ঢাকা শহরের আশেপাশের প্রাচীন ইতিহাসস্থাপত্যগুলোর তালিকার দিকে চোখ বুলালে গাজীপুর ভাওয়াল রাজবাড়ি আর শ্মশানঘাট এর মঠ আসবেই আসেবে।
ভাওয়াল রাজবাড়ি এখন ব্যবহার করা হচ্ছে সরকারী দাপ্তরিক কাজকর্মের জন্য।
তাই সঙ্গত কারণেই ভাওয়াল রাজবাড়িতে কয়েকবার যাওয়া হলেও টঙ্গীতে আমার বাসা হওয়ার পরও এই গাজীপুর শ্মশানঘাটে যাওয়া হয়নি।
যানজটের কথা ভাবলে ঢাকার আশেপাশে কোথাও যেতে ইচ্ছে হয় না।
ঈদের ছুটিটাকে কাজে লাগিয়ে ফেললাম।
ঈদের একদিন পর নাস্তা সেরে তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়ি গাজীপুরের উদ্দেশ্যে।
গাজীপুরেই ভাওয়াল রাজাদের অনন্য কীর্তি ভাওয়াল শ্মশান মঠ। এই শ্মশান মঠ পুরাকীর্তিপ্রেমীদের কাছে খুবই আকর্ষণীয়।
ঢাকা থেকে খুব সহজেই গাজীপুর আসা যায়। ফার্মগেট, মহাখালী থেকে এয়ারপোর্ট-উত্তরা আর তারপর টঙ্গী-জয়দেবপুর হয়ে গাজীপুরের বাস চলে সারাদিন।
নানান কাউন্টার সার্ভিস। ঢাকা থেকে গাজীপুরের দূরত্ব ৪০ কিলোমিটার। বাস থেকে নামতে হবে শিববাড়ী মোড়ে। জয়দেবপুর থেকে শিববাড়ি আসার পথে ডানে চোখে পড়বে বিশাল বিস্তৃত ফসলের ক্ষেত। এখানেই বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান, বীজ প্রত্যয়ন কেন্দ্র, ধান গবেষণা ইনষ্টিটিউট ইত্যাদি।
শিববাড়ী মোড়ে নেমে রিকশা চেপে বসা। এখান থেকে শ্মশানঘাট মঠের ভাড়া ১৫ টাকা। গাজীপুরের এ রাস্তায় অসংখ্য রিকশা চলাচল করে। বাসের চলাচল নেই। শিববাড়ি থেকে রেললাইন পার হয়ে হাতের বামে ভাওয়াল রাজবাড়ি, ডানে রানী বিলাসমণি উচ্চ বিদ্যালয়।
ভাওয়াল রাজবাড়ি যেমন বড় তেমনি সুন্দর। এই সুদৃশ্য ভবনটি এখন গাজীপুরের জেলা প্রশাসকের কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এছাড়া আছে কোর্টভবন, রেজিষ্ট্রি অফিস সহ নানান সরকারী দপ্তর। অন্যান্য রাজবাড়ির মতো এটি বিশালকায় কয়েকতলা উচ্চতার নয়। উঁচু ভবনের বদলে এই রাজবাড়ি আয়তনে প্রশ্বস্ত।
শিববাড়ী থেকে শ্মশান মঠের দূরত্ব ৩ কিলোমিটার। এ পথের দু’ধারে গড়ে উঠেছে চমৎকার সব দালান। ঢাকায় চাকরি কিংবা ব্যবসা করেন এমন অনেক ব্যক্তি এখানে বাড়ি নির্মাণ করে আছেন। এখান থেকেই তারা নিত্যদিন ঢাকা আসা-যাওয়া করেন। রিকশা ১৪/১৫ মি. চলার পর কয়েকটি দোকানের পাশে এসে থামল।
রিকশা ভাড়া মিটিয়ে পা রাখলাম ভাওয়াল শ্মশানঘাট মঠ প্রাঙ্গণে।
আগে শুনেছিলাম নানা প্রকার গাছ-গাছালির ভীড়ে শ্মশান ভূমির প্রবেশ স্থল থেকে মঠগুলো নাকি দেখা যায় না। দেখলাম এখন আর তেমন নেই। গাছটাছ কেটে সাবাড়। তবু কয়েক গজ হেঁটে গেলেই চোখে পড়ে বিস্ময়কর স্থাপত্য।
সামনের তিনটি মঠের নির্মাণশৈলী সাধারণ এবং দেখতে একই রকম। কিন্তু বাকি পাঁচটি মঠের নির্মাণশৈলী চিত্তাকর্ষক। এদের মধ্যে একটি মঠ সবচেয়ে উঁচু। মঠগুলোর দরজা-জানালা ভাঙা। কোন কোনটির স্মৃতিচিহ্ন মুছে গেছে।
অসাধারণ সব নকশাগুলো প্রায় মুছে যেতে বসেছে। প্রত্যেক মঠ ঘুরে ঘুরে দেখি, ছবি তুলি। ভাওয়াল জমিদারদের এই রাজকীয় শ্মশান মঠের পূর্ব পাশে ছোট পুকুর। সংস্কারের অভাবে এর ঘাটটি ভেঙে গেছে, স্মৃতিটুকু পড়ে আছে কেবল। পুকুরের পূর্বপাশে চিতা।
এখানে শবদাহ করা হয়। তার পূর্বদিকে রয়েছে বেশকিছু খোলা জায়গা। এক সময় এই জায়গা দিয়ে চিনাই নদী বয়ে যেত। এখন তার চিহ্ন মাত্র নেই। চিনাই নদীর পাশেই আর শ্মশাণ পাশে বলেই এর নাম শ্মশানঘাটের মঠ।
ঘুরে ফিরে দেখে ক্লান্ত হয়ে বসি মনোরম এই জায়গায়। পড়ন্ত দুপুরে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি মাথা উঁচু করে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মঠগুলোর দিকে।
ভাওয়াল এলাকার জমিদারদের পূর্বপুরুষ বর্তমান মুন্সীগঞ্জ জেলার বজ্রযোগিনী গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। এই গ্রামেরই লোক বলরাম রায় আঠারো শতকের চল্লিশ দশকে গাজীপুরের ভাওয়াল পরগনার জমিদার দৌলত গাজীর দেওয়ান হিসেবে কাজ করতেন। দৌলত গাজীর অনুপস্থিতিতে দীর্ঘদিন খাজনা প্রদান বাকি পড়ে যাওয়ায় ভাওয়াল জমিদারি নিলামে ওঠে।
মুর্শিদকুলী খানের সঙ্গে সখ্য থাকায় বলরাম রায় কৌশলে এই জমিদারি হস্তগত করে ফেলতে সক্ষম হন। রাজস্ব আদায়ের স্বার্থে মুর্শিদকুলী খান (শাসন: ১৭৪০-৫৬) মুসলমান জমিদারদের স্থলে পূর্ববঙ্গে হিন্দু জমিদারদের নিযুক্ত করতেন। বলরাম রায়ের মৃত্যুর (১৭৪৩) পর তার সুযোগ্য পুত্র কৃষ্ণরায় জমিদারি পরিচালনার দায়িত্ব পান। তিনি ভাওয়াল জমিদারিকে স্থায়ীরূপ দেন। কৃষ্ণ রায়ের মৃত্যুর (১৭৫০) পর তার পুত্র জয়দেব রায় ভাওয়াল জমিদারির উত্তরাধিকার নির্বাচিত হন এবং দক্ষতার সঙ্গে জমিদারি পরিচালনা করেন।
এ সময় তার নামানুসারে ভাওয়াল এলাকার নামকরণ হয় জয়দেবপুর।
জয়দেব রায়ের মৃত্যুর (১৭৫৬) পর ভাওয়াল জমিদারি এস্টেট পরিচালনার দায়িত্ব লাভ করেন তার ছেলে ইন্দ্রনারায়ণ রায় । ইন্দ্রনারায়ণ রায়ের মৃত্যুর পর ধারাবাহিকভাবে তাদের উত্তরাধিকারীরা ভাওয়াল জমিদারি পরিচালনার দায়িত্ব পালন করে যান। ১৮৫৬ সালে উত্তরাধিকারদেও একজন গোলক নারায়ণের মৃত্যুর পর তার পুত্র কালী নারায়ণ রায় জমিদারি পরিচালনার ভার গ্রহণ করেন। বস্তুত তার সময়ই ভাওয়াল জমিদারির ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটে।
জমিদার নিজেই জমিদারি পরিচালনা করতেন, প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে কাচারিতে বসতেন। কৃতিত্বের সঙ্গে জমিদারি পরিচালনার জন্য ব্রিটিশ সরকার কালী নারায়ণ রায়কে বংশানুক্রমে ব্যবহারের জন্য রায় চৌধুরী এবং রাজা উপাধি প্রদান করেন। কালী নারায়ণের সময়ই ভাওয়াল রাজবাড়ী এবং ভাওয়াল শ্মশান মঠ নির্মিত হয়।
এরপরের ইতিহাস রাজেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী, তার স্ত্রী রানী বিলাস মনি, রাজস্ব কর্মচারী ছিলেন স্বভাবকবি গোবিন্দ দাস, রাজেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরীর তিন ছেলে রণেন্দ্র নারায়ণ, রমেন্দ্র নারায়ণ এবং রবীন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী, রমেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরীর স্ত্রী বিভাবতী দেবী, তাদেও পারিবারিক চিকিৎসক আশুতোষ ডাক্তারের সাথে বিভাবতী দেবীর প্রেম, কূট কৌশল, গোপন ষড়যন্ত্র আর বিশ্বজুড়ে আলোড়ন তোলা ভাওয়াল সন্নাসীর মামলা’র ইতিহাস। সে আরেক বিশাল অধ্যায়।
১৯৫১ সালে জমিদারি প্রথা বাতিল হয়ে গেলে যবনিকা ঘটে ভাওয়াল জমিদারদের আড়াই শ’ বছরের শাসনের ইতিহাস। কিন্তু ভাওয়াল সন্ন্যাসী মামলা নিয়ে গল্প-উপন্যাস, যাত্রা-সিনেমা নির্মাণ চলে বহু বছর। ভাওয়াল সন্ন্যাসীর মামলা আজও এদেশের প্রবীণ ব্যক্তিদের আলোড়িত করে। উনিশ শতকের শেষের দিকে নির্মিত এই মঠগুলো কালের সাক্ষী হয়ে আজও টিকে আছে। সবচেয়ে বড় মঠটি নির্মিত হয়েছে ভাওয়াল জমিদারির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা কৃষ্ণ নারায়ণ রায়ের উদ্দেশে।
বাকিগুলো নির্মিত হয়েছে অন্য জমিদারদের স্মৃতির উদ্দেশে। রাজেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরীর দুই ছেলে যথাক্রমে রণেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী এবং রবীন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরীর স্মৃতির উদ্দেশে মঠ নির্মিত হলেও অপর ছেলে জমিদার রমেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরীর (ভাওয়াল সন্ন্যাসী) কোন স্মৃতিমঠ এই শ্মশান ভূমিতে নেই।
ভাওয়ালের এই রাজকীয় মঠের যে দিকটি যে কাউকে মুগ্ধ করে তা হলো এর নির্মাণশৈলী। গৌড়ীয় স্থাপত্য রীতি অনুসরণে নির্মিত এই মঠগুলোর প্রতিটি অত্যন্ত আকর্ষণীয়। এই মঠগুলোর অলঙ্করণও মনোমুগ্ধকর।
বাংলার বিস্মৃতপ্রায় মন্দির শিল্পের এক অনন্য উদাহরণ এই মঠগুলো। একদিন সময় করে আপনিও ঘুরে আসতে পারেন, মন্দ লাগবে না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।