গুদামে পচবে খাদ্যশস্য আর ক্ষুধায় মরবে ভারত
‘আমরা নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির ব্যাপারে সচেতন। আমরা দায়িত্বশীল সরকার। ’ মাত্র এক বছর আগে এই ৬ই আগস্টেই সংসদে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করেছিলেন দেশের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি। বছর ঘুরতেই সেই অর্থমন্ত্রীই চরম ঔদ্ধত্যের শিখরে বসে সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘যতোই প্রতিবাদ হরতাল হোক, পেট্রোপণ্যের দাম আর কমানো হবে না। ’ ভোটের আগে ইউ পি এ সরকারের বৃহৎ শরিক দলের নেত্রী মমতা ব্যানার্জি বলেছিলেন, ‘গণবণ্টন ব্যবস্থাকে দলতন্ত্র মুক্ত করে মজবুত করার ব্যবস্থা নেবে তৃণমূল কংগ্রেস।
নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের গণবণ্টন ব্যবস্থার দাবি জানাবে দল। ’ গরিব মানুষের খাদ্য নিরাপত্তার প্রশ্নে কোথায় গেলো সেই প্রতিশ্রুতি?
এই দ্বিচারিতা মানতে পারেন নি দেশের মানুষ। জিনিসের দামবৃদ্ধির বিরুদ্ধে পরপর দু-দু’টি হরতালে অচল হয়েছে ভারত। পেট্রোল-ডিজেল-গ্যাস-কেরোসিনের দাম-বাড়ানো সরকারের বিরুদ্ধে বামপন্থীদের ডাকা দেশজুড়ে হরতাল যে এমন ব্যাপক চেহারায় অশনিসঙ্কেত দেবে, তা বোধহয় আগেরদিনও টের পায়নি কেন্দ্রের শাসক দল। যারা ভেবেছিলেন এই হরতালে শুধুই পশ্চিমবঙ্গ, কেরালা, ত্রিপুরায় প্রতিবাদ ধ্বনিত হবে, তাঁদের অঙ্ককে গুলিয়ে দিয়ে গোটা দেশেই এমন হরতাল হয়েছে যে, গত দু’দশকেও প্রতিবাদের এমন চেহারা দেখেনি নয়াদিল্লি।
৫ই জুলাই সর্বাত্মক হরতালে নামার আগে তো কেন্দ্রের সরকারের কাছে এই দেশ খুব সাধারণ কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর চেয়েছিল। জানতে চেয়েছিল, আন্তর্জাতিক বাজারে গত ৬মাসে যখন দাম বেড়েছে ৭০পয়সা, তখন তোমরা পেট্রোলের দাম ৬টাকা ৪৪পয়সা, ডিজেলের দাম ৪টাকা ৫৫পয়সা বাড়িয়েছ কেন? পেট্রোপণ্যে যা ভরতুকি তুমি দাও, আয় করো তার চেয়ে অনেক বেশি। আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে দেশে পেট্রোপণ্যের দাম কম হলেই তাকে ‘লোকসান’ বলে চালাচ্ছো কেন? উত্তর দেওয়ার দায় নেয়নি দেশের সরকার। গরিবের পেটের জ্বালা আর ওরা বুঝবেন কী করে?
দেশের সরকার মানতেই চায় না, খোরাকির মুদ্রাস্ফীতি হলে গরিবের দেহের সাইজ ছোট হয়ে যায়। একটা জাতি খেতে না পেলে, দীর্ঘকাল পুষ্টি না দিলে, মগজের ওজন কমে যায়।
ভাবুন একবার, এ দেশের সরকার বলছে, হতদরিদ্র পরিবারে দুধ খাওয়া বেড়েছে, তাই নাকি দুধের দাম বেড়েছে। উৎসবের মরসুম আসছে বলে নাকি ভোজ্যতেলের দাম বেড়েছে। গমের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণ নাকি সরকার তার বাজার সহায়ক মূল্য বাড়িয়েছে। সবজির দাম বাড়ার কারণ নাকি মরসুমী সমস্যা। দাম বাড়ার এমন সব যুক্তি খাঁড়া করেছে দেশের খাদ্যমন্ত্রক।
খাদ্যপণ্যে ফাটকা কারবারকে মূল্যবৃদ্ধির কোন কারণ হিসাবে স্বীকারই করতে চায় না এ সরকার। উলটে বাজার নীতির সমর্থক কেন্দ্রের সরকার বলছে, চাহিদাই খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ানোয় সহায়তা করেছে। আর এই সরকারের খাদ্যমন্ত্রকই স্বীকার করছে, দেশে খাদ্যশস্যের দাম বাড়লেও বণ্টন না হওয়া ও সরকারী গুদামে পচে যাওয়া খাদ্যের পরিমাণ বাড়ছে। পর্যাপ্ত গুদামের ব্যবস্থা না থাকার ছেঁদো যুক্তিতে বিপুল খাদ্যশস্য প্রতিবছর পচছে খোলা আকাশের নিচে।
খাদ্যমন্ত্রীর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, দেশে কতো পরিমাণ খাদ্যশস্য সরকারী গুদামে পচছে এবং তা দিয়ে জনগণের কতো অংশকে খাদ্য সরবরাহ করা যেত।
পচে যাওয়া খাদ্য শস্যের হিসাব দিয়েছেন মন্ত্রী। কিন্তু, না পচিয়ে বণ্টন করা হলে কতো জন তাতে অনাহার থেকে মুক্তি পেতেন, তার জবাব তো দেয় নি সরকার। খাদ্যমন্ত্রীই জানিয়েছেন, ২০০৭-০৮, ২০০৮-০৯ এবং ২০০৯-১০ এই তিন বছরে মজুত তথা পচে যাওয়া গমের পরিমাণ হলো ৯২৪টন, ৯৪৭টন এবং ২০১০টন। চালের ক্ষেত্রে এই হার হলো ৩২হাজার ৬১৫টন, ১৯হাজার ১৬৩টন এবং ৩হাজার ৮০টন। অর্থ্যাৎ, অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে মানুষ না খেয়ে মরলেও সরকারী গুদামে চাল-গম পচবে।
কিন্তু সর্বজনীন রেশন ব্যবস্থা সরকার চালু করবে না। উলটে অর্থমন্ত্রী প্রনব মুখার্জি দাবি করেছেন, ‘রাজ্যে রাজ্যে গণবন্টন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে’।
অথচ, রেশনের আওতা থেকে নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত মানুষকে বাদ দেওয়ার পরিকল্পনা করছে এই ইউ পি এ সরকারই। তথাকথিত এ পি এল অথবা দারিদ্র্যসীমার উপরে থাকা মানুষকে ভরতুকিপ্রাপ্ত খাদ্যশস্য আর না দেওয়ার সিদ্ধান্তের দিকেই এগোচ্ছে কেন্দ্র। সকলের জন্য রেশন ব্যবস্থা কার্যত তুলে দেওয়ার পথেই যাচ্ছে কেন্দ্রের কংগ্রেস-তৃণমূল সরকার।
আর এমন এক সময়ে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে যখন গোটা দেশে খাদ্যের দাম আকাশছোঁয়া।
ইউ পি এ সরকারের প্রস্তাব হলো, গণ-বণ্টন ব্যবস্থায় এ পি এল পরিবারগুলির জন্য চাল ও গমের খুচরো দাম দাড়াবে ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের ৭৫শতাংশ। পরে তা বাড়িয়ে বাজারের সমান করা হবে। এর ফলে সরকারের আশা বর্তমান গণ-বণ্টন ব্যবস্থায় এ পি এল পরিবারগুলি বছরে যে ৪৮মিলিয়ন টন পরিমাণ খাদ্যশস্য কেনে তা কমে দাঁড়াবে ১২মিলিয়ন টনে। খাদ্য নিরাপত্তা আইনের নামে, খাদ্য ভরতুকি কমানোর লক্ষ্যেই এই যুক্তি।
তাতে গরিব মানুষ না খেয়ে মরলে সরকারের কী?
ইউ পি এ সরকার বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন মন্ত্রীগোষ্ঠী ব্যস্ত কিভাবে এ পি এল ক্রেতাদের জন্য খাদ্যশস্যের দাম বাড়িয়ে চাহিদা কমিয়ে, শেষপর্যন্ত খাদ্যে ভরতুকি হ্রাস করা সম্ভব হয়। সরকার এরফলে ৮০০০কোটি টাকা ভরতুকি বাবদ বাঁচাতে পারবে। কিন্তু এতে তো কেন্দ্রের ‘সবার জন্য খাদ্য নিরাপত্তা’ নামক নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির অপমৃত্যু ঘটবে। বাড়বে খোলা বাজারের ওপর নির্ভরতা। আর ঝলমলে ভারতের পেটের ভিতর ক্রমে বেড়ে চলেবে ক্ষুধার্ত ভারতের পরিধি!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।