বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম খবর দিয়েছে যে চাঁদপুরে মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের পুকুরে পরীক্ষামূলকভাবে চাষ করা ইলিশ পোনাগুলোর আকৃতি বেড়েছে। জাটকা থেকে পরিণত ইলিশে পরিণত হওয়ার পথে কয়েক মাস আগে ছাড়া পোনাগুলো। ইনস্টিটিউটের ইলিশ গবেষকরা নাকি ১৪ বছর ধরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এ সিদ্ধান্তে পৌছান যে বদ্ধ জলাশয়েও ইলিশের উৎপাদন সম্ভব। আমাদের মনে আছে, গত মে মাসে ইলিশের পোনা পুকুরে ছাড়ার খবর এ খবর দেশীয় সংবাদমাধ্যম তো বটেই, বিদেশেও বেশ মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল।
হৈ চৈ পরবারই কথা।
সন্দেহ নেই, এর আগেও পাঙ্গাসসহ নদীজীবি কয়েকটি মাছ পুকুরে চাষযোগ্য করে তোলার ক্ষেত্রে আমাদের গবেষকরা সাফল্য পেয়েছিলেন; কিন্তু ইলিশ বলে কথা। আমরা নদী থেকে ধরে আনলেও ইলিশ মহৃলত সামুদ্রিক মাছ। নেহায়েত ডিম ছাড়ার প্রয়োজনে সাগর ত্যাগ করে। কারণ ইলিশের ডিম ফোটার জন্য মিঠা পানি ও প্রবল স্রোত প্রয়োজন। এজন্য সাগরের ইলিশ স্রোতস্বিনীতে এসে ডিম ছাড়ে।
ইলিশের পোনা বা জাটকা নদীতেই বেড়ে ওঠে এবং এক পর্যায়ে, যখন উজানের ঘোলা পানি ভাটিতে গড়াতে থাকে, মাতৃ বা পিতৃভূমি সাগরে ফিরে যায়। ডিম ছাড়ার উপযোগী হলে আবার উজানে পাড়ি জমায়। সুতরাং সামুদ্রিক ইলিশকে পুকুরে বন্দী করার খবর তো সাড়া ফেলবেই।
অবশ্য যত সহজে খবর তৈরি করা সম্ভব হয়েছে, উৎপাদনের বিষয়টি তত সহজ হবে বলে মনে হয় না। হাজার হাজার বছর ধরে ইলিশ সাগর-নদীর সমন্বয়ে যে জীবনচক্র গড়ে তুলেছে, সেটাকে পুকুরের উপযোগী করা খুবই কঠিন।
যতটুকু বোঝা যাচ্ছে, ইলিশের ডিম ছাড়া ও বাচ্চা ফোটার কাজটি আগের মতোই থাকবে; নদী থেকে জাটকা ধরে এনে পুকুরে প্রতিপালন করা হবে। সেখান থেকে বাজার। বুদ্ধি মন্দ নয়। কেউ কেউ এ নিয়ে ‘পুকুরের ইলিশ’ সংক্রান্ত বহুল আলোচিত রসিকতাটির পুনরাবৃত্তিও করতে পারেন; কিন্তু নতুন উদ্যোগটি নিছক রসিকতার বিষয় নয়। নয় কেবল মৎস্য উৎপাদনের ব্যাপার।
প্রথমত, জাটকা থেকে আহরণযোগ্য ইলিশে পরিণত হতে মাছটিকে লোনা পানিতে বাস করতেই হবে। বদ্ধ জলায়শ বা পুকুরে কীভাবে লোনা পানি পাওয়া যাবে? উপকূলীয় অঞ্চলে চিংড়ি ঘের করার ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি বাইরে থেকে লোনা পানি ঢোকানো হয়েছে। এতে করে তথাকথিত সাদা সোনা পাওয়া গেছে বটে, ওই অঞ্চলে ভূমির বারটা বেজেছে। লবণাক্ত ভূমিতে আর কোন চাষাবাদ কঠিন হয়ে পড়েছে। ইলিশ চাষের ক্ষেত্রেও যদি পুকুরে লোনা পানি ঢোকানো হয়, তাহলে আমাদের জন্য অপক্ষা করছে আঠারো আনা বিপর্যয়।
দ্বিতীয়ত, সাগরের ইলিশকে পুকুরে টেনে আনার সঙ্গে প্রাণসম্পদ অধিকারের বিষয়টিও জড়িত। এ সংক্রান্ত বৈশ্বিক চুক্তি ট্রিপস-এ ভৌগলিকভাবে নির্দেশিত প্রাণ ও প্রক্রিয়া নিবন্ধনের সুযোগ রাখা হয়েছে। ইলিশ যদিও বঙ্গোপসাগর ও আশপাশের মাছ, গঙ্গা-যমুনা-মেঘনা নদীঅঞ্চলই এর মূল আহরণ কেন্দ্র। পদ্মার ইলিশকে এখনও শ্রেষ্ঠ মান্য করা হয়। ইলিশের সঙ্গে বাঙালির রসনার সম্পর্কটিও যেন অলিখিত প্যাটেন্ট হয়ে আছে।
এখন পুকুরে যদি চাষ করা সম্ভব হয়, তাহলে সেটা সারা বিশ্বের বদ্ধ জলাশয়েই স্থানান্তর সম্ভব। তাহলে বিশ্বখ্যাত মাছটির ওপর আমাদের অধিকার কি অক্ষুন্ন থাকবে? প্রাকৃতিক স্বাদ ও গুনের প্রশ্নটিতো থাকলোই।
তৃতীয়ত, প্রাকৃতিক সম্পদের বাণিজ্যিকীকরণের বিরোধীতা যারা করেন, ইলিশের পুকুরপ্রাপ্তি তাদের জন্যও নিঃসন্দেহে দুঃসংবাদ। এখনও ইলিশ বাজারজাত হয়, রফতানি হয়; কিন্তু এর সঙ্গে দফায় দফায় বিপুল জনগোষ্ঠীর জীবিকার নিশ্চয়তা থাকে। পুকুরে উৎপাদন সম্ভব হলে যে কোন জাতীয় বা বহুজাতিক কোম্পানি অনায়াসে নিজের ব্রান্ডের ইলিশ উৎপাদন করে বাজার দখলে নিয়ে নিতে পারবে।
ইলিশনির্ভর জনগোষ্ঠীর কী হবে?
চতুর্থত, জীববৈচিত্র্য শেকলে ইলিশের যে অবদান, মাছটিকে পুকুরে তোলা হলে তাই বা পূরণ হবে কী দিয়ে?
পুকুরে ইলিশ উৎপাদনের উদ্যোগের পেছনে নদীর নাব্যতা ও দূষণের কথা বলছেন গবেষকরা। কিন্তু সেজন্য নদীকে দহৃষণমুক্ত না করে বা নাব্যতা ফিরিয়ে না এনে খোদ ইলিশই সরিয়ে নেবার উদ্যোগ?
কী হাস্যকর!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।