এডিট করুন
রুবেল ভাই। এক সুপার হিরো। আমার খুব প্রিয় একজন মানুষ। এখন কোথায় আছে জানি না। উনার সাথে আমার খুব খাতির ছিল।
উনার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলাম অন্য এক কারণে। ছোটবেলায় বিভিন্ন টিভি অনুষ্ঠানে নায়কদের শক্তিমত্তা দেখে আমারো ইচ্ছা করত তাদের মত হতে। তারা যেভাবে বিরাট লাফ দেয় বা এক ঘুষি দিয়ে দেয়াল ভেঙ্গে ফেলে তা দেখে আমারো মনে হত, আহা! আমিও যদি এমন পারতাম! নিজের শক্তিমত্তা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন ব্যায়াম করতাম। ব্যায়ামগুলো ছিল আমার নিজের উদ্ভাবন করা। আমাদের কারখানার ভেতর অনেক গাছপালা ছিল।
আমি এক গাছ থেকে আরেক গাছে দড়ি বেধে, সেই দড়ি বেয়ে এক গাছ থেকে আরেক গাছে যেতাম। একটা পেয়ারা গাছ ছিল। সেই পেয়ারা গাছে একটা শক্ত ডাল ছিল আনুভূমিক। সেই ডালে পা বাধিয়ে উলটা ঝুলে থাকতাম। নিচের মাটির পৃথিবী তখন অন্যরকম লাগত।
কারখানার দেয়ালের যেখানে আস্তর মারা হয়নি, সেখান দিয়ে ইটের কানায় পা বাধিয়ে নীচ থেকে উপরতলায় ছাদে যাবার চেষ্টা করতাম। হাতে কাপড় বেধে দেয়ালে ঘুষি মারতাম। জঙ্গলের ভিতর দিয়ে ক্রলিং করতাম। ক্রলিং প্র্যাক্টিস করতে গিয়ে যে কত পিপড়ার কামড় খেয়েছি! ইত্যাদি নানা রকম ছেলেমানুষি কাজ কারবার আর কি! তা রুবেল ভাই আমাকে প্রথম ধারণা দেন যে শক্তিমত্তা অর্জনের জন্য একটা বিশেষ উপায় আছে। তা হল, মার্শাল আর্ট চর্চা করা।
উনি মার্শাল আর্ট চর্চা করতেন। উনি আমাকে মার্শাল আর্টের কিছু পাঠ দেন। উনার কাছ থেকেই আমার মার্শাল আর্টের প্রথম পাঠ নেওয়া। উনি বলতেন হাতের শক্তি যদি অর্জন করতে চাও তবে বস্তায় বালি ভরে প্রতিদিন সেই বস্তা সকাল বেলা ঘুম থেকে ঘুষাতে হবে। আমি মায়ের কাছে একটা চিনির বস্তার জন্য বায়না ধরলাম।
বললাম আমি বালি ভরে এই বস্তা ঘুষাব। মা কিছুতেই আমাকে বস্তা দিতে রাজী নন। অনেক বলার পর একটা বস্তা দিলেন। আমি বস্তা পেয়ে মহানন্দে বালির খোজে বের হলাম। আমাদের এরিয়ায় সবসময়ই বিভিন্ন কারখানার নির্মান কাজ লেগেই থাকে।
রাস্তা দিয়ে হাটলেই কিছুদুর পর পর বালির ডিবি পাওয়া যায়। আমি একটা পলিথিন ব্যাগে করে বালি এনে জমাতে লাগলাম। কারন একসাথে বেশী বালি আনা সম্ভব না। রুবেল ভাই আমার বালি আনার করুণ অবস্থা দেখে বস্তা নিয়ে চললেন আমার সাথে বালি আনার জন্য। উনি ছিলেন প্রচন্ড শক্তিশালী।
আমাকে উনার হাত দেখাতেন। পাথরের মত শক্ত হাড্ডিগুলো। উনি উনার হাতের শক্তি দেখানোর জন্য আমার সামনে বিরাট বিরাট ঘরের দেয়াল ঘুষাতেন। উনার ঘুষি খেয়ে দেয়াল কাপত। হাত দিয়ে ধরে দেয়ালের কাপন বোঝা লাগত না।
চোখেই দেখা যেত যে দেয়াল কাপছে। উনি ইতিমধ্যে বালির বস্তা ছেড়ে গুড়া পাথরের বস্তা ঘুষানো শুরু করেছেন বলে আমাকে বললেন। আমি শুধু ভাবতাম কবে একটা দেয়াল এক ঘুষিতে ভেঙ্গে ফেলার ক্ষমতা আমার হবে! তা রুবেল ভাই আর আমি এক বস্তা বালি এনে ওটাকে একটা শবেদা গাছে ঝুলালাম। কিন্তু বস্তার ভারে গাছের ডাল ভেঙ্গে পড়ল। আমরা দুজনেই ভ পেয়ে গেলাম।
কারণ শবেদা গাছের প্রতি বাবা খুব যত্ন নিচ্ছেন ইদানিং। কিছুদিন পরেই শবেদা হবে। তাছাড়া ফলের গাছের ডাল ভাঙ্গা বাবার একেবারেই অপছন্দ। কোনমতে ভাঙ্গা ডাল পাশের কারখানার দেয়াল ডিঙ্গিয়ে দেয়ালের ওপাশে ফেলে দিলাম। তারপর আমি বুদ্ধি দিলাম যে বস্তাটাকে আমি যে পেয়ারা গাছে উলটা হয়ে ঝুলে থাকি সেখানে ঝুলানো যেতে পারে।
পেয়ারা গাছের ডাল খুব শক্ত। অতঃপর পেয়ারা গাছেই ঝুলানো হল বস্তাটা। আমি ঝুলানো মাত্রই খালি হাতে একটা ঘুষি দিলাম বালির বস্তায়। ভাবলাম বালি তো নরম জিনিস। এ জিনিস ঘুষানো আর কি কঠিন কাজ? কিন্তু ঘুষিটা দিয়েই টের পেলাম এ জিনিস সে জিনিস নয়।
একে তো ছালার বস্তার অমসৃণ আবরণ তার উপর বালি জমে পাথরের মত শক্ত হয়েছে। ঐদিক রুবেল ভাই দমাদম ঘুষাতে লাগল বালির বস্তা। আমি ভাবি কবে আমি এ রকম পারব। আমি তখন হাতে কাপড় বেধে ঘুষানো আরম্ভ করলাম। কিছুক্ষণ পর দেখি হাতের হাড্ডি ব্যাথা করছে।
দেখা গেলো আমি কতক্ষণ ঘুষাই আবার রুবেল ভাই কতক্ষণ ঘুষায়। আমার ঘুষানিতে বালির বস্তা নড়েও না আর উনি দমাদম চালিয়ে যান। উনি বলতে থাকেন, "বাবু ( আমার অলিখিত ডাকনাম বাবু ) যেদিন তুমি এই বালির বস্তা ঘুষিয়ে ছিড়ে ফেলতে পারবে সেইদিন তুমি পাথরের বস্তা ঘুষানোর যোগ্যতা অর্জন করবে। আমি ইতিমধ্যে এই যোগ্যতা অর্জন করেছি। " আমি ভাবতাম, ব্যাপার না।
টানা এক মাস নিয়মিত ঘুষালেই হয়ে যাবে। আসলে তখন কোনকিছুকে কঠিন মনে করতাম না। মনে হত আমার দ্বারা সব সম্ভব। ঠিকমত চেষ্টা করলে একদিন আমি এক লাফ দিয়ে মাটি থেকে ছাদে উঠতে পারব। রুবেল ভাই তার মার্শাল আর্টের গল্প বলতেন।
বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় উনার বিজয়ের কথা বলতেন। উনি একদিন কারখানার কাজে আসেননি। পরেরদিন একটা লাল চোখ নিয়ে আসলেন। বাবা ধরলেন কি হয়েছে তোর? উনি বলেন চোখে লাকড়ি ছিটে গিয়েছিল লাকড়ি ফাড়ার সময়। কিন্তু আমাকে বললেন অন্য কথা।
বললেন গতকাল একটা প্রতিযোগিতা ছিল। উনি সেটায় দ্বিতীয় হয়েছেন। প্রথম যে হয়েছে তার একটা দাত উনি ফেলে দিয়েছেন। কিন্তু হঠাৎ উলটা একটা ঘুষি খেয়ে উনার চোখের বারটা বাজে। ঠিকমত দেখতে না পারার কারনে শেষ পর্যন্ত হারতে হয়েছে তাকে।
তবে উনি সেই প্রতিপক্ষকে নাকি বলে এসেছেন, "আবার দেখা হবে"। উনি জামার তলায় লুকিয়ে রাখা উনার মেডেলটা দেখালেন। আমি হাতিয়ে হাতিয়ে মেডেলটা দেখতে লাগলাম। আমি আর উনি পেয়ারা গাছেন নীচে বসে, দুই অসম বন্ধু। এক বন্ধু আরেকজনের কাছে তার সাফল্য ব্যার্থতা ভাগাভাগি করছে।
কারখানার কাজ শেষ হয়ে গেছে। উনার ছুটি। কিন্তু উনি এখনই বাড়ী না যেয়ে আমার সাথে বসে গল্প বলছেন। ভাগাভাগি করছেন নিজের ছোট ছোট প্রাপ্তি অপ্রাপ্তিগুলো। বিকেলের শেষ রোদ এসে পড়ছে ঘন ঝোপ আর গাছগুলোর উপর।
পাশের রাস্তাটা দিয়ে মাঝে মাঝে একটা দুটো বাস ট্রাক যাচ্ছে। সেই পেয়ারা গাছটা আর নেই।
আর ভাল লাগছে না। উনার কথা মনে পড়ে চোখে পানি এসে যাচ্ছে। রুবেল ভাই আমি তোমাকে ভালবাসি।
শেষ না করার জন্য দুঃখিত।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।