আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কবির নির্জন বাড়িটি



বাবা : [আঙুল তুলে] ওই যে দেখছো ওটাই কাজী নজরুল ইসলামের কবর। ছেলে : [বিস্মিত চেখে তাকিয়ে] ওইটাই! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদের পাশে কাজী নজরুল ইসলামের কবরের পাশ দিয়ে হাঁটার সময় এই দৃশ্য একদিন দেখেছিলাম। সেদিন জানা হয়ে গিয়েছিল, প্রিয় কবিরা প্রয়াত হলে ভক্ত-পাঠকের কাছে কেবল কবির সৃষ্টি নয়, কবির কবরটাও সম্মানিত হয়ে ওঠে। দর্শনীয় হয়ে ওঠে কবির থাকার জায়গা, ব্যবহৃত পোশাক, লেখার টেবিল, কলম, চশমা, এমনকি কবির পায়ে চলার পথও। যে কারণে জীবনানন্দ দাশের কবিতার ধানসিড়ি নদী বা তার পৈতৃক বাড়ির শেষচিহ্ন খুঁটি দুটিও হয়ে ওঠে আমাদের আবেগের অংশ; অদৃশ্য ইশারায় হাতছানি দিয়ে ডাকে রবীন্দ্রনাথের বিশাল ঠাকুরবাড়ি; খুব ইচ্ছে হয় একটু বসতে বিনয় মজুমদারের বাড়িতে গিয়ে।

কেউ কেউ আবার অবাক হয়ে দেখি, হায়াৎ মামুদ সম্পাদিত ‘শ্রেষ্ঠ পাবলো নেরুদা’ নামের বইতে অদেখা দেশ চিলির মহান কবি পাবলো নেরুদার পড়ার লাইব্রেরি, লেখার টেবিল কিংবা বাড়ির বারান্দার ছবি। কেউ ইন্টারনেটে সার্চ করে বের করি এলিয়ট, ইয়েটস বা মাহমুদ দারবিশের বাড়ি, কবর বা মুখচ্ছবি। কিন্তু কেন এই খোঁজ-খবর নেওয়া? নিশ্চয়ই আমরা এগুলোর মধ্যেও খুঁজি কবির জীবদ্দশার ঘ্রাণ, কবির কাল বা হয়তো লৌকিক আলোয় কবির অলৌকিকতা সৃষ্টির উৎসকেই। ২. ২০০৬ সালের ১৭ আগস্ট প্রয়াত হয়েছেন ‘স্বাধীনতা তুমি’র কবি শামসুর রাহমান। কেমন আছে কবিবিহীন কবির লেখার টেবিল, কবির লাইব্রেরি বা কবির বাড়িÑ এটা জানতেই তার পুত্রবধু টিয়ার সাথে কথা হয়।

কড়া রোদ মাথায় নিয়ে একদিন চলে যাই ফটোগ্রাফার তরুকে নিয়ে শামসুর রাহমানের শ্যামলীর বাড়িতে। বর্তমানে এ বাড়িতে বসবাস করছেন কবির স্ত্রী জোহরা রাহমান, ছেলে ফাইয়াজ রাহমান, ছেলের বউ টিয়া রাহমান ও দুই নাতনি নয়না, দীপিতা। কবির দুই মেয়েই বর্তমানে বিদেশে অবস্থান করছেন। অসুস্থ অবস্থায় আছেন কবিপতœী। প্রায় তিন বছর হয়ে গেলো শামসুর রাহমান নেই এখানে, তবু এ বাড়ির সর্বত্রই যেন ছড়ানো তার স্মৃতি।

৩. শামসুর রাহমান জন্মগ্রহণ করেন ১৯২৯ সালের ২৩ অক্টোবর ঢাকার মাহুতটুলীতে। ডাক নাম বাচ্চু। সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র থাকা অবস্থায় ছোট বোন নেহারের মৃত্যুতে একটি কবিতা লেখেন তিনি। তাঁর লেখা জীবনের প্রথম এই কবিতাটি শুনে তাঁর মা কেঁদেছিলেন। এরপর তিনি লিখেছেন অসংখ্য কবিতা।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামসহ বাঙালি-নাগরিক জীবনের নানা চিত্র বিভিন্ন সময়ে উঠে এসেছে তার কবিতায়। ১৯৬৮ সালে আইয়ুব খান তৎকালীন পাকিস্তানের সব ভাষায় অভিন্ন রোমান হরফ চালু করার প্রস্তাব করলে ৪১ জন কবি, সাংবাদিক, সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক ও সংস্কৃতিকর্মীর সঙ্গে এর বিরুদ্ধে বিবৃতি দেন শামসুর রাহমান। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই পরে তিনি লেখেন ‘বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’। ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি গুলিস্তানে একটি মিছিলের সামনে একটি লাঠিতে শহীদ আসাদের রক্তাক্ত শার্ট দিয়ে বানানো পতাকা দেখে মানসিকভাবে আলোড়িত হয়ে, সন্ধ্যায় বাসায় ফিরেই লেখেন ‘আসাদের শার্ট’ কবিতাটি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পরিবার নিয়ে চলে যান নরসিংদী পাড়াতলী গ্রামে।

এপ্রিলের প্রথম দিকে লেখেন তার বিখ্যাত ‘স্বাধীনতা তুমি’ ও ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’ কবিতাদুটি। এভাবেই অসংখ্যবার দেশের নানান সংকটময় মুহূর্ত ইতিহাসের ছবি হয়ে উঠে এসেছে তার কবিতায়। আর এসব কবিতা রচনার মধ্য দিয়েই তিনি আমাদের বাংলাদেশের ইতিহাসেরও অংশ হয়ে ওঠেন। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, অনুবাদ ও শিশুসাহিত্যসহ লিখেছেন শতাধিক বই। সম্ভবত বাংলা কবিতায় এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি সংখ্যক কবিতা লিখেছেন তিনি।

৪. শামসুর রাহমানের বাড়ির সামনে যখন আমরা আসি তখন চারদিকে দুপুরের নীরবতা। দোতলা সুন্দর বাক্সের মতো বাড়িটি স্থির দাঁড়িয়ে। কলিং বেল বাজাতেই দরজা খুলে দেয় গৃহকর্মী। আমার মনে পড়ে তিন-চার বছর আগেও বেল বাজালে বারান্দায় এসে দাঁড়াতেন কবি নিজে। অনুভব করি এই বারান্দায় কবি আর কখনই দাঁড়াবেন না! বাড়িতে ঢুকতেই আমাদের চোখে পড়ে শামসুর রাহমানের কয়েকটা ফটো ও পোর্ট্রটে।

ওইগুলির মধ্যে একটি কাইয়ুম চৌধুরীর আঁকা ‘মুক্তিযুদ্ধের কবি’ শিরোনামে তার এক কোলাজ ছবি। ওই ছবিগুলো দেখতে দেখতে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে থাকি ওপরে, মনে মনে আওড়াই শামসুর রাহমানেরই একটি কবিতা- ‘দেয়ালে মৃতের ফটোগ্রাফ,/পড়েছে ধুলোর কিছু ছাপ,/ছবির দু’চোখ দ্যাখে চেয়ে কৌতূহলে/নিজেকে কাফন মোড়া টেবিলে রয়েছে পড়ে বাসি/ বেলফুল কিছু, শিয়রে স্মৃতির মতো জ্বলে/ নিভৃত আগরবাতি, ফটোর সুস্মিত ঠোঁটে কেমন রহস্যময় হাসি’ [হাসি : শামসুর রাহমান] দোতলায় উঠেই দেখি একটি ডাইনিং টেবিল, এটাতেই সপরিবারে খাওয়াদাওয়া করতেন কবি। প্রবেশ করি কবি যে রুমটাতে থাকতেন সেখানে। রুমের সাজসজ্জায় কিছুটা পরিবর্তন এলেও পরিপাটি করে গোছানো রয়েছে কবির বিছানা, চেয়ার, লেখার টেবিল, কাগজ-কলম, চশমা, টেলিফোন। সাজানো রয়েছে টেবিলের ওপর রবীন্দ্র রচনাবলীর সেট।

মনে হয় কাগজ-কলম আর টেবিল যেন এখনো প্রতীক্ষায়, কখন কবি এসে বসবেন লিখতে। দেখি কবির শয়নরুমে দুটি বুকশেলফ রয়েছে বইয়ে ঠাসা, তবে দেখে মনে হলো দীর্ঘদিন এই বই স্পর্শ করে না কোনো পাঠকের হাত। আমাদের ফটোগ্রাফার একের পর এক ছবি তুলতে থাকেন কবির রুমের, আর আমি দেখি রুমের দেয়ালে ঝুলন্ত কবি আর কবির মায়ের ছবি। কবির মা আমেনা খাতুন প্রয়াত হন ১৯৯৭ সালে। এক ঝলক উঁকি মারি রুমের সাথেই থাকা কবির প্রিয় বারান্দায়, ওখানে বসেই কবি দেখতেন দিন-রাতের দৃশ্য, লোকেদের আসা-যাওয়া, শুনতেন নাগরিক পাখির কিচিরমিচির বা ফেরিওয়ালার হাঁকডাক।

হয়ত ওখানে বসে বা দাঁড়িয়েই কবির মাথায় এসেছে কবিতার বহু পঙক্তি। পাশেই অপর এক রুমে রাখা হয়েছে এ পর্যন্ত কবিতার স্বীকৃতিস্বরূপ পাওয়া কবির বিভিন্ন পুরস্কার। আমরা দেখি পুরস্কারগুলো। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন গুণীজন, যেমনÑ অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক, কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমান, শিল্পী এস এম সুলতানসহ অনেকের সাথে তোলা ছবি সংরক্ষণ করা হয়েছে ভিন্নভাবে। কবির এখনো কোনো অপ্রকাশিত লেখা আছে কিনা জানতে চাইলে, টিয়া রাহমান জানানÑ তাদের কাছে শামসুর রাহমানের কোনো অপ্রকাশিত লেখাই নেই।

তিনি যখন বেঁচে ছিলেন তখন দেখা যেত, নতুন কোনো কবিতা লিখিত হওয়ার আগেই কেউ না কেউ কবিতা ছাপানো জন্য চেয়ে রাখতো। ৫. কবির বিশাল একটা লাইব্রেরি রয়েছে একতলায়, ওটা দেখার জন্য যখন পুনরায় নিচে নামি তখন দেখি সেখানে তালা মারা। বন্ধ লাইব্রেরি-রুম খুলে দিলে চোখে পড়ে শেলফভর্তি দেশি-বিদেশি, খ্যাত-অখ্যাত, নবীন-প্রবীণ অসংখ্য লেখকের বিচিত্র ধরনের বই। এ বইগুলির সংরক্ষণ বা কবির অনুপস্থিতির বিষয়ে টিয়া রাহমান আমাদের বলেন ‘আমার মনেই হয় না আব্বু নেই, আব্বুর মতো মানুষই হয় না। তার মতো ভালো মানুষ আমি আর একটিও দেখিনি।

মাঝেমধ্যে পরিষ্কার করি তার রেখে যাওয়া বইগুলি। এ বইগুলো এখানে যেভাবে আছে সেভাবেই গোছানো অবস্থায় রাখতে চাই। ’ রুমটাকে প্রথমে কিছুটা অগোছালো মনে হলেও বুঝতে পারি এখান থেকে বই চুরি যাওয়ার কোনো সম্ভবনা নেই, কেননা লাইব্রেরির প্রতিটি শেলফই ছিল তালা বন্ধ। তবে বইগুলিতে যেন ধুল জমে আছে, হয়ত এখন আর কেউ এ বইগুলি পড়ার প্রয়োজনই বোধ করে না! কবি যখন ছিলেন প্রতিদিনই নানাজন যেতেন তাঁর কাছে। কবি তাদের সঙ্গ দিতেন তাঁর স্বভাবজাত সৌজন্য আর মমতা নিয়ে।

এখন কবি নেই, তাই সেই সরবতাও নেই। কিন্তু আছে কবির নিজের জগৎ, শান্ত আর নির্জন।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.