সালওয়া করপোরেশনের আমদানি করা গার্মেন্ট সামগ্রী হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো গুদামে আসে ৫ নভেম্বর। চার দিন পর প্রতিষ্ঠানটি মালামাল খালাস করতে গিয়ে দেখে তা নেই। থানায় জিডি করা হয় ১১ নভেম্বর। এখনো খোঁজ মেলেনি তাদের পণ্যের। বিভিন্ন সময়ে এভাবে প্রায় ৬০০ কোটি টাকার পণ্য চুরির ঘটনা এখন ফাইলবন্দি।
সালওয়া করপোরেশনের ঘটনার কিছু দিন আগে সিঙ্গাপুর থেকে ব্যাবিলন গ্রুপের আমদানি করা ২০২টি কার্টনে প্রায় ২০ লাখ টাকার গার্মেন্ট সামগ্রী কার্গো গুদামে খালাস করতে গিয়ে দেখা যায়, পুরো মালই হাওয়া। কার্গো আমদানি ভবনের মেইন ওয়্যারহাউসের (১) কক্ষ থেকে একইভাবে গায়েব হয়েছে সোনা, হীরাসহ মূল্যবান সামগ্রী। গুদামে রাখা ১০০ কেজি হেরোইনেরও কোনো পাত্তা নেই। খুঁজে পাওয়া যায়নি ১০ কেজি স্বর্ণ। বিমানবন্দরে সবচেয়ে সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে চিহ্নিত কার্গো গুদাম থেকে এভাবে গায়েব হয়ে যাচ্ছে কোটি কোটি টাকার মালামাল।
কিন্তু জড়িতরা অদৃশ্যই থেকে যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রায় ৬০০ কোটি টাকার পণ্য গায়েবের অভিযোগ সিভিল এভিয়েশন, এয়ারফ্রেইট ও বিমানের মহাব্যবস্থাপকের (কার্গো কমপ্লেঙ্) টেবিলে ফাইলবন্দি। বছরের পর বছর এসব ঘটনায় কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। ফলে শক্তিশালী এই সংঘবদ্ধ চক্র নিয়ে যাচ্ছে মূল্যবান সামগ্রী। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলে উল্টো নানা হয়রানি থেকে শুরু করে প্রাণনাশের হুমকিতে পড়তে হচ্ছে।
বিমানবন্দরের কাস্টমস গুদাম জিম্মি হয়ে পড়েছে এই চক্রের কাছে।
একটি গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, বিমানের কার্গো আমদানি ভবনটি চুরি আর লুটপাটের স্বর্গরাজ্য। এখানে পণ্য ডেলিভারিতে কোনো ধরনের নিয়ম-শৃঙ্খলা নেই। সিকিউরিটি গার্ড থেকে শুরু করে বিমানের কিছু স্টাফ, কাস্টমস কর্মকর্তা-কর্মচারী, সিএন্ডএফ এজেন্ট যে যেভাবে পারছে লুটপাট করছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, কাগজে-কলমে সংরক্ষিত বলা হলেও কার্গো গুদামের পুরোটাই অরক্ষিত।
গার্মেন্ট এঙ্সেরিস, মোবাইল ফোনসেট, স্বর্ণালঙ্কার, হীরা, মূল্যবান কেমিক্যাল, ওষুধের কাঁচামাল, অস্ত্র- এমন কোনো পণ্য নেই এখান থেকে চুরি হচ্ছে না। সিভিল এভিয়েশন, বিমান, কার্গো টার্মিনালের কর্মকর্তা-কর্মচারী, থানা পুলিশ, বিমান সিকিউরিটি, কাস্টমসসহ গোয়েন্দা সংস্থার লোকজনও এর সঙ্গে জড়িত। চোরাই সিন্ডিকেটের সদস্যরা সব গেটই ব্যবহার করছে। তারা গাড়ি নিয়ে বিভিন্ন গেট দিয়ে অবাধে ভেতরে যাচ্ছে, আবার নির্বিঘ্নে বেরিয়ে আসছে। কাস্টমস গুদামের একজন কর্মকর্তা জানান, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির অভাবে সময়মতো মালামাল ডেলিভারি দেওয়া সম্ভব হয় না।
পাশাপাশি মালামাল রাখার জায়গারও অভাব রয়েছে। সিভিল এভিয়েশনের কাছে মালামাল রাখার জন্য আরও জায়গা বরাদ্দের আবেদন করা হয়েছে। তা ছাড়া বিমানবন্দরে শুধু বিমান নয়, কাস্টমসসহ বিভিন্ন সরকারি সংস্থা কাজ করছে। তারা যদি যথাসময়ে মালামাল ডেলিভারির ক্লিয়ারেন্স ও শুল্কায়ন না করেন তাহলে মালামালের চাপ বেড়ে যায়। প্রতিদিন বিমানবন্দর দিয়ে যে পরিমাণ মালামাল আসে তার পুরোটা খালাস করা যাচ্ছে না।
এ কারণে কিছু কিছু চুরি বা নষ্ট হচ্ছে। কাস্টমস সূত্র জানায়, জালিয়াতি ও শুল্ক ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগে তিনটি সিএন্ডএফ ও কুরিয়ার সার্ভিসকে চিহ্নিত করেছে কাস্টমস। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো_ রয়েল এশিয়া, এওয়াইজেড এবং এফএমআই ওয়ার্ল্ড ওয়াইড এঙ্প্রেস। ইতোমধ্যে এদের কারণ দর্শানোর নোটিস দেওয়া হয়েছে। ভুক্তভোগী সালওয়া করপোরেশনের মালিক আমিনুল ইসলাম বলেন, 'পণ্য গায়েব হওয়ার ঘটনায় বিমানবন্দর থানায় ১১ নভেম্বর জিডি করি।
হংকং থেকে থাই এয়ারওয়েজের ফ্লাইটে ৫ নভেম্বর এ পণ্য আসে, যার এয়ার ওয়ে বিল নম্বর ২১৭-৪৬৪৭-১২৯৪। যথারীতি আমাদের সিএন্ডএফ এজেন্ট হলি কার্গো এঙ্প্রেসের কর্মচারীরা কার্গো হাউসে মালামাল খালাস করতে যায়। তখন তাদের জানানো হয়, এসব মালামাল নিয়ে গেছে এনএইচ ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি সিএন্ডএফ প্রতিষ্ঠান। ' আমিনুল ইসলাম অভিযোগ করেন, 'মোজাম্মেল, জসিম ও মুন্না নামের তিনজন এসব মালামাল জালিয়াতি ও প্রভাব খাটিয়ে নিয়ে গেছে। আমি নিজ হাতে কার্গো হাউসের বিমান কর্মচারী (এফটি) আনোয়ারের কাছে এয়ারওয়ে বিল জমা দিয়ে আসি।
পুলিশ ও র্যাবকে এ ঘটনা জানানো হয়। র্যাব সরেজমিন তদন্ত করে ঘটনার সত্যতাও পায়। কিন্তু এখনো এর সুরাহা হয়নি। ' সূত্র জানায়, বিমানবন্দরের কাস্টমস গোডাউনের দায়িত্বপ্রাপ্তদের সমন্বয়ে গঠিত একটি সংঘবদ্ধ জালিয়াতচক্র গোডাউন থেকে ১০ কেজি স্বর্ণও গায়েব করে দিয়েছে। এর পর প্রায় ৪০০ কোটি টাকা দামের ১০৫ কেজি হেরোইন ও মাদক গায়েব করা হয়।
ওই ঘটনায় বিমানবন্দরে ব্যাপক আলোচনা হয়। বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর অনেক তথ্য। সরকারি কোটি কোটি টাকার মালামাল গায়েবের ঘটনার সঙ্গে কাস্টমসের ১১ কর্মকর্তা-কর্মচারীর একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট জড়িত রয়েছে বলে গোয়েন্দারা জানতে পারেন। তবে এর পরও অপরাধী চক্রের সদস্য ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের এ সিন্ডিকেট কোটি কোটি টাকার পণ্য গায়েব করে দিচ্ছে। ঢাকা কাস্টম হাউসের কমিশনার জাকিয়া সুলতানা বিষয়টি স্বীকার করেছেন।
কীভাবে একজনের পণ্য আরেকজন খালাস করে নিয়ে যাচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'ওরা সংঘবদ্ধ জালিয়াত চক্র। বছরের পর বছর ধরে এ ধরনের দুর্বৃত্তপনা করেও পার পেয়ে যাচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলে উল্টো কাস্টম হাউস অচল করে দেওয়ার হুমকি দিত। কিন্তু এবার এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া শুরু হচ্ছে। '
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।