আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সংবিধানে স্বাস্থ্য অধিকারের স্বীকৃতি চাই



এস.এম.সৈকত মানবাধিকারর্কমী ও নির্বাহী পরিচালক সিরাক-বাংলাদেশ ‘স্বাস্থ্যসেবা’ আমাদের অধিকার। এমন দাবি অনেকদিন ধরে দেশের মানবাধিকার ও উন্নয়নকর্মীরা জানিয়ে আসছেন। এই দাবির সাথে কতটুকু একাত্ম হতে পারা সম্ভব তা বলা দুষ্কর। এই কারনেই যে, যে দেশের মূল চালিকাশক্তি ‘সংবিধান’ সেখানে উক্ত বিষয়টি কি অবস্থানে স্থাপিত তা না জেনে সুস্পষ্ট মত প্রকাশ না করাই আমার মতো সাধারণের উচিত। আমরা যারা বিভিন্ন দিক থেকে স্বাস্থ্যকে অধিকার হিসেবে দাবি জানিয়ে আন্দোলন, সমাবেশ, মানববন্ধন, র‌্যালি, সভা করে আসছি তাদের প্রায় সকলেই জানি যে, স্বাস্থ্যসেবাকে সংবিধানে মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে নয় বরং মৌলিক চাহিদা হিসেবে স্থান দেয়া হয়েছে।

প্রসঙ্গতঃ মৌলিক চাহিদা আর মৌলিক অধিকারের মধ্যে কি পার্থক্য? এ প্রশ্নটি অনেকের মত আমার মনেও উদয় হয়েছে। বেশ কিছু আইনী পুস্তক ঘেটে জানতে পারি- বাংলাদেশের সংবিধানের যে অংশে (২য় ভাগে) মৌলিক চাহিদাসমূহের (অনুচ্ছেদ ১৫) বর্ণনা করা হয়েছে তা প্রকৃতপক্ষে ‘রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি’। আর আইনসিদ্ধ ব্যাখ্যা হল-এই ধরনের নীতিসমূহ আদালত কর্তৃক বলবৎযোগ্য নয়। কারনও বেশ জোড়ালো- মূলনীতি হল রাষ্ট্রের গোড়াপত্তনকারী জনগণের ভাবতান্ত্রিক আদর্শ এবং আদর্শের সাথে আইনী যুক্তির বেশ খানিকটা মৌলিক ব্যবধান রয়েছে। আর ‘অধিকার’ কথাটি মানবাধিকারেরই একটি রূপ।

মুখ্য কারনে সংবিধান হয় মানুষের প্রয়োজনকেন্দ্রিক। সংজ্ঞায়নে জানা যায় মানুষ তার জন্মের সাথে সাথে যে সকল প্রাকৃতিক স্বাধীনতাজনিত অধিকার প্রাপ্ত হয় তা-ই ‘মানবাধিকার’। তাহলে সেই আলোতে আমাদের দেশের মহান সংবিধানে অধিকারকে কি রূপে স্থান দেয়া হয়েছে তা দেখা জরুরী। যেহেতু প্রবন্ধটি স্বাস্থ্য অধিকার সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি আর মৌলিক অধিকারের মধ্যে বিশ্লেষণধর্মী তাই সংবিধানের সকল অংশের উপর আলোচনা করা আমার পক্ষে নিতান্তই ধৃষ্টতার শামিল বলে মনে করছি। তথাপি, প্রয়োজন সাপেক্ষে ২য় ও ৩য় ভাগ এর বাইরে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অনুচ্ছেদের অবতারনা করার অধিকার রাষ্ট্রের একজন নাগরিক হিসেবে আমিও সংরক্ষণ করি বটে।

প্রথমেই দেখা যাক, ২য় ভাগ অর্থাৎ মূলনীতি সমূহের অবস্থান। আমাদের সংবিধানে স্থানীয় সরকারের উন্নয়ন, নারীর সুযোগ সৃষ্টি, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের চর্চা, মালিকানা নীতি , কৃষক-শ্রমিক শোষন মুক্তি, মৌলিক চাহিদা (অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসা) এছাড়াও কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা, বিশ্রাম-বিনোদন, অবকাশ, সামাজিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা, গ্রামীন উন্নয়ন, অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষার ব্যবস্থা, জনস্বাস্থ্য এবং নৈতিকতা, সকল নাগরিকের জন্য সমসুযোগ, প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীর কর্তব্যসহ বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ ইত্যাদি বিষয় স্থান পেয়েছে। এদিকে সংবিধানের ৩য় ভাগের বিষয়বস্তু মৌলিক অধিকার। এ অংশের উল্লেখযোগ্য বিষয়ের মধ্যে আইনের দৃষ্টিতে সমতা, বৈষম্য দূরীকরণ, আইনের শাসন, চলাফেরার স্বাধীনতা, চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা, বাক-স্বাধীনতা, সমাবেশ-সংগঠনের স্বাধীনতা, ধর্মের স্বাধীনতা সহ সম্পত্তির অধিকার প্রভৃতি বিষয়গুলো স্থান পেয়েছে। দুটি অংশের বিষয়বস্তুর গুরুত্বানুসারে যেকোন আইনজ্ঞ নিঃসন্দেহে সমর্থন দেবেন যে, নাগরিকের স্বাস্থ্যসেবা আর কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা সম পর্যায়ের গুরুত্ব বহন করে না।

বরং গুরুত্বের স্কেলে স্বাস্থ্যসেবা সম্পত্তির অধিকারের মতো মৌলিক অধিকারেরও অনেকখানি উপরে স্থান পায়। তবে কি কারনে এই অসামঞ্জস্য করা হলো সংবিধানে? ১৯৭১ সালের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর একটি সদ্য স্বাধীন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের প্রতিটি অংশে যখন অনাহার, অভাব, ভেঙ্গে পড়া প্রশাসন, রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতিটি অংশে হাহাকার চলছে তখন লিখিত একটি গাইড প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল রাষ্ট্রকে রার জন্য। সেই গাইড বইটিই আমাদের আজকের এই সংবিধান। সেদিন স্বাধীন দেশের জনগণের আকাঙ্খাকে রূপ দেয়া হয় সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে। যা দিয়ে দেশ চালাবে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত গণতান্ত্রিক একটি সরকার।

সংকীর্ণ সুযোগ আর সীমাবদ্ধতার সেই যুগে দেশের প্রতিটি নাগরিকের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়ত ছিলনা। কিন্তু তৎকালীন প্রেক্ষিত আর আজকের পরিস্থিতি এক নয়। বাংলাদেশ এখন আর কোন শিশু রাষ্ট্র নয়, বিশ্বায়নের এই যুগে বাংলাদেশ শক্তিশালী স্থান করেছে পৃথিবীর শ্রম বাজারে, এখানে উন্নয়নের মাইলফলক স্থাপন করা হয় প্রতি মাসে। তাহলে বাংলাদেশ নামক এই রাষ্ট্র এখন তার নাগরিকের কাছে কি জবাব দেবে, যে ৩৯ বছরেও স্বাস্থ্যসেবাকে জনগণের দোড়গোড়ায় পৌছে দেয়া সম্ভব নয় ! তাহলে এ খাতে সকল সরকারের অর্জন আজ প্রশ্নের সম্মুখীন হবে। ফিরে দেখা প্রয়োজন হবে বর্তমানসহ স্বাধীনতা উত্তর বিগত সবগুলি সরকার কোন নীতিতে স্বাস্থ্যসেবা খাতকে পরিচালনা করেছে।

তাদের তথাকথিত অর্জন গুলোকে বিশ্লেষন করতে হবে সংবিধানের মূলনীতিগুলোর আলোকে। পূর্ববর্তী আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এ বিষয়টি পরিস্কার যে, মৌলিক অধিকার সমূহের আইনী প্রতিবিধান রয়েছে। তাহলে একটি প্রশ্ন দেখা দেয়, তবে কি এর বাইরে কোন কিছু অধিকার নয়? সেগুলো কি বাস্তবায়ন সম্ভব নয়? আইনী যুক্তি হল- অবশ্যই সম্ভব। উপরোক্ত তালিকাভূক্ত অধিকারের সাথে সংশ্লিষ্ট অথবা একই প্রকৃতির এবং এগুলোর প্রান্তিক অধিকার গুলোকেও স্বীকৃতি প্রদান করা যাবে। সে হিসেবে বলা যায়- যেহেতু ২৮ অনুচ্ছেদে সর্ব প্রকার বৈষম্য হতে রার অধিকার রয়েছে নাগরিকের, সেহেতু যদি চিকিৎসার অভাবে রাষ্ট্রের দরিদ্র শ্রেণীর মানুষ মারা যায়, আর অর্থের বলে বিত্তশালী নাগরিক সেই সুবিধা পায় তবে তা স্পষ্ট বৈষম্যের উদাহরন।

আর এধরনের বৈষম্য দূরীকরণে রাষ্ট্র এ ধরনের সুবিধাকে অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিতে পারে। যাতে করে ঐ সুবিধাবঞ্চিত জনগণের প্রতি বৈষম্য নিরসন হয়। কিন্তু এসব কথা বাস্তবায়ন করা অতটা সোজা না। কারন ঐ দরিদ্র শ্রেণীর মানুষ হাইকোর্টে এসে সিনিয়র উকিল বা ব্যারিস্টার এর মোটা অংকের ফিস দিয়ে মাননীয় আদালতের কাছে এই বিষয়ে একখানা রিট দায়ের করার মতা রাখেন না। উল্টোটা সবারই জানা।

এখানেও অর্থেরই দাপট। হ্যা, কিছু সংগঠন রয়েছে যারা নাগরিক অধিকার সম্পর্কিত এ ধরনের রিট দায়ের করে থাকে। আফসোসের কথা হল- আইনের দেবতার মতো তারাও যেন চোখে কালো ফিতা বেঁধে রেখেছেন। নইলে অতদিনেও আন্দোলন করেও আমরা কেন স্বাস্থ্যকে অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি পাইনি ! যাহোক। প্রবাদ আছে- যা আইন পারে না, তা আইন প্রণেতারা পারেন।

এ বিষয়ে আমাদের এখানে নেতিবাচক উদাহরন-ই বেশী, তাই অভ্যন্তরে না গিয়ে বলতে চাই, কিছুদিন যাবৎ বর্তমান সরকারের আইন প্রণেতাদের সংবিধান সংশোধনের উৎসাহ বেশ প্রবল বলে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। রাজনীতি দেশের জন্য অপরিহার্য একটি বিষয়, আমি সুস্থ এবং উদার রাজনৈতিক চর্চার পক্ষে তাই বর্তমান রাজনীতির অভ্যন্তরে না গিয়েই বলি যেহেতু সংখ্যাগরিষ্টের মতামতের গণতন্ত্র জে. বেনথামের উপযোগবাদকে পুরোপুরি সমর্থন দেয় কিন্তু পাশাপাশি সংখ্যালঘুর স্বার্থকে জলাঞ্জলি দেয়ার কারনে হয় সমভাবে সমালোচিত। আমাদের জাতীয় সংসদের পরিস্থিতিও এখন সমালোচনার ঠিক এ অবস্থানেই। এখন যেহেতু সংবিধান সংশোধন হবেই-তো নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় সংবিধানে স্বাস্থ্যকে মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে ২য় ভাগ থেকে ৩য় ভাগে স্থানান্তর করতে হবে। অন্যথায় যতোই দেশের প্রয়াত মহান নেতাদের নাম ভাঙ্গানো বচন আর মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দোহাই দেয়া হোক না কেন- স্বাস্থ্যসেবা খাতে সাধারণ মানুষের উন্নয়ন হবে না বিন্দুমাত্র।

পরিশেষে একজন নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্র পরিচালকদের নিকট একটিই আর্জি নাগরিকের স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করুন, নইলে সংবিধানের যেকোন সংশোধনী প্রশ্নের সম্মুখীন হবে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.