আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সংবিধান সংশোধন : আশাবাদ ও আশংকা গণআন্দোলনের শক্তিই গণতান্ত্রিক অধিকারের রক্ষাকবচ

মাঝে মাঝে মন নিয়ন্ত্রনহীন হতে চায়; কিন্তু...............

। । ভ্যানগার্ড প্রতিবেদন। । যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং সংবিধান সংশোধন এ দুটো বিষয় নিয়ে নানা মহল থেকে এত কথা বলা হচ্ছে যে রাজনীতির বাতাসে এখন ছোটখাটো ঘূর্ণিঝড়ই চলছে বলা যায়।

বিশেষত সংবিধান সংশোধন নিয়ে এখন যত কথা চালাচালি হচ্ছে তা বোধ করি সংবিধান প্রণয়নের সময়ও হয়নি। গত ২৭ জুলাই সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ কর্তৃক ৫ম সংশোধনীকে বাতিল করে দেয়া রায়ে সামরিক শাসনকে বেআইনি ঘোষণা এবং একে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসাবে উল্লেখ করার পাশাপাশি ‘সব ধরনের সংবিধান বহিভূর্ত কর্মকা-কে চিরকালের জন্য বিদায়’ জানানোর কথা বলা হয়েছে। এ রায় প্রকাশের পর কিছু বিষয় নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। বিতর্কের কেন্দ্রে রয়েছে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি এবং রাজনৈতিক দলগুলো কীভাবে নিষিদ্ধ হবে এবং আদালতের রায় কীভাবে সংবিধানে সংযোজিত হবে। এছাড়া সংবিধানের অন্যান্য অগণতান্ত্রিক সংশোধনী বাতিল, বিভিনড়ব সময় অবৈধ পন্থায় রাষ্ট্রক্ষমতা দখলকারীদের বিচার ইত্যাদি বিষয় নিয়েও বিতর্ক চলছে।

দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে নির্বাচিত তথাকথিত গণতান্ত্রিক শাসকরা যখন সংবিধান লঙ্ঘন করেছে বা করছে তার বিচার হবে কিনা, এ প্রশড়বও উঠেছে। ’৭২-এর মূল সংবিধানে ফিরে যাওয়া বা ’৭২-এর সংবিধান পুনঃস্থাপন একটি আলোচিত দাবি। আওয়ামী লীগ নানা সময়ে এ দাবি তুলেছে। ’৭২-এর সংবিধানে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক চেতনাকে শাসকশ্রেণী অস্বীকার করতে পারেনি। তারপরও বহু অসম্পূর্ণতা নিয়ে জারি করা ওই সংবিধান গত ৩৯ বছর ধরে নানা কায়দায় বিকৃত এবং নস্যাৎ করা হয়েছে।

দেশের অপরাপর বাম-গণতান্ত্রিক মহলের পক্ষ থেকেও ওই সংবিধানের অসম্পূর্ণতা দূর করে পুনঃস্থাপনের কথা বলা হয়েছে। ৫ম সংশোধনীবাতিলের রায় ঘোষিত হওয়ার পর ’৭২-এর মূল সংবিধান কীভাবে পুনঃস্থাপিত হবে, ওই সংবিধানের অসম্পূর্ণতাগুলো দূর করা হবে কিনা তা নিয়েও জোর বিতর্ক চলছে। ইতোমধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে সংবিধান সংশোধনের জন্য পার্লামেন্টারি বিশেষ কমিটি গঠন করা হয়েছে। বিতর্ক কমিটির গঠন নিয়েও রয়েছে। সংবিধানের ইংরেজি প্রতিশব্দ কনস্টিটিউশন (ঈড়হংঃরঃঁঃরড়হ) যার আভিধানিক অর্থ হল গঠনতন্ত্র।

অর্থাৎ রাষ্ট্রটি কিভাবে গঠিত এবং পরিচালিত হবে তা এখানে বিবৃত থাকে। সংবিধান রচিত হয় জনগণের আকাক্সক্ষার ভিত্তিতে। জনগণের আকাক্সক্ষা, অভিপ্রায় এবং অধিকারকে আইন রূপে হাজির করা হয় সংবিধানে। এটিই দেশের সর্বোচ্চ আইন, শাসকরা এর ভিত্তিতেই দেশ চালাবে। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে।

এরও পেছনে আছে পাকিস্তানী স্বৈরশাসকদের ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ২৩ বছরের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ধারাবাহিকতা। ফলে আমাদের সংবিধানে কিছু অসম্পূর্ণতা সত্ত্বেও আপেক্ষিক অর্থে জনগণের গণতান্ত্রিক আশা-আকাক্সক্ষা প্রতিফলিত হয়েছিল এবং তা বাস্তবায়নের অঙ্গীকারও ঘোষিত হয়েছিল। বলা হয়েছিল যে শাসকগোষ্ঠি এর প্রতি অনুগত থাকবে। কিন্তু গত ৩৯ বছরে তা হয়নি। দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর, ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর ‘জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা’কে রাষ্ট্রীয় ৪ মূলনীতি ঘোষণা করে প্রণীত এবং ১৬ ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হয় আমাদের সংবিধান।

এরপর গত ৩৯ বছরে সংবিধানে ১৪ বার সংশোধনী আনা হয়েছে যায় প্রায় সবকটিই শাসকদের ইচ্ছা ও অভিলাষ পূরণ করা এবং তাদের ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করার স্বার্থে। দেশের সর্বোচ্চ আদালত, যার হাতে সংবিধান অক্ষুণড়ব রাখার দায়িত্ব (অতীতে এ ভূমিকা আদালত কতটুকু পালন করেছে সেটা ভিনড়ব বিতর্ক), সংবিধানের ৫ম সংশোধনী বাতিল করে দেয়া রায়ের মাধ্যমে একটি ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছেন। ৫ম সংশোধনী জিয়াউর রহমানের শাসনামলে ১৯৭৯ সালের ৫ ও ৬ এপ্রিল প্রণীত হয়েছিল সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী। এই সংশোধনী দ্বারা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল তারিখের মধ্যে প্রণীত সকল সামরিক ফরমান, আইন ও বিধান সংবিধানের অঙ্গীভূত করা হয়। এর মধ্যে শেখ মুজিবর রহমানসহ তাঁর পরিবারের নিহত সদস্যদের হত্যার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচার থেকে রেহাই দিয়ে খন্দকার মোশতাকের সময় জারিকৃত ইন্ডেমনিটি অর্ডিনেন্সও রয়েছে।

পঞ্চম সংশোধনী দ্বারা একদলীয় বাকশাল ব্যবস্থা বাতিল করে বহুদলীয় ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করা হলেও দ্বিতীয় ও চতুর্ সংশোধনী দ্বারা যেসব কালাকানুন প্রবর্তন করা হয়েছিল তা’ অক্ষত রয়ে যায়। বরং পূর্ববর্তী কালাকানুনের সঙ্গে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে সংযুক্ত সাম্প্রদায়িকতা মিলে সংবিধান আরও ভয়ঙ্কর মূর্তি ধারণ করে। প্রমত, পঞ্চম সংশোধনী দ্বারা সংবিধানের প্রস্তাবনার শীর্ষে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ সংযোজিত হয়েছে। রাষ্ট্র পরিচালনার একটি মূলনীতি ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ পরিবর্তন করে তদস্থলে ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহের উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ স্থাপন করা হয়েছে। মূল সংবিধানে বলা হয়েছিল, “আমরা, বাংলাদেশের জনগণ, ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসের ২৬ তারিখে স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়া জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করিয়াছি; আমরা অঙ্গীকার করিতেছি যে, যে সকল মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদদিগকে প্রাণোৎসর্গ করিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল Ñ জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার সেই সকল আদর্শ এই সংবিধানে মূলনীতি হইবে।

” সংশোধনীতে ‘জাতীয় মুক্তির’ স্থলে ‘জাতীয় স্বাধীনতা’ এবং ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ বাতিল করে জাতীয়তাবাদের পূর্বে ‘সর্বশক্তিমান আল−াহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ সংযোজন করা হয়েছে। এটা এমনভাবে যুক্ত করা হয়েছে যার অর্থ দাঁড়ায় ’৭১- এর যুদ্ধটা মুক্তিযুদ্ধ নয়, এক ধরনের ধর্মযুদ্ধ ছিল। একইসাথে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি সম্পর্কে বলা হল যে, “সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাসই হইবে যাবতীয় কার্যাবলীর ভিত্তি। ” মূল সংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছিল যে Ñ “ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি বাস্তবায়নের জন্য Ñ সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতা, রাষ্ট্র কতৃর্ক কোন ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দান, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মীয় অপব্যবহার এবং কোন বিশেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তাহার উপর নিপীড়ন বিলোপ করা হবে। ” এই অনুচ্ছেদটি বাতিল করা হয়।

মূল সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদের শর্তাংশে বলা হয়েছিল, “তবে শর্ত থাকে যে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যসম্পনড়ব বা লক্ষানুসারী কোন সাম্প্রদায়িক সমিতি বা সংঘ কিংবা অনুরূপ উদ্দেশ্য সম্পনড়ব বা লক্ষানুসারী ধর্মীয় নামযুক্ত বা ধর্মভিত্তিক অন্য কোন সমিতি বা সংঘ গঠন করিবার বা তাহার সদস্য হইবার বা অন্য কোন প্রকারে তাহার তৎপরতায় অংশগ্রহণ করিবার অধিকার কোন ব্যক্তির থাকিবে না। ” এই অনুচ্ছেদটিও বাতিল করা হয়। দ-প্রাপ্ত পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সহযোগীরা মূল সংবিধান অনুসারে সংসদ সদস্য হতে পারতো না। পঞ্চম সংশোধনী দ্বারা ওই বিধানটি রদ করা হয়। এছাড়া বিচার বিভাগ সম্পর্কিত দুটো সংশোধনী আনা হয়েছিল।

ওই সংশোধনীতে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে বাতিল করে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ স্থাপন করা হয় এবং বাংলাদেশের জনগণের নাগরিকত্ব বাংলাদেশী হিসাবে উল্লেখ করা হয়। ৫ম সংশোধনী বাতিলের ইতিহাস একটি সিনেমা হলের মালিকানা সংμাšও মামলায় অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবেই এ রায় এসেছে। রাজধানীর পুরাতন ঢাকায় অবস্থিত ‘মুন’ সিনেমা হলের মালিক হলের মালিকানা সংμাšও বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে একটি রিট আবেদন দায়ের করেন। ওই রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০০৫ সালের ২৯ আগস্ট মাননীয় বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক ও বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীরের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করেন। ওই রায়ে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত জারি করা সমস্ত সামরিক ফরমান অবৈধ ঘোষণা করা হয়।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করার পর আওয়ামী লীগ নেতা খন্দকার মোশতাক আহমদ, একই বছরের ৬ নভেম্বর বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম এবং ২৯ নভেম্বর ১৯৭৬ জেনারেল জিয়ার ক্ষমতা গ্রহণ এবং সামরিক শাসন জারিকে অবৈধ ঘোষণা করে। রায়ে বলা হয়, ওই সময়ের মধ্যে জারি করা সামরিক শাসকদের বিভিনড়ব ফরমান এবং আদেশে সংবিধানের শ্রেষ্ঠত্ব ক্ষুণড়ব হয়েছে বলে তা অবৈধ। আদালত সংবিধানের চতুর্ তফসিলের ৩(ক) অনুচ্ছেদ যা পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে যুক্ত করা হয়েছে তা সংবিধান-পরিপন্থি হিসাবে ঘোষণা করেন। হাইকোর্ট পর্যবেক্ষণসহ ২২টি মতামত দেন। হাইকোর্ট বলেছিল, এই সংশোধনীর মাধ্যমে জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে।

হাইকোর্ট এ রায় ঘোষণার পর তৎকালীন বিএনপি-জামাত জোট সরকার রায়টি স্থগিত করার আবেদন করলে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের মাননীয় চেম্বার জজ ওইদিনই রায়ের কার্যকারিতা স্থগিত করেন। এরপর জোট সরকার হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল (আপিল অনুমতির আবেদন) করেন। বর্তমান মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর আপিল আবেদন প্রত্যাহার করে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে জামাত সমর্থক সুপ্রিম কোর্টের তিনজন আইনজীবী এবং পরে বিএনপির মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন সরকারের আপিল অনুমতির আবেদনের সঙ্গে পক্ষভুক্ত হয়ে হাইকোর্টের রায় বাতিলের পক্ষে বক্তব্য রাখতে চান। এরই মধ্যে গত ৩ জানুয়ারি সরকারের আবেদনে লিভ টু আপিল প্রত্যাহার করার অনুমতি দেন আপিল বিভাগ।

হাইকোর্টের রায়ের ওপর যে স্থগিতাদেশ ছিল তাও তুলে নেওয়া হয়। পরে বিএনপি মহাসচিব ও জামাত সমর্থক তিন আইনজীবী সুপ্রিম কোর্টের অনুমতি নিয়ে লিভ টু আপিল দাখিল করেন। ২ ফেব্রুয়ারি পরিমার্জন ও পর্যবেক্ষণ সাপেক্ষে লিভ টু আপিল খারিজ করে দেন আপিল বিভাগ। তৎকালীন মাননীয় প্রধান বিচারপতি মো. তাফাজ্জুল ইসলামের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের ছয় বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ যে রায় দেন তা গত ২৭ জুলাই ঘোষণা করা হয়। ৫ম সংশোধনী বাতিল হলেই কি সংবিধান গণতান্ত্রিক হয়ে যাবে? সংবিধানের অগণতান্ত্রিক সংশোধনী নিয়ে আমরা বিভিনড়ব সময় আলোচনা করেছি।

আমরা বলেছি যে সংবিধানের ২য়, ৫ম, ৮ম সংশোধনী বহাল থাকলে এ সংবিধানের কোনো গণতান্ত্রিক চরিত্র থাকবে না, এর সাহায্যে গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠাও সম্ভব হবে না। এখানে এ নিয়ে বিস্তৃত আলোচনার সুযোগ নেই, তারপরও সংক্ষেপে কিছু বিষয় উল্লেখ করা দরকার। ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে যে সংবিধান বাংলাদেশে বলবৎ হয়েছিল, তা অক্ষত অবস্থায় এক বছরও অতিμম করতে পারেনি। সংবিধান জারির সাত মাসের মাথায় ১৯৭৩ সালের ১৫ জুলাই থেকে সংবিধানের দ্বিতীয় সংশোধনী কার্যকর হয়। এই দ্বিতীয় সংশোধনী দিয়ে সংবিধানে বর্ণিত মৌলিক অধিকারের রক্ষাকবচ গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়।

সংবিধানের তৃতীয়ভাগে ২৬ থেকে ৪৭ (ক) অনুচ্ছেদ পর্যন্ত মৌলিক অধিকার সংμাšও বিষয়গুলি লিপিবদ্ধ আছে। এখানে বলা আছে, রাষ্ট্র নাগরিকদের কোন কোন অধিকারের নিশ্চয়তা দেবে। যদিও ওই অনুচ্ছেদসমূহে অনড়ব, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও কাজ-কে মৌলিক অধিকার হিসাবে অন্তভুর্ক্ত করা হয় নি। এটা আমাদের সংবিধানের একটা বড় দুর্বলতা। যা হোক, মূল সংবিধানের ২৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছিল, ওই সমস্ত মৌলিক অধিকার অলঙ্ঘনীয়।

অর্থাৎ দেশে এমন কোনো আইন থাকতে পারবে না বা ভবিষ্যতেও প্রণয়ন করা যাবে না যা ‘মৌলিক অধিকারে’র পরিপন্থী। এই বিধানের বদৌলতে ইংরেজ ও পাকিস্তানী আমলে প্রণীত সকল অগণতান্ত্রিক কালাকানুন আপনাআপনি বাতিল হয়ে যাবে। সেই সাথে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের মতলব খারাপ হলেই তারা তাদের ইচ্ছামত এমন কোনো আইন প্রণয়ন করতে পারবে না যা সংবিধানের তৃতীয় ভাগে বর্ণিত কোনো মৌলিক অধিকার খর্ব করতে পারে। তাই মূল সংবিধানের ২৬ অনুচ্ছেদ মৌলিক অধিকার সুরক্ষার এমন এক দুর্ভেদ্য প্রাচীর গড়ে তুলেছিল যে, ৩৩০ জন সাংসদ একত্রে মিলেও মৌলিক অধিকারের বুকে একটা আঁচড়ও কাটতে পারতেন না। কিন্তু এহেন দুর্ভেদ্য প্রাচীরের স্থায়ীত্ব ছিল মাত্র সাত মাস।

দ্বিতীয় সংশোধনী ওই প্রাচীরের গায়ে একটা বিরাট ফাটল ধরিয়ে দেয়, কালাকানুন জারির সিংহদ্বার খুলে দেয়। দ্বিতীয় সংশোধনীতে ২৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে বলা হলো Ñ “সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদের অধীনে প্রণীত সংশোধনের এই অনুচ্ছেদের কোন কিছুই প্রযোজ্য হবে না। ” এরমাধ্যমে সংবিধান সংশোধন করে মৌলিক অধিকার পরিপন্থী আইন প্রণয়ন করার ক্ষমতা সংসদকে দেয়া হল। অর্থাৎ সংবিধানের অন্যান্য অনুচ্ছেদ যেমন সংশোধন করা যায় তেমনি মৌলিক অধিকার সংμাšও অনুচ্ছেদগুলিও সংশোধন করা যাবে। এই সংশোধনের ফলে সংশ্লিষ্ট মৌলিক অধিকারটি যদি কার্যত নাকচ হয়েও যায়, তাতেও কিছু মাত্র অশুদ্ধ হবে না।

ফলে আগে যেখানে আঁচড় কাটার পর্যন্ত ক্ষমতা ছিল না, সংবিধানের দ্বিতীয় সংশোধনী সেখানে মৌলিক অধিকারের বুকে ছুরি চালাবার ক্ষমতা দিয়েদিল। এই দ্বিতীয় সংশোধনীর ফলেই ১৯৭৪ সালে নিবর্তনমূলক আটকের বিধান সম্বলিত বিশেষ ক্ষমতা আইন প্রণীত হয়। এই আইনে যে কোনো ব্যক্তিকে গ্রেফতার ও বিনাবিচারে বছরের পর বছর আটক রাখা যায়। ফলে মূল সংবিধানে ৩৩ অনুচ্ছেদে বর্ণিত গ্রেফতার ও আটক সম্পর্কে রক্ষাকবচ বাস্তবে নাকচ হয়ে গেল। ওই একই (দ্বিতীয়) সংশোধনীর দ্বারা দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণার বিধান সনিড়ববেশ করা হয়।

রাষ্ট্রপতি যদি মনে করেন দেশ বহিঃশত্রু দ্বারা আμাšও হতে পারে বা দেশে গোলযোগ সংঘটিত হবার সম্ভাবনা আছে তবে তিনি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে পারেন এবং বাংলাদেশের মানুষের মৌলিক অধিকার বলবৎ করার অধিকার স্থগিত করতে পারবেন। জরুরি অবস্থার সময় মানুষের চলাফেরা, সমাবেশ, সংগঠন, ভাব প্রকাশ, পেশা গ্রহণ এবং সম্পত্তি অর্জনের মৌলিক অধিকার খর্ব করে আইন করা যাবে। ওই সময় আমাদের বৃহৎ প্রতিবেশী ভারতের সাথে ২৫ বছরের অনাμমণ চুক্তি কার্যকর ছিল। ফলে বহিঃশত্রুর আμমণ ছিল একটা ফাঁকা কথা। বাস্তবে দেশের অভ্যন্তরে গণআন্দোলন দমন করার উদ্দেশ্য ছাড়া জরুরি অবস্থার বিধান যুক্ত করার আর কোনো কারণ ছিল না।

১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি প্রণীত হয়েছিল সংবিধানের চতুর্ সংশোধনী। এই সংশোধনীর মাধ্যমে ১৯৭২ সালের সংবিধানের চেহারা আমূল পাল্টে দেয়া হয়েছিল। সংসদীয় পদ্ধতির পরিবর্তে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার পদ্ধতির প্রবর্তন করা হয়। রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ Ñ শাসন বিভাগ, আইনসভা ও বিচার বিভাগের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে কেন্দ্রীভূত করে একটা ফ্যাসিবাদী শাসন সেদিন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। বিশিষ্ট আইনজ্ঞ প্রয়াত গাজী শামছুর রহমান চতুর্ সংশোধনীতে দেয়া রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা সম্পর্কে মন্তব্য করে লিখেছেন Ñ “মানুষের ক্ষমতার মধ্যে যা কিছু পড়ে, তার সবই তিনি করতে পারেন।

ব্রিটিশ পার্লামেন্টের ক্ষমতার ব্যাপারে একটি প্রবাদ আছে। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট একমাত্র পুরুষকে নারী এবং নারীকে পুরুষ বানানো ছাড়া, আর সবকিছু করতে পারে। এই সংশোধনীর মাধ্যমে প্রদত্ত রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা প্রায় এই রকম। ” এই চতুর্ সংশোধনীর দ্বারা রাষ্ট্রপতির আদেশের মাধ্যমে দেশে একটা মাত্র রাজনৈতিক দল হিসাবে একটা জাতীয় দল গঠন ও পরিচালনার ক্ষমতাও দেয়া হয়েছিল। যার ভিত্তিতে মুজিব সরকার সব দল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) গঠন করেছিল।

১৯৮৬ সালের ১০ নভেম্বর প্রণীত হয় সংবিধানের সপ্তম সংশোধনী। এর দ্বারা ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ থেকে এই সংশোধনী জারির দিনের মধ্যে সকল সামরিক ফরমান, আদেশ, প্রবিধান, নির্দেশ, অধ্যাদেশ অনুমোদন ও সমর্থন করা হয়। অর্থাৎ এই সংশোধনীর দ্বারা সামরিক স্বৈরশাসক এরশাদের সকল বর্বরতা ও জালিয়াতিকে সংবিধান-সম্মত করে নেওয়া হয়। অষ্টম সংশোধনী ১৯৮৮ সালের ৯ জুন বলবৎ হয়। এই সংশোধনী দ্বারা দু’টি পরিবর্তন করা হয়।

প্র মত, সংবিধানে একটা নতুন অনুচ্ছেদ সংযোজন করে বলা হয় যে, ইসলাম প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম হবে। দ্বিতীয়ত, সংশোধনীর সাহায্যে বাংলাদেশের বিভিনড়ব এলাকায় ছয়টি হাইকোর্ট বেঞ্চ স্থাপন করা হয়। এই দ্বিতীয় পরিবর্তন সুপ্রীম কোর্ট অনেক আগেই নাকচ করে দিয়েছে। রায় কার্যকর ও সংশোধনী নিয়ে বিতর্ক : উদ্দেশ্য কি? আপিল বিভাগ তার রায়ে সংবিধানের প্রস্তাবনাকে বলছেন ‘ধ্রুবতারা’। প্রস্তাবনা হল সংবিধানের অন্যতম মৌলিক কাঠামো, এটা রাষ্ট্র ও জনগণকে পথ দেখায়।

রায়ে বলা হয়েছে, ‘প্রস্তাবনা সংবিধানের নিছক শোভা নয়। জনগণ কী আকাক্সক্ষা ও উদ্দেশ্য নিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির পত্তন করেছিল সেটাই সংবিধানের প্রস্তাবনা বিধায় সেটা পরিবর্তন যোগ্য নয়। ’ সংবিধান সংশোধন নিয়েও একটি দিকনির্দেশনা দিয়েছেন আদালত। রায়ে বলা হয়েছে, ‘সংশোধন’ শব্দটিতে এটাই বোঝায় যে আদি দলিলের বৈশিষ্ট্যের অনুসরণে সংযোজন অথবা পরিবর্তন, যার ফলাফল হবে উৎকর্ষসাধন অথবা যে উদ্দেশ্যে প্রণীত সেটা অধিক কার্যকর করা। এর ভিতিতে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, ’৭২-এর সংবিধানে ঘোষিত মূল চার নীতি Ñ জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাই হবে বাংলাদেশের সংবিধানের মূলনীতি বা রাষ্ট্রীয় মূলনীতি।

সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে বিষয়গুলো সম্পর্কে এ ধরনের স্পষ্ট বক্তব্য থাকার পরও সংবিধান সংশোধন নিয়ে বিতর্কের অন্ত নেই। কিন্তু এসব বিতর্কের প্রায় সবটাই সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থে, জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার ও চেতনার প্রশেড়ব নয়। যেমন শেখ হাসিনা আগ বাড়িয়ে বলছেন যে তার সরকার ‘বিসমিল্লাহ’ বাতিল করবেন না, এমনকি রাষ্ট্রধর্মও বাতিল করবেন না। ‘বিসমিল্লাহ’ বা ‘রাষ্ট্রধর্ম’ কি আমদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা? সংবিধান কি কোনো ধর্মগ্রন্থ? নাকি শুধু ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসীদের জন্য রচিত হয়েছে? বাংলাদেশের মানুষ কি একটি ধর্মরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য মুক্তিযুদ্ধ করেছিল? এসব প্রশেড়বর কোনো সদুত্তর শেখ হাসিনা বা তার কথায় যারা পোঁ ধরেন তাদের কাছ থেকে পাওয়া যাবে না। অন্যদিকে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো নিষিদ্ধের বিষয়ে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেছেন, নির্বাচন কমিশন ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর নিবন্ধন বাতিল করবে।

এ বিষয়ে সরকারের কোনো কিছু করার নেই। অন্যদিকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ড. এটিএম শামসুল হুদা জানিয়েছেন, কমিশন কোনো দলের নিবন্ধন বাতিল করবে না। সরকার যেসব দল নিষিদ্ধ করবেকমিশন শুধু তাদের নিবন্ধন বাতিল করবে। বোঝাই যাচ্ছে, সরকার এ বিষয়ে স্পষ্ট কোনো অবস্থান নিতে নারাজ। সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী সংμাšও সুপ্রিম কোর্ট আপিল বিভাগের রায় কী পদ্ধতিতে সংবিধানে সংযোজিত করা হবে এ নিয়ে আইন ও সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মধ্যে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে।

এদের একাংশ মনে করেন, আদালতের রায় হুবহু ছাপিয়ে তা গেজেট আকারে প্রকাশ করতে হবে। অপরাংশ মনে করেন, রায় পরীক্ষা-নিরীক্ষার এখতিয়ার সংসদের। এ প্রসঙ্গে দেশের বিশিষ্ট আইনজ্ঞ এবং সংবিধান প্রণয়ন কমিটির আহবায়ক ড. কামাল হোসেন ও হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারক বিচারপতি সৈয়দ আমিরুল ইসলাম বলেছেন, আদালতের রায়ের সঙ্গে সঙ্গে সংবিধানের সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদগুলো পুনরুজ্জীবিত হয়ে গেছে। এখন সরকারকে একটি গেজেট প্রকাশ করলেই হবে। এজন্য সংসদে কোনো বিল উত্থাপনের দরকার নেই।

সরকার যে বিশেষ কমিটি করেছে তার সঙ্গে আদালতের রায় বাস্তবায়নের কোনো সম্পর্ক নেই। এ প্রসঙ্গে বিচারপতি সৈয়দ আমিরুল ইসলাম বলেন, আদালতের রায় হুবহু ছাপানোর পর সংসদ যদি মনে করে তা নতুন করে সংশোধন করার প্রয়োজন তা হলে এই এখতিয়ার সংসদের রয়েছে। কিন্তু আগে আদালতের রায় বাস্তবায়ন করতে হবে। কামাল হোসেনের মতে, এই রায়ের বাইরে সংবিধানের অন্য কোনো সংশোধনের বিষয় থাকলে সংবিধান সংশোধন কমিটি তা বিবেচনা করতে পারে। অন্যদিকে বিএনপি ও তাদের সমমনা রাজনৈতিক শক্তির মুখপাত্ররা বলছেন যে, সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংবিধান সংশোধনের একমাত্র এখতিয়ার সংসদের।

রক্ষক হয়ে ভক্ষকের ভূমিকা রাখার কোনো সুযোগ সংবিধান বিচারকদের দেয়নি। তাদের বক্তব্য হল, পঞ্চম সংশোধনীর রায় রাজনৈতিকভাবে একটি স্পর্শকাতর রায়। আদালতের ভেতরে-বাইরে কোথাও এ ব্যাপারে কোনো ঐকমত্য হয়নি। তাদের অভিযোগ যে বিচারকরা তাদের নিজেদের শপথ ভঙ্গ করে দায়িত্বের বাইরে গিয়ে এই রায় দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে সাকা চৌধুরী বলেছেন, “তাদের রায়েই স্ববিরোধিতা রয়েছে।

সামরিক আইন যদি অবৈধ তাহলে তাদের সকল ফরমানই অবৈধ হবে। ৪১টি অনুচ্ছেদের মধ্যে ১১টি হাইকোর্ট এবং ৯টি আপিল বিভাগ অবৈধ ঘোষণা করেছেন। এর মধ্যে ৬টি হচ্ছে ‘আল্লাহ’ সংশ্লিষ্ট। উনারা রায় দিয়েছেন ‘আল্লাহ’কে সংবিধান থেকে বাদ দেয়ার জন্য। ” অন্যদিকে সংবিধান সংশোধন সংμাšও সংসদের বিশেষ কমিটির কো-চেয়ারম্যান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এমপি বলেছেন, আমরা কোনো বিতর্কে যাব না।

সবকিছুই পর্যালোচনা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কমিটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। তার মতে, সংবিধান সংশোধন করার ক্ষমতা ১৪২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী একমাত্র সংসদের। বিতর্কের ধুম্রজালে মূল বিষয়টিই আড়াল করে ফেলা হচ্ছে। ৫ম সংশোধনীর বাইরে সংবিধানের আরো যেসব অগণতান্ত্রিক সংশোধনী আছে (সংক্ষেপে হলেও সেগুলো আমরা উল্লেখ করেছি), সংবিধানের মৌলচেতনার সাথে পরিপন্থী যেসব ধারা-উপধারা আছে সেগুলোর কি হবে? ভবিষ্যতে যাতে সামরিক শাসন জারি করতে না পারে সেজন্য আদালত সামরিক শাসন জারিকে অবৈধ এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসাবে উল্লেখ করেছে। প্রশড়ব উঠেছে, অতীতে যারা সামরিক শাসন জারি করেছিল, যেমন ক্ষমতাসীন মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টি এবং জেনারেল এরশাদ, তাদের কি বিচার হবে? বিভিনড়ব সময় যারা সংবিধান লঙ্ঘন করেছে (নির্বাচিত হোক কিংবা অনির্বাচিত) তাদের বিষয়ে কি হবে এ নিয়ে কারো কোনো কথা নেই।

সংবিধান লঙ্ঘন ও শাসকদের জবাবদিহি আমাদের সংবিধানে অনড়ব, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও কাজ ইত্যাদি মৌলিক অধিকারকে অঙ্গীকারের পর্যায়ে রাখা হয়েছে, সাংবিধানকি মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। এটা একটা বড় দুর্বলতা। কিন্তু বিশ্বের বহু দেশে এ নজির রয়েছে যে রাষ্ট্র শুরুতে সংবিধানে ঘোষিত মৌলনীতিগুলোকে ধীরে ধীরে মৌলিক অধিকার হিসাবে স্বীকৃতি দেয় এবং সংবিধানে তাকে অন্তর্ভুক্ত করে। আমাদের শাসকরা তো করেই নি উপরন্তু বিভিনড়ব অঙ্গীকারকে পায়ে দলে চলেছে। সংবিধানের ১৭ অনুচ্ছেদের ‘ক’ ধারায় বলা আছে, রাষ্ট্র আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সর্বজনীন বৈষম্যহীন একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা চালু করবে।

অথচ দেশে চলছে তিন ধারার শিক্ষাব্যবস্থা। সংবিধানের ২০ নং অনুচ্ছেদে বলা আছে, রাষ্ট্র এমন অবস্থা সৃষ্টির চেষ্টা করবে, যেখানে সাধারণ নীতি হিসাবে কোনো ব্যক্তি অনুপার্জিত আয় ভোগ করতে সমর্থ হবে না। অথচ স্বাধীনতার পর থেকেই অনুপার্জিত আয় তথা কালো টাকাকে সাদা করার বিধান প্রতি বাজেটেই করা হচ্ছে। ১৫ নং অনুচ্ছেদে পরিকল্পিত অর্থনীতির মাধ্যমে জনগণের আর্থিক ও সাংস্কৃতিক উনড়বতি বিধান, জীবনের মৌলিক চাহিদা খাদ্য, পোষাক, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা এবং কাজের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং যুক্তিসঙ্গত মজুরি প্রতিষ্ঠার কথা বলা আছে। অথচ শাসকরা চালু করেছে মুক্তবাজার অর্থনীতি।

কাজের অধিকার দেয়া দূরে থাক, শিল্প-কারখানা-ব্যাংক-বীমা বন্ধ করে বা বিরাষ্ট্রীয়করণ করে চলছে শ্রমিক ছাঁটাই। বেকারদের ভাতা দেয়া এবং অসুস্থ, পঙ্গু, বিধবা, এতিম, বৃদ্ধ ইত্যাদি অসহায় মানুষকে রাষ্ট্রীয় ভাতা ও বিবিধ সাহায্য প্রদানের কথা বলা আছে যার কোনো বাস্তবায়ন নেই। সংবিধানের ১৮ নং অনুচ্ছেদে বলা আছে, রাষ্ট্র পতিতালয় ও জুয়া বন্ধের কার্যকর পদক্ষেপনেবে। অথচ বাংলাদেশে পতিতাবৃত্তিকে আইনসঙ্গত করে রাখা হয়েছে। জুয়াকেও আইনি বৈধতা দেওয়া হয়েছে।

সংবিধানের ২৫ নং অনুচ্ছেদে বলা আছে যে রাষ্ট্র সাম্রাজ্যবাদ, ঔপনিবেশিকতাবাদ বা বর্ণবৈষম্যবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বের সর্বত্র নিপীড়িত জনগণের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামকে সমর্থন দেবে। অথচ ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ইরাক আগ্রাসন ও দখল করার পরও সরকারি প্রতিবাদ বা পার্লামেন্টে কোনো নিন্দা প্রস্তাব পর্যন্ত উত্থাপিত হয়নি। সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদের ‘ক’ ধারায় বলা আছে, প্রত্যেক ব্যক্তির অপরাধমূলক কর্মকা- প্রকাশ্য আদালতে দ্রুত বিচারের অধিকার থাকবে। অথচ র‌্যাব-চিতা-কোবরা বাহিনী ঙμসফায়ারে’র নামে চালাচ্ছে বিচারবহিভূর্ত খুন। পুলিশও এই ঙμসফায়ারঙ ‘এনকাউন্টার’ নাম দিয়ে নির্বিচারে খুন চালিয়ে যাচ্ছে।

এইভাবে ১১, ১৩(ক), ২৯(২)-সহ অসংখ্য ধারা লঙ্ঘন করেই অতীত ও বর্তমান সরকার দেশ চালিয়েছে এবং চালাচ্ছে। এর বাইরে বিশেষ ক্ষমতা আইন ’৭৪, বাংলাদেশ দ- বিধির ৫০৫ (ক) ধারা, ফৌজদারি কার্যবিধির ৯৯ (ক) ধারা, ৫৪ ধারা, ডিএমপি ৮৬ ধারা, সন্ত্রাস দমন অধ্যাদেশ, অর্পিত (শত্রু) সম্পত্তি আইন ইত্যাদি কালাকানুন বহাল রয়েছে। যেমন, ফৌজদারী কার্যবিধির ৯৯ক ধারা এবং দ-বিধির ৫০৫ক ধারার সাহায্যে কোনো আদালতে প্রমাণিত হওয়ার আগেই সরকার যে কারো কণ্ঠরোধ করতে পারে, মতপ্রকাশের অধিকার হরণ করতে পারে। ৫ম সংশোধনী বাতিলের রায়ে উচ্চ আদালত যখন অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় ‘সব ধরনের সংবিধান বহির্ভূত কর্মকা-কে চিরকালের জন্য বিদায়’ জানানোর কথা বলছে তখন স্বাভাবিকভাবেই এ দাবিও ওঠে যে সংবিধান লঙ্ঘনের দায়ে অতীতের প্রতিটি সরকারকেই আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে, একই সাথে বর্তমানে ও ভবিষ্যতে যারাই সংবিধান লঙ্ঘন করছে এবং করবে তাদেরকেও বিচারের সম্মুখীন হতে হবে। সংবিধানের গণতন্ত্রায়ন হবে কি? গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর পক্ষ থেকে যখন ’৭২-এর মূল সংবিধান পুনঃস্থাপন করার কথা বলা হয় তার অর্থ হল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মৌলচেতনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সংবিধানের ২য়, ৪র্থ, ৫ম, ৭ম এবং ৮ম সংশোধনী বাতিল করা।

সুপ্রিম কোর্টের রায়ে সংবিধানের ‘প্রস্তাবনা’ এবং ‘সংশোধন’ সম্পর্কে যে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে তার ভিত্তিতে একথা বলা যায় যে সংবিধানে এমন কোনো বিধান থাকতে পারে না বা যুক্ত হতে পারে না যা মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতির সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ। ফলে দ্বিতীয় সংশোধনী যার মাধ্যমে মৌলিক অধিকার পরিপন্থী আইন প্রণয়ন করা যাবে, বা জরুরি অবস্থা জারি করা যাবে Ñ এসব সংশোধনী কিছুতেই বহাল থাকতে পারে না। রাষ্ট্রকাঠামের ক্ষমতার বিভাজন নীতি সম্পর্কে এখানে বি¯ৃতÍ আলোচনার সুযোগ কম। রাষ্ট্রের তিনটি প্রধান কাজ রয়েছে। জনগণের আকাক্সক্ষা, অভিপ্রায় এবং অধিকারকে আইন রূপে হাজির করা; সে আইন অনুসারে জনগণের অধিকারগুলো বাস্তবায়ন করা; এবং আইন অনুযায়ী জনগণ তার ন্যায্য অধিকার পাচ্ছে কিনা তা যাচাই করা।

এই তিনটি কাজকে রাষ্ট্রের তিনটি প্রধান অংশের মধ্যে বণ্টন করা হয়। প্র মোক্ত কাজ অর্থাৎ আইন প্রণয়নের ভার আইন সভার ওপর, যাকে আমরা বলি সংসদ। জনগণের অধিকার বাস্তবায়নের কাজটি রাষ্ট্রের যে অংশ করে তাকে বলা হয় নির্বাহী প্রশাসন বা আমলাতন্ত্র। আর জনগণ অধিকার ভোগ করছে কিনা অর্থাৎ কোথাও আইনের লঙ্ঘন হচ্ছে কি না তা দেখভাল বা যাচাই করছে বিচার বিভাগ। ক্ষমতার বিভাজনের পাশাপাশি বিভাগতিনটির মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্যও রক্ষা করা আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য।

বলা হয় যে, রাষ্ট্রের প্রধান তিনটি বিভাগ যদি নিজস্ব ক্ষেত্রে পৃ কভাবে কাজ করে এবং তাদের পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্যের নীতি অনুসরণ করে তাহলে সেটাই স্বৈরশাসন প্রতিরোধের এবং জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার সর্বাপেক্ষা কার্যকরী উপায়। আমাদের বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী একই ব্যক্তি নির্বাহী বিভাগ এবং আইনসভার প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। যিনি প্রধানমন্ত্রী তিনিই জাতীয় সংসদের নেতা। এ পদ্ধতি পরিবর্তন করার কোনো ভাবনা বর্তমান সরকার বা যারা সংবিধান সংশোধন করার কথা বলছে, ’৭২-এর সংবিধান পুনঃপ্রবর্তনের কথা বলছেন তাদের কাছ থেকে শোনা যাচ্ছে না। একই অবস্থা বিচারবিভাগের স্বাধীনতার প্রশেড়বও।

উচ্চ আদালত থেকে শুরু করে নিমড়ব আদালত পর্যন্ত সর্বত্র শাসকদের ছড়ি ঘোরানোর পথ কি করে বন্ধ হবে তা নিয়েও এদের বক্তব্য নেই। এছাড়া সংবিধানের ৭০(১) অনুচ্ছেদের মাধ্যমে সংসদে দলতন্ত্র কায়েম করার ব্যবস্থা আছে, ১৪৫(ক) ধারার মাধ্যমে বিদেশের সাথে গোপন চুক্তি করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এসব বিধানের কি হবে তা নিয়েও সরকারের তরফ থেকে কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। ’৭২-এর সংবিধানের অন্যতম দুর্বলতা হল এ সংবিধানে জনগণের মৌলিক অধিকারের আইনি স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। এছাড়া ক্ষুদ্রজাতিসত্তার সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও তাদের অধিকারের ঘোষণা দেওয়া হয়নি।

বৈষম্য রাখা হয়েছে সম্পত্তিতে নারী-পুরুষের উত্তরাধিকারের বিষয়ে। এসব ধারার বাতিল করে গণতান্ত্রিক চেতনার স্বীকৃতি দেওয়া হবে কি? গণআন্দোলনের শক্তিই গণতান্ত্রিক অধিকারের একমাত্র রক্ষাকবচ সংবিধান সংশোধন নিয়ে আজ যে বিতর্ক হচ্ছে, আমরা শুরুতেই বলেছি, সম্ভবত প্রণয়নের সময়ও এতো বিতর্ক হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের পরপরই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী জনগণের সকল অংশ, রাজনৈতিক দল, শ্রেণী-পেশার প্রতিনিধিদের নিয়ে আলাপ-আলোচনা, তর্ক-বিতর্কের মধ্য দিয়ে আমাদের সংবিধান রচিত হয়নি। এ দুর্বলতা নিয়েই বাংলাদেশের সংবিধান প্রণীত হয়েছে। আমাদের শাসকরা যদি গণতান্ত্রিক হতেন, জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ হতেন, তাহলে এ বিতর্ক তারা পরেও করতে পারতেন।

কিন্তু সংবিধান নিয়ে আলাপ-আলোচনা দূরে থাক, সংবিধানে যতটুকু গণতান্ত্রিক অধিকারের স্বীকৃতি ছিল একে একে সেগুলোকে উৎখাত করা হয়েছে। দেরীতে হলেও দেশের উচ্চ আদালত একটা ঐতিহাসিক রায় দিয়েছে এবং তাকে ঘিরে একটা বিতর্ক চলছে। শাসকদের দায়িত্ব ছিল একে একটা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এগিয়ে নেওয়া, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী, গণতান্ত্রিক চেতনায় বিশ্বাসী সকল দলমতে ক যুক্ত করা। কিন্তু শাসকদের কর্মকা-ে এমন কোনো লক্ষণ প্রকাশ পাচ্ছে না। আদালতের রায় সামরিক শাসনকে বেআইনি ঘোষণা এবং একে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসাবে উল্লেখ করার পাশাপাশি ‘সব ধরনের সংবিধান বহিভূর্ত কর্মকা-কে চিরকালের জন্য বিদায়’ জানানোর কথা বলছে।

বলা হচ্ছে যে সামরিক শাসনকে অবৈধ ঘোষণা করে সংবিধানে নতুন সংশোধনী যুক্ত করা হবে। এটা নিঃসন্দেহে গণতান্ত্রিক শাসন প্রত্যাশীদের জন্য আশার খবর। কিন্তু আইন প্রণয়ন হলেই কিংবা সংবিধানে ধারা যুক্ত হলেই সামরিক শাসন বা সংবিধান বহির্ভূত কর্মকা- বন্ধ করা যায় কি? ইতিহাসের শিক্ষা হল, যায় না। বুর্জোয়াশ্রেণীর কাছে সংবিধান, আইন এ সবই শ্রেণীস্বার্থ রক্ষার হাতিয়ার মাত্র। সংবিধানের আওতায় থেকে, আইনের আওতায় থেকে যখন বুর্জোয়ারা তাদের শ্রেণীস্বার্থ রক্ষা করতে পারে না, তারা এসব কিছু পায়ে দলে যেতেও দ্বিধা করে না।

আরইতিহাসের এমন এক সময় আমরা উপস্থিত হয়েছি যখন দুনিয়া জুড়েই বুর্জোয়াশ্রেণী এবং তাদের প্রতিষ্ঠিত পুঁজিবা।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.