নর্দমার রাত, হিরন্ময় তাঁত
প্রতিটি জাতিগোষ্ঠীর বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি বিষয়ে আলাদা পুরাণকথা বিদ্যমান। সে হিশেবে চৈনিক পুরাণেও আছে ছয়টি ভিন্ন ভিন্ন কাহিনি, যেগুলোতে প্রতিটি চরিত্রের রয়েছে একটি স্বকীয় ভূমিকা।
নুগুয়া
প্রথম কাহিনি আবর্তিত হয় 'নুগুয়া' নামের এক প্রাচীন দেবীকে কেন্দ্র করে। ‘গুয়া’ শব্দের অর্থ হলো একটি শামুকসদৃশ সৃষ্টি ; এমন পোকা এবং সরীসৃপ, যারা পাল্টে ফেলতো খোলস এবং যাদের প্রজনন-ক্ষমতা ছিলো বলে বিশ্বাস করা হতো। ‘নুগুয়া’ গ্রহণ করেন সত্তরটি রূপান্তর, যেগুলো থেকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড এবং সকল জীবিত সত্তার সৃষ্টি হলো।
তার দেবীত্ব এতটাই শক্তিশালী ছিল যে, তার অন্ত্র থেকে জন্ম নিলো ‘নুগুয়ার অন্ত্র’ নামে দশজন দেব-চরিত্র।
হুন্দুন
দ্বিতীয় কাহিনি আবর্তিত হয় হুন্দুন নামক এক দেবতাকে ঘিরে, যার মুখমণ্ডল বা দেহে কোনো ছিদ্র ছিলো না।
হুন্দুন শাসন করতেন জগতের কেন্দ্রকে। আর দণি ও উত্তরের জলভাগের নিয়ন্ত্রণ করতেন দুইজন দেবতা। এই দুজন সমুদ্রদেবতা প্রায়ই হুন্দুনের সাথে দেখা করতেন।
ফলত তাদের মনে হলো যেহেতু তার কোনো মুখমণ্ডল নেই, তাই তারা তার দেহে সাতটি ছিদ্র করে দেবেন, যেগুলো দ্বারা তিনি দেখতে, শুনতে, খেতে এবং শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ করতে পারবেন। তারা প্রতিদিন একটি করে ছিদ্র সৃষ্টি করলেন, কিন্তু সপ্তম দিনে হুন্দুনের মৃত্যু ঘটলো।
অন্য এক কাহিনিতে হুন্দুনকে বর্ণনা করা হয় একটি হলুদ বস্তা রূপে, যিনি ছিলেন সিঁদুরের মতো লাল, অগ্নিশিখাময়, যার ছিল ছয়টি পা এবং চারটি ডানা, কিন্তু ছিল না কোনো মুখমণ্ডল বা চোখ।
তৃতীয় কাহিনিতে বলা হয় আদি বাষ্প থেকে ইন এবং ইয়াং নামে দুটি জাগতিক শক্তির উত্থান ঘটে। তাদের মিলনে মধ্য দিয়ে এই বিশ্ব দেহপ্রাপ্ত হলো।
আকাশ আবির্ভূত হলো এক গোলীয় চাদোয়ার মতো, যা ঢেকে দিলো চারপাশ বিশিষ্ট সমতল মর্তকে, যেখানে আকাশ এবং মর্ত একত্রে গাঁথা থাকলো বিশাল পর্বতমালার মাধ্যমে (বা বিভিন্ন স্তম্ভের মাধ্যমে), যেগুলো ঝুলানো ছিলো রশির মাধ্যমে।
চতুর্থ কাহিনিতে আমরা দেখি, বিশ্ব সৃষ্টির পূর্বে ছিলো বাষ্পের এক বিদেহি বিস্তার। এই আদি উপাদান থেকে সৃষ্টি হল ‘ইন’ শক্তি, যা হলো অন্ধকারাচ্ছন্ন, শীতল, ছায়াময়, ভারি, স্ত্রীলিঙ্গীয় ও অকর্মক এবং ‘ইয়াং’ শক্তি, যা হলো আলোকময়, উষ্ণ, রৌদ্রকরোজ্জ্বল, হালকা, পুংলিঙ্গীয় এবং সকর্মক। ইন এবং ইয়াং-এর সঙ্গমে সৃষ্টি হলো চারটি ঋতু এবং প্রাকৃতিক জগৎ। ইয়াং জন্ম দিলেন অগ্নি এবং সূর্যকে; ইন জন্ম দিলেন জল এবং চাঁদ, এবং অতঃপর নত্রদলকে।
পঞ্চম কাহিনিতে আকাশ এবং মর্তের বিচ্ছিন্ন হওয়ার পুরাণটি একটি সৃষ্টি-উপাখ্যানের সাথে সম্পর্কিত। এটি বর্ণনা করে ‘ঝুয়ান জু’ নামে এক কিম্ভূতকিমাকার আকাশ দেবতাকে, যিনি নিয়ন্ত্রণ করেন আকাশের কীলককে। তিনি তার পৌত্র ‘চং’কে নির্দেশ দিলেন আকাশটিকে চিরদিনের মতো উপরে ঠেস দেয়ার জন্য এবং অন্য পৌত্র ‘লি’কে বললেন মর্তকে চিরদিনের মতো নিচে চেপে ধরার জন্য।
ষষ্ঠ কাহিনি আবর্তিত হয় ‘প্যানগু’ কে কেন্দ্র করে, যিনি ছিলেন প্রথম এবং অর্ধদৈব মানব। এটি বর্ণনা করে, কিভাবে তিনি মুমূর্ষু অবস্থায় শুয়ে থাকলেন এবং তার মৃত্যুর পর তার নিঃশ্বাস হয়ে উঠলো বায়ু এবং মেঘমালা, তার কণ্ঠস্বর হয়ে উঠলো বজ্র, তার চোখ দুটি হয়ে উঠলো সূর্য এবং চাঁদ, তার শরীর হয়ে উঠল পর্বতমালা।
তার দেহরস পরিণত হলো বৃষ্টি এবং নদীতে, তার মাংস পরিণত হলো মাটিতে। তার মাথার চুল পরিণত হলো নক্ষত্রমালায়, তার শরীরের লোম পরিণত হলো গাছপালায়। তার দাঁত, অস্থি এবং মজ্জা পরিণত হলো খনিজদ্রব্যে। তার শরীরের উপরকার পোকাগুলি পরিণত হলো মানুষে।
প্যানগু
‘প্যানগু’ পুরাণের আরেকটি ভাষ্য উল্লেখ করে যে, আদিতে সকল পদার্থ ছিলো একটি মুরগির ডিমের মতো।
আঠারোহাজার বছর পর এটি বিচ্ছিন্ন হয়ে পরিণত হলো ‘ইয়াং’ নামের বায়বীয় পদার্থে, যা উপরে উঠে গেলো আকাশ সৃষ্টি করার জন্য এবং ‘ইন’ নামের ভারি পদার্থে, যা ডুবে গিয়ে সৃষ্টি করল মর্ত। ‘প্যানগু’ জন্ম নিলো এই পবিত্র এবং আদি পদার্থসমূহের মাঝে, যখন এগুলো উন্মোচিত হলো-- তার এই রূপটি অতিক্রম করল নয়টি রূপান্তরপর্ব, তিনি হয়ে উঠলেন আকাশ এবং মর্তের মতো দৈব এবং জ্ঞানী। আরো আঠারোহাজার বছর পর আকাশ, মর্ত এবং প্রথম মানব পৌঁছে গেল তাদের সর্বোচ্চ আকৃতিতে এবং সৃষ্টি হল ‘স্বর্গ’, ‘মর্ত’ এবং ‘মানবজাতি’।
-------------------------------------------------------------------------------
সূত্র:
১. World of myths by Felipe Fernández-Armesto
২. অন্তর্জাল
-------------------------------------------------------------------------------
উৎসর্গ:
প্রিয় ইমনদাদা
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।