভবিষ্যতেই তাকে ও তার মতো সরাসরি আওয়ামী লীগপন্থী নন এমন মহাজোট সমর্থক নেতাদের খোলামেলা কথা বলতে হবে। গতকালের (রোববার, সেপ্টেম্বর ১৯, ২০১০) আমার দেশ পত্রিকার প্রধান সংবাদ ছিল যে আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনগুলোর অভ্যন্তরীণ কোন্দলে বিগত ২০ মাসে, অর্থাৎ গত বছর ৬ জানুয়ারিতে আওয়ামী লীগ ও মহাজোট নেত্রী শেখ হাসিনা সরকার গঠন করার পর আজ পর্যন্ত অন্তত ৮৮ জন খুন হয়েছে।
এসবই হয়েছে দুর্নীতি করার সুবিধা দখলে রাখার জন্য। গত পরশু (শনিবার) বগুড়ায় আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন শ্রমিক লীগের দুই সদস্য গুলিতে নিহত হয়েছে। সন্দেহ করা হচ্ছে, অপর সহযোগী সংগঠন স্বেচ্ছাসেবক লীগের লোকদের হাতে তারা খুন হয়েছে। নিহত ব্যক্তিদের পুলিশ অবশ্য সন্ত্রাসী হিসেবেই দেখত। এরা আসলে কেমন চরিত্রের মানুষ আর হত্যাকারীরাই-বা কী ধরনের লোক তা নিয়ে অনেক কথা হতে পারে কিন্তু মূল কথা হচ্ছে, রক্তপাত ও প্রাণ সংহার হয়েছে।
এমনকি নারীঘটিত ব্যাপার অন্যত্র এরকম খুনোখুনি হয়েছে। আর আওয়ামী লীগ ও তার প্রভাব বলয়ের মধ্যে এ ধরনের খুনাখুনি থামছেই না। এমনকি তা থামবার নয় বলেও ভয় হয়। তার কারণ, আমরা দেখতে পাচ্ছি যে বিভিন্ন অপরাধ ও অপকীর্তির সঙ্গে জড়িত যেসব লোক নিজেদের আওয়ামী লীগ সমর্থক বলে পরিচয় দিতে পারছে তারা আওয়ামী লীগের নেতাদের কাছ থেকে অনৈতিকভাবে সমর্থন পাচ্ছে। যেমন, পাবনায় চাকরির পরীক্ষা চলার সময় দুর্বৃত্তরা পরীক্ষা কেন্দ্রে হামলা চালিয়ে পরীক্ষা বন্ধ করে দেয়।
সরেজমিন উপস্থিত সরকারি কর্মকর্তারা হামলাকারীদের নেতাদের কয়েকজনকে ছাত্রলীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে চিনতে পেরে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছেন। আর সেখানকার দলীয় এমপিসহ আওয়ামী লীগ নেতারা সংবাদ সম্মেলন করে বলছেন, এসব মিথ্যা কথা। আগেই প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে বলে পরীক্ষার্থীরা নিজেরাই কেন্দ্রে ভাংচুর করে পরীক্ষা দিতে অস্বীকার করে। অপরাধ করে অপরাধীই অভিযোগকারীকে আসামি করার পুরনো কৌশলটি দেশজুড়ে আওয়ামী লীগপন্থীরা ইদানীং নিয়মিতভাবে ব্যবহার করছে বলে বিভিন্ন সংবাদে দেখছি। এ ধরনের আচরণে দেশে এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতি নেমে আসছে।
কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতারা এই অপ্রিয় সত্যটি মানতে রাজি নন। এতে জনগণের সমস্যা হচ্ছে, তারা নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ছে। একই সঙ্গে আরেক বিপদ হলো, উচ্চ পর্যায়ে আস্কারা পেয়ে বা উচ্চ পর্যায়ে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিদের তুষ্ট করতে বিশেষ ক্ষমতাপ্রাপ্ত কিছু সরকারি প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা সংবিধান এবং আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে ক্ষমতাসীনদের অপছন্দের লোকদের নানানভাবে বিপদে ফেলছে। ব্যবসায়িক জগতেও ভয়-ভীতি সংক্রমিত হওয়ার অভিযোগও নতুন করে উঠছে ইদানীং। ফলে দেশে অনিশ্চয়তা দেখা দিচ্ছে, যা বিদেশি পর্যবেক্ষকদের নজরেও পড়েছে।
এদিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বিশ্বের একজন নেতা বলে অভিহিত করেছেন। আমার মনে হয়, একথায় শেখ হাসিনার অবিলম্বে সাবধান হওয়া উচিত। কারণ গত শতকে দেখা গেছে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ব্যর্থ সরকারপ্রধানরা নিজের ঘরের যন্ত্রণা এড়াতে দুনিয়ার খবরদারি করতেন আর চাটুকাররা তাদের বিশ্বের নেতা বলে ঢোল পেটাতেন। মজার ব্যাপার হলো, দেশে বা বিদেশে খুব কম লোকই এমন অপপ্রচারে কান দিত। শেষকালটায় সেই শাসক সবার কৌতুকের পাত্রে পরিণত হতেন।
আমরা আন্তরিকভাবে আশা করি, শেখ হাসিনা এ ধরনের ফাঁদে পা দেবেন না।
[সূত্রঃ আমার দেশ, ২০/০৯/১০]
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।