সিঙ্গাপুরে চিকিৎসারত একজন ফ্লাইট লেফটেন্যান্টের জন্য ১৮ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী দুই কোটি টাকা অনুদান দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর যে কোনো মানবিক পদক্ষেপ অবশ্যই প্রশংসানীয়। তবুও এ ঘটনা কেন যেন বুকের ভেতর কুঠার আঘাত হানছে। দেশের জন্মের বেদনার সঙ্গে জড়িতদের অন্যতম জননেতা আবদুর রাজ্জাক কি নিদারুণ অর্থকষ্টে-অনাদরে লন্ডনের হাসপাতালে বিনা চিকিৎসায় চিরতরে বিদায় নিলেন। তার জন্য কই, কোটি কেন লাখ টাকাও জোটেনি।
আওয়ামী লীগের আরেক প্রবীণ নেতা জনাব আবদুল জলিল সিঙ্গাপুরে মারা গেলেন। তার তেমন আর্থিক কষ্ট না থাকলেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কোনো খোঁজ নেননি। আল্লাহ না করুন আমি অথবা আমার পরিবারের কেউ গুরুতর অসুস্থ হলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কি রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে কোনো কানাকড়ি খরচ করবেন? গত তিন বছরে আমার স্ত্রী দুইবার গুরুতর অসুস্থ হয়ে মাসাধিক হাসপাতালে কাটিয়েছে। আমিও গুরুতর অসুস্থ হয়ে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে এক মাস ছিলাম। কেউ কোনো খোঁজখবর নেননি।
তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী, ইচ্ছা করলেই যা খুশি তা করতে পারেন_ এটা ঠিক না। আজ না হোক কাল এসবের জবাব অবশ্যই তাকে দিতে হবে।
ফেলানী হত্যার বিচার নিয়ে ক'দিন হলো খুব আলোচনা হচ্ছে। আমাদের যে কি হয়েছে? বিএসএফের বিচার হচ্ছে বিএসএফের আদালতে। সেখানে কি বিচার হবে? লোকদেখানো কেউ দোষী হলেও বড়জোর দু-এক বছরের কোর্ট মার্শাল? শৃঙ্খলা বাহিনীর শাস্তি রাত-দিনে বছর।
দুই বছর জেল হলে এক বছর খেটেই খালাস। তা ছাড়া ভালো ব্যবহারের জন্য তিন ভাগের এক ভাগ মাফ। ফেলানীর বাপ-মা যত সাক্ষ্যই দিন আদালতের তো বেশি সাজা দেওয়ার ক্ষমতা নেই। ফেলানীর লাশ কাঁটাতারে ঝুলে থাকায় দুই কলম লিখেছিলাম। সেই থেকে ঢাকার ভারতীয় দূতাবাসে দাওয়াত বন্ধ।
যদিও ভারতের মহামান্য রাষ্ট্রপতি খবর দিয়ে পুরো পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছেন। মাননীয় মন্ত্রী এলে বাড়ি এসে খেয়ে যান। কিন্তু দূতাবাসের দাওয়াত পাই না। না পেলাম, আমার কথা আমি বলেই যাব। তাতে দাওয়াত পেলে পেলাম, না পেলে না পেলাম।
নেশা করে ছোট্ট মেয়ে তার মা-বাবাকে যখন অমন নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে তখন আইনশৃঙ্খলা থাকে কোথায়? সেও যদি পুলিশের লোক হয় সেক্ষেত্রে সরকারের দেশ চালানোর আর কি অধিকার থাকে? বোধশক্তি থাকলে কচুগাছের সঙ্গে গুটি সুতোয় ফাঁস নিয়ে মরা উচিত। সাংবাদিক সাগর-রুনি হত্যার দুই বছরেও কূলকিনারা হলো না। পুলিশ বাবা-মা হত্যার কূলকিনারা হতে আবার কত যুগ লাগবে কে জানে।
বজ্রকথনে '১৫ই আগস্ট এক মহাবিপর্যয়ের দিন' নামে নিয়মিত কলাম লিখেছিলাম। সেখানে প্রতিরোধ সংগ্রামীদের কথা বলতে গিয়ে কোম্পানি কমান্ডার সুকুমার, জিতেন ভৌমিক, কবির বেগ, দেলোয়ার হোসেন, শাহাদৎ হোসেন সুজা, হুমায়ুনের নাম লিখিনি।
প্রাসঙ্গিকও ছিল না। কিন্তু কি করে যে সখিপুরের আবদুল হালিম, লুৎফর রহমান, ফুফাতো ভাই শাহালম, বিশেষ করে নওশের আলী নসুর নাম বাদ পড়েছিল ভেবে পাই না। ধামরাইর শরিফ, সাভারের ফিরোজ কবির, ডা. শরিফুল, আলী আজম আলমগীর (আলম), দুলাল দে বিপ্লব এদের চেয়ে শেষ মুহূর্তে নসুর ভূমিকা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে গ্রেফতার হয়ে চান্দভূই ক্যাম্প ছাড়তে গিয়ে ভারতীয় জিপে ওঠার সময়ও নওশের আলী নসু নোটবই হাতে জাতীয় মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়কের প্রতি মুহূর্তের কাজ রেকর্ড করছিল। গাড়িতে উঠলে শেষ নোটখাতাটি আমার হাতে তুলে দিয়েছিল।
তাতে লেখা ছিল_ 'সর্বাধিনায়ক এইমাত্র গ্রেফতার হয়ে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের গাড়িতে আমাদের ক্যাম্প ত্যাগ করলেন। ' সেই নসুর কথা লেখা হয়নি। এটা একটা মারাত্দক ভুল। বয়সের কারণেই এমন বড় বড় ভুল হচ্ছে কিনা, নাকি বাসা ঠিকঠাক করার জন্য কাগজপত্র এলোমেলো থাকায় হচ্ছে বুঝতে পারছি না। শেষবার হেডকোয়ার্টারের অস্ত্রাগারের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় গাইবান্ধার ছোট্ট রফিক এটেনশন হয়ে এক অসাধারণ স্যালুট দিয়েছিল।
যোদ্ধা দলে সুন্দর স্যালুট দেওয়াই স্বাভাবিক। কারণ সারা দিন একজন আরেকজনকে স্যালুট দিতে হয়। যে কোনো সামরিক ছাউনিতে স্যালুট বাঙালির ডাল-ভাতের মতো। জীবনে কত হাজার লাখ স্যালুট পেয়েছি, এখনো পাই তার লেখাজোখা নেই। কিন্তু সেদিনের সেই স্যালুট আজো আমার চোখে ভাসে, হৃদয়ে গেঁথে আছে।
লেখাটির অবতারণা করেছিলাম সম্প্রতি বোন রেহানার এক সাক্ষাৎকারকে কেন্দ্র করে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এটা ওটা বলেন কিছু মনে করি না। সরকারপ্রধান হিসেবে তার অনেক বাধ্যবাধকতা। তেমন সৎ সাহস না থাকলে সত্য বলা কঠিন। কিন্তু বোন রেহানার তেমন বাধ্যবাধকতা কই? প্রাক্তন স্পিকার হুমায়ুন রশিদ চৌধুরীকে ফেরেস্তার সঙ্গে তুলনা করে, আমাদের কোনো পর্যায়েই না ফেলায় খুবই বিরক্ত লেগেছে।
ফেরেস্তাতুল্য জনাব হুমায়ুন রশিদ বঙ্গবন্ধু হত্যার পর জিয়াউর রহমানের চাকরি করেছেন, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মন্ত্রী ছিলেন। একে খন্দকার বীরউত্তম জিয়াউর রহমানের চাকরি করেছেন, এরশাদের মন্ত্রী ছিলেন, এখন মহাজোটের মন্ত্রী। আবুল মাল আবদুল মুহিত জিয়া-এরশাদকে ভেজে খেয়ে এখন মন্ত্রী। বঙ্গবন্ধুর চামড়া তুলে নিতে চেয়ে মতিয়া চৌধুরী মন্ত্রী। জাতির পিতাকে জুতার ফিতা বলে হাসানুল হক ইনু মন্ত্রী।
কতজনের কথা বলব? বঙ্গবন্ধুর হত্যার প্রতিবাদ-প্রতিরোধ শুধু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, রেহানা, জয়-পুতুলই করেনি, আরও অনেকেই করেছে, যারা তাদের অমূল্য প্রাণ দিয়েছে। তাদের সঙ্গে প্রতারণার প্রকৃতিই একদিন বিচার করবে। আমি শুধু মনে করিয়ে দিলাম মাত্র। জানি সত্য সব সময় গায়ে জ্বালা ধরায়। কিন্তু বড় হলে সত্য হজমের ক্ষমতা অর্জন করতে হয়।
ববি-টিউলিপ অথবা জয়-পুতুলের ছেলেমেয়েদের বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে ভূমিকা রাখার কথা বললাম না কারণ তখনো তারা জন্মায়নি। বলেছে জয়-পুতুলই ছিল তখন তার সময় কাটানোর প্রধান অবলম্বন। হতে পারে, ৬-৮ মাস রেহানা জয়-পুতুলের কাছে ছিল। কিন্তু তারপর জয়-পুতুলের চায়না ক্লে নিয়ে খেলায় যতক্ষণ সময় দিয়েছি তার শতভাগের এক ভাগও দিতে পারেনি। পান্ডারা রোডের বাড়ির নিচে বিকালে পুতুল যখন ছোটাছুটি করত, বাচ্চাদের সঙ্গে খেলত, আমি গেলে নড়তে দিত না।
চার-পাঁচ বছরের বাচ্চা কি করি? তার মন ভাঙতে পারতাম না। যতক্ষণ খেলত শত কাজ থাকলেও অপেক্ষা করতে হতো। খেলা শেষে ছুটে এসে মামা বলে যখন জড়িয়ে ধরত তখন ছোট্ট বাচ্চার স্পর্শে প্রবাসের শত দুঃখেও বুক জুড়িয়ে যেত। যেমনটা এখন কুশিমণি করে। সারা বাড়ি একদিকে কুশিমণি একাই একদিকে।
সে যা বলবে তা-ই হবে। গাড়ির ড্রাইভার, কম্পিউটার অপারেটর, গেটের দারোয়ান, কাজের ছেলে, কাজের মেয়ে, বাড়িঘর মেরামতের রড মিস্ত্রি, কাঠমিস্ত্রি, রাজমিস্ত্রি, জোগালি কারও রক্ষা নেই। কেউ কথা না শুনলেই চিৎকার, আব্বু... হোসেন কথা শুনে না, ফরিদ চাচ্চু কেমন করে, তুহিন দুষ্টামি করছে, আবদুল্লাহ চাচ্চু খেলে না_ এ রকম হাজারো অভিযোগ। অমন অভিযোগই জয়-পুতুলও দিলি্লতে করত। তখন রেহানা ধারেকাছেও ছিলেন না, ছিলেন লন্ডনে।
তবে ভাগিনা-ভাগনিকে অসম্ভব ভালোবাসতেন, এখনো বাসেন। মা-বাবার মধ্যে তর্ক হলে আমি গেলেই দুজন জড়িয়ে ধরে বলত, দেখ মামা, মা-বাবা অমন করলে, মন খারাপ করে থাকলে আমরা কি করব? যে কারণে দিলি্ল গেলে যত বেশি পারতাম ওদের সময় দিতাম। আমাকে পেলে প্রধানমন্ত্রী কি যে খুশি হতেন তা শুধু আল্লাহই জানেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মোটা কাচের চশমা পরতেন। চশমা খুলে কিছুই দেখতেন না।
একটু দূরে চশমা থাকলে খুঁজে পেতেন না। তাকে ২৪ ঘণ্টাই চোখে চশমা রাখতে হতো। মানে ঘুম ছাড়া সব সময় চশমা পরা। ঘুমের সময় হঠাৎ চশমা হাতছাড়া হলে নিজে খুঁজে পেতেন না। অনেক সময় অন্যকে খুঁজে দিতে হতো।
এখনো দিতে হয় কিনা জানি না। রান্না করতে গিয়ে অনেক সময় অসুবিধায় পড়তেন। একজন মানুষ হিসেবে দিলি্লর কষ্টের জীবন ছিল বাঙালি মা হিসেবে, বাঙালি বোন হিসেবে তার শ্রেষ্ঠ সময়। কামাল, জামাল, রাসেলকে হারিয়ে ভাই হিসেবে আমাকে অসম্ভব যত্ন করেছেন। মা-পাগল মানুষ ছিলাম আমি।
তিনি আমার ছোট না হলেও বয়সে মোটেই বেশি বড় হবেন না। তবুও তাকে মায়ের মতো দেখেছি। আমি দিলি্লর যে দিনগুলোর কথা বলছি তখন আমাদের বড় দুর্দিন ছিল। তাই কোনো কলুষতা, মলিনতা ছিল না। অর্থবিত্ত ছিল না তাই কোনো অভাবও ছিল না।
চিত্ত ছিল শ্রদ্ধা-ভক্তি-ভালোবাসা ও আন্তরিকতার ধনে ভরা। যখনই পান্ডারা রোডে গেছি একবারও না খেয়ে ফিরিনি।
১৫ আগস্ট বেলা ১টায় সহধর্মিণী নাসরীন ছেলেমেয়ে নিয়ে ঢাকার দিকে পাড়ি জমিয়েছিল। নিজে যখন গাড়িতে থাকি তখন তেমন চিন্তা হয় না। কিন্তু পরিবার-পরিজন যখনই গাড়িতে উঠে স্বস্তি পাই না।
গাড়ির চালক হোসেন, যীশু, মান্নান সবাই অভিজ্ঞ, ধীরস্থির। কেউ প্রায় ৪০ বছর ধরে আছে। কিন্তু তবু রাস্তাঘাটের অবস্থা দেখে একটা অস্বস্তি লেগেই থাকে। ঔরসজাত দীপ-কুঁড়ি বড় হয়েছে। কিন্তু আল্লাহর দান কুশিমণি বেশ ছোট।
বাইরে গেলে ওর কথা মন থেকে আড়াল করতে পারি না। আল্লাহর রহমতে ওরা সহিসালামতেই দুই-সোয়া দুই ঘণ্টায় ঢাকা পেঁৗছেছিল। কিন্তু ওর কয়েক ঘণ্টা পরেই শুরু হয়েছিল সেই মহাজট_ যা চলেছিল ৬০ থেকে ৭০ ঘণ্টা। মানুষের সে যে কি কষ্ট!
১৯৭১-এর ১৬ আগস্ট হানাদারদের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে ধলাপাড়ার মাকরাইয়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলাম। বাঁচার তেমন আশাই ছিল না।
আল্লাহর দয়ায় কেন বেঁচে আছি তা তিনিই জানেন। প্রতি বছরই মাকরাই যাই। কয়েক বছর আগে বিকল্প ধারার সভাপতি ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী, স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলক আ. স. ম. আবদুর রব, বিকল্প ধারা মহাসচিব মেজর (অব.) মান্নান গিয়েছিলেন। কয়েক লাখ লোক সমাগম হয়েছিল সেবার কিন্তু এবার যেতে পারিনি। কারণ পরম সুহৃদ মেজর (অব.) আবদুল মান্নানের মেয়ের আংটি বদল।
অন্তরের টানে যেতে বাধ্য হয়েছিলাম। মানুষের আন্তরিকতার যে কত শক্তি সেটি দুই-চারজন গরিব এবং দুই-একজন ধনবানের মধ্যে দেখেছি। তাদের মধ্যে মেজর (অব.) আবদুল মান্নান অন্যতম। এমনিতে ধনবানদের অনেককেই আমার ভালো লাগে না। কিন্তু কি করে যেন মেজর মান্নান সেই বেরিয়ারটা অতিক্রম করেছেন।
যতবার তার কাছে গেছি কখনো ছাড়তে চাননি। সময় নষ্ট হচ্ছে ভেবে উঠতে চাইলে উঠতে দেননি। প্রথম প্রথম মনে হতো লৌকিকতা করছেন। কিন্তু অনেক দিন দেখে দেখে সে ধারণা বদলে গেছে। এখন মনে হয় আমাকে পেলে সত্যিই তিনি বড় বেশি খুশি হন।
ব্যবসার ঝামেলা থেকে কিছু সময় অন্য চিন্তা করার সুযোগ পান। আমি আদার বেপারি জাহাজের খবর কিই-বা জানি। তারপরও মাঝে-মধ্যে নিজের কষ্টের কথা বলে হালকা হতে চেষ্টা করেন, সেটা সব ধরনের কথাই। আমারও বেশ ভালো লাগে। জীবনে কত কষ্ট করেছি, এখনো কত শঙ্কা, কত জ্বালায় থাকি।
কেউ হাত পাতলে ভরে দিতে পারি না, সে এক জ্বালা। যারা এক সময় হাত পেতে থাকত তারা এখন তাদের সম্পদের নিচে আমাদের কবর দিতে চায়। সে আরেক জ্বালা। ক্ষমতাবান কেউ কেউ এমন ব্যস্ততা দেখায় ফোন করলে ধরে না। আবার কখনো প্রয়োজন হলে ঘণ্টায় সাতবার ফোন করে বিরক্ত করে।
এসবের বাইরের মানুষ মেজর (অব.) আবদুল মান্নান। আগেই বলেছি ১৬ তারিখ আমার মরণদিন। তারপরও মেজর মান্নানের মেয়ের বিয়ের আংটি বদলে যোগ দিতে বেলা ২টায় টাঙ্গাইল থেকে রওনা হয়েছিলাম। ঢাকার রাস্তায় গাড়ি জমে থাকায় গোড়াই হয়ে না গিয়ে ভাতকুড়া, বাসাইল, সখিপুর, ভালুকা সিডস্টোরের রাস্তা ধরেছিলাম। গ্রামে প্রবাদ আছে, 'তাড়াতাড়ি যেতে চাও তো ঘুরে যাও'।
সেদিন সেই ঘুরা পথই ধরেছিলাম। কিন্তু তাতে তাড়াতাড়ি হয়েছিল কিনা বলতে পারব না। জয়দেবপুর চৌরাস্তায় সে কি ভিড়, দেড়-দুই কিলোমিটারে দুই ঘণ্টা লেগেছে। ৮টার দাওয়াতে ৯টা ৪০ মিনিটে সোনারগাঁও হোটেলের বলরুমে গিয়েছিলাম। খুব মার্জিত চমৎকার ব্যবস্থাপনা ছিল।
গেটে জাহাঙ্গীর, হলের দরজায় মেজর মান্নান দাঁড়িয়েছিলেন। বহুদিন পর তাকে বড় বেশি হাসি-খুশি মনে হচ্ছিল। তার তিন মেয়ে এক ছেলে। আমার দুই মেয়ে এক ছেলে। ১৬ তারিখই প্রথম মনে হলো, আমার মেয়ের বিয়ের দিন আমারও কি অমন হবে? হলে দেখলাম ১ নম্বর টেবিলে জনাব হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ।
পাশের টেবিলে ড. কামাল হোসেন, তার স্ত্রী ও প্রাক্তন জ্বালানিমন্ত্রী জেনারেল নুরউদ্দিন। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পাশে আমাদের বসানো হয়। ডানে কুশিমণি, তারপর তার মা নাসরীন। এরশাদ সাহেবের বামে এফবিসিসিআই'র প্রাক্তন সভাপতি ফরিদপুরের একে আজাদ। যার ফরিদপুরের সংবর্ধনা নিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিয়াই মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনের সঙ্গে বিরোধের কারণে জাতীয় দৈনিকের প্রথম পাতায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলের নেত্রীর চেয়ে বড় বড় ছবি ছাপায় বেশ আলোচিত।
অনুষ্ঠানের একপর্যায়ে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. ইউনূস এসেছিলেন। কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে তাকে এই প্রথম দেখলাম। হয়তো আরও অনেক অনুষ্ঠানে যান কিন্তু আমি দেখিনি। ড. কামাল হোসেন এবং জেনারেল নুরউদ্দিনের মাঝে বসেছিলেন। অধ্যাপক ইউনূস এবং ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে কথা বলে আমরা আগেই চলে এসেছিলাম।
আমাদেরও আগে জনাব এরশাদ চলে গিয়েছিলেন।
সেদিন আমার এক প্রিয় সাংবাদিক সাগর আনোয়ারের প্রশ্ন ছিল, কোনো বিদেশি রাষ্ট্র তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য বা ষড়যন্ত্র সফল করতে অধ্যাপক ইউনূসকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছেন কিনা? আমার বরাত দিয়ে সে উল্লেখ করেছে, 'যদি বিদেশি কোনো রাষ্ট্র ষড়যন্ত্র করে, তবে ড. ইউনূসকে দিয়ে লাভবান হবে না। অধ্যাপক ইউনূস ষড়যন্ত্রের মাধ্যম হওয়ার উপযুক্ত নন। এমনটাই মনে করেন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি ও মুক্তিযুদ্ধের কাদেরিয়া বাহিনীর সর্বাধিনায়ক বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী। ' আসলে অধ্যাপক ইউনূসকে আগে কখনো ঝেঁকে দেখিনি, অধ্যয়ন করিনি।
গ্রামীণ ব্যাংকের ঘটনায় তাকে পরতে পরতে উল্টে-পাল্টে দেখার চেষ্টা করেছি। আমারও এক সময় মনে হয়েছিল ঘুষ টুষ দিয়ে নোবেল পেয়েছেন। কিন্তু নাড়াচাড়া করে উপলব্ধি হয়েছে, কেউ তাকে দয়া করে নোবেল দেয়নি। তার যোগ্যতাকে সম্মান জানাতে নোবেল কমিটি বাধ্য হয়েছে। আর বিদেশি রাষ্ট্রের কোনো এজেন্ডার বাহন হওয়ার মতো চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তার নেই।
সাদাসিধা, খোলামেলা নিরহংকার একজন খাঁটি বাঙালি তিনি। তার মধ্যে দেশপ্রেমের যে স্ফুরণ আমি দেখেছি অমন মানুষ অন্যের উদ্দেশ্য সাধনের বাহন হতে পারে না। তাই ওকথা বলেছি, অধ্যাপক ইউনূসকে জাতীয়ভাবেই আমাদের আরও সম্মান করা উচিত। তাকে আর বিব্রত করা উচিত নয়। তার মেধাকে কাজে লাগালে জাতি উপকৃত হবে।
জাতীয় এই কল্যাণব্রতী মানুষটাকে নাজেহাল করতে গিয়ে আমরাই বড় বেশি নাজেহাল ও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। ক্ষমতাসীনদের কবে উপলব্ধি হবে? তবে যত তাড়াতাড়ি হবে ততই দেশের কল্যাণ বা মঙ্গল।
মহাজোট সরকারের এটাই ছিল সরকারিভাবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর শেষ শোক পালন। তারা আর সরকারিভাবে শোক পালন করতে পারবে কিনা ভবিতব্যই জানে। তবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রীয় শোক পালনে দলাদলির কোনো মানে হয় না।
যারা অমন করবেন তাদের মহাকালের কলঙ্ক অবশ্যই গ্রাস করবে। কারণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কালোত্তীর্ণ বাংলার জনগণ তথা বিশ্বের নিপীড়িত মানবতার অগ্রদূত। নিপীড়িত-নির্যাতিত মানুষের বন্ধু। আমরা তাকে বঙ্গবন্ধু বললেও তিনি তার আপন মহিমায় মানবতার বন্ধু, বিশ্ব বন্ধু। কিন্তু অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করলাম আওয়ামী লীগ এবং অঙ্গ সংগঠন ছাড়া ১৫ আগস্টে মহাজোটের অন্য শরিকদের কোনো উচ্চবাচ্য দেখা গেল না।
কেমন যেন কোছ কাটা ছুরির মতো সবাই লুকিয়েছিল।
বছর আড়াই আগে প্রধান বিরোধী দলের নেতা বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে দুই ঘণ্টার একটু কম একান্তে আলোচনা হয়েছিল। চারদলীয় জোটের শক্তি বৃদ্ধির জন্য তাদের আমাকে দরকার। ওরকম আওয়ামীদেরও আমাকে চাই। আলোচনার এক পর্যায়ে বলেছিলাম, স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত সঙ্গে থাকলে আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
তাছাড়া যৌবনে প্রেম করিনি, বঙ্গবন্ধুকে ভালো বেসেছিলাম, না চাইতেই তার সঙ্গে একটা প্রেমের অনুভূতির মিশ্রণ ঘটেছে। জীবিত মুজিবের চেয়ে মৃত মুজিব বেশি হৃদয়জুড়ে আছে। বিধবার সাজ না ধরলেও আমার অন্তরাত্দাজুড়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। আপনার জোটের নেতারা তাকে নিয়ে যখন তখন যা খুশি তা বললে আমার পক্ষে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করা সম্ভব হবে না। তাছাড়া ১৫ আগস্ট শোকে আমরা যখন মুহ্যমান, জাতির মহারক্তক্ষরণের ক্ষণে আপনার শুভ জন্মদিন, বড় নিষ্ঠুরভাবে হৃদয়ে বাজে।
তাই ওটা থেকে বিরত হতে হবে। তিনি বলেছিলেন, অমন একজন মহান নেতার নির্মম মৃত্যুদিনে ঘটা করে জন্মদিন পালনে আমিও উৎসাহী নই। কিন্তু কি করব, দশের চক্রে ভগবান ভূতের মতো অবস্থা। দলীয় নেতা-কর্মীরা করে, দেশের যে রাজনৈতিক অবস্থা তাদের ফিরাই কি করে? তবে আপনার কথা মনে রাখব। জানি না কতটা মনে রেখেছেন।
কিন্তু পরের বছর তিনি জন্মদিন পালন করেননি। জন্মদিনে সৌদি আরব ছিলেন। গত বছর ছিল মাহে রমজান। এ বছরও নিজে কেক কাটেননি, দলের নেতারা কেটেছেন। জানি না তার নিজের কেক না কাটা বা তাতে অংশ না নেওয়া শ্রদ্ধা নাকি কৌশল।
তবে আওয়ামী লীগের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। তারা বলেছে, যারা বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর দিনে ঘটা করে জন্মদিন পালন করে, আনন্দ-ফুর্তি করে তাদের সঙ্গে আবার সমঝোতা কিসের। তাহলে কোনো আওয়ামী নেতার ১৫ আগস্ট বাচ্চাকাচ্চা হলে গলা টিপে মেরে ফেলবে না তো? শুধু ছোটখাটো নেতারা বলেননি, স্বয়ং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও বলেছেন। দেখাই যাক কত ধানে কত চাল। এসবে নতুন করে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
মহামান্য হাইকোর্ট জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ করেছে, বেগম জিয়া জন্মদিনে নিজে কেক কাটেননি, এতে কি তাদের সঙ্গে আমাদের মিশে যাওয়ার পথ খুলে যাচ্ছে? আবার আওয়ামীরা স্বাধীনতার পক্ষ বলে রাতে যোগাযোগ করছে। সময় বড় নিয়ামক।
সময়ের এক ঘা অসময়ের শত ঘা সমান। বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী পবিত্র সংসদে বলেছেন, তিনি আর নির্বাচন করবেন না। না করলে যাওয়ার সময় সাধারণ মানুষের তবু একটু সম্মান পেয়ে যাবেন।
আর নেত্রীর কথায় যদি নির্বাচন করেন লোকজন বলবে, মদখোরের 'রাত কি বাত, বাত কি বাত'। মানে নেশার ঘোরে রাতের কথা কথার কথা, কোনো মূল্য নেই। আওয়ামী নেতাদেরও কথার কোনো মূল্য নেই। বেগম খালেদা জিয়া নিজে কেক কাটেননি, তাই এমন চিৎকার। কোনো সমঝোতা করবেন না।
নিজে কেক কেটে ঘটা করে জন্মদিন পালন করলে মনে হয় সব নেতা আত্দহত্যা করতেন। কোনো সমঝোতা না হলে কার ক্ষতি? সব থেকে বেশি দেশের। তারপরই তো আওয়ামীপন্থিদের। কথাটা একটু হৃদয়ঙ্গম করতে চেষ্টা করবেন। আর জিয়াউর রহমানের নিহত হওয়ার দিনে আওয়ামীদেরও কি এবং কেমন করা উচিত সেটাও ভাবার মনে হয় সময় এসেছে...।
লেখক : রাজনীতিক।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।