যক্ষ্মা নির্মূলে সবাইকে
এগিয়ে আসতে হবে
মিজান রহমান
বর্তমানে আমাদের দেশে যক্ষ্মা একটি মারাত্মক জনস্বা¯’্য সমস্যা। এটি জীবাণু ঘটিত সংক্রামক রোগ। এই রোগের জীবাণু সাধারণত ফুসফুস আক্রমণ করে। তবে রোগটি কোন বংশজনিত রোগ নয়। কফ, হাঁচি, কাশির মাধ্যমে রোগের জীবাণু বাতাসের সাথে মিশে শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে তা সু¯’ ব্যক্তির ফুসফুসে ঢুকে বংশ বৃদ্ধি করে রোগ সৃষ্টি করে।
এক হিসাব করে দেখা গছে প্রাপ্ত বয়স্ক জনসংখ্যার ৫০% যক্ষ্মার জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত। বিশ্বের ২২টি দেশের মধ্যে যক্ষ্মা রোগীর সংখ্যা সর্বাধিক, বাংলাদেশ তার মধ্যে রয়েছে। বিশ্বে যক্ষ্মা সার্বিক পরি¯ি’তি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় বিশ্ব জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ যক্ষ্মার জীবণু বহন করছে। প্রতি বছর ৯ মিলিয়নের বেশি লোক এ রোগে আক্রান্ত হ”েছ। ১.৫ মিলিয়ন লোক প্রতিবছর যক্ষ্মায় মারা যা”েছ।
ঐ ২২টি দেশে বিশ্বের মোট যক্ষ্মা রোগীর ৮৫% এবং মোট যক্ষ্মাজনিত মৃতের হার ৯০%। এবং মোট যক্ষ্মা রোগীর ৩৬% দক্ষিণ পূর্ব-এশিয়া অঞ্চলে বাস করছে। এ হিসাব মতে বাংলাদেশ ঝুঁকির মধ্যে অব¯’ান করছে। আমাদের দেশে বিভিন্ন কারণে বা অবহেলায় যক্ষ্মা রোগীকে শনাক্ত করা সম্ভব হয় না যার ফলে ঐ সব রেগীরা চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হ”েছ এবং বৃদ্ধি করছে যক্ষ্মা রোগীর সংখ্যা। এ রোগ থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে প্রথমে রোগীকে শনাক্ত করতে হবেÑএর পেছনের দিক তাকালে আমরা দেখতে পাই, বিশ্বে ভয়ানক ধরনের যক্ষ্মা বিস্তার যখন ঘটলো তখন বোঝা গেল পৃথিবীর অন্যতম ভয়ঙ্কর এই রোগকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জর“রী কিš‘ বিশ্বজুড়ে যে প্রোগ্রাম চলছিল তা তেমন আশানুরূপ হ”েছ না।
এই প্রোগ্রামের মধ্যে ছিল যক্ষ্মারোগ শনাক্ত করা, রোগীরা এন্টিবায়োটিক ঠিকমত গ্রহণ করছে তা নিশ্চিত করা, এসব ওষুধে তাদের রেজিস্ট্যান্স হ”েছ কি না তা পরীক্ষা করা এবং রোগের বিস্তার হলে তা মনিটর করা। কিš‘ আন্তর্জাতিক যক্ষ্মা বিশেষজ্ঞরা বললেন, এই ব্যব¯’া বেশ কয়েকটি কারণে সমস্যায় পড়েছেঃ এন্টিবায়োটিকের অপব্যবহার ; অন্যান্য অপচিকিৎসা, যেমন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে উ”চ ঝুঁকি রোগীদের আলাদা রাখতে ব্যর্থ হওয়া এবং ওষুধ সরবরাহে অর্থ খরচে সরকারের গাফলতি। এসব কারণে ড্রাগÑরেজিস্ট্যান্ট যক্ষ্মার জীবাণু বেড়ে চলছে ঃ যে ভয়ংকর ব্যাপারটি পৃথিবী মানুষ বুঝতে শিখেছে তা হ”েছ- কত ভয়ানক এই বিপদ! এই রোগের পেছনে অণুজীব মাইকোব্যাকটেরিয়াম টিবারকুলোসিম’ আবি®কৃত হয়েছিল ১২৪ বছর আগে মার্চ মাসে। বর্তমানে এই জীবাণু প্রতিবছর ৮.৮ মিলিয়ন লোককে সংক্রমিক করছে; ঘটছে ১.৬ মিলিয়ন লোকের প্রাণহানি। রোগীর কফ কাশের সময় সূক্ষ্ম বিন্দুকণার মাধ্যমে ছড়ায় এ জীবাণু।
জাতীয় পর্যায়ে সর্বশেষ যক্ষ্মা জরিপের তথ্য প্রকাশ করা হয় গত জুলাই মাসে। এই জরিপের প্রধান তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্বে ছিলেন আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা কে জামান। তিনি বলেন, ১৫ বছরের বেশি বয়সী মানুষের মধ্যে প্রতি লাখে ৭৯ জন যক্ষ্মার জীবাণু বহন করছে। বিশ্ব স্বা¯’্য সং¯’া যক্ষ্মার প্রকোপ বেপ্তি এমন ২২টি দেশের যে তালিকা তৈরি করেছে তাতে বাংলাদেশের ¯’ান ষষ্ঠ।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ব্র্যাকের পরিচালক (স্বা¯’্য) ফার“ক আহমেদ বলেন, গ্লোবাল ফান্ডের বিপুল পরিমাণ আর্থিক অনুদানের ফলে জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি ভালোভাবে চলছে।
সারা দেশ কর্মসূচির আওতায় থাকার কারণে দেশে যক্ষ্মার প্রকোপ আগের চেয়ে কমেছে।
মাঠ পর্যায়ে কফ পরীক্ষা, রোগী শনাক্তকরণ এবং প্রতিটি রোগীকে প্রতিদিন ওষুধ দেওয়ার মূল কাজ করেন এনজিওকর্মীরা। সার্বিক সমন্বয়, ওষুধ ও রি-এজেন্ট কেনা, মাঠ পর্যায়ে তা পৌঁছে দেওয়া, এমডিআর যক্ষ্মা রোগীর চিকিৎসা দেওয়া, প্রশিক্ষণ—এসব কাজ সরকারের। গত মাসে গ্লোবাল ফান্ড সরকারকে বলেছে, তারা শুধু ওষুধ কেনার টাকা দেবে।
গ্লোবাল ফান্ডের পক্ষ থেকে এ বছর ও গত বছর স্বা¯’্যসচিব ও লাইন ডিরেক্টরকে লেখা একাধিক চিঠিতে আর্থিক শৃঙ্খলা বজায় রাখা, উপযুক্ত লোক নিয়োগ করার কথা বলেছে।
বিশ্ব স্বা¯’্য সং¯’ার নাম প্রকাশে অনি”ছুক একজন পরামর্শক প্রথম আলোকে বলেন, কর্মসূচিতে ও মন্ত্রণালয়ে একটি চক্র দীর্ঘদিন ধরে অনিয়ম করে আসছে। এই চক্র গ্লোবাল ফান্ডের চিঠি বা সতর্ক বার্তাকে পাত্তা দেয়নি। এই চক্রটি এতটাই শক্তিশালী যে, তাদের অনিয়ম সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত হওয়ার পরও সরকার শাস্তি দিতে পারছে না।
বছরে প্রায় দেড় লাখ যক্ষ্মা রোগীর চিকিৎসা দেওয়া হয় জাতীয় কর্মসূচির মাধ্যমে। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, প্রতিদিন ৭০ থেকে ৮০ হাজার রোগীর হাতে যক্ষ্মার ওষুধ পৌঁছে দেন মাঠ পর্যায়ের এনজিওকর্মীরা।
এনজিও কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তাঁরা কমপক্ষে চার মাসের ওষুধ মজুদ রাখেন। একটি এনজিওর কর্মকর্তা বলেছেন, তাঁরা এই চার মাসের মজুদ থেকে ওষুধ দি”েছন রোগীদের। টাঙ্গাইলের একটি উপজেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত এনজিও কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সেখানে যক্ষ্মার ওষুধ ‘স্টেপট্রোমাইসিনের’ মজুদ নেই। এই ওষুধ সরকার বিদেশ থেকে আনে।
একাধিক এনজিওর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কফ পরীক্ষার রি-এজেন্ট (জীবাণু পরীক্ষার রাসায়নিক দ্রব্য) মাঝেমধ্যেই ফুরিয়ে যায়।
তাঁরা বলছেন, কর্মসূচিতে টাকার কোনো কমতি নেই, শুধু দক্ষতার সঙ্গে খরচ করতে পারে না বলে মাঠ পর্যায়ে ওষুধ ও রি-এজেন্টের সংকট তৈরি হয়।
তবে জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির কর্মসূচি ব্যব¯’াপক মো. নজর“ল ইসলাম বলেন, ‘মাঠ পর্যায়ের ওষুধ শেষ হওয়ার আগেই নতুন ওষুধ চলে আসবে। ’
নতুন লাইন ডিরেক্টর মোসাদ্দেক আহমেদ বলেন, কর্মসূচির দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা চালানো হ”েছ। তিনি বলেন, ওষুধ বা রি-এজেন্টের যেন সংকট না হয়, তার জন্য সর্বো”চ ব্যব¯’া নেওয়া হবে।
এমডিআর যক্ষ্মা: বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারকে যেকোনো মূল্যে সাধারণ যক্ষ্মার ওষুধের সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।
কোনো কারণে ওষুধ সরবরাহ বন্ধ থাকলে দেশে এমডিআর যক্ষ্মা বহু গুণ বেড়ে যাবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য মো. নজর“ল ইসলাম বলেন, যক্ষ্মার ওষুধ সঠিক মাত্রায় নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত সেবন করতে হয়। মাত্রা যদি ঠিক না থাকে অথবা নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত ওষুধ সেবন না করলে রোগীর দেহের যক্ষ্মা জীবাণু (ব্যাকটেরিয়া) ওষুধ সহনশীল হয়ে পড়ে। নির্দিষ্ট ওষুধে ওই জীবাণু আর মারা পড়ে না। তখন তাকে বলে মাল্টি ড্রাগ রেজিস্টেন্ট (এমডিআর) বা বহু ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা।
সাধারণ যক্ষ্মায় ছয় মাস ওষুধ সেবন করতে হয়। সরকারি কর্মসূচিতে এই ওষুধ রোগীকে বিনা মূল্যে দেওয়া হয়। আর এমডিআর যক্ষ্মা রোগীকে দুই বছর ওষুধ সেবন করতে হয়।
কে জামান বলেন, বাংলাদেশে এমডিআর যক্ষ্মা রোগীর সংখ্যা কমপক্ষে ১০ হাজার। এ যক্ষ্মার প্রকোপ ঢাকা শহরেই বেশি।
সরকারি কর্মসূচির মাধ্যমে মাত্র ৪১৩ জন এমডিআর যক্ষ্মা রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হ”েছ। এ ছাড়া ডেমিয়েন ফাউন্ডেশন নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কিছু রোগীকে চিকিৎসা দি”েছ।
একাধিক সূত্র বলছে, এমডিআর রোগীর চিকিৎসা ও ওষুধ নিয়েও অব্যব¯’াপনা চলছে। একাধিক সূত্র বলেছে, এমডিআর যক্ষ্মার ওষুধেরও মজুদ ফুরিয়ে যা”েছ। এ বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সাবেরা সুলতানা বলেন, ওষুধ কেনার প্রক্রিয়া চলছে, মজুদ ফুরানোর আগেই নতুন ওষুধ দেশে চলে আসবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।