একটি স্বাধীন দেশের মানুষ কতটা স্বাধীনতা ভোগ করছে তা যদি কেউ পরিমাপ করতে চায় , তবে সে দেশের মানুষ কতটা বাকস্বাধীনতা ভোগ করছে তা পর্যবেক্ষন করলেই বুঝতে পারবে । গনতান্ত্রিক মোড়কে যে সকল দেশ পরিচালিত হয় , তার প্রধান লক্ষনীয় বিষয় বাকস্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ না করা । কেননা গনতন্ত্র অবাধ বাকস্বাধীনতার উপর গুরুত্বারোপ করে । বিশ্বের যে সকল দেশ গনতান্ত্রিক কাঠামোতে পরিচালিত হয় সে সকল দেশসমূহের মধ্যে , সিংহ ভাগ দেশেই লিখিত সংবিধান আছে । প্রত্যেক দেশের সংবিধানেই বাকস্বাধীনতার বিষয়কে স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয়েছে ।
স্বাধীনতা বলতে সব কাজের ব্যাপারে অবাধ স্বাধীনতার স্বীকৃতি না দিলেও গুরুত্বপূর্ন এবং যোক্তিক বিষয়ের স্বাধীনতা দেয়াকে বুঝায় । তবে স্বাধীনতা ভোগ কারীকেও খেয়াল রাখতে হবে , নিজে স্বাধীনতা ভোগ করার মানে অন্যের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা নয় । অর্থ্যাৎ অন্যের অধিকারভূ্ক্ত কোন কর্মকান্ডের উপর অনৈতিক হস্তক্ষেপ করে নিজে প্রবৃত্তির আবরনে ইচ্ছামত চলার নাম স্বাধীনতা নয় । স্বাধীনতার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে পাকিস্তানের জনক কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলেছেন “স্বাধীনতার অর্থ উশৃঙ্খলতা নয় । স্বাধীনতার অর্থ এটা নয় যে , জনসাধারণ ও রাষ্ট্রীয় স্বার্থের কোন পরওয়া না করে আপনার যা খুশি তা করবেন ।
বাক স্বাধীনতার গুরুত্ব বুঝাতে গিয়ে জর্জ বেকন বলেন , “বাকস্বাধীনতাই সকল প্রকার স্বাধীনতাকে আমন্ত্রন জানায় , সক্রিয় করে তোলে এবং মানুষকে নতুন জ্ঞানে সমৃদ্ধশালী করে তোলে” ।
অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশকে পরিচালিত করার মূল সনদ , বাংলাদেশ সংবিধানেও বাকস্বাধীনতার বিষয়টিকে অত্যন্ত স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয়েছে । বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ নং ধারার ১ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে “ চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তাদান করা হইল”। ৩৯ নং ধারার ২ নং অনুচ্ছেদের (ক) এবং (খ) তে বলা হয়েছে “প্রত্যেক নাগরিকের বাক্ ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের ও সংবাদপক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল”।
সংবিধান বাকস্বাধীনতার আলোচনায় কোন প্রকার অস্পষ্টতা ব্যতীরেকেই বাকস্বাধীনতার স্বীকৃতি দিয়েছে ।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের শাসনামলে ড. কামাল হোসেনকে প্রধান করে মোট ৩৪ সদস্য বিশিষ্ট সংবিধান প্রনয়ন কমিটি গঠন করা হয় । এ কমিটি ব্যাপক গবেষণার মাধ্যমে সর্বমোট ৯৩ টি বৈঠকে মিলিতে হয়ে বাংলাদেশকে পরিচালিত করার জন্য সংবিধানের চুড়ান্ত কপি রচনা করেন । অবশেষে ১৯৭২ সালের ৪ঠা নভেম্বর গনপরিষদ সদস্যদের তুমুল করতালি ও হর্ষধ্বনির মাধ্যমে বাংলাদেশের সংবিধান পাশ হয়ে গৃহীত হয় । সংবিধান প্রনয়নের সূচনালগ্নেই বাকস্বাধীনতার বিষয়টিকে নিশ্চিত করা হয় । বাংলাদেশের সংবিধান স্বাধীনতা পরবর্তী ৪২ বছরে সর্বমোট ১৫ বার সংশোধন করা হলেও বাকস্বাধীনতার ক্ষেত্রে কোন প্রকার হস্তক্ষেপ হয় নি ।
৯০ এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে সাবেক স্বৈর-শাসক হোসাইন মোহাম্মদ এরশাদের শাসনামলে বাকস্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার উপরে নগ্ন হস্তক্ষেপ করা হয় । যার কারনে পরবর্তী সময়ে তার পতনে মিডিয়ার ভূমিকা অনস্বীকার্য ভাবেই প্রমাণ হয় । পরবর্তী সময়ে এরশাদ সাহেব তার কৃত ভূলের জন্য নানা ভাবে অনুশোচনা করেছেন । কিন্তু সময়ের কাজ সময়ে না করলে যা হয় সে রকম এক ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে এরশাদ সাহেবের গোটা জীবন কাটাতে হচ্ছে । এখনও সাংবাদিকরা এরশাদ সাহেবের সাথে সম্পর্কিত কোন সংবাদ প্রকাশের সময়ে নানা প্রকার কটুক্তিমূলক শব্দ প্রয়োগ করেন ।
বাকস্বাধীনতাকে হরন করার অতীতের সকল রেকর্ড ভেঙ্গে দূর্বার গতিতে এগিয়ে চলছে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিত সরকার । তাদের বিরুদ্ধ ভাবাপন্ন প্রায় সকল মিডিয়াকে বন্ধ করে দিয়েছে । এ সকল মিডিয়ার সাথে জড়িত সকল ব্যক্তিবর্গকে হয়রানির মধ্যে রাখা হয়েছে । বিশিষ্ট জনেরা বলেছেন , বঙ্গবন্ধু প্রবর্তিত বাকশাল প্রতিষ্ঠা কালীন সময়ের চেয়েও বর্তমান সময় খারাপ যাচ্ছে । বঙ্গবন্ধু ঘোষনা দিয়ে বাকশাল ( বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক জনতালীগ) প্রতিষ্ঠা করলেও তার কন্যার তত্ত্ববধানে পরিচালিত সরকার ব্যবস্থা অঘোষিত ভাবে বাকশাল প্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছে ।
তারই ধারাবাহিকতায় বর্তমান শাসনামলে তাদের বিরুদ্ধবাদী কোন ব্যক্তি বা মিডিয়াকে স্বাভাবিক ভাবে কথা বলতে বা খবর সম্প্রচার করতে দেয় নি ।
সাংবাদিকতার অঙ্গনে পরিচিত যুগল সাগর এবং রুনিকে হত্যা করা হয় আওয়ামী সরকারের শাসনামলের মাঝামঝি সময়ে । তাদের হত্যা করার পর সরকার বিভিন্ন মেয়াদের আল্টিমেটাম দিলেও খুনীদেরকে শনাক্ত করতে পারে নি । সাগর-রুনির হ্ত্যার বিচার চেয়ে তার সহকর্মী সহ সকল সাংবাদিক নেতাকর্মীরা বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করেছে । তাতেও কোন ফল পাওয়া যায় নি ।
সময়ের সাহসী লেখক মাহমুদুর রহমান বাংলাদেশের একটি পরিচিত নাম । তার সম্পাদিত “আমার দেশ ” পত্রিকাটি একটি জনপ্রিয় বহুল প্রচারিত পত্রিকা ছিল । আওয়ামী সরকারের নানামূখী গঠনমূলক সমালোচনার জন্য এ প্রত্রিকাটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল । আমার দেশ পত্রিকাকে এদেশের মানুষ সত্যের প্রকাশক হিসেবে চিনত । এই জনপ্রিয়তার প্রতি হিংসাপরায়ন হয়ে সরকার কয়েক দফা এ পত্রিকাটিকে বন্ধ করে এবং মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে কতগুলো অমূলক , অসত্য অভিযোগ তুলে তাকে গ্রেফতার করে অমানুষিক নির্যাতন করে ।
তবে কিছুদিন আটক রাখার পর মাহমুদুর রহমান মুক্তি পেয়েছিলেন । কয়েক দিন বন্ধ থেকে পত্রিকাও আবার প্রকাশ হয়েছিল । কিন্তু গত মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময়ে অর্থ আত্মসাতের দায়ে মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করে তার সাহসী কলমকে আজ পর্যন্ত বন্ধ রাখা হয়েছে । দিনের পর দিন তাকে রিমান্ডে নিয়ে অমানুষিক অত্যাচার করা হয়েছে । মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করার পর গোপনে একদিন আমার দেশ পত্রিকা বের হয়েছিল ।
তারপর থেকে আমার দেশ পত্রিকাটিকে বন্ধ করে রাখা হয়েছে ।
ইনকিলাব পত্রিকার সম্পাদক স্বভাবগত ভাবেই বহুরুপী মানুষ । গত পাঁচ বছরের প্রায় পুরোটা সময়েই তিনি আওয়ামী সরকারের অন্ধভাবে গুনকীর্তন করেছেন । সরকার ক্ষমতা ছাড়ার আগ মূহুর্তে তিনি সরকারের সাথে বিবাদে জড়িয়ে পড়েন । অতীতের কোন গুনকীর্তন এবার আর কাজে আসে নি ।
তার বিরুদ্ধেও গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হল । তবে দৈব কোন কারনে সম্পাদক সাহেব এখনও গ্রেফতার হননি । এম এম বাহাউদ্দিন সাহেবর সাথে ঘটিত ঘটনাও বাকস্বাধীনতার বিরুদ্ধে বজ্রাঘাতের প্রমান দেয় ।
বাংলাদেশের মানুষের আয়না ছিল দিগন্ত এবং ইসলামিক টেলিভিশন । গত এপ্রিল মাসের ৫ তারিখ রাতে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ , শাপলা চত্ত্বরে অবস্থান করে ।
সরকার হেফাজতের এ সমাবেশকে তাদের জন্য হুমকি মনে করে ভোর রাতে অবস্থানরতদের উপর আক্রমন চালায় । সরকারের নিষেধকে উপেক্ষা করে দিগন্ত টেলিভিশনের সাংবাদিকরা সে সকল নারকীয় দৃশ্য ধারন করে । সরকার চিন্তিতি হয়ে পড়ে । অবশেষে ফজরের আজানের পর-পর যৌথ বাহীনি দিয়ে তল্লাসীর নামে দিগন্ত টেলিভিশন কার্যালয়ে ভাংচুর ও লুটপাট চালায় । বন্ধ করে দেয় টেলিভিশনটির সম্প্রচার ।
দিগন্ত টেলিভিশন বন্ধ করার রাতেই বন্ধ করে দেয়া হয় ইসলামিক টেলিভিশনের সম্প্রচারও ।
বাংলাদেশের একটি অন্যতম মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’ । এর পরিচালক আদিলুর রহমান শুভ্র একজন অবসর প্রাপ্ত আর্মির অফিসার । এই আদিলূর রহমানকেও কিছু দিন আগে গ্রেফতার করা হয় । তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হয় , তিনি ভিত্তিহীন তথ্য দিয়ে জনমনে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন ।
গ্রেফতার হওয়ার আগে আদিলুর রহমান শুভ্র , এপ্রিল মাসে হেফাজতের সে সকল ব্যক্তিকে হত্যা করা হয় তার মধ্য থেকে ২০১ জনের পূর্ন পরিচয় প্রকাশ করেন। হেফাজতের সমাবেশে আক্রমন করার পর সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছিল এতে একজন লোকও নিহত হয়নি । সরকারের দাবীকে মিথ্যা প্রমান করার কারনে আদিলুর রহমান শুভ্রকে দিনের পর দিন রিমান্ডে রাখা হয়েছে । অধিকার অফিসে তল্লাসীর অযুহাতে তছনছ করা হয়েছে ।
সাম্প্রতিক সময়ের অত্যন্ত আলোচিত ঘটনা হল মাহমুদুর রহমান মান্নার উপরে নিষেধাজ্ঞা ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রলীগের পর-পর দুইবারের সভাপতির উপর কেন এই নিষেধাজ্ঞা ? মাহমুদুর রহমান মান্না চ্যানেল টুয়েন্টি ফোরের একটি টকশোর আলোচক ছিল । কিন্তু সরকারের কর্মকান্ডের সমালোচনা করার কারনে তাকেও নানা ভাবে হেনস্তা হতে হচ্ছে । এছাড়াও স্কাইপি কেলেংকারী প্রকাশ করার অপরাধে আমার দেশের পত্রিকার সিনিয়র সাংবাদিক অলিউল্লাহ নোমানকে দেশান্তরীণ হতে হয়েছে । বিশিষ্ট সাংবাদিক ফরহাদ মাজহারকে নানাভাবে হুমকি প্রদান করার সাথে সাথে তার বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে । যে কোন সময়ে তিনিও আটক হতে পারেন ।
গোলাম মাওলা রনির আটকের খবর শুনে জাতি আশ্চার্য হয়েছিল । আওয়ামী সরকার ক্ষমতায় থাকার আমালেই আওয়ামীলীগের সাংসদ গ্রেফতার হয়ে দীর্ঘ দিন কারাবাস করবেন , সেটা বাংলাদেশ রাজনৈতিক অবস্থায় ভাবা অসম্ভব । এ অসম্ভবকেও সম্ভব করেছে আওয়ামী সরকার । যে ফালতু অভিযোগে গোলাম মাওলা রনিকে গ্রেফতার করা হয়েছে সেটা কোন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অপরাধ না । সাংবাদিকদের হত্যা করে যেখানে মানুষ পাড় পেয়ে যাচ্ছে সেখানে সাংবাদিকদের কয়েক কিল দিয়ে একজন সরকার দলীয় সাংসদকে বিচারের মূখোমূখী হতে হবে সেটা অকল্পনীয় ।
বোদ্ধা শ্রেনীরা মনে করেন , গোলাম মাওলা রনি মূলত সরকারের বিভিন্ন কর্মকান্ডের সমালোচনা করার কারনে এতটা পর্যদুস্ত হয়েছিলেন ।
এছাড়াও বাংলাদেশের আরও শত শত ব্যক্তি সরকারের সমালোচনা করার কারনে বিভিন্ন শাস্তির মূখোমুখি হয়েছেন । বাকস্বাধীনতার ব্যাপারে সংবিধান নাগরিককে পূর্ণ স্বাধীনতা দিলেও সরকারের কাছ থেকে নাগরিকরা তেমন কোন সুযোগ পায় নি । বরং অনেক ক্ষেত্রে লাঞ্ছনার মূখোমূখি হতে হয়েছে । বাংলাদেশের পরিচালনানীতি সংবিধানের এ ধারাট যদি কার্যকর করতে সরকার না চায় তবে নতুন কোন সংশোধনী বোর্ড গঠন করে অবিলম্বে বাকস্বাধীনতার বিষয়টিকে মুছে দিলেই , জাতির জন্য মঙ্গল হয় ।
তাহলে হয়ত নতুন করে কোন ব্যক্তি সরকারের কোন প্রকার সমালোচনা করতে সাহস পাবে না । তা না হলে যতক্ষন বাকস্বাধীনতার বিষয়টি সংবিধানে থাকবে ততোক্ষন এ দেশের বিপ্লবী মানুষেরা সংবিধানের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস রেখে ন্যায়ের পক্ষে এবং অন্যায়ের বিপক্ষে কথা বলেই যাবে ।
লেখক : রাজু আহমেদ । শিক্ষার্থী , কলামিষ্ট ও প্রাবন্ধিক ।
সরকারী বি এম কলেজ , বরিশাল ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।