আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আঁধার রাতের কথামালা অথবা ভূত ও আলেয়া (প্রিয় অন্ধকার দিনগুলো)

সকাল আর আসেনা গোলাপ হয়ে ফোটেনা কিশোরীর হাতে

আমি তখন বার কি তের। অর্থাৎ আমার তখন বালাই বয়স। আমি আমার খুঁপরি ঘরটাতেই থাকি । একা। একা থাকার মজাটা তখন থেকেই পেয়েছি।

দরজা বাহির থেকে বন্ধ করে রাতে যেখানে সেখানে যাওয়া যায়। কোথায় ,কোন গ্রামে গান হবে,যাত্রা হবে ,পালা হবে,কোন বাড়িতে ভিডিও দেখানো হবে ইত্যাদির খবর আগে থেকেই জোগাড় করে রাখতাম। আর সন্ধ্যায় খাবারের পর সবাই ঘুমিয়ে গেলে লুকিয়ে লুকিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতাম। সারা রাত কাটিয়ে ঠিক ভোরে আব্বা ঘুম থেকে উঠার আগে ঘরে এসে হাজির হতাম। সকালে আব্বা বুঝতেও পারেতেন না যে তার বোকাসোকা ছেলেটা সারারাত কোথায় কি করে এসেছে ।

ফসলের মাঠ,ঝুপঝাড়,বাঁশঝাড়,চিপা চাপা গলি পেরিয়ে চলে যেতাম গ্রাম থেকে গ্রামে। কখনো একা । কখনোবা সঙ্গী সাথীদের সাথে। একটুও ভয় পেতাম না। গ্রামে কিছু কিছু জায়গার নাম শুনলেই ভয় ভয় করতো যেমন চিতাশাল,কবর,জোড়াদিঘির পাড়।

এসব জায়গায় মানুষ দিনের বেলাও একা যাবার সাহস পেত না। আর আমি কিনা রাত দুপুরে গা ছমছম করা অন্ধকারে দপাস দপাস পা ফেলে ওসব জায়গা মাড়িয়ে গেছি একগ্রাম থেকে আরেক গ্রামে। কিছু কিছু জায়গা এমনই ভয়ানক ছিল যে ওসব জায়গাতে মানুষ মরে পরে থাকতে দেখেছি। লোকে বলত জ্বীনে মানুষ মেরে ফেলে রেখেছে। একবার একটা লাশ লাশ দেখে আমি যারপর নাই ভয় পেয়েছিলাম।

এক গৃহবধূর লাশ। গল্পটা এরকম ছিল-একরাতে মা বধূটি প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে বের হন। গ্রামে আগে একটা ব্যাপার ছিল নির্জন পুকুর পাড়কে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেবার উৎকৃস্ট স্থান ভাবা হত । ওসব জায়গা গুলো এমন হতো যে এমনি্তেই ভূতুরে ভূতুরে লাগতো। এমনই এক পুকুর পাড়ে ঐ বউটি বের হবার পর আর ফিরে আসেনি।

এদিকে ঘরে তার বাচ্চারা কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছে। বাচ্চাদের কান্না সইতে না পেরে বাচ্চার বাবা সারারাত খুঁজাখুঁজি করলেন ,ডাকাডাকি করলেন কিন্ত্ত কোথাও খুঁজে পেলেন না। সকালে অনেক তালাশের পর দেখলো যে কালামইন্না পুকুরের নির্জন পাড়ে লাশ পড়ে আছে। অর্ধেক শরীর পানিতে আর অর্ধেক শরীর মাটিতে। এমনিতেই জংলা গা ছমছম জায়গা মাসের পর পর মাস চলে যায় কেউ মাড়ায় না।

তো মরলো কিভাবে?ভূতে মেরে ফেলে রেখেছে । আমি দেখেছি লাশের কান দিয়ে রক্ত পড়ছে,গলায় লাল দাগ,সারা শরীর ক্ষতবিক্ষত। লোকে বলাবলি করলো ভূতে গলাটিপে মারছে। গ্রামে এসমস্ত ভূতে মারার ঘটনা প্রায় ঘটত। ভূতের নামে সব খালাস অপমৃত্যু।

এতে কারো জেল জুলুম হতো। একেকটা ঘটনা ঘটত আর পুরোগ্রাম ভূতের ভয়ে ছমছম করতো। একবার আমাদের গ্রামে একবাড়িতে চোর ধরা পড়েছে। চোর ব্যাটা আবার এই গ্রামেরই। ধরা খেয়ে চোরের কি তেজ! সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে হুমকি কামডা বেশি বালা হইলো ব্যাপারী।

কিছুদিন বলতে গেলে মাস ছয়েক পর দেখা গেল ব্যাপারীর ছেলেটা একটা দুর্গম খালের চিপায় মরে পরে আছে । তার মাথা মাটির নিচে পুতে রাখা আর শরীর ,পা মাটির উপরে খাড়া করা। এ ঘটনাও ভূতে ঘটাইছে। তো যা বলছিলাম আমি আমার ঘরটাতে একলাই থাকি। এক সময় নিম্নচাপ পড়েছে।

দিনের পর দিন বৃষ্টি। কৃষকের ধান পঁচে যাচ্ছে। শুকাতে পারছে না। আহা! প্রাণের চেয়ে প্রিয় ফসল পঁচে যাচ্ছে ঘরের ভেতর । কিছুই করার নেই।

রোদ নেই তাই শুকানো যাচ্ছে না। পঁচা ধানের গন্ধে চারদিক ভুরভুর। এমনই সময়ে পাশের বাড়ি ঠিক না আমাদের বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে মোটামোটি সড়কের কাছাকাছি একটা বাড়ির বাচ্চা ছেলে একটা ডুবার মধ্যে মরে পড়ে ছিল । তার লাশ দেখেছি । ঘাড়টা একদিকে হেলানো।

এ নিয়ে লোকে বলাবলি করলো যে এটা আজর শয়তানের কাম । আজর শয়তান মানুষের ঘাড় মটকিয়ে মারে। ছেলেটার মরা মুখটা ভুলতে পারছিলাম না। একদিন বৃষ্টির রাত। এমন বৃষ্টি! ঝুমঝুম সারাক্ষণ।

এমন অন্ধকার যে কিছুই দেখা যায় না। হাত মেলে ধরলে নিজের হাতটাকেই খুঁজে পাওয়া না এমন অন্ধকার। ঘরে ঘুমিয়ে ছিলাম। মাঝ রাতে জলবিয়োগ করার জন্য উঠলাম ঘুম থেকে। এখন টয়লেটে যেতে হলে বৃষ্টিতে ভিজতে হবে।

এটা করা যাবেনা। আম্মাকে ডাক দিলাম কয়েক বার । ও ঘরে আমার আওয়াজ যায়না। কি আর করা!দরজা খুলে দাওয়ায় দাঁড়িয়ে ...বৃষ্টি সব ধুয়ে নিয়ে গেল। যেই না আমি উত্তর দিকে তাকালাম আমার শরীরের পশম কাঁটা দিয়ে উঠল।

একটা আলো ক্রমশ জ্বলছে আর নিভছে। আলোটা বৃত্তাকার। ধপ করে জ্বলে আবার নিভে যায়। জ্বলে একটু উপরে দিকে উঠে কয়েক গজ সামনে আগায়। আবার নিভে।

আবার জ্বলে । আলোটা ক্রমশ যে ছেলেটা দু'দিন আগে মারা গেল তার বাড়ির দিকে যাচ্ছিল। দেখার উৎসাহ আর ভয় দুইটাই কাজ করছিল। একবার ভাবি ঠাস করে দরজা বন্ধ করে দিই। আরেকবার ভাবি আম্মাকে ডাক দিই আম্মাও দেখুক।

কিন্ত্ত এত বৃষ্টি । ডাক দিলে কাজ হবে না। আর আমার গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোবে কিনা তাও সন্দেহ। একটা জেদ কাজ করছিল। জিনিসটা কি? দিমু নাকি দৌড় একটা! গিয়ে দেখে আসি শালা ভূতের বাচ্চা।

ভয় কাজ করছে আর জেদ কাজ করছে। ভয়টাকে করাত দিয়ে কেটে ফেলতে ইচ্ছে করছিল। ভয় কেনো পাব?ভূত তো ভূত আর আমি হচ্ছি আমি। আমার কি শক্তি নাই। শালা ভূতের গোষ্ঠি কিলাই।

হঠাৎ দেখি আলোটা আর দেখা যাচ্ছে না। কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম । না আর জ্বলছে না। ভূতটা মনে হয় দেখতে পেয়েছে যে তাকে আমি দেখছি। দরজা বন্ধ করে এসে বিছানায় শুই কিন্ত্ত ঘুম আর আসেনা।

পরে ঘটনাটা আরো কয়েকজনের কাছে বলি । তারা বরল তারাও নাকি এটা দেখেছে । প্রতি রাতে মরে যাওয়া ছেলেটা তার বাড়িতে চলে আসে । ভূত হয়ে ভয় দেখায়। ছেলের মা ও মাঝে মাঝে ঘুম থেকে উঠে শুনে ছেলেটা কান্না করছে ।

বৃষ্টিতে ভিজছে। মা দরজা খুলে ছেলেকে ঘরে আনতে যাবে দেখে কেউ নেই। খাখা আন্ধার।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।