[পঞ্চাশের দশকের উল্লেখযোগ্য কথাসাহিত্যিক দেবেশ রায়। দেবেশ রায়ের জন্ম ১৯৩৬ সালের ১৭ ডিসেম্বর। পশ্চিমবঙ্গেই বসবাস করছেন তিনি। তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে- তিস্তাপাড়ের বৃত্তান্ত, মফস্বলি বৃত্তান্ত, সময় অসময়ের বৃত্তান্ত, আত্মীয় বৃত্তান্ত, শিল্পায়নের প্রতিবেদন, দাঙ্গার প্রতিবেদন, খরার প্রতিবেদন, যযাতি, তিস্তাপুরাণ, বরিশালের যোগেন মণ্ডল ইত্যাদি। গল্পগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে দেবেশ রায়ের ছোটগল্প (৬ খণ্ড), প্রবন্ধগ্রন্থের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর আদি গদ্য, সময় সমকাল, উপন্যাস নিয়ে, উপন্যাসের নতুন ধরনের খোঁজে, শিল্পের প্রত্যহে, উপনিবেশের সমাজ ও বাংলা সাংবাদিক গদ্য ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
২০০৯ সালের ১৬ জানুয়ারি ঢাকা থিয়েটারের আমন্ত্রণে তিনি বাংলাদেশে এসে ১৯ জানুয়ারি পর্যন্ত ঢাকায় ছিলেন। এর আগে ২০০৮ সালের জানুয়ারি মাসেও বাংলাদেশে বেড়াতে এসেছিলেন তিনি। দু’বারই তাঁর সঙ্গে বেশকিছু খণ্ড খণ্ড আড্ডা হয়। সেই আড্ডা থেকেই এ লেখাটি তৈরি করেছেন সফেদ ফরাজী ]
‘লেখকের অপরিচয়ে আমি বিশ্বাস করি। আত্মগোপন প্রতিটি লেখকের ধর্ম হওয়া উচিত বলে মনে করি।
এটা তো প্রচল কোনো ধর্ম নয়, এটা অভ্যাস। নিজেকে নির্বাসন দণ্ড না দিলে কেউ কবি বা লেখক হতে পারে না। ’ সাহিত্যিক জীবনের দীর্ঘ চড়াই-উৎরাই পার হয়ে ৩০ জানুয়ারি ২০০৮-এর আলো-আঁধারি এক রাতে দৃঢ় প্রত্যয়জড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বললেন কথাসাহিত্যিক দেবেশ রায়। লেখকের জন্য তাহলে কি অপরিচয় অপরিহার্য? কোনো এক আত্মগোপন? কেন এই অপরিচয়, কেনই-বা আত্মগোপন? লেখক কি তাহলে আড়ালে থেকে সবকিছু কেবলি দেখে যাবেন, কিন্তু নিজেকে দেখাবেন না। যত বোঝাপড়া ওই সৃষ্টিকর্মের সঙ্গেই।
কথায় কথায় এমতো ভাবনাগুলো উস্কে দিচ্ছিলেন তিনি।
আমরা তখন জীবনানন্দের জন্মধন্য বরিশাল শহর থেকে ফিরছিলাম, লঞ্চে। দোতলা কেবিনের একটি বারান্দায় বসে আছি। শীতকাল চলছে। নদীতে তুমুল বাতাস।
হালকা বৃষ্টিও পড়ছে। আমরা কাঁপছি শীতে। আকাশে চাঁদের ক্ষীণ আভা। মাঝে মাঝে দূর থেকে হাত নাড়ছে যেন জেলেনৌকার কুপিবাতিগুলো। জলের ওপর জল ভেঙে পড়ার শব্দ হচ্ছে ছলাৎ ছলাৎ...।
এক অপূর্ব ব্যঞ্জনায় ভেসে চলছে আমাদের লঞ্চ। আমরা দেবেশ দা’র কাছ থেকে উনার সাহিত্য ও ব্যক্তিজীবনের বিভিন্ন বিষয় শুনতে চাইলাম। তিনি স্বভাবসুলভ ধীরকণ্ঠে থেমে থেমে বলছিলেন নিজের চিন্তা ও মধুর স্মৃতিকথাগুলো। যেহেতু আমরা জীবনানন্দের শহর থেকে ফিরছিলাম, তাই জীবনানন্দের সাহিত্য বিষয়ে তাঁর মতামত কী, জানতে চাইলাম। তিনি একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘জীবনানন্দ দাশ কবি হিসেবে কত বড় তা আন্দাজ ছিল, কিন্তু এত বড় ঔপন্যাসিক তা আগে আন্দাজ ছিল না।
৩২, ৩৬, ৩৭, ৩৮ বছরে তিনি মূলত উপন্যাস লিখেছেন। তাঁর জীবনের ১২টি বছর কোথাও কোনো কবিতা প্রকাশিত হয়নি। সে সময় তিনি উপন্যাস লিখেছেন। ওই সময়ে উনার কোনো কবিতা প্রকাশিত হয়নি, হতে পারে কেউ উনার কবিতা ছাপেননি কিংবা তিনি নিজেই দেননি। একজন এত বড়মাপের কবির ক্ষেত্রে এটা কতটা বিস্ময়ের ব্যাপার, একবার ভাবুন তো! আমি তো মনে করি তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ কবিদের একজন।
১৯৩৬ সালে বসে জীবনানন্দ দাশ ২০০৮ সালের আধুনিকতা করে গেছেন। তিনি গল্প-উপন্যাসে যে ভাষা ব্যবহার করেছেন তাঁর সময়কালের লেখকদের থেকে তা অনেক বেশি আধুনিক। যদিও জীবনানন্দের ঔপন্যাসিক স্ট্যাটেজি ব্যাপক গোলমেলে। তবুও তিনি যা করেছেন তা বিস্ময়কর। জীবনানন্দের মতো আমি যদি একটি উপন্যাস ঘটাতে পারতাম, তাহলে দু’চারদিন মূর্ছিত থাকতাম।
’ এদিকে বাতাসের বেগ ক্রমাগত বাড়ছেই। ঠাণ্ডাও পড়েছে ভীষণ। যদিও বারান্দায়ই ভালো লাগছিল কিন্তু দেবেশ দা’র শারীরিক অবস্থার কথা চিন্তা করেই তাঁর কেবিনে ঢুকে আবার আড্ডায় মেতে উঠলাম। উপন্যাস নিয়ে কথা বলতে গিয়ে তিনি বললেন, ‘উপন্যাসের শব্দ ব্যবহার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়- আমার মনে হয়। উপন্যাসে ‘অনৈতিক শব্দ’ ব্যবহার করাটাকে আমি সমর্থন করি না।
ধরুন, একজনের চারটি বউ, তার শেষ পরে বউয়ের সঙ্গে প্রথম পরে বউয়ের ছেলের বিয়ে হয়ে গেল। এরকম বিষয়কেও আমি ঘৃণা করি। ’ স্বপ্নময় চক্রবর্তীর লেখা কেমন লাগে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার ভালো লাগে না। আমি ভাই ভালো লেখার দাস। ’ সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের বিষয়ে তিনি জানান, ‘একসময় সন্দীপনের লেখার যারা এত নিন্দা করতো, আমি চ্যালেঞ্জ করলে তারা সন্দীপনের, একবারে একটি বাক্য পড়তে পারবে না।
একবার আমার এক তরুণ বন্ধু খবর দিল, সন্দীপনের লেখা বন্ধই হয়েছিল প্রায়। ১৯৮২ বা ১৯৮৫ সালে ‘প্রতিণ’ শুরু হলো। সন্দীপনকে লিখতে বললাম। ‘আজকাল’-এ উপন্যাস লিখতে বললাম। সন্দীপন লিখল।
এর মাঝে ১০টি বৎসর সন্দীপন লিখে নাই। আমি চাইতাম সন্দীপন লিখুক, ওর ভেতর শক্তি আছে। সন্দীপনকে লিখিয়ে আমার কী লাভ হলো, জানি না। সেসময় অনেকেই বলতেন, সন্দীপন দু’জন উকিল জোগাড় করেছে, একজন দেবেশ রায়, আর অন্যজন শঙ্খ ঘোষ। আফসারের লেখা খুব শক্তিশালী।
ওর লেখা আমার খুব ভালো লাগে। আমার তো মনে হয় আফসার আমেদ বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে ভালো লিখিয়েদের অন্যতম একজন ঔপন্যাসিক। একবার আফসারকে একটি কাগজের জন্য গল্প দিতে বললাম। এবং বলে দিলাম যেহেতু বন্যার সময় চলছে, তোমার গল্পটির প্রথমেই জল থাকা চাই। দুদিন পর ও ঠিকই একটি গল্প নিয়ে হাজির হলো।
এবং পড়ে দেখলাম, প্রথম বাক্যেই জল ঢুকে গেছে, অসম্ভব সুন্দর গল্প। ’ শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের বিষয়ে বলেন, ‘‘কুবেরের বিষয় আশয়’ খুব ভালো লেখা। ‘বৃহন্নলা’ যখন লেখে তখনও লেখক হবে কি-না ও জানতো না। এ বিষয়ে আর কিছু বলব না। ’ বলেই মুচকি হাসলেন কিছুণ।
আমরা বললাম, আপনার লেখালেখি সম্পর্কে কিছু বলবেন কি? তিনি বললেন, ‘আমার লেখা নিয়ে কিছু বলতে বা শুনতে আমার ভালো লাগে না। পারতপে আমি সাহিত্যের সভা-সেমিনারে যেতে চাই না। আমি আড়ালেই থাকতে চাই। ’
২.
তারপর আমরা দেবেশ দা’র জীবনস্মৃতির পাতার ’পরে কান পাতলাম। প্রথমেই তিনি একজন পাগলের গল্প দিয়ে শুরু করলেন, ‘আগে আমাদের পাড়ায় কিছু পাগল থাকত, এরা ছিল সিজনাল পাগল।
পাগল তো আর পুরো পয়েন্টে পাগল না, একটা পয়েন্টে। কেননা পাগল তার একটা যুক্তিতে অটল থাকে। তো আমাদের গ্রামের নিধু পাগলা। সে কবে পাগল হয় তা জানা যায় না। তার বউ আমাদের বাড়িতে কাজ করত।
যমুনা নদী তো পাড় ভাঙা। একদিন কি কারণে যেন সেই পাড়ভাঙা নদীতে ভরা বর্ষায় নিধু দিল ঝাঁপ, আর তখনি একটি পাড় পড়ল ভেঙে। অর্থাৎ নিধুর মৃত্যু নিশ্চিত হলো! হিন্দু শাস্ত্রমতে, কারো স্বামী নিখোঁজ হওয়ার ছয় মাসের মধ্যে যদি ফিরে না আসে, তাকে মৃত ধরে নেওয়া হয়। এবং তার স্ত্রীকে বৈধব্য গ্রহণ করতে হয়। রীতি অনুযায়ী নিধুর বউকেও বৈধব্য গ্রহণ করতে হলো।
কিন্তু একবছর পর নিধু ফিরে এল। জলজ্যান্ত। আমাদের চেনা নিধুই। আমার দাদু সাধু ভাষায় কথা বলতেন। তিনি নিধুকে বললেন, নিধু তুই তো পরলোকগত।
পরলোক থেকে কী করে ফিরলি? নিধু বলল, ফিইরা আইলাম আর কি। দাদু বললেন, তোর তো শ্রাদ্ধ হইল, হরিষ্যি হইল। নিধু বলে, আমিও হরিষ্যি খাব। দাদু বলে, নিধু তুই এই ভরা বর্ষায় যমুনায় ঝাঁপ দিয়ে কি করিয়া বাঁচিলে? নিধু বলে, কর্তা, মইরা দেখলাম, মইরা কোনো সুখ নাই! -নিধুর এই ঘটনাটা আমি সারাজীবনেও ভুলতে পারি না। বিশেষত ওই কথাটি, ‘কর্তা, মইরা দেখলাম, মইরা কোনো সুখ নাই’।
অসংখ্যবার এই কথাটি ভেবেছি। সত্যিই কি মরণে সুখ নাই, বেঁচে থাকাতেই সুখ?’
এরপর দেবেশ দা’ বলেন, ‘তখন ইন্টারমিডিয়েট পড়ি। একবার আমরা বন্ধুরা মিলে বুদগয়ায় পিকনিকে যাই। সেখানে ঘোরাফেরা করছি, এমন সময় এক পুরোহিত আমার পিছু নিল। আমি জানতে চাইলাম, কী চান? তিনি বললেন, পিণ্ডি দিতে হবে।
আমি বলি, কার পিণ্ডি দেব? তিনি বলেন, ঠাকুর্দা, ঠাকুর্মা... এমন কারো। আমি বলি, সেই কবে উনারা মারা গেছেন, উনাদের পিণ্ডিও দেওয়া হয়ে গেছে। কিন্তু নাছোড়বান্দা পুরোহিত, আমার কাছ থেকে পিণ্ডি না আদায় করে ছাড়বেন না, দিতেই হবে পিণ্ডি। তো কি আর করা। মজাও পাচ্ছিলাম ভেতরে ভেতরে।
বললাম, দিন, ৫০ পয়সার পিণ্ডি দিন। পুরোহিত পিণ্ডিদানের আয়োজন করলেন এবং বললেন, পিণ্ডি যার নামে উনার নাম কী? আমি বললাম, উনার নাম শ্রী দেবেশ রায়। তিনি বললেন, পিতার নাম কী, মাতার নাম কী, গোত্র কী ? আমি ওগুলোও বললাম। এরপর তিনি বললেন, এবার চোখ বন্ধ করে ভাবুন, উনি মানে শ্রী দেবেশ রায় স্বর্গীয় চেহারা নিয়ে এসে পিণ্ডি খাচ্ছেন। আমি চোখ বন্ধ করে থাকলাম।
তিনি জিজ্ঞেস করলেন, দেখতে পাচ্ছেন? আমি বললাম, হ্যাঁ। উনি বললেন, এবার উনার জন্য মঙ্গল কামনা করুন। আমি বললাম, হ্যাঁ করলাম। এরপর ৫০ পয়সা দিয়ে চলে আসতে আসতে ভীষণ হাসি পেল। বাড়ি এসে কথাটি কোনোভাবেই পেটে রাখতে পারলাম না।
বলে দিলাম। আমার বাবা রাশভারী মানুষ ছিলেন। বাবার রাগ তখন সে যে কি, সবাই ভয় পেতাম। পিণ্ডি দেওয়ার কথা শুনে রেগে বাবা বললেন, সন্ন্যাসীরা সন্ন্যাসী হওয়ার আগে শ্রাদ্ধ করে। যে ছেলে পিণ্ডি দিয়েছে, শ্রাদ্ধ করেছে, সে ছেলে গেছে! মা বলল, তুই এ-কি করলি বাবা? আমার নামে পিণ্ডি দিলেওতো পারতি, আমার বয়স হয়েছে।
এখন কি যে হবে! এই পিণ্ডিদানের ঘটনাটা সারাবাড়ি জুড়ে তখন এক বিস্ময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সবাই খুব সিরিয়াসলি নিচ্ছে বিষয়টাকে। কিন্তু আমি বেশ মজাই পাচ্ছিলাম। তো কি আর করা, পিণ্ডি ফিরাতে হবে। পরদিন শাস্ত্রমতে স্নান করিয়ে একজন পুরোহিত ডেকে মন্ত্রপাঠের আসরে যজ্ঞে বসাল আমাকে।
যাতে শ্রাদ্ধ দূর হয়, পিণ্ডি ফেরত যায়। পুরোহিতের তন্ত্রমন্ত্রপাঠের কর্ম শেষ হলে আমি ঠাকুর মশায়কে জিজ্ঞেস করলাম, মশায়, আমি কি এইমাত্র পৃথিবীতে অবতীর্ণ হলাম? তিনি বললেন, ধর, হ্যাঁ। আমি বললাম, তাহলে কি আমার জীবনের বিগত ১৭/১৮ বছর ক্যান্সেল হয়ে গেল!’ এ পর্যন্ত বলেই শিশুবাচ্চার মতো তুমুল হাসতে লাগলেন দেবেশ রায়। হয়তো কিছুণের জন্য ফিরে গেলেন সেই সোনালি শৈশবে।
সাহিত্য জীবনের মজার কোনো অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানতে চাইলে দেবেশ দা’ বলেন, ‘সাহিত্য মহলে বা আমার সাহিত্য জীবনে আমি মজার লেখক হিসেবে পরিচিত হতে পারিনি।
একবার শঙ্খ ঘোষের বাড়িতে একটি ছেলে বলল, আপনার লেখা পড়লে হাসি পায়, আপনার কথা শুনলে কান্না পায়। আমি বললাম, আমার কথা শুনলে হাসি পেলে ভালো হতো। তারপর সবাই মিলে হেসে উঠল। ’
এদিকে রাত রাড়ছে। লঞ্চ এগিয়ে চলছে মাঝ নদী বরাবর।
তখনও রাতের খাবার খাওয়া হয়নি। এবার খাওয়াদাওয়ার পালা। দেবেশ দা’সহ সবাই খাওয়াদাওয়া করলাম আমরা। খেতে খেতে আড্ডা চলছিল। সবার খাওয়া শেষ হলেও দেবেশ দা’ খুব ধীর গতিতে খাচ্ছেন, যতটা ধীর গতিতে কথা বলেন তিনি।
খাওয়া শেষ হলে তিনি বললেন, ‘রাতের খাওয়ার পর আমার তো মিষ্টি খাওয়ার অভ্যাস। আমাকে মিষ্টি খাওয়াতে হবে। ’ আমাদের কাছে মিষ্টি ছিল না। এত রাতে লঞ্চে কোথায় মিষ্টি পাওয়া যায়! কিন্তু তিনিও নাছোরবান্দা। মিষ্টি খাওয়াতেই হবে।
তিনি বললেন, ‘লঞ্চে ৮-৯শ মানুষ, কারো না কারো কাছে মিষ্টি আছেই, আমার বিশ্বাস। যেখানে মানুষ আছে সেখানে কোনো কিছু নেই, এমনটি হতে পারে না। ’ তো আমরা মিষ্টির সন্ধানে বেরুলাম, লঞ্চের কেবিন বয়কে ডাকা হলো, তাকেও মিষ্টি সংগ্রহ করে দেওয়ার জন্য বলা হলো। কিন্তু কোথাও মিষ্টি পাওযা গেল না। শেষে উনাকে মিষ্টির পরিবর্তে সাদা চিনি ও চকোলেট দেয়া হলো।
উনি দুধের স্বাদ গোলে মিটানোর মতো চিনি ও চকলেট খেতে খেতে জানালেন, ‘আমার মিষ্টি খাওয়া নিয়ে কলকাতায় এমন কথা আছে যে, আমি নাকি মিষ্টির জন্য পাগলের মতো ব্যবহার করি। আবার কেউ নিন্দা করতে গিয়ে বলে, ও দেবেশ রায়, ওর জন্য তো বৌঠান রি রেঁধে দেয়, ও খায়, কাকলী বাজার করে দেয়। ’
কথা প্রসঙ্গে উনাকে জিজ্ঞেস করা হলো, দাদা, কখন থেকে মদ ছেড়েছেন? উনি রসিকতা করে বললেন, ‘তার মানে কবে থেকে মদ খাওয়া শুরু করেছি, এটা তো আগে জানা দরকার, তাই না! একবার জর্জিয়ায় গিয়েছি, নিমন্ত্রনে। ব্যাপক জলতৃষ্ণা পেয়েছে। এয়ারপোর্টে নেমে দেখি এক রেস্টুরেন্টের সামনে কাঠের চোঙের ভেতর থেকে জুসের মতো কি যেন অনেকেই গ্লাস ভরে নিচ্ছে আর খাচ্ছে।
আমিও একটি গ্লাস ভরে নিলাম। এবং খেয়ে ফেললাম। দেখলাম ভালোই তো লাগে। এভাবে জুস ভেবে পর পর বেশ কয়েক গ্লাস খেলাম। পাশে যারা ছিল, তারা অবাক বিস্ময়ে আমার দিকে বারবার তাকাচ্ছিল।
আমি তখন বুঝতে পারিনি রহস্যটা কী! পরে জানলাম, জুস ভেবে আমি যা খেয়েছি, তা আসলে জুস না, মদ। তো যারা আমাকে নিমন্ত্রন করেছিল, তারা আমাকে নিতে এসে যখন শুনল যে আমি পর পর বেশ কয়েক গ্লাস চুমুকেই ইতিমধ্যেই পান করে ফেলেছি, ওরা তো শুনে ভাবল ভারতবর্ষের মানুষ তাহলে দারুণ মদ খায়। সেজন্য আমি যেখানে উঠলাম, সেখানে বেশ কয়েক বোতল সরবরাহ করা হলো। সন্ধ্যার দিকে, বিকেলের শেষ মুহূর্তে আমি রেস্টহাউসের বেলকনিতে বসে সূর্যের সোনালি আভা এবং সূর্যডোবা দেখছিলাম। ওখানকার একটি ছেলে দু’বোতল নিয়ে এসে আমার পাশে বসল।
এবং মদভর্তি গ্লাস আমার দিকে বাড়িয়ে দিল। আমি বুঝলাম, এয়ারপোর্টের ঘটনাটাই এজন্য দায়ী। আমি তো আসলে মদ খাই না। জীবনে কখনোই না। না জেনে জুস ভেবে কয়েক গ্লাস খেয়েছি, কিন্তু জেনে তো এক ফোঁটাও খেতে পারবো না।
কিন্তু ভারতবর্ষের সম্মান বলে কথা। ছেলেটির হাত থেকে গ্লাস নিয়ে ছেলেটিকে আমার বামপাশে বসতে দিলাম এবং আমি ডানপাশে বসলাম। কারণ ডানপাশে ছিল একটি জানালা। আমি গ্লাস হাতে নিয়ে ছেলেটির সাথে গল্পে মেতেছি, আর সূর্যডোবা দেখছি, ছেলেটি মদ খাচ্ছে। আর আমি ছেলেটির চোখ ফাঁকি দিয়ে জানালা দিয়ে মদটুকু বাইরে ঢেলে দিচ্ছি।
এভাবে আবার ছেলেটি দুটো গ্লাসে মদ ঢালে, একগ্লাস সে খায়, অন্য গ্লাস আমাকে দেয়। আমিও যথারীতি বাইরে ঢেলে দিই। একসময় মদ শেষ হয়ে এল। ছেলেটি তখন মদাসক্ত, নেশায় ঢুলোঢুলো। আমি তো স্বাভাবিক।
এরপর সেই ছেলেটি অনেকটা তৃপ্তির ঢেকুর তুলে আমার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে চলে গেল। ’
দেবেশ দা’ স্মৃতিগল্পগুলো বলতে বলতে একসময় বললেন, ‘ছোটবেলায় একবার দাওয়া থেকে পড়ে গিয়েছিলাম বালতির ভেতর, মাথা নিচের দিকে, পা উপরের দিকে, এমনভাবে। সবাই দৌড়ে এসে আমাকে ওখান থেকে উদ্ধার করলো। কিন্তু আমার মাথার বাম পাশে বেশ খানিকটা কেটে গেল। অনেক রক্তও ঝরেছিল।
সেই কাটাদাগটি এখনো আমার মাথায় রয়ে গেছে। তখন সেই ঘটনায় আমাকে অনেকেই বকাবকি করলো। আমার ঠাকুরদা বললেন, ও তো বোমভোলা। ওর তো কোনো হুশজ্ঞান নেই। সেই থেকে পারিবারিক মহলে আমার আরেকটি নাম স্বীকৃত হয়ে যায় ‘বোমভোলা’।
যদিও নামটি ছিল রসিকতাপূর্ণ। কিন্তু সেই নাম ধরে যারা আমায় ডাকতো সেই লোকগুলোর সংখ্যাও দিন দিন কমতে কমতে এখন প্রায় শেষ দিকে চলে এসেছে। হয়তো একদিন আর ‘বোমভোলা’ নাম ধরে আমাকে ডাকবে না কেউ!’
কথাগুলো বলে দেবেশ দা’ কিছুটা চুপ হয়ে গেলেন। হয়তো অনেক হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জনের মুখ-স্মৃতি মনে পড়ায় তিনি অতীত জীবনের দিকে ছুটে যাচ্ছিলেন, একা। সবার সমর্থন এবার গানের দিকে।
মালা ভাবী গান ধরলেন, রবীন্দ্রসঙ্গীত- ‘অমল ধবল পালে লেগেছে মন্দমধুর হাওয়া, দেখি নাই কভু দেখি নাই এমন তরণী বাওয়া’... । মাঝনদীতে ছুটে চলা লঞ্চের কেবিনের নির্জনতায় এতই মায়াবী রূপ নিয়ে ভাসছিল গানটি, যে আবহটি সত্যিই বর্ণনাতীত; চমৎকারভাবে খুব দরদ দিয়েই গাওয়া হলো গান। গানটি শেষ হতেই দেবেশ দা’ আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বললেন, ‘একবার বাবার সঙ্গে কোথায় যেন যাচ্ছিলাম। গ্রামের পথ ধরে, ধানক্ষেতের পাশ দিয়ে, হেঁটে হেঁটে। বাতাস বইছিল।
এমন সময় আমার বাবা এই গানটিই ধরেছিলেন ‘অমল ধবল পালে লেগেছে মন্দমধুর হাওয়া..’ এত সুন্দর গান এর আগে আমি আর শুনিনি। এরপর অনেকবার বাবার কণ্ঠে অনেক গান শুনেছি কিন্তু সেইদিনের এই গানটির কথা ভুলতে পারিনি কোনোদিনই। বাবার মুখে শোনা ওই গানটিই আমার শোনা প্রথম রবীন্দ্র সঙ্গীত। বাবা চলে গেছেন অনেকদিন। কিন্তু যখনই এই গানটি শুনি, বাবার কথা মনে পড়ে যায় খুব....।
’
স্মৃতিতাড়িত হয়ে এত বড়মাপের কথাসাহিত্যিক দেবেশ রায়ের চোখও জলে ছলছল করে উঠতে দেখলাম। এরপর ওই রাতে উনার সাথে আর কথা নয়। সবাই যার যার কেবিনের দিকে চলে গেলাম আমরা। আমাদের আড্ডাসঙ্গী ছিলেন আসাদ মান্নান, সালমা বাণী, পারভেজ হোসেন, শহীদুল আলম, অনিকত শামীম, শামীম রেজা, জাহানারা পারভীন, আশফাকুর রহমান, মালা ভাবী, নাজমা মান্নান ও মুন্নী ফরাজী। এছাড়াও পথসঙ্গী ছিলেন আব্দুর রাজ্জাক, সোহেল রহমান, কচি রেজা, মানসী কীর্তনিয়া, জুয়েল মোস্তাফিজ, মামুন খান প্রমুখ।
৩.
এর এক বছর পর আবার ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসের ১৬ তারিখ বাংলাদেশে বেড়াতে এসেছিলেন দেবেশ রায়। ১৮ জানুয়ারি শাহবাগের আজিজ মার্কেটে সেলিম আল দীন পাঠশালার অনুষ্ঠানে এক ঘণ্টার মতো বক্তব্য রাখলেন। এখানেও তাঁর জীবনের অনেক মূল্যবান তথ্য জানিয়েছেন তিনি। বক্তব্যের এক পর্যায়ে জানালেন, ‘একবার তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার পত্রালাপ হয়, তাঁর একটা লেখা প্রসঙ্গে। চিঠি পেয়ে উনি জবাব দেয়, বেশ মুগ্ধতাসহ।
এরপর বেশ কয়েকবার চিঠি চালাচালি হলে একবার তারাশঙ্কর চিঠিতে জানায়, যে, তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য। কিন্তু আমি দেখা করবো না ঠিক করেই নিয়েছি। এরপর একবার এক অনুষ্ঠানের দাওয়াত পেয়ে সেখানে গিয়ে দেখি বারান্দায় তারাশঙ্কর বসে আছে। দূর থেকে দেখেই দাঁড়িয়ে পড়ি। এমন সময় আমার এক বন্ধু, যে কি-না আয়োজক কমিটির একজন, সে বলল, কি তুই নিমন্ত্রণ পাসনি, তোকে তো নিমন্ত্রণ পাঠানো হয়েছে।
আর তারাশঙ্কর তোর সাথে দেখা করার জন্য তোকে খবর পাঠিয়েছে, খবর পাসনি? আমি বললাম, হ্যাঁ পেয়েছি। সে বলল, তাহলে উনার কাছে যাচ্ছিস না কেন? আমাকে উনার কাছে যাওয়ার জন্য বন্ধুটি বেশ কয়েকবার তাগাদা দিল। কিন্তু আমি গেলাম না। দেখলাম কিছুণের মধ্যেই তারাশঙ্করকে ঘিরে বেশ কিছু কবি সাহিত্যিকের ভিড় জমে গেল। আমি চুপ করে পাশ কেটে অনুষ্ঠানে ঢুকে গেলাম।
তারাশঙ্করের মতো বিখ্যাত লেখকের সঙ্গে দেখা করার আমার যে ইচ্ছে হয়নি তা নয়, আমিও তো মানুষ। কিন্তু কেন যেন মনে সায় পাচ্ছিলাম না। লেখকের আড়ালে থাকাটাকে আমি সমর্থন করি। ’
এরপর এক পর্যায়ে তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস তিস্তা পুরাণ লেখার মুহূর্ত প্রসঙ্গে জানালেন, ‘একদিন দুপুরে শুয়ে আছি, দুপুরে খাওয়ার পর ঘুমাতে আমার বেশ ভালো লাগে। তো দুপুরে খেয়ে শুয়ে আছি, ঘুম আসছে না কিছুতেই, বিছানায় গড়াগড়ি খাচ্ছি, এপাশ-ওপাশ করছি।
তন্দ্রামতো ভাব। এরকম সময় শুনতে পেলাম আমার কানের কাছে কেবলি সংলাপ আসছে। তখনি বিছানা ছেড়ে উঠে টেবিলে গিয়ে কাগজ-কলম নিয়ে লিখতে বসে গেলাম তিস্তা পুরাণ। আমার হয় কি, একটা লিখা কাগজে কলমে লেখার বহু আগে মাথায় প্রস্তুতকার্য চলে। কি রকম কাগজে, কি রকম কলমে, কি রকম লাইনগুলো, অরগুলো কি রকম হবে- এগুলো যদি ঠিক ঠিক আমার চোখের সামনে ভেসে না ওঠে তাহলে আমি লিখতে পারি না।
একটা লিখা লেখার জন্য বহু সময় লেগে যায় এজন্য আমার। কোনো কোনোটা আবার দ্রুতও হয়ে যায়। ’
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।