সত্য প্রকাশে সবসময় নির্ভিক।
প্রণব মুখার্জির ঝটিকা সফরের পর আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি সাংবাদিকদের ডেকে যেসব কথা বললেন, তাতে করে আমি নিশ্চিত হতে পারছি না তার কথার মধ্যে সত্যতা কতটুকু আছে। তিনি স্পষ্ট করেই বলেছেন, ‘ভারতের ঋণে রেল-নদী-সড়ক ও বন্দর উন্নয়ন হলে উভয় দেশই লাভবান হবে। ’ আমরা তো লাভবান হতেই চাই। কিন্তু ওই চুক্তিতে বাংলাদেশ কতটুকু লাভবান হবে? পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা দিলে যে আয় হবে, সেটা বাংলাদেশের রোজগারের অন্যতম উপায় হবে।
’ তার ভাষায়
১. বাংলাদেশ নেপাল ও ভুটানে যাওয়ার জন্য ভারতের ট্রানজিট পাবে,
২. যেসব প্রকল্পে ঋণ নেয়া হয়েছে, তা চিহ্নিত করবে বাংলাদেশ,
৩. ভারতীয় ঋণের কোনো শর্ত নেই,
৪. তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি এ বছর হবে না,
৫. সিডর উপদ্রুত এলাকায় ভারত যে ঘরবাড়ি তৈরি করে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সে ব্যাপারে অগ্রগতি নেই,
৬. ভারতীয় ঋণ অন্য দাতাদের ঋণের চেয়ে সস্তা ও সহজ। এসব কথা কি পররাষ্ট্রমন্ত্রী সত্য বলেছেন? পররাষ্ট্রমন্ত্রী সত্য কথা বলেননি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী যখন বলেন যেসব প্রকল্পে ঋণ নেয়া হবে, তা চিহ্নিত করবে বাংলাদেশ। ঠিক তখনই ভারতীয় হাইকমিশন এক বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছে, প্রকল্পগুলো উভয় দেশই চিহ্নিত করবে (যুগান্তর, ৯ আগস্ট)। তাহলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাতিকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে কার স্বার্থ রক্ষা করলেন? তিনি বলেছেন, ভারতীয় ঋণ সহজ ও সস্তা।
এটিও সত্য নয়। এক সময়ে বিশ্বব্যাংকে কাজ করা সাবেক আমলা ড. আকবর আলি খান (যিনি কোনো অবস্থায় বিএনপির রাজনীতির সমর্থক নন) জানিয়েছেন, বিশ্বব্যাংক, এডিবি বা আইএমএফ শতকরা পয়েন্ট ২৫ থেকে ১ ভাগ সুদে বিভিন্ন ঋণ দেয়। আর ভারতের সুদের পরিমাণ ১ দশমিক ৭৫। কমিটমেন্ট চার্জ নামে পয়েন্ট ৫০ পার্সেন্ট সুদ ধরা হয়েছে। কাবুলিওয়ালারাও এ ধরনের সুদ নেয়নি।
চুক্তি করার পর যদি এ টাকা ব্যয় না হয় তবুও বাংলাদেশকে প্রতিশ্রুত টাকার ওপর বছরের পর বছর কমিটমেন্ট চার্জ নামের এ সুদ দিতে হবে (আমার দেশ, ৯ আগস্ট)। বাংলাদেশের এডিবি প্রকল্পের প্রধান জাহিদ হোসেনও মনে করেন, ভারতীয় ঋণে যে ১৪টি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে, তাতে ব্যয় হবে ৬০০ মিলিয়ন ডলার। অবশিষ্ট ৪০০ মিলিয়ন ডলারের জন্য আরও প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশের অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, প্রকল্প বাস্তবায়ন ঠিকমত হয় না। আর এ ক্ষেত্রে এমনটা যদি ঘটে তবে ঋণের এই চুক্তি কাজে আসবে না (ডেসটিনি ৯ আগস্ট)।
এসব বক্তব্য থেকে কি মনে হয় ভারতীয় ঋণ সম্পর্কে আমাদের দীপু মনি সত্য কথা বলেছেন? তিনি আবারও অসত্যের আশ্রয় নিয়েছেন, যখন তিনি বলেছেন ঋণের কোনো শর্ত নেই।
তামাম অর্থনীতিবিদরা বললেন, ঋণের যে শর্ত আছে তাতে শতকরা ৮৫ ভাগ পণ্য ভারত থেকে কিনতে হবে আর সেবা (বিশেষজ্ঞ নিয়োগ) নিতে হবে একশ ভাগ। মিথ্যা তথ্য দিয়ে কার স্বার্থ রক্ষা করছেন দীপু মনি? দীপু মনি বলেছেন, আমরা লাভবান হবো। কথাটা মিথ্যা। দৃষ্টান্ত—এক. সরাইল-ব্রাহ্মণবাড়িয়া-সুলতানপুর-চিনাইর-আখাউড়া- সোনারসাদ সড়ক উন্নয়ন।
এই সড়ক উন্নয়ন করা হবে ভারতীয় হেভি ট্রাক চলাচলের জন্য, ট্রানজিটের আওতায়। বাংলাদেশের স্বার্থে এটি নয়। দুই. আশুগঞ্জ অভ্যন্তরীণ কনটেইনার নৌ-বন্দর উন্নয়ন করা হবে। এটি করা হবে ভারতীয় ওডিসি (ওভার ডাইমেনশনাল কার্গো) পরিবহনের জন্য। ওডিসি চলাচলের সময় স্থানীয় ট্রাফিক বন্ধ থাকবে।
এই রুটে পণ্যবাহী ট্রাকও চলাচল করবে (যুগান্তর, ২৩ জুলাই)। তিন. রেলওয়ের অ্যাপ্রোচসহ দ্বিতীয় ভৈরব ও দ্বিতীয় তিতাস সেতু নির্মাণে ব্যয় হবে ঋণের একটা অংশ। এটা করা হবে ভারতীয় স্বার্থে, ট্রানজিটের সুবিধার্থে। চার. ঋণের আওতায় বিআরটিসির জন্য দোতলা বাস, সাধারণ বাস ও আর্টিকুলেটেড বাস কেনা হবে। এ বাসের ক্রয়মূল্য যাচাই করার কোনো সুযোগ নেই।
যে মূল্য নির্ধারিত হবে তা দিয়েই কিনতে হবে। দক্ষিণ কোরিয়া কিংবা চীন থেকে এর চেয়ে সস্তায় বাস পাওয়া গেলেও তা কেনা যাবে না শর্তের কারণে। পাঁচ. বারইয়ারহাট-হেয়াকো-রামগড়-সাবরুম স্থলবন্দর সংযোগ সড়ক নির্মাণ করা হবে, যাতে করে ভারতীয় কার্গো চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করতে পারে। এটাও ভারতের স্বার্থে, বাংলাদেশের স্বার্থে নয়। উপরন্তু চট্টগ্রাম বন্দর আছে এমনিতেই নানা সমস্যায়।
বাংলাদেশি কনটেইনার হ্যান্ডলিং নিয়ে এ বন্দরটি হিমশিম খাচ্ছে। উপরন্তু কর্ণফুলী নদীতে নাব্যতা বৃদ্ধি পাওয়ায় একটা বড় ধরনের জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। যেখানে বহির্নোঙরে কোনো কোনো জাহাজের অবস্থান সময় ১৫ দিন পার হয়ে যায়, জেটিতে ভেড়ার পর কনটেইনার খালাসে লেগে যায় ৭-৮ দিন (যুগান্তর, ৯ আগস্ট), সেখানে আমরা আগামীতে ভারতীয় কনটেইনার হ্যান্ডলিং করতে দিই কীভাবে? এতে করে বাংলাদেশী আমদানি-রফতানি একটি ঝুঁকির মুখে থাকবে। ছয়. ১৪টি প্রকল্পে ভারতীয় ঋণ ব্যবহৃত হবে। প্রকল্পে ব্যয়কৃত অর্থ থেকে বাংলাদেশ কতটুকু শুল্ক পাবে তা স্পস্ট নয়।
সাত. বাংলাদেশ প্রায় ১১০০ কোটি টাকা ব্যয় করে বাংলাদেশ ও ভারত অংশে মোট ১২০ কিলোমিটার গ্রিডলাইন স্থাপন করে ৩ বছর পর ভারত থেকে বিদ্যুত্ আমদানির উদ্যোগ নিয়েছে। অথচ এই টাকা ব্যয় করে বাংলাদেশ নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করতে পারত। উপরন্তু ভারতের যেখানে নিজেরই বিদ্যুত্ ঘাটতি রয়েছে, সেখানে বাংলাদেশে বিদ্যুত্ সরবরাহের একটি যুক্তি থেকেই যায়। এ ক্ষেত্রে ‘রাজনৈতিক বিবেচনা’ প্রশ্নটি না হয় বাদই দিলাম। আট. বাংলাদেশ নেপাল ও ভূটানে আবার ট্রানজিট পাবে—পররাষ্ট্রমন্ত্রী খুব আশাবাদী।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী কি ইতিহাস পড়েন?
১৯৯৬-২০০০ মেয়াদের আওয়ামী লীগের শাসনামলে তত্কালীন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ নেপালের সঙ্গে ট্রানজিট চালু করেছিলেন। কিন্তু মাত্র ১৫ মিনিট পর সেটি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি অনুযায়ী বেরুবাড়ী আমরা ভারতকে দিয়েছিলাম। এ জন্য সংবিধানে সংশোধনীও আনা হয়েছিল। কিন্তু তিনবিঘা ভারত আমাদের কোনোদিন দেয়নি।
এখন ভারতীয় কথায় আমরা কতটুকু আশ্বস্ত হতে পারি? তিস্তা নিয়ে বাকি একটি চুক্তি হবে—দীপু মনি আমাদের বলেন সে কথা। যে সরকার গঙ্গার চুক্তি করে বাংলাদেশের পানি প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে পারে না, সেগুনবাগিচার শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে দীপু মনিরা যখন পদ্মায় চাষাবাদ কিংবা গড়াই নদীতে সাঁকো দেয়া ছবি দেখেও না দেখার ভান করেন, সেখানে তিস্তা নিয়ে চুক্তি হবে, উত্তরাঞ্চলের মানুষের পানি প্রাপ্তি নিশ্চিত হবে—এতে কতটুকু আশ্বস্ত হতে পারি আমরা? সিডর উপদ্রুত এলাকায় ঘরবাড়ি তৈরি করার আশ্বাস দিয়েও তৈরি করেনি ভারত। সীমান্তে পাখির মতো মানুষ মারে বিএসএফ। সেগুনবাগিচায় দীপু মনিদের কাছে তা গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় না। সীমান্ত চিহ্নিত হয় না।
তা নিয়েও আমরা কথা বলি না। ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ৮০ লাখ পিস শার্ট কিনবেন বাংলাদেশ থেকে। ওই শার্ট আজও ভারতে যায়নি। স্পর্শকাতর তালিকা তৈরি করে বাংলাদেশী পণ্যের ভারতে প্রবেশ বন্ধ রেখেছে। ভারত-আমরা দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় এ প্রশ্নে শক্ত অবস্থান নিতে পারিনি।
ট্রানজিটের পক্ষে আবারও যুক্তি দেখালেন দীপু মনি। ট্রানজিটের মাধ্যমে ভারত চাচ্ছে মূলত করিডোর। ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে যাওয়ার জন্য বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করা। এতে করে আমাদের লাভবানের কোনো সুযোগ নেই। পাঠক, আসুন একটু ম্যাপের দিকে চোখ বুলানো যাক।
ভারত ট্রানজিট চাচ্ছে তার নিজের স্বার্থে। কেননা অনেকটা পথ ঘুরে এখন ভারতীয় পণ্য উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোয় প্রবেশ করছে। এখন যে পথে ভারতীয় পণ্য চলাচল করে তা অনেকটা এরকম : কলকাতা-আগরতলা (ত্রিপুরা) ১৬৮০ কিমি, কলকাতা-আইজল (মিজোরাম) ১৫৫০ কিমি, কলকাতা-শিলং (মেঘালয়) ১১৮০ কিমি ও কলকাতা-কোহিমা (নাগাল্যান্ড) ১৪২০ কিমি। ভারত বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে এসব করিডোর সুবিধা লাভ করায় এই দূরত্ব কোনো কোনো ক্ষেত্রে এক-তৃতীয়াংশেরও কম হবে। ভারত যখন আগামীতে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করবে, তখন ওইসব স্থানের দূরত্ব হবে নিম্নরূপ : চট্টগ্রাম-আগরতলা ২৪৮ কিমি, চট্টগ্রাম-আইজল ৬৫৫ কিমি (নদীপথে ২৫০ কিমি), চট্টগ্রাম-শিলং ৫৭৫ কিমি ও চট্টগ্রাম-কোহিমা ৮৮০ কিমি।
মাননীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এতে করে লাভ কাদের হলো? ‘কানেকটিভিটি’ শব্দটি আমাদের কাছে খুব পরিচিত হয়ে গেছে ইদানীং। এই কানেকটিভিটির আওতায় ভারতকে আমরা করিডোর দিচ্ছি। কিন্তু ভারতের কাছ থেকে আমরা সেই সুযোগ কোনোদিন আদায় করে নিতে পারিনি। আগামীতেও পারব না।
আমি আবারও বলি, ভারত আমাদের বন্ধু দেশ।
ভারতের সাহায্য ও সহযোগিতা আমাদের প্রয়োজন আছে। আমরা ভারতীয় সাহায্য অবশ্যই নেব। কিন্তু সবকিছু যেন একপক্ষীয় হয়ে যাচ্ছে। আমাদের স্বার্থ রক্ষিত হচ্ছে না। ভারত তার সুবিধা আদায় করে নিচ্ছে।
কিন্তু আমরা আমাদের ন্যূনতম সুবিধাটুকুও আদায় করে নিতে পারছি না। আমাদের পররাষ্ট্রনীতির ব্যর্থতা এখানেই। সম্পর্ক হওয়া উচিত সমমর্যাদা ভিত্তিক। ভারত সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে এই সমমর্যাদার বিষয়টিকে উপেক্ষা করছে।
ড. তারেক শামসুর রেহমান
লেখক : আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিশ্লেষক
[সূত্রঃ আমার দেশ, ১৫/০৮/১০]
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।