আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

যক্ষ্মা: একটি প্রাণঘাতী রোগ

কিছু বল্লাম না

যক্ষ্মা কি? যক্ষ্মা পৃথিবীর অন্যতম একটি প্রাণঘাতী সংক্রামক ব্যধি যার জন্য দায়ী হল মাইকোব্যাকটেরিয়াম টিউবারক্লোসিস নামের এক ধরণের ব্যাকটেরিয়া। যক্ষ্মা রোগীদেও ক্ষেত্রে প্রধানত ফুসফুসই আক্রান্ত হয়। যক্ষ্মা রোগের ইতিহাস প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই যক্ষ্মা রোগের প্রাদুর্ভাব ছিল। আজ থেকে প্রায় ১৮ হাজার বছর পূর্বে বাইসন নামের একপ্রকার পশু যক্ষ্মা দ্বারা আক্রান্ত হত বলে ধারণা করা হয়। প্রাচীন মিশরের মমি করে রাখা মৃতদেহেও যক্ষ্মার নমুনা পাওয়া গিয়েছে।

এছাড়া প্রাচীন গ্রীস ও দক্ষিন আমেরিকায়ও প্রাচীনকাল থেকেই যক্ষ্মার প্রাদুর্ভাব ছিল। ভারতীয় উপমহাদেশেও যক্ষ্মার প্রাদুর্ভাব ছিল প্রাচীনকাল থেকেই। এই রোগে যেহেতু স্বাস্থ নষ্ট হয়ে যেত, দেহের ওজন কমে যেত এবং রোগী ঘন ঘন বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হত তাই ভারতবর্ষে একে অভিহিত করা হত ‘ক্ষয় রোগ’ নামে। যক্ষ্মার জীবাণু প্রথম আবিষ্কার করেন জার্মান চিকিৎসাবিজ্ঞানী রবার্ট কক। ১৮৮২ সালের ২৪ মার্চ জনসমক্ষে তিনি তাঁর এই আবিষ্কারের কথা প্রকাশ করেন।

এই আবিষ্কারের জন্য তিনি ১৯০৫ সালে চিকিৎসায় নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন। ১৯০৬ সালে দুইজন ফরাসী বিজ্ঞানী আলবার্ট কালমেত্তি ও ক্যামেলি গুয়েরিন যক্ষ্মার প্রতিষেধক টিকা ‘বিসিজি’ আবিষ্কার করেন। মানবদেহে বিসিজি টিকা প্রথম দেওয়া শুরু হয় ১৯২১ সালে ফ্রান্সে। ১৯৪৬ সালে আবিষ্ক্রত স্পেট্রোমাইসিন হল যক্ষ্মার বিরুদ্ধে ব্যবহার করা প্রথম এন্টিবায়োটিক। যক্ষ্মায় শরীরের যেসকল অংশ আক্রান্ত হয় যক্ষ্মা রোগীদের ক্ষেত্রে প্রধানত ফুসফুসই আক্রান্ত হয়।

তবে শরীরের যে কোন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গই যক্ষ্মার জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। যক্ষ্মার জীবাণু মানব দেহে প্রথমে প্রবেশ করে ফুসফুসে। ফুসফুস থেকে রক্ত, লসিকা ইত্যাদির মাধ্যমে অন্যান্য অঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে। যক্ষ্মা সংক্রমণের হার বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষ যক্ষ্মার জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত। সারা পৃথিবীতে প্রতি বছর প্রায় ৯০ লক্ষ মানুষ যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয় এবং এদের মধ্যে প্রায় ২০ লক্ষ রোগী প্রতি বছর মারা যায়।

যক্ষ্মায় আক্রান্ত মানুষজনের শতকরা ৯০ ভাগই বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশে বাস করেন। ১৯৯৩ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) রোগটিকে একটি ‘বৈশ্বিক হুমকি’ হিসেবে চিহ্নিত করে। যক্ষ্মা যেভাবে ছড়ায় যক্ষ্মার জীবাণু মূলত বাতাসের মাধ্যমে একজনের শরীর থেকে অন্যজনের শরীরে ছড়ায়। যক্ষ্মায় আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি-কাশির মাধ্যমে জীবাণু বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। ঐ হাঁচি-কাশির সংস্পর্শে আসলে জীবাণু অপরাপর ব্যক্তির শরীরেও ছড়িয়ে পড়ে।

যক্ষ্মা সংক্রমণ ও যক্ষ্মা রোগ কি এক জিনিস? যক্ষ্মা সংক্রমণ ও যক্ষ্মা রোগ এক জিনিস নয়। যক্ষ্মা রোগীর সংস্পর্শে আসা যে কোন ব্যক্তির দেহেই এই রোগের জীবাণু প্রবেশ করতে পারে। তবে জীবাণু প্রবেশ করলেই উক্ত ব্যক্তি যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে যান না। প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষের দেহেই যক্ষ্মা প্রতিরোধের মত স্বাভাবিক প্রতিরোধশক্তি থাকে। ফলে শরীরে জীবাণু ঢুকলেও তা তাদেরকে কাবু করতে পারে না।

মাত্র দশ শতাংশ লোক যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম তারাই কেবলমাত্র রোগে আক্রান্ত হয়। যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হল ফুসফুসে ব্যাকটেরিয়ার বংশবৃদ্ধি ও বিভিন্ন ধরণের লক্ষণ প্রকাশ পাওয়া। যক্ষ্মা রোগের লক্ষণ যক্ষ্মার লক্ষ্মণসমূহের মধ্যে রয়েছে এক নাগাড়ে কাশি, রক্তমিশ্রিত কফ, বুকে ব্যথা, জ্বর জ্বর ভাব, রাত্রিকালীন সময়ে অধিক হারে ঘামানো, ওজন হ্রাস, ক্ষুধা মন্দা, দৌর্বল্য, শরীরে হলদেটে-সাদা ভাব ইত্যাদি। যে সকল মানুষজনের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম তাদের মধ্যে লক্ষণগুলো তীব্রভাবে দেখা দেয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যক্ষ্মা বাংলাদেশ একটি ঘনবসতিপূর্ণ দেশ এবং এখানে যক্ষ্মার প্রাদুর্ভাব বেশ দৃশ্যমান।

বিশ্ব স্বাস্থ সংস্থা প্রণীত তালিকায় যক্ষ্মাপ্রবণ দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। এই দেশে প্রতি বছর তিন লাখ লোক নতুন করে যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয় এবং সত্তর হাজার লোক প্রতি বছর যক্ষ্মায় মারা যায়। যক্ষ্মা নিরোধের লক্ষে বংলাদেশে সরকারী-বেসরকারী বিভিন্ন পর্যায়ে বহুমুখী কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে। জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচী (এনটিপি) বাংলাদেশে বিস্তৃত পরিসরে যক্ষ্মার চিকিৎসা শুরু হয় ১৯৬৫ সালের দিকে। তবে তখন কেবলমাত্র বিশেষায়িত যক্ষ্মা হাসপাতাল ও ক্লিনিকে এই চিকিৎসাসেবা পাওয়া যেত।

১৯৮০ সালে প্রণীত স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা বিষয়ক দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় দেশের ১২৪ টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যক্ষ্মার চিকিৎসাসেবা বিস্তৃত করা হয়। জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচীতে যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণের বিশেষ পদ্ধতি ‘ডটস পদ্ধতি’ যোগ করা হয় ১৯৯২ সাওে প্রণীত স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা বিষয়ক চতুর্থ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায়। এনটিপি ১৯৯৩ সালে প্রাথমিকভাবে দেশের চারটি থানা ও দু’টি জেলায় কাজ শুরু করে। ১৯৯৮ সালের মাঝ বরাবর এই পরিষেবা দেশের প্রায় সবকটি থানায় পৌঁছে যায়। ডটস্ পদ্ধতির কার্যক্রম ঢাকা মেট্রোপলিটন শহরে শুরু হয় ২০০২ সালে এবং ২০০৩ সালের মধ্যে দেশের প্রায় ৯৯ শতাংশ জনগোষ্ঠী ডটসের আওয়তায় চলে আসে।

এনটিপি’র উদ্ধেশ্য ও লক্ষ্য হল যক্ষ্মার প্রকোপ কমিয়ে এনে ২০১০ সালে মধ্যে যক্ষ্মাজনিত মৃত্যুহার অর্ধেকে নামিয়ে নিয়ে আসা এবং ২০১৫ সালের মধ্যে ‘সহস্রাব্দের উন্নয়ন নীতিমালা’য় বর্ণিত লক্ষ্য অর্জন করা। এই দুই লক্ষ্য পূরণের জন্য এনটিপি বিভিন্ন ধরণের কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। ডটস্ পদ্ধতি যক্ষ্মা নির্মূল ও নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। এদের মধ্যে একটি জনপ্রিয় ও কার্যকর চিকিৎসা পদ্ধতি হল ‘ডটস্ পদ্ধতি’। যক্ষ্মা হলে নিয়মমত এবং নির্দিষ্ট একটি সময় পর্যন্ত ওষুধ গ্রহণ করতে হয়।

ওষুধ গ্রহণে যেন কোন রকম অবহেলা বা ভুল-ভ্রান্তি না হয় সেজন্য যক্ষ্মা রোগীদেরকে বিশেষ তত্ত্বাবধানে রেখে ওষুধ সেবন করানো হয়। এটিই হল ডটস্ পদ্ধতি। এর পূর্ণাঙ্গ রূপ হল ‘ডাইরেক্ট অবজার্ভড ট্রিটমেন্ট স্ট্রাটেজি’।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।