জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর বাংলাদেশ সফরের পর সংলাপ-সংলাপ খেলা প্রায় ফাইনাল রাউন্ডে পৌঁছে গেছে বলে মনে হচ্ছে। তাঁর সফর, প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতার সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক, সংবাদ সম্মেলন ইত্যাদি সংবাদমাধ্যমে গুরুত্ব পেয়েছে। ১৪ মের প্রথম আলোর প্রধান শিরোনামও ছিল এই তারানকোর সংলাপসংক্রান্ত আহ্বান। অন্য অনেক সংবাদপত্রও কমবেশি গুরুত্ব দিয়ে এই সংবাদটি ছাপিয়েছে। কলাম লেখা হয়েছে, হচ্ছে (অর্থাৎ অধমের এ কলামসহ) টক শোতে সংলাপকে অবিরাম কচলিয়ে কচলিয়ে লেবু-তেতো করার মতো কর্মযজ্ঞ চলছে।
অধমও এই ‘সংলাপ লেবু কচলানো কর্মে’ নিয়োজিত হয়েছি বার কয়েক।
রাজনৈতিক নেতারাও প্রায় বিরামহীনভাবে এখন সংলাপ-সংলাপ ধ্বনি তুলছেন। সংলাপ-সংলাপ জিকির না হলেও অচিরেই সংলাপ নিয়ে কেউ কেউ নিশ্চয় ‘প্রতীকী আমরণ অনশনে’ লিপ্ত হবেন। আমাদের ‘হুজুগে বাঙালি’ তো আর এমনি এমনি বলে না। অধমও নিখাদ হুজুগে বাঙালি, না হলে এ লেখা নিশ্চয় লিখতাম না।
অবশ্য শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক রেহমান সোবহানের কথা সম্পূর্ণ আলাদা। সারা জীবন যেভাবে জাতির কল্যাণের জন্য কাজ করেছেন তত্ত্ব-বিশ্লেষণ আর লেখালেখি দিয়ে, তারই ধারাবাহিকতায় ১৪ মে, ২০১৩-তে প্রথম আলোতে কলাম লিখেছেন ‘ইতিহাস থেকে শেখা না-শেখা’ শিরোনামে। সেই গত শতাব্দীর ষাটের দশকের শেষের দিক থেকে তাঁদের (ড. কামাল হোসেন, হামিদা হোসেন, রেহমান সোবহান ও অন্যান্য) ফোরাম ম্যাগাজিন থেকে ১৪ তারিখের কলাম—প্রায় ৫০ বছর ধরে নিবেদিত লেখালেখি সম্পূর্ণ ভিন্ন মাত্রার ব্যাপার। তাঁর এই শেখা না-শেখা লেখায় নির্বাচনকালীন সরকার সম্পর্কে প্রায় সবকিছুই বলা হয়ে গেছে। শুধু জ্ঞানী লোকেরাই পারেন সব বড় বিষয় অল্প কথায় সেরে ফেলতে।
অধমেরা পারে লেবু কচলাতে, বিরামহীনভাবে।
দুই
প্রধানমন্ত্রী বেশ কয়েক বছর ধরে বিভিন্নভাবে, বিভিন্ন উপলক্ষে, বিভিন্ন কথায় প্রকাশ্যে ‘সত্য ইতিহাসতত্ত্ব’-এর কথা বলে আসছেন। বারবার আহ্বান জানিয়েছেন ‘সত্য ইতিহাস’ বলার, লেখার আর শেখানোর জন্য। ইতিহাস বিকৃতি থেকে বিরত থাকার জন্য। হক কথা।
ইতিহাস বিকৃতির দায়ে মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগ বেশ কয়েকবার রিট ক্ষমতা ব্যবহারে স্বপ্রণোদিত হয়ে এবং রিট পিটিশনের ভিত্তিতে রুল জারি করেছেন, কারণ দর্শাতে বলেছেন। ইতিহাস বিকৃতির জন্য সশরীরে আদালতে হাজির হয়ে অনেক অধ্যাপককে ‘সঠিক ইতিহাস’, ‘ইতিহাস বিকৃতি’ ইত্যাদি অতি জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক ব্যাপারে মহামান্য বিচারপতির বক্তব্য, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ শ্রবণ করতে হয় সেই আদালতে উপস্থিত তলবপ্রাপ্ত ব্যক্তি, আইনজীবী, সাংবাদিকদের। এ-সংক্রান্ত রায়গুলো এখনো পড়া হয়ে ওঠেনি। ‘সঠিক ইতিহাস’সংক্রান্ত মহামান্য আদালতের ব্যাখ্যা সব ইতিহাসবিদকে গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়তে হবে। কারণ, খুব কম দেশেরই ইতিহাসবিদদের সুযোগ হয় সঠিক ইতিহাস কী, তা তাঁদের নিজ নিজ দেশের সর্বোচ্চ আদালত এবং প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে তালিম নেওয়ার।
ঔপন্যাসিকদেরও নিজেদের বঞ্চিত বোধ করার কোনো কারণ নেই। যত দূর মনে পড়ে, মহামান্য আদালত প্রয়াত ঔপন্যাসিক লেখক হুমায়ূন আহমেদকেও তালিম দিয়েছিলেন কীভাবে সঠিক ইতিহাস উপন্যাসে সন্নিবেশ করতে হবে। হুমায়ূন আহমেদের প্রকাশককে এখন খেয়াল রাখতে হবে যেন সঠিক উপন্যাস সন্নিবেশ না করে হুমায়ূন আহমেদের ইতিহাস বইটি পুনর্মুদ্রিত না হয়!
তথ্য আর ইতিহাসের মধ্যেও যে ছোট্ট একটু পার্থক্য আছে, সেটা কেউই খেয়াল করছে না। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাহিনীর সঙ্গে নবাব সিরাজউদ্দৌলার বাহিনীর যুদ্ধ হয়েছিল এবং সেই যুদ্ধে নবাবের বাহিনী পরাজিত হয়েছিল—এটা তথ্য। কেন পরাজিত হয়েছিল অর্থাৎ ঘটনার পেছনের কারণ, তার বিশ্লেষণ আর সেই বিশ্লেষণের জন্য অন্যান্য তথ্য-উপাত্ত—সেটা হলো ইতিহাস।
একটা ঐতিহাসিক ঘটনা বা পটপরিবর্তন কী কারণে হয়েছে তার বিশ্লেষণটা হলো ইতিহাস। ঘটনাটা ইতিহাস নয়, বিশ্লেষণটা হলো ইতিহাস। এবং একজন বিশ্লেষকের বিশ্লেষণ, ব্যাখ্যা, কারণের বয়ান, যুক্তি ইত্যাদি অন্য বিশ্লেষক-ঐতিহাসিকের সঙ্গে মিলবে না। মিললে কোনো বড় ঐতিহাসিক ঘটনা নিয়ে বই থাকত কুল্লে একটা। পলাশীর যুদ্ধ নিয়ে যত বই লেখা হয়েছে—বলা বাহুল্য, সব পড়িনি তবে ধারণা করছি—তার সব কটিতে যুদ্ধের তারিখ বলা হয়েছে একটাই, যেটা তথ্য।
কিন্তু যুদ্ধের আগের পর্বের কারণ, প্রভাব ইত্যাদি বিভিন্ন ঐতিহাসিক নানাভাবে নিজ নিজ যুক্তিতর্ক দিয়ে উপস্থাপন করেছেন। তথ্য আর বিশ্লেষণের মধ্যকার পার্থক্যটা অনেকেরই অগোচরে থেকে গেছে। তাই বোধ হয় ‘সঠিক ইতিহাস’ নিয়ে এত মাতম।
তিন
এক বন্ধু মনে করিয়ে দিয়েছিল—ইতিহাসের শিক্ষা হলো, কেউ ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না। নেওয়া সম্ভবও নয়।
কারণ, বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার মতো, কোনো ঐতিহাসিক ঘটনার হুবহু পুনরাবৃত্তি সম্ভব নয়। যেই ঘটনা ঘটে গেছে—পলাশীর যুদ্ধ—সেটাকে আজ আবার ঘটানো যাবে না। নবাবের বাহিনীর পরাজয়ের জন্য একমাত্র কারণ হিসেবে মীর জাফরকে চিহ্নিত করা যায়। কিন্তু সেটা প্রমাণ করার জন্য মীর জাফরের পরিবর্তে অন্য কোনো সেনাপতির অধীনে সেই পলাশীর যুদ্ধটা পুনর্মঞ্চায়ন সম্ভব নয়। অর্থাৎ ইতিহাসের সম্পূর্ণ পুনরাবৃত্তি অসম্ভব।
কাছাকাছি পুনরাবৃত্তিও অসম্ভব।
আর যেহেতু পুনরাবৃত্তি হবে না, সেহেতু শিক্ষা নেওয়ার কিছু নেই।
আমাদের এ বক্তব্য ‘সরলীকরণ’ দোষে দুষ্ট। অর্থাৎ কথাগুলো খুব বেশি বড় দাগে বলছি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম থাকে, আছে।
তবে সেটা মুখ্য নয়, মুখ্য হলো ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয় না। ইতিহাসচর্চা থেকে জ্ঞান বৃদ্ধি হয়, জ্ঞান কাজে লাগে। শেখার জন্যও কাজে লাগে।
সেই শেখাটা কাজে লাগাতে হলে কিছু জ্ঞান থাকতে হবে। সেই জ্ঞান না থাকলে ইতিহাস কাজে লাগে না।
ইতিহাস থেকে শেখা না-শেখার চেয়ে বড় কথা হলো ‘স্বার্থ’। রাজনীতি হলো ব্যক্তি-পরিবার-গোষ্ঠীর স্বার্থকেন্দ্রিক। স্বার্থের একটা উৎকৃষ্ট উদাহরণ আছে ১৫ মে, ২০১৩-এর ডেইলি স্টার পত্রিকার শেষ পাতার খবরে। রাজশাহীর মেয়রের তাঁর মেয়রকালীন মেয়াদে বার্ষিক আয় বৃদ্ধি করেছেন প্রায় আড়াই লাখ টাকা থেকে ৫৮ লাখ টাকায়। অর্থাৎ ২০০৮ সালে যখন তিনি মেয়র নির্বাচিত হন, তখন তাঁরই দেওয়া হিসাব অনুযায়ী তাঁর আয় ছিল বার্ষিক আড়াই লাখ টাকার কিছু কম।
এ বছর ৫৮ লাখ টাকার কিছু বেশি। অবশ্য এই ৫৮ লাখ টাকার মধ্যে মেয়র হিসেবে পারিতোষিক পেয়েছেন ছয় লাখ টাকার কিছু বেশি। অর্থাৎ পাঁচ বছরে কমবেশি ২০ গুণ আয় বৃদ্ধি। তাঁর মতো সৌভাগ্যবান হলে ২০০৮ সালে রাজশাহীর যে রিকশাচালকের মাসে এক হাজার করে বার্ষিক আয় যদি ছিল ১২ হাজার, তাহলে সেই রিকশাচালকের ২০১৩-তে আয় হওয়ার কথা বার্ষিক প্রায় আড়াই লাখ টাকা।
নির্বাচিত পদে যখন এত মধু, তখন সেই পদ কে ছাড়বে? বা কেন এমন কোনো ব্যবস্থা মেনে নেবে যে ব্যবস্থায় তাঁর পুনর্নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ কিছুটা মাত্র হ্রাস পায়।
অন্যদিকে ঠিক একইভাবে নির্বাচিত হয়ে আয় বৃদ্ধির বিরাট সম্ভাবনা যদি কোনো ব্যবস্থায় বাস্তবায়িত হওয়ার পথে বিন্দুমাত্র বাধার সৃষ্টি করে, সে ব্যবস্থা বিরোধী দল মেনে নেবে না।
নির্বাচনে জেতার জন্য সংবিধানের ১৪তম সংশোধনীর মাধ্যমে পছন্দের সাবেক বিচারপতিকে প্রধান উপদেষ্টা করা, সংবিধান লঙ্ঘন করে (যে সংবিধান লঙ্ঘনের ব্যাপার রায়ের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল) আপিল বিভাগের বিচারপতিকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ করা এবং শেষতক এসবের কোনো কিছুই যখন কাজে দিল না, তখন নিজ দলের রাষ্ট্রপতিকে প্রধান উপদেষ্টা করা—অর্থাৎ নিজ স্বার্থের জন্য যত অকাম-কুকাম করা সম্ভব, সবই করা। একইভাবে অন্য দলটি ১৫তম সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলোপ করে নিজ দলের অধীনে নির্বাচন করে ক্ষমতায় থাকার ব্যবস্থা তাঁদের দৃষ্টিতে পাকা করেছে। অর্থাৎ নির্বাচনে জেতার জন্য হন্যে হয়ে ওঠা—এ অবস্থা থেকে কেউ সরে আসবে না, সহজে।
স্বার্থসিদ্ধির পথে কোনো বাধা, কোনো অন্তরায় কেউই সহ্য করবে না।
সংলাপে বসলে উভয় পক্ষকে কিছু ছাড় দিতে হবে। ছাড় দেওয়া মানেই নির্বাচনে নিশ্চিত বিজয়ের ব্যবস্থাপত্র থেকে কিছুটা হলেও সরে আসা বা পিছু হটা।
আর এখন নির্বাচনে হারা মানে নির্বাচনের পর সম্ভব-অসম্ভব নির্যাতন। এটা তো স্পষ্ট যে আগামী নির্বাচনে যে হারবে, তার ওপর অত্যাচার-নির্যাতনের মাত্রা বর্তমান সময়ের চেয়ে একটু বেশিই হবে। কথাটা বললাম আলতোভাবেই।
অতএব সংলাপ-সংলাপ খেলা চলবে আরও দুই-তিন মাস। চিঠি চালাচালি, এজেন্ডা-ফেজেন্ডা, স্থান-সময়, প্রতিনিধি নির্বাচন এবং আনুষঙ্গিক আয়োজন, আলোচনা-সমালোচনা কলাম লেখা, টক শো ইত্যাদি বহুবিধ কাজে নিয়োজিত থাকতে হবে, নিঃসন্দেহে অন্তত রমজান মাস পর্যন্ত।
আশা, রমজান-ঈদে মাস দেড়েক বিরতি থাকবে। তারপর সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে ‘ফাইনাল শোডাউন’। এক পক্ষ দাঁড়িয়ে থাকবে,
অপর পক্ষ হবে কুপোকাত-ধরাশায়ী।
সে সময়তক আমরা হয়ে যাব ব্যর্থ রাষ্ট্রের ক্ষত-বিক্ষত নাগরিক।
ড. শাহদীন মালিক: অ্যাডভোকেট, সুপ্রিম কোর্ট; অধ্যাপক, স্কুল অব ল, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।