আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ঢাকার যানজট, জলাবদ্ধতা: যাদের বদৈলতে তৈরি



ঢাকা শহরের যানজট ও জলাবদ্ধতা প্রাকৃতিক দুযোর্গসহ বিভিন্ন কারণে একটি বহুল আলোচিত সমস্যা। এ সমস্যা আজকের নয়, অনেক দিনেরই। এ দুই সমস্যার জন্য বিশ্বব্যাংক, এডিবি সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ঋণ নিয়ে কি পরিমান গবেষণা আর প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। তবে ঋণের টাকা এবং তথাকথিত পরিকল্পনাকারীদের পরামর্শের ফলাফল বর্তমানের অসহনীয় যানজট এবং জলাবদ্ধতা। পরিকল্পনা ও উন্নয়নের নামে অনেক সংস্থা ও ব্যক্তির পকেট ভারী হলেও জনগনের কাধে চেপেছে ঋণ, যানজট ও জলাবদ্ধতা।

বতর্মান সংকটের অবস্থায় ভয় হচ্ছে, আবার কোন প্রকল্প আসছে কিনা! কোন একটি সমস্যাকে টিকিয়ে রাখা একটি ভাল ব্যবসা। ঢাকা শহরের যানজটও হয়তো এ ধরনের একটি বিষয়, তাই অব্যাহত বৃদ্ধি পাচ্ছে। তার সাথে সাথে আসছে নতুন নতুন প্রকল্প, আর নিয়মিত ব্যবসা। এর পরিণতিই বা কি হবে? যদি বিগত দিনের মতো অনুউর্ব্বর অপরিপক্ক ভুল পরিকল্পনা ও পরামর্শ অনুসারে তাড়াহুড়ো করে লোক দেখানো কাজ করা হয়, তবে এই অবস্থা আরো ভয়ংকর হবে, তা বলার অবকাশ রাখেন। ঢাকা শহরের যানজটের কারণ জিজ্ঞেস করলে বলা হয় রিকশা ও ফুটপাত দখল।

যদি বলি ভাই যে সকল রাসত্মায় রিকশা চলে না, সে সকল রাসত্মায় যানজটের কারণ কি? তাহলে বলবে এলোপাথারি বাস রাখা। ফুটপাত দখল করে রাখে হকার, বাস ও রিকশা নিয়ম না মেনে রাস্তায় চলে, ফলে সৃষ্টি হয় যানজট। তাই বিগত দিনে যানজট নিয়ন্ত্রণে ঢাকা শহরের ট্রাক চলাচল নিয়ন্ত্রণ, বাস নিয়ন্ত্রণ, মানুষকে পর্বত সমান ফুটওভার ব্রিজ দিয়ে চলার ব্যবস্থা, ট্রেনের সময় পরিবর্তন, বিভিন্ন রাস্তায় রিকশা নিষিদ্ধ, ফুটপাত হতে হকার উচ্ছেদসহ নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। কিন্তু সমাধান আসেনি বরং বেড়েছে। পাঠকগণ একটু লক্ষ্য করলে দেখুন যে, সকল বিষয়ে সিদ্ধানত্ম গ্রহণ করা হয়েছে তার সবকিছুই সাধারন মানুষের জীবনের সাথে সম্পর্কিত।

শুধু প্রাইভেট কার বিষয়ে কোন সিদ্ধানত্ম গ্রহণ করা হয়নি। ঢাকার যে সকল রাসত্মায় বর্তমানে যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে, সেই সকল রাসত্মায় শুধু প্রাইভেট গাড়ীর অধিপত্য। প্রাইভেট গাড়ী দখল করছে রাস্তা আর ফুটপাত। কিন' এ ব্যক্তিগত যানবাহন নিয়ন্ত্রণের জন্য আজ পর্যন্ত কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। বরং জনগনের টাকায় পাকিং, ফ্লাইওভার মতো প্রকল্প গ্রহণ করে ব্যক্তিগত যানবাহন চলাচলের সুবিধা নিশ্চিত করা হচ্ছে বা করার পরিকল্পনা গ্রহণ করছে।

প্রাইভেট গাড়ী কেন নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় না, তা আশা করি সকলের অনুমেয়। তথাপিও একটু ব্যাখা করছি, প্রথমত যারা সিদ্ধানত্ম নেন তারা এই যানবাহনে চলাচল করেন। তারা তাদের সুবিধা নিশ্চিত করে বা করার মানসিকতা নিয়ে সিদ্ধানত্ম গ্রহণ করেন। দ্বিতীয়ত এ সাথে জড়িত প্রাইভেট গাড়ী, তেল, পাকিং, ফ্লাইওভার সংক্রানত্ম ব্যবসা। ঋণপ্রদানকারী গোষ্ঠীর সহযোগিরা (যেমন বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি) তারাও সকল কিছু নিয়ন্ত্রণে কথা বললেও প্রাইভেট গাড়ী নিয়ন্ত্রণে কথা বলে না।

কারণ ঋণের ব্যবসার সাথে সাথে প্রাইভেট গাড়ী সংক্রানত্ম ব্যবসার পরিবেশ নিশ্চিত করাই যেন তাদের অন্যতম দায়িত্ব। ঢাকা শহরের এই অব্যাহত যানজটের প্রেক্ষিতে তারা আবারো হয়তো ঋণ প্রদান করবে নতুন গবেষণা বা প্রকল্পের জন্য। সমাধান হোক না হোক তাদের ব্যবসা হবেই, কারণ ঋণের অর্থতো পরিশোধ করতে হবে দেশের জনগনকে। যানজট একটি লাভজনক ব্যবসা। তার পরিসমাপ্তি হবে তখন যখন মানুষের সুবিধা নিশ্চিত করে পরিকল্পনা করা হবে।

ঢাকা শহরের অধিকাংশ মানুষ বাসে, হেটে, রিকশায় ও সাইকেলে যাতায়াত করে। কিন্ত স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত বাস সার্ভিসের মান নিম্নমূখী হয়েছে। অধিকাংশ বাসে চলাচল এ প্রকার যন্ত্রণাদায়ক এবং অর্থদন্ডের শামিল। বাস কাউন্টারগুলোতে মানুষের দাড়ানো অবস্থা কি তা নিজেই প্রতিদিন দেখছেন। আর একটি অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে, কাউন্টারগুলোকে অব্যাহতভাবে স্থান ত্যাগ করতে হচ্ছে।

যেমন সিটি কলেজে যে কাউন্টারগুলো ছিল তা এসেছে এলিয়েন্স ফ্রান্সিসেসর কাছে, ঝিগাতলা কাউন্টার চলে এসেছে ধানমন্ডি ৪/এ কাছে। তথাকথিত পরিকল্পনাকারী ও সরকারের সংশ্লিস্ট প্রতিষ্ঠানগুলো এত টাকার ঋণের প্রকল্পের পর একটি মানসম্মত বাস কাউন্টারও নিশ্চিত করতে পারেনি, এ হচ্ছে জনগনের পরিবহন বাসের অবস্থা। আসুন রিকশার কথা দেখি, ঢাকায় বিভিন্ন রাসত্মায় রিকশা উচ্ছেদের সময়, জনগনকে তুষ্ট করতে ললিপপের মতো কিছু বিআরটিসি বাস নামানো হয়েছিল। এ সকল বাসগুলো কোথায় গিয়েছে? কেন গিয়েছে তা সকলের অনুমেয়। আমরা জনগনও তুষ্ট।

ফলাফল নিউমার্কেটের সামনে প্রাইভেট গাড়ীগুলোর পার্কিং ব্যবস্থা। আর আমরা সাধারণ জনগনের নিউমার্কেট থেকে কখনো কখনো সিটি কলেজ পুলিশ বক্স পর্যনত্ম সরু লম্বা রিকশার লাইনে অপেক্ষায়। সমপ্রতি দেখছি নিউমার্কেটে পিছনে একটি মার্কেট হয়েছে, ঐ মার্কেটের ১০০০ গাড়ী পার্কিংর ব্যবস'া রয়েছে, রয়েছে হেলিকাপ্টারের যাবার ব্যবস্থা। বড়লোক ও প্রাইভেট গাড়ীর মালিকগণ কিভাবে যাবে তা বুঝেছি, কিন' ঐ মার্কেট পুরোপুরি চালু হলে সাধারণ মানুষ এই সরু রাস্তায় রিকশা বা হেঁটে কিভাবে যাবে তা বোধগম্য নয়। এই সরু রাসত্মায় রাজউক কি বুঝে এতবড় একটি মার্কেটের অনুমোদন দিয়েছে তাও একটি বিস্ময়।

স্বাস্থ্য অর্থনীতি ও পরিবেশকে প্রধান্য দিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যখন হাঁটাকে অগ্রাধিকার প্রদান করা হচ্ছে। তখন আমাদের দেশে হাঁটার অবস্থা কি? আমি আর এ বিষয়ে ব্যাখায় যাই না, কারণ আমরা সাধারণ মানুষকে নিয়মিত এই তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়েই চলতে হয়। শুধু একটি বিষয়ে অদ্ভুত বিষয়ে আপনাদের দৃষ্টি আর্কষণ করছি। ঢাকার যাতায়াত পরিকল্পনা নাকি তৈরি হচ্ছে, পথচারীদের অগ্রাধিকার দিয়ে। তবে কেন একজন মানুষকে পর্বত সমান ফুটওভার ব্রিজ পার হতে হবে? কেন জ্রেবা ক্রসিং থাকবে না? পৃথিবীর কোন সভ্য দেশে হেটে চলার জন্য মানুষকে এ ধরনের পর্বত অতিক্রম করতে হয়? পরিকল্পনাবিদ, সরকারের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ কি একবারও ভাবেন না? একজন বৃদ্ধ, শিশু, মহিলা বা গর্ভবতী মানুষ কিভাবে এই পর্বতে উঠবে? নূন্যতম এককিলোমিটার হাটার পর কোন মানুষের পক্ষে কি এই পর্বত সমান ফুটওভার ব্রিজ অতিক্রম সম্ভব? হাতে কোন মালামাল থাকার পর কি এই ব্রিজ স্বাভাবিকভাবে অতিক্রম সম্ভব? অবশ্যই সম্ভব নয় করো পক্ষে।

তথাপিও কেন ঋণে টাকা নিয়ে জেব্রা ক্রসিংগুলো তুলে দিয়ে ফুটওভার ব্রিজ করা হচ্ছে তা বিস্ময়কর। অদ্ভুত লাগে ভাবতে পথচারীদের অগ্রাধিকার প্রদানের এই অবস্থা। সংবিধান অনুসারেও হেটে চলাচলকারী মানুষগুলো প্রধান্য পাওয়া উচিত। কিন' অদ্ভুত হলেও সত্য শরীরের ঘাম ঝড়িয়ে, কষ্ট করে চলাচলকারী মানুষকে পর্বত সমান ব্রিজ অতিক্রম করতে হয়। আরো অদ্ভুত হচ্ছে অনেক স্থানে আইন প্রয়োগকারী লোকদের নিয়োগ করা মানুষকে ফুটওভার ব্রিজে উঠতে বাধ্য করা হচ্ছে ।

আমি নিজেও একটু হাটার পর এই পর্বতে উঠতে পারি না, হাপিয়ে উঠি, বেশ কয়েকবার বাকবিতন্ডা হয়েছে। গুটি কয়েক মানুষের বাহন গাড়ী অপেক্ষা একটি বড় অংশের মানুষ হেঁটে যায়, তাদের জন্য কেন জ্রেবা ক্রসিং থাকবে না? এই অধিকাংশ সাধারণ মানুষ কেন রাসত্মায় হাটতে অগ্রাধিকার পাবে না? অধিকাংশ মানুষের চলাচলে বিঘ্ন ঘটিয়ে যানজট নিরসন আর বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠান, এগুলো মানুষের সাথে উপহাস বৈ অন্য কি? যারা ফুটওভার ব্রিজের জন্য পরিকল্পনা বা সুপারিশ করেন, তাদের পরীক্ষামূলক একমাস এই ব্যবস'া যাতায়াতের জন্য বাধ্য করা উচিত। যদি তারা নিজেরা এই ব্যবস্থায় চলতে পারেন, তবেই তা মানুষের জন্য উম্মুত্ত করা উচিত। জলাবদ্ধতা ঢাকার একটি ভয়ংকর অবস্থা। একটু বৃষ্টি হলেই সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা।

প্রশ্ন্ হচ্ছে এই জলাবদ্ধতা কেন সৃষ্টি হয়েছে? সহজ ও সরল উত্তর ভূল পরিকল্পনার কারণ। কিন' কারা, কেন, কিভাবে এই ভুল পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে তা কি তলিয়ে দেখা হবে? এই ভুল পরিকল্পনার জন্য কত অর্থ খরচ করা হয়েছে? কারা দিয়েছে? পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত গ্রহনের পূর্বে এই বিষয়গুলো বিবেচনা করা কি বাঞ্চনীয় নয়? কারণ এই জলাবদ্ধতার জন্য দায়ী সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও বিশ্বব্যাংক এবং এডিবি-র মতো ঋণপ্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। ঋণ প্রদানকারী এই প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণের অর্থে বক্সকালভার্ট নির্মাণ করে ঢাকা খালগুলো ধ্বংস করছে সরকারী সংস্থার কতিপয় ব্যক্তিবর্গ এবং তাদের দোসর কতিপয় পরিকল্পনাকারী। তখন বলা হয়েছিল এই বক্সকালভার্ট হলে নানা সুবিধা হবে, তাদেরই প্রতিষ্ঠান হয়তো পরিবেশ ইমপ্যাক্ট স্ট্যাডি ও এসেমেন্ট রিপোর্ট প্রণয়ন করছে। মন ভুলানো পরিকল্পনায় আমরা অনেকেই মুগ্ধ ছিলাম।

পরিবেশকর্মীদের দাবিতে তখন অহেতুক চিৎকার মনে হয়েছে। আর ফলাফল এখন বর্তমান ঢাকার ৪৩টি খাল গিলে খেয়েছে তথাকথিত পরিকল্পনাকারী, অসাধু কর্মকর্তা এবং বিশ্বব্যাংক ও এডিবি-র মতো প্রতিষ্ঠানের চক্র। তাতে তাদের লাভ বৈ ক্ষতি হয়নি। প্রতিবছর আবার পরিস্কার ও উন্নয়নের নামে ঋণ দিয়েছে, লুটপাটও হয়েছে। এখন আবার ঋণ দেবে খালগুলো উদ্ধারে বা অন্যকোন উপায়ে এই জলাবদ্ধতা হ্রাস, ঋণের ব্যবসা অব্যাহত হয়তো থাকবে।

কিন' আমাদের শিক্ষা কি? আমরা কি আবারো এভাবেই পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবো বা সায় দেবো? সরকারী সংস্থা ও ঋণপ্রদানকারী সংস্থাগুলো আমাদেরই প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে মানুষের সমস্যাকে পুজি করে, ব্যবসা করছে একটি চক্র। আমাদের সমস্যাকে চক্র করে অব্যাহত ব্যবসা হতে মুক্তির পথ খুজতে হবে। তবে পরবর্তীতে যে কোন পরিকল্পনা পূর্বে একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা প্রয়োজন। বিগত দিনের প্রকল্পগুলো কেন ব্যর্থ হয়েছে? কারা লাভবান হয়েছে? যদি আমরা সুনিপুনভাবে বিগত কাজগুলো হতে শিক্ষা নিতে পারি তবে যানজট ও জলাবদ্ধতা হতে মুক্তি।

নয়তো আবারো কোন প্রকল্প ব্যবসায়ীর পন্য হবে জনগন... চলতেই থাকবে যানজট ও জলাবদ্ধতার সমস্যা ও ব্যবসা।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।