সময়... অনাদি... হতে... অনন্তের... পথে...
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি এবং আমাদের প্রিয় মানুষ। সুদীর্ঘ জীবনে তিনি শত শত বই লিখেছেন। এসব বইয়ের মধ্যে ছোটদের জন্য রচিত বইয়ের সংখ্যা কম নয়। গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, নাটক, গান ও ছড়া এসব বইয়ে স্থান পেয়েছে। ছোটদের জন্য আবার পত্রিকাও সম্পাদনা করেছেন।
আবার ছোটদের জন্য রচিত বইয়ের অলঙ্করণ করেছেন তিনি। সে এবং খাপছাড়ার মজাদার ছবিগুলোর কথা সহজে ভোলা যায়' তিনি নিজেও ছিলেন বিশ্বের অন্যতম ছবি আঁকিয়ে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্য জীবন ও কর্মজীবন নিয়ে শত শত বই লেখা হয়েছে। এসব বই পড়ে আমরা কবি সম্পর্কে অবহিত হই। কবি নিজেও নিজের সম্পর্কে তিনখানি বই লিখেছেন।
তিনখানি হলো ছেলেবেলা, জীবনস্মৃতি ও আত্মপরিচয়। এসব বই ছাড়াও তিনি প্রবন্ধ ও চিঠিপত্র নিজেকে তুলে ধরেছেন নানাভাবে। ছেলেবেলা কেবলমাত্র শিশু-কিশোরদের জন্য। এ বইখানি বড়োরাও গভীর আগ্রহ নিয়ে পড়ে থাকেন। কিন্তু অনেকেই জানেন না প্রথমে কবি ছেলেবেলার কাহিনী গদ্য ছন্দে লিখতে শুরম্ন করেন কিন্তু পরে আর তিনি গদ্য ছন্দে লিখতে শুরম্ন করেন কিন্তু পরে আর তিনি গদ্য ছন্দে না লিখে গদ্যে লেখেন।
ছেলেবেলা ১৯৪০ সালে ভাদ্রমাসে গ্রন্থাকারে প্রথম প্রকাশিত হয়। রবীন্দ্রভবনে রড়্গিত পাণ্ডলিপিতে দু’টি কবিতা আছে। কবিতা দু’টির নাম পালকি ও বাল্যদশা। ঐ এ বছর বৈশাখ মাসে লেখা ঐ কবিতা দু’টি গদ্য ছন্দে আঁকা। ছেলেবেলার প্রথম অধ্যায়ের বিষয় বস্তু ঐ দু’টি কবিতায় আঁকা।
একারণেই ধারণা করা হয় তিনি ছেলেবেলায় কাহিনী গদ্য কবিতায় লিখতে চেয়েছিলেন। লিখলে মন্দ হতো না। আমরা তাঁর শৈশব ও কৈশোরের কাহিনী গদ্য কবিতায় পড়তে পারতাম।
ছেলেবেলার ঘটনাগুলো ভারি মজার। রবীন্দ্রনাথ তার শৈশব-কৈশোর, কবিতা লেখা, পরিবারে তার অবস্থা এবং লেখা-পড়ার নিটোল ছবি এঁকেছেন এই গ্রন্থখানিতে।
কোলকাতার পারিপার্শ্বিক বিবরণও তুলে ধরা হয়েছে এই বইটিতে। তিনি বইটির ভূমিকা কিশোর বয়সের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লিখেছেনঃ গোঁসাইজির কাছ থেকে অনুরোধ এল ছেলেদের জন্য কিছু লিখি। ভাবলুম ছেলে মানুষ রবীন্দ্রনাথের কথা লেখা যাক। চেষ্টা করলুম সেই অতীতের প্রেতলোকে প্রবেশ করতে। এখনকার সঙ্গে তার অন্তôর-বাহিরের মাপ মেলে না।
তখনকার প্রদীপে যত ছিল আলো তার চেয়ে ধোঁয়া ছিল বেশি। বুদ্ধির এলাকায় তখন বৈজ্ঞানিক সার্ভে আরম্ভ হয়নি, সম্ভব-অসম্ভবের সীমাসরহদ্দের চিহß ছিল পরস্পর জড়ানো।
সেই সময়টুকুর বিবরণ যে ভাষায় গেঁথেছি সে স্বভাবতই হয়েছে সহজ। যথাসম্ভব ছেলেদেরই ভাবনার উপযুক্ত। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে ছেলে মানুষি কল্পনাজাল মন থেকে কুয়াশার মতো যখন কেটে যেতে লাগল তখনকার কালের বর্ণনার ভাষা বদল করিনি কিন্তু ভাবটা আপনিই শৈশবকে ছাড়িয়ে গেছে।
এই বিবরণটিকে ছেলেবেলাকার সীমা অতিক্রম করতে দেওয়া হয়নি ৈকিন্তু শেষকালে এই স্মৃতি কিশোর বয়সের মুখোমুখি এসে পেঁৗছিয়েছে। সেইখানে একবার স্থির হয়ে দাঁড়ালে বোঝা যাবে কেমন করে বালকের মনঃপ্রকৃতি বিচিত্র পারিপার্শ্বিকের আকস্মিক এবং অপরিহার্য সমবায়ে ক্রমশঃ পরিণত হয়ে উঠেছে। সমস্তô বিবরণটাকেই ছেলেবেলা আখ্যা দেয়ার বিশেষ সার্থকতা এই যে, ছেলেমানুষের বুদ্ধি তার প্রাণশক্তির বৃদ্ধি। জীবনের আদিপূর্বে প্রধানত সেইটেরই গতি অনুসরণযোগ্য। যে পোষণপদার্থ তার প্রাণের সঙ্গে আপনি মেলে বালক তাই চারিদিক থেকে সহজে আত্মসাৎ করে চলে এসেছে।
প্রচলিত শিড়্গাপ্রণালী দ্বারা তাকে মানুষ করবার চেষ্টাকে সে মেনে নিয়েছে অতি সামান্য পরিমাণেই।
ছেলেবেলার শুরম্নতে রয়েছে রবীন্দ্রনাথের সেই বালক শীর্ষক সেই বিখ্যাত কবিতাটি। ছেলেবেলায় সব কাহিনীটুকুর সারাংশ যেন কবিতাটিতে বর্ণনা করেছেন। কবিতাটি এরকমঃ
ছেলেবেলার কাহিনী চৌদ্দটি অধ্যায়ে বিধৃত। প্রত্যেকটি অধ্যায়ের বর্ণনা সহজ-সরল।
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন ৈএ বইটাতে বালভাষিত গদ্যে। ছেলেবেলার শুরম্নটা এরকমঃ
আমি জন্ম নিয়েছিলুম সেকেলে কলকাতায়। শহরে শ্যাকরাগাড়ি ছুটছে তখন ছড়ছড় করে ধুলো উড়িয়ে, দড়ির চাবুক পড়ছে হাড়-বের-করা ঘোড়ার পিঠে। না ছিল ট্রাম, না ছিল বাস, না ছিল মোটরগাড়ি। তখন কাজের এত বেশি হাঁসফাঁসানি ছিল না, রয়ে বসে দিন চলতো।
বাবুরা আপিসে যেতেন কষে তামাক টেনে নিয়ে পান চিবতে চিবতে, কেউবা পালকি চড়ে কেউবা ভাগের গাড়িতে। যাঁরা ছিলেন টাকাওয়ালা তাঁদের গাড়ি ছিল তকমা-আঁকা, চামড়ার আধঘোমটাওয়ালা, কোচবাে কোচমান বসত মাথায় পাগড়ি হেলিয়ে, দুই দুই সইস থাকত পিছনে, কোমরে চামর বাঁধা, হেঁইয়ো শব্দে চমক লাগিয়ে দিত পায়ে-চলতি মানুষকে।
ছেলেবেলার চতুর্থ অধ্যায়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেনঃ আমরা যখন ছোটো ছিলুম, তখন সন্ধেবেলায় কলকাতা শহর এখনকার মতো এতবেশি সজাগ ছিলো না। তখনকারকালে সূর্যের আলোর দিনটা যেমনি কুড়িয়েছে অমনি শুরম্ন হয়েছে বিজলী আলোর দিন। সে সময়টাতে শহরে কাজ কম কিন্তু বিশ্রাম নেই।
উনুনে যেন জ্বল কাঠ নিভছে তবু কয়লায় জ্বলছে আগুন। তেলকল চলে না, স্টিমারের বাঁশি থেমে থাকে, কারখানা থেকে মজুরের দল বেরিয়ে গেছে। পাটের গাঁটটানা গাড়ির মোষগুলো গেছে টিনের নিচে শহুরে গোষ্ঠে।
সমস্তô দিন যে শহুরের মাথা ছিল নানা চিন্তôায় তেতে আগুন, এখনও তার নাড়িগুলো যেন দব দব করছে। রাস্তôার দু’ধারে দোকানগুলোতে কেনাবেচা তেমনি আছে, কেবল সামান্য কিছু ছাই-চাপা।
রকম-বেরকম গোঙানি দিতে দিতে হাওয়া গাড়ী ছুটেছে দশ দিকে, তাদের দৌড়ের পিছনে গরজের ঠেলা কম।
আলাদা বই হিসেবে ছেলেবেলার অনেক সংস্ড়্গরণ হয়েছে। ছোটবড়ো সকলেই এই বইটির পাঠক। বিশ্বভারতী থেকে প্রকাশিত রবীন্দ্র রচনাবলীর ষড়বিংশ খণ্ডে ছেলেবেলা স্থান পেয়েছে। এই খণ্ডে রবীন্দ্রনাথের লেখা ছোটদের বই ছড়া, গল্পসল্প, সে বাংলাভাষার পরিচয় লিপিকাও স্থান পেয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১২৬৮ বঙ্গাব্দের ২৫শে বৈশাখ জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, মায়ের নাম সারদা দেবী। তাদের পরিবার ছিলো পীরালী ব্রাহ্মণবংশের। আগামী সোমবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ৬৭তম মৃত্যুদিবস। ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দের ৭ই আগস্ট তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
আমরা তাঁকে স্মরণ করি ও শ্রদ্ধা জানাই। তথ্যঃ ইত্তেফাক।
বয়স তখন ছিল কাঁচা, হালকা দেহখানা
ছিল পাখির মতো, শুধু ছিলনা তার ডানা।
উড়ত পাশের ছাদের থেকে পায়রাগুলোর ঝাঁক,
বারান্দাটার রেলিঙ’ পরে ডাকত এসে কাক।
ফেরিওয়ালা হেঁকে যেত গলির ও পার থেকে
তপসিমাছের ঝুড়িখানা গামছা দিয়ে ঢেকে।
বেহালাটা হেলিয়ে কাঁধে ছাদের পরে দাদা,
সন্ধ্যাতারার সুরে যেন সুর হত তাঁর সাধা।
জুটেছি বৌদিদির কাছে ইংরেজি পাঠ ছেড়ে,
মুখখানিতে ঘের দেওয়া তাঁর শাড়িটি লালপেড়ে।
চুরি ক’রে চাবির গোছা লুকিয়ে ফুলের টবে
স্নেহের রাগে লাগিয়ে দিতেন নানান উপদ্রবে।
কিশোরী চাটুজ্যে হঠাৎ জুটত সন্ধ্যা হলে,
বাঁ হাতে তার থেসো হুঁকো, চাদর কাঁধে ঝোলে।
দ্রম্নতলয়ে আউড়ে যেত লবকুশের ছড়া,
থাকত আমার খাতা লেখা, পড়ে থাকত পড়া;
মনে মনে ইচ্ছে হত যদিই কোনো ছলে
ভরতি হওয়া সহজ হত এই পাঁচালির দলে,
ভাবনা মাথায় ছাপত নাকো কাসে ওঠার দায়ে,
গান শুনিয়ে চলে যেতুম নতুন নতুন গাঁয়ে।
স্কুলের ছুটি হয়ে গেলে বাড়ির কাছে এসে
হঠাৎ দেখি, মেঘ নেমেছে ছাদের কাছ ঘেঁষে।
আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামে, রাস্তôা ভাসে জলে,
ঐরাবতের শুঁড় দেখা দেয় জল-ঢালা সব নলে।
অন্ধকারে শোনা যেত রিমঝিমিনি ধারা,
রাজপুত্র তেপান্তôরে কোথা, সে পথহারা।
ম্যাপে যেসব পাহাড় জানি, জানি যেসব গাঙ
কুয়েনলুন আর মিসিসিপি, ইয়াংসিকিয়াঙ-
জানার সঙ্গে আধেক-জানা, দূরের থেকে শোনা,
নানা রঙের নানা সুতোয় সব দিয়ে জাল-বোনা,
নানারকম ধ্বনির সঙ্গে নানান চলাফেরা
সবদিয়ে এক হালকা জগৎ মন দিয়ে মোর ঘেরা-
ভাবনাগুলো তারি মধ্যে ফিরত থাকি থাকি
বানের জলে শ্যাওলা যেমন, মেঘের তলে পাখি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।