.........
রাত মনে হয় ৮টার মত বাজছে। একা বসে আছি বারিধারা লেকের পাশে। আমার মন খারাপ হলেই এখানে চলে আসি। বাবা আর বড় ভাইয়া যে কতবার ফোন দিচ্ছে কে জানে? মোবাইল তো সেই কখন্ সাইলেন্ট মোডে দিয়ে রেখেছি।
"আব্বা, তুমি এখানে? কতবার ফোন দিচ্ছি?" ,ঘাড় বাঁকিয়ে দেখি আমার বাবা আমার পেছনে দাঁড়িয়ে।
আমার বাবা, আমার জীবনের সবথেকে প্রিয়বন্ধু। আমাকে যখন বেশি আদর করে ডাকে,তখন আমাকে "আব্বা" বলে ডাকে। এত বড় হয়েছি তাও বাবার সাথে আমার ব্যবহার ঠিক বাচ্চাদের মত। বাবার সামনে আমি বেশি আহলাদি হয়ে যাই।
বাবা আমার পাশে এসে বসলেন।
কাঁধে রাখলেন হাত।
"রাত কত হয়েছে, আমার ক্ষুধা পায়না? সেই দুপুরের পর কিছু খাইনি"- বাবা বললেন।
"তুমি এখনো খাওনি আব্বু, এক্ষোন চল বাসায়"-আমি উঠে দাঁড়ালাম সাথে সাথে।
বাবাও দাঁড়ালো।
"তোর মা চলে গেছে তো কি হয়েছে, তোর সুপার বাবা আছেনা"-বাবা বলে মৃদু হাসলেন।
হ্যাঁ, বাবাকে ছোট থাকতেই আমরা দু'ভাই সুপার বাবা ডাকতাম। হয়ত আমাদের কাছে সেই ছিল সুপার হিরো।
"এমনি বাবা,আমার কিছু হয়নি,একা একা লাগছিল ,তাই এখানে চলে এলাম"- গাড়িতে উঠতে উঠতে বললাম।
আমার বাবা আমাকে ছাড়া বাসায় কখনো খেতে পারতোনা। যখন জেনেছে যে আমি বাসায় নেই,সাথে সাথেই বুঝে গেছেন যে কোথায় আমি।
গাড়িতে আমি চুপচাপ বসে আছি, বাবা আমার কাঁধ জড়িয়ে বসে আছেন।
"বাবা, আমাকে ছেড়ে কখনো যাবে নাতো"- আমি বললাম
"ধুর, আমি তোর মা'র মত ফাঁকিবাজ নাকি যে তোদেরকে ছেড়ে চলে যাবো?" - বাবা মজা করে বললেন।
কিন্তু জানি, বাবা মা'কে কতটা ভালবাসতেন। আজকাল সারারাত জেগে থাকেন,আর বারান্দায় হাঁটেন। মাঝে মাঝে চোখের পানিও ফেলেন কিন্তু আমরা যদি দেখে ফেলি, এই ভয়ে সাথে সাথে নিজেকে সামলে নেন।
"শোন, তোর বাবা হাজার বছর বাঁচবে। আমি নাতি-নাতনী না দেখে মরবো ভেবেছিস? নেভার এভার"- বলে আমার কাঁধে ঝাঁকি মারলেন।
আমিও সেই পরম আশ্বস্তে বাবার কাঁধে মাথা রাখলাম।
"ছোট থাকতেই তুই আমাকে ছাড়া ঘুমাতে চাইতিনা, খেতে চাইতিনা,আর তোকে ছাড়া আমি কোথাও যাবো,সেটা অসম্ভব। সো নো চিন্তা ডু ফুর্তি।
"- বাবা আশ্বস্ত করেন।
৬ মাস পর
যাকে জীবনের প্রথম ও শেষ ভালবাসলাম, তাকে নিয়ে আজ কফি খেতে যাচ্ছি। এখনো তাকে আমি কিছু বলিনি, শুধু বলেছি "আপনি কি আমাকে শুধু আপনার একটি বিকেল আমাকে দেবেন? আপনার কাছে আর কিছু চাইনা। "
সে রাজী হয়েছে। শর্ত একটাই,তাকে আর কখনো জ্বালাতন করা যাবেনা আর আমার মন কখনো খারাপ করা যাবেনা।
আমি জানতাম তার সবথেকে পছন্দ হচ্ছে কফি। আমারো, আমার বাবারও। আমাদের ৩ জনেরই মনে হয় এই একমাত্র বদ অভ্যাস হচ্ছে অতিরিক্ত কফি পান।
"বিল আমি দেবো"- আমি টেবিলে বসতে বসতে বললাম।
সে অবাক হয়ে তাকালো।
"আমি জীবনে এমন ছেলে দেখিনি যে কিনা কোথাও বসার আগেই বলে বিল আমি দেবো। " -বলেই সে হেসে দিলো।
আমি কিছুটা লজ্জা পেলাম। আসলেই বোধহয় প্রেমে পরলে মানুষ একটু বেশী বোকা হয়ে যায়।
"তো তুমি খুশি যে তোমার সাথে কফি খেতে এসেছি?আশাকরি কাল থেকে আর কষ্ট করে আমার জন্য ক্যান্টিনে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকতে হবে না।
দেখো ছেলে,তোমার এখন জীবন গড়ার সময়। আর তুমি নিশ্চয়ই জানো আমি তোমার থেকে পড়াশুনা বা বয়স দু'টোতেই বড়। "- এক নাগাড়ে সে কথাগুলো বলে গেলো।
"তো কি হয়েছে, আমাদের নবীজীও তো তাঁর বয়সের চেয়ে বড় একজন কে বিয়ে করে ছিলেন। "- আমারো ঘাড় বাঁকা উত্তর
"ওরে বাবা, তা তুমি কোন এলাকার নবী ,শুনি একটু?"- বলেই আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো।
"শোনো, তুমি সারাক্ষণ একা একা থাকো আমি জানি। আমি আজ এখানে শুধু তোমার সাথে এসেছি যদি তোমার একটু ভালো লাগে এটাই আমি চাই। তার মানে এইনা যে আমি তোমার প্রেমে পড়েছি। " - সে বললো
"উফফ, আপনি থামবেন একটু"- বলে কফি হাতে নিলাম
"জ্বী, থামলাম। তাই আগেই বলে রাখলাম, আজকের কফির পর আবার আমার কাছে আর কোনো কিছুর আশা করবেনা"- সে।
"ইয়ে মানে আরেকটা জিনিস চাইতাম আপনার কাছে"- বলে একটু লাজুক হাসি দিলাম।
সে হতাশ আর ক্লান্ত চোখে আমার দিকে তাকালো।
"আর কি চাই তোমার"- সে
"আমার সাথে একটু হাঁটবেন,শুধু একটু"-আমি
"কোথায়?" - সে
"আরে হাঁটলেই বুঝবেন" - আমি
"আগে বল, নয়তো না" - সে
"বারিধারা লেক" -আমি
কি ভাবলো কে জানে, রাজী হয়ে গেল।
তখন শীত আসি আসি করছে। লেকের পাড়ের রাঁধাচূড়ার গাছগুলোকে যেনো বেশী সুন্দর লাগছে আজ।
আমার পাশে সে হাঁটছে। তার দিকে তাকালাম। শেষ বিকেলের আলোতে তাকে যেনো আরো বেশী অপরূপ লাগছে। গাছের পাতাগুলো অল্প অল্প ঝড়ে পড়ছে। আমাদের হাঁটা শেষ হচ্ছেনা, মনে হচ্ছে আজীবন আমি তার সাথে হেঁটে চলে যেতে পারবো বহুদূর।
"আর কিছু" -সে
"মানে?" - আমি
"আর কিছু চাইবার আছে তোমার আর?" - সে বিরক্ত কন্ঠে বললো
" আর শেষ একটি চাওয়া, আপনার দু'হাত ধরতে চাই" - আমি
" তুমি মনে হয় সিনেমা বেশী দেখো"- বিরক্ত সে।
"না, আমার শুধু এই শেষ চাওয়া, আর কিছু চাইবার নেই। আপনি আমাকে এক বিকেল দিয়েছেন,এতেই আমি সারাজীবন খুশি থাকবো" - আমি।
মনে হয় আমার কন্ঠে তেমন কিছু ছিল, সে তার হাত দু'টো বাড়িয়ে দিল।
আমি হাত দু'টো আমার দু'হাত দিয়ে ধরে বললাম,
"আমি আপনাকে খুব ভালবাসি, বোঝাতে পারবোনা কতটা।
আমি আপনাকে দেখলে কতটা ভালো থাকি আপনি বোধহয় জানেননা।
সে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। আমার চোখে পানি এসে যাচ্ছিল,কিন্তু সামলে নিয়েছি। কিন্তু সে সব দেখেছে। কিছু বললো না আমাকে।
খুব শান্ত হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।
আস্তে আস্তে তার গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। আমি একটুও দু:খিত নই,কারন আমি তো তার এক বিকেল পেয়েই গেছি।
সেই দিনই রাত ৮টা।
ভাইয়া পাশে বসলেন।
"ফোন কেন ধরো না,আমি সেই কখন থেকে চিন্তায় আছি"- ভাইয়া
"আমার মনটা খুব ভালো ভাইয়া'- আমি
"সত্যি? সাবাশ, তাহলে আমার মনটাও আজ ভালো হলো"- ভাইয়া
"চল বাসায়" - আমি
"ইয়েস, লেটস গো। তোমার সুপার ভাইয়া আজ....."
"ভাইয়া"- বলে আমি ভাইয়াকে থামালাম। আর বললাম,
"বাবাও সুপার বাবা ছিল, আজ সেও ফাঁকি দিয়ে চলে গেছেন দূরে, আমি তোমাকে হারাতে চাইনা ভাইয়া। " - বলেই ভাইয়াকে জড়িয়ে করলাম।
টের পেলাম ভাইয়ার ফোঁপানো কান্না,তীব্র চাপা কষ্টের দীর্ঘশ্বাস।
দু:খ আর সুখ মিশেল সে কান্না। আজ তার ছোট ভাই অনেক দিন পর খুশি, এতেই তাঁর সব পাওয়া।
আমার ভাইয়া, আমার একমাত্র ভাইয়া,পৃথিবীতে আমার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন।
[বেশ ক'বছর আগের কিছু ঘটনা নিয়ে লেখা]
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।