এই রাতের সড়কে নেমেছিল ঝড়। আমি ছিলাম সেই উত্তাল মিলনের দর্শক।
শিক্ষা ও সংস্কৃতি
আবু জাফর শামসুদ্দীন
সম্প্রতি ঘণ্টা সতের সময় আমাকে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী চট্টগ্রামে কাটাতে হয়। সেখানে কিছু সংখ্যক শুভানুধ্যায়ী এবং হিতাকাঙ্ক্ষী বন্ধুস্থানীয় ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল। তারা সবাই বিদগ্ধজন-বিদ্বান ও বুদ্ধিমান।
সাহিত্যের ভাষায় আমরা এ শ্রেণীর লোককে সমাজসচেতন বুদ্ধিজীবী বলে থাকি। ওদের মধ্যে দৈনিক সংবাদের নিয়মিত পাঠকরাও ছিলেন। বাঙালি জাতির চিরাচরিত স্বভাব অনুযায়ী আমরা সাম্প্রতিক ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন_ যাকে কোন কোন প্রার্থী মুদ্রিত পোস্টারে সাধারণ নির্বাচন বলতেও বিন্দুমাত্র দ্বিধাদ্বন্দ্ব বোধ করেননি (আমি নিজেই এরূপ একটি পোস্টার দেখেছি)_হতে শুরু করে বাজার দর পর্যন্ত দেশের প্রায় যাবতীয় চলতি আলোচ্য বিষয়ের ওপর নিজ নিজ মতামত প্রকাশ করছিলাম।
এই রসালাপের মধ্যে সহসা জনৈক বিদগ্ধ ব্যক্তি বললেন, 'আপনি তো বহু বিষয়ে লেখেন, দেশের কিশোরদের সম্বন্ধে কিছু লেখেন না কেন?' তাঁর মতে আদর্শ এবং প্রবর্তনার (সড়ঃরাধঃরড়হ) অভাবে দেশের কিশোর সমাজ বিপথে চলে যাচ্ছে। তাদের মধ্যে আদর্শনিষ্ঠা এবং প্রবর্তনা তৈরি করা আবশ্যক।
সংবাদপত্রের মাধ্যমে এ কাজ হতে পারে। 'আপনি সংবাদপত্রে নিয়মিত লেখেন, সুতরাং এ বিষয়েও কিছু লিখুন। ' ভদ্রলোকের কথাবার্তায় বুঝলাম, তিনি সত্য সত্যই দেশের কিশোর সমাজের ভবিষ্যৎ ভেবে উদ্বিগ্ন। উদ্বিগ্ন হওয়ার কথাও বটে, কেননা আজ যারা কিশোর তারাই আগমীকাল দেশের প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিক, সুতরাং দেশ-নিয়ন্তা। তাঁর উদ্বেগ লক্ষ্য করে আমি বিশেষ কিছু না ভেবেচিন্তেই বলে ফেললাম, আপনার দাবি পূরণ করার চেষ্টা করব।
তিনি আমাকে ট্রেনে তুলে দিয়ে চলে গেলেন। আমার তখন চিন্তা শুরু হলো। ভদ্রলোককে প্রতিশ্রুতি দিলাম তো কিন্তু লিখবটা কি? কিশোর তো আলাদা কোন জাত নয়-সমাজেরই একাংশ। কিশোরদের পিতামাতা অথবা কোন না কোন শ্রেণীর অভিভাবক আছে। এবং সবার উপরে আছে রাষ্ট্র কর্তৃক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পরিচালিত নানা ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
সরকারি-বেসরকারি ক্রীড়া অর্থাৎ খেলাধুলার ব্যবস্থাও আছে। আগেও এসব ছিল : বলা যায় চিরকালই ছিল, চিরকালই থাকবে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, বৃহত্তর সমাজের বাইরে কিশোরদের আলাদা কোন স্থান নেই। এমনকি তারা সম্পূর্ণ স্বাধীনও নয়, তারা গৃহে অভিভাবক, বিদ্যালয়ে শিক্ষক এবং ক্রীড়াস্থলে পরিচালকের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণাধীন। এই উভয়বিধ নিয়ন্ত্রণের বাইরে তাদের হাতে যে সময়টুকু উদ্বৃত্ত থাকে তার প্রায় সবটাই আহার ও নিদ্রায় অতিবাহিত হয়।
তার পরেও যে সময়টুকু অবশিষ্ট থাকে তার সুযোগে কোন কিশোরের পক্ষে বখাটে হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। সুতরাং কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ আবিষ্কারের ন্যায় কিশোরদের সম্বন্ধে কিছু লেখার মানসিক মুসাবিদা করতে গিয়ে দেখি, আমার লেখার বিষয়বস্তু প্রকৃতপক্ষে কিশোর সমাজ নয়, বিষয়বস্তু হয়ে যাচ্ছে কিশোরদের বিভিন্ন প্রকারের অভিভাবক শ্রেণী। কিশোর উপলক্ষ হতে পারে, কিন্তু লিখতে হবে কিশোরের বাপ-চাচা সম্বন্ধে। এই জায়গাটাই বড় নাজুক। কাকে কি বলব? চিৎ হয়ে থুথু ফেললে নিজের গায়েই পড়ে।
লেখক-সত্তার বাইরেও আমার একটা আলাদা সত্তা আছে : অর্থাৎ আমি নিজেও অভিভাবক শ্রেণী অর্থাৎ দেশের সাবালক শ্রেণীর একজন। সে হিসেবে আমার ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধানাধীন কোন কিশোর এই মুহূর্তে না থাকলেও দেশের অভিভাবক অর্থাৎ সাবালক শ্রেণীর মধ্যেই আমার স্থান।
এরই মধ্যে সহসা রবীন্দ্রনাথ বর্ণিত জবালা ও তার পুত্র সত্যকামের কাহিনীটি কেন যে মনে পড়ল, ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। জবালার পুত্র সত্যকাম গুরু গৌতমের সমীপে উপস্থিত হয়ে বলল, 'ভগবন, ব্রহ্মবিদ্যা শিক্ষা অভিলাষী, আসিয়াছি দীক্ষাতরে কুশক্ষেত্রবাসী_সত্যকাম নাম মোর' তখন 'ব্রহ্মর্ষি কহিলা তারে স্নেহশান্ত ভাষে, কুশল হউক সৌম্য, গোত্র কী তোমার? বৎস, শুধু ব্রাহ্মণের আছে অধিকার ব্রহ্মবিদ্যা লাভে। ' সত্যকাম তখনও তার গোত্র জানত না।
সে মুখ ভার করে বাড়ি ফিরে গিয়ে মা জবালার কাছে পিতৃপরিচয় জানতে চাইলে জবালা বিব্রতবোধ করলেও সত্য কথাই বলল, 'যৌবনে দারিদ্র্যমুখে বহু পরিচর্যা করি পেয়েছিনু তোরে; জন্মেছিস ভর্তৃহীনা জবালার ক্রোড়ে; গোত্র তব নাহি জানি তাত'। পরদিন সকালে সত্যকাম এ সংবাদ নিয়ে গুরুর কাছে গেল। উপস্থিত ছাত্র-শিষ্য এ বার্তা শুনে ছিঃ ছিঃ করতে লাগল। কিন্তু 'উঠিলা গৌতম ঋষি ছাড়িয়া আসন বাহু মেলি, বালকেরে করি আলিঙ্গন কহিলেন, অব্রাহ্মণ নহ তুমি তাত, তুমি দ্বিজোত্তম, তুমি সত্যকুলজাত। '
রবীন্দ্রনাথের কবিতাটি এখানেই শেষ।
আমার এই নিবন্ধের বিষয় বস্তুর সঙ্গে এ কাহিনীর কি সম্পর্ক তদ্বিষয়ে পাঠক সম্ভবত ইতোমধ্যেই মনে মনে প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। আমিও আমাকে এ প্রশ্ন করছি। এ প্রশ্নের একটি উত্তর খুঁজে পেয়েছি। এবং তাই সবিনয়ে পরিবেশন করছি। রবীন্দ্রনাথের কবিতাটির তিনটি চরিত্র : (১) জবালা- মা এবং অভিভাবিকা, (২) গুরু গৌতম-শিক্ষক, (৩) সত্যকাম-শিক্ষার্থী কিশোর।
একটি বিষয়ে এই তিনজনের চরিত্রের মধ্যে আশ্চর্য রকমের মিল লক্ষ্য করা যায়। তিনজনই সত্যভাষী। গুরু গৌতমের মধ্যে আরও একটি অতিরিক্ত গুণ বিদ্যমান। তিনি সত্যের কদর করতে জানেন। সত্যবাদীকেই তিনি প্রকৃত ব্রাহ্মণ অর্থাৎ মানুষ জ্ঞান করেন।
মানুষের বংশ পরিচয় তাঁর কাছে বিশেষ তাৎপর্য বহন করে না। বলাবাহুল্য, এহেন চরিত্রবান শিক্ষক এবং অভিভাবকের তত্ত্বাবধানে কিশোরদের বিপথগামী হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। গৃহে অভিভাবক এবং বিদ্যালয়ে শিক্ষক কিশোরের আদর্শ। তাঁরা যা বলেন কিশোর তা শোনে, যা করেন কিশোর তা দেখে। তাদের কথা ও কাজের মধ্যে যদি অসঙ্গতি থাকে কিশোর সেই অসঙ্গতিও নিশ্চয়ই লক্ষ্য করে।
কিশোর মন কাঁচা এবং নমনীয় বলেই তার ওপর পরিবেশের প্রভাব খুব বেশি করে পড়াই স্বাভাবিক। বাংলাদেশও এই সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশের কিশোরদেরও আদর্শ পুরুষ গৃহে পিতামাতা বা অন্য অভিভাবক, বিদ্যালয়ে শিক্ষক এবং সমাজে সমাজপতি। অভিভাবক, শিক্ষক এবং সমাজপতির কার্যকলাপ, আচার আচরণ, রুচি, সুনীতি কুনীতিবোধ প্রভৃতি দেশের কিশোরদের সম্মুখে সূর্যালোকের ন্যায় দেদীপ্যমান। তারা এগুলো অনূকরণ ও অনুসরণ না করে নিছক কেতাবি বুলি শুনবে এবং পালন করবে এমন আশা করা যায় না।
আশা করলে তা হবে আকাশ কুসুম রচনার তুল্য অস্বাভাবিক কাজ।
এখন বয়স্কদের নিয়ে গঠিত এ দেশীয় সমাজের চেহারাটা কি তা দেখার চেষ্টা করা যাক। সমাজের শিখরে রয়েছেন তাঁরাই যাঁরা কোন না কোন প্রকার দুর্নীতিকে ভিত্তি করে ঐশ্বর্য, বৈভব এবং ক্ষমতার পাহাড় গড়ে তুলেছেন। এটাও বাংলাদেশের আলাদা বৈশিষ্ট্য নয়; পৃথিবীর সব দেশের উচ্চ শ্রেণীর বৈভব ও ক্ষমতার মূলে রয়েছে দুর্নীতি। কিন্তু পৃথিবীর অন্যত্র উচ্চ শ্রেণী গড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে উঁচুমানের সংস্কৃতি ও বৈদগ্ধও গড়ে উঠেছে; সমাজ জীবনে ঘটেছে বিপ্লব।
ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি প্রভৃতি ইয়োরোপীয় দেশে শিল্প বিপ্লবের ফলে একটি উচ্চ শোষক শ্রেণী গড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে একটি অভিজাত সংস্কৃতিও জন্ম লাভ করে। এটাকে বলা যায় সাংস্কৃতিক বিপ্লব। ঊনবিংশ শতাব্দীর রাশিয়া অন্যান্য ইয়োরোপীয় দেশের তুলনায় অনগ্রসর ছিল। কিন্তু বৃহত্তর ইয়োরোপীয় সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ঢেউ রাশিয়াকেও প্লাবিত করে। অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় সাহিত্য, দর্শন, শিল্প, বিজ্ঞান প্রভৃতি সেই সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সাক্ষী।
রুশো, ভলতেয়ার, দিদেরো (উরফবৎড়ঃ), ফিজিওক্রাট অর্থবিদ্যাবিদ শ্রেণী, কান্ট, হেগেল, মার্কস, এঙ্গেলস, মিল, হবস, বেন্থাম, শোপেনহাওয়ার প্রমুখ পশ্চিম ইয়োরোপীয় এবং পুশকিন, দস্তয়ভস্কি, টলস্টয়, গগোল, গর্কি প্রমুখ অগণিত রুশ মনীষীর রচনাবলি এটাই প্রমাণ করে যে, ইয়োরোপীয় শিল্প বিপ্লব সমাজের সব স্তর থেকে যেমন মনীষী সৃষ্টি করেছে তেমনি শিল্প বিপ্লবের মর্মবাণী অনুযায়ী ইয়োরোপীয় মানবসমাজে রুচি-আচার-আচরণ এবং শিক্ষাব্যবস্থাকেও পুনর্গঠন করেছে। শুধু পুনর্গঠন করেছে বললে বড় জিনিসকে ছোট করে দেখা হয়। ইয়োরোপীয় মন ও মানসে নতুন প্রবর্তনা (সড়ঃরাধঃরড়হ) সৃষ্টির মূলেও রয়েছে শিল্প বিপ্লবের মর্মবাণী। এই প্রবর্তনাই ইয়োরোপীয় মানুষকে দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়তে আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড প্রভৃতি দেশে বসতি স্থাপন করতে উদ্বুদ্ধ করেছে। এই প্রবর্তনাই ইউরোপীয় মানুষকে এক সময়ে নেপোলিয়ানের পশ্চাতে এসে দাঁড়াতে এবং ইয়োরোপীয় সমান্ততন্ত্রকে ভেঙেচুরে তার স্থলে ভাষা, সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক ঐক্যভিত্তিক জাতি রাষ্ট্র গঠন করতে প্রেরণা যুগিয়েছে : প্রেরণা যুগিয়েছে জনশিক্ষা বিষয়ে গবেষণা চালিয়ে নতুন নতুন পদ্ধতির শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে।
চূড়ান্ত পর্যায়ে এই প্রবর্তনাই প্রথমে রাশিয়া এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরে পূর্ব ইয়োরোপের বিভিন্ন দেশে শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে সর্বহারা শ্রেণীকে প্রবুদ্ধ করেছে। বলাবাহুল্য, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব শিল্প বিপ্লবেরই উত্তরকাল।
আমাদের দেশে ঘটেছে সম্পূর্ণ বিপরীত ঘটনা। দুর্নীতিকে ভিত্তি করে গঠিত উঁচু শ্রেণীটিতে রয়েছেন ব্যাপারী, ব্যবসায়ী এবং কিছু আমলা অথবা ভূতপূর্ব আমলা। এঁদের একাংশের জীবনযাপন প্রণালী প্রায় ইউরো-আমেরিকীয় হলেও মন ও মানসের দিক থেকে ওঁরা দৃষ্টিকটু সঙ্কর।
কমোডে পায়খানা, বাথটাবে গোসল, ড্রেসিং টেবিল সমুখে নিয়ে সাজ সজ্জা এবং মোটর গাড়ি ও হাওয়াই জাহাজে চলাফেরা করলেই ইউরোপীয় হওয়া যায় না। তজ্জন্য যে বিদ্যাবত্তা, বৈদগ্ধ, মুক্তবুদ্ধি, সাংস্কৃতিক চেতনা আবশ্যক, বিরল ব্যতিক্রম ব্যতিরেকে ওঁদের মধ্যে তা সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। ওঁদের বৈঠকখানায় কুৎসিত সাজসজ্জা, শো কেস, টেলিভিশন প্রভৃতি সব কিছু দেখা যায়, কিন্তু সব বাড়ি তন্ন তন্ন করে খুঁজলেও বই-পুস্তকের সন্ধান পাওয়া যায় না। কোনরূপ সাংস্কৃতিক বা শিক্ষা আন্দোলনের সঙ্গে ওঁরা সম্পৃক্ত নন। কিশোর ছেলেমেয়েদের জ্ঞাতসারে এবং চোখের সমুখেই ওঁরা অসুদপায়ে টাকা কড়ি উপার্জন করেন, ওই টাকা দ্বারা কিশোর সন্তানদের সাজান এবং 'টা টা' কালচার শিক্ষা দেন।
সন্ধ্যায় টেলিভিশন নিয়ে বসেন এবং ছেলেমেয়েসহ অতি তৃতীয় শ্রেণীর বিদেশি ছবি দেখেন_ যেগুলোর মধ্যে মারামারি, খুনোখুনি, ঘুষাঘুষিই অধিক। বলা বাহুল্য, 'টা টা' বিলেতি সংস্কৃতির বাইরের দিক মাত্র, ভেতরের দিক নয়। বড় লোকের কিশোর ছেলেমেয়েরা এই 'টা টা' সংস্কৃতিতে দীক্ষিত হচ্ছে। সুনীতি-কুনীতির পার্থক্য ওদের অভিভাবকেরাও বিবেচনা করেন না, ওরাও বিবেচনা করে না।
দ্বিতীয় স্তরে আছে এ দেশের বিরাট মধ্যবিত্ত শ্রেণী।
ওঁরা মন-মানস এবং অর্থনৈতিক অবস্থার দিক থেকে বিভিন্ন স্তরে বিভক্ত হলেও উচ্চাভিলাষের ব্যাপারে ওঁরা সবাই এক স্তরে। মুখে ধর্ম ও নীতির বুলি কিন্তু সু-কু নির্বিশেষে যে কোন উপায়ে টাকাকড়ি রোজগার করে উচ্চ শ্রেণীতে প্রমোশন লাভ করার ব্যাপারে ওঁরা ঐক্যবদ্ধ। মন ও মানসের দিক থেকে বিরল ব্যতিক্রম বাদে ওঁরা প্রায় সবাই মধ্যযুগে বসবাস করছেন। নিজেরা বাস্তব জীবনে কোনরূপ অসততাকেই অসৎ ও অন্যায় জ্ঞানে পরিহার না করলেও কিশোরদের হিতোপদেশ দিতে সতত নিযুক্ত। কিন্তু কথা ও কাজের মধ্যে সামঞ্জস্য না থাকায় ওঁদের হিতোপদেশের প্রতি কিশোররা কর্ণপাত করে না।
তারা বরং অভিভাবকদের বাস্তব জীবনযাপন রীতিই অনুসরণ করতে চেষ্টা করে।
মধ্যবিত্ত সমাজের কোন কোন স্তরে অল্পবিস্তর সংস্কৃতি চর্চা হয়ে থাকে; কিছু কিছু লোক, যেমন শিক্ষক শ্রেণী, কখনও মনের তাগিদে, কখনও বা পেশাগত কারণে বাধ্য হয়ে কিছু লেখাপড়ার চর্চাও করে থাকেন। কিন্তু শ্রেণী হিসেবে বিচার করলে এ শ্রেণীর মধ্যে যে কোন উপায়ে অর্থবিত্ত লাভ ব্যতীত অন্য কোনরূপ প্রবর্তনা আদৌ নেই বললেও অত্যুক্তি হয় না। কখনও বকধার্মিকের বেশে, কখনও বা প্রগ্রেসিভের (প্রগতিশীল) বেশে সমাজে বিচরণ করলেও দেশে নব জীবনের সঞ্চার, উন্নতির নতুন দিগন্ত উন্মোচনের নেতৃত্ব দেয়ার কোনও আগ্রহ ও উদ্যোগ ওঁদের নেই। ওঁদের একটি অংশ বরং বাংলাদেশের জন্মেরও বহু পূর্বে হতে দেশে মূর্খতা সম্প্রসারণের আদর্শে উদ্বুদ্ধ এবং তজ্জন্য কাজ করে যাচ্ছেন।
বলাবাহুল্য, ওঁরা যে মূর্খতা সম্প্রসারণের কার্যে নিযুক্ত সে বিষয়েও ওঁরা সচেতন নন, কেননা ওঁদের বিদ্যাবুদ্ধির মাত্রা এত নিচে যে, ওঁরা মূর্খতা সম্প্রসারণের কাজটাকেই বৈপ্লবিক কাজ মনে করেন। তার প্রমাণ আমরা দেখতে পাচ্ছি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায়। বিগত প্রায় তিরিশ বছরকাল মধ্যে দু-দুবার রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করলেও, অদ্যাবধি আমরা একটি সমন্বিত ও সুসংহত শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন করতে পারিনি। একদিকে আছে 'টা টা' কালচারের প্রতিনিধিস্থানীয় ইংরেজি বাংলা মিডিয়মের তথাকথিত উচ্চ মানের নার্সারি-স্কুল, ক্যাডেট কলেজ প্রভৃতি, অন্যদিকে রয়েছে ওয়ারেন হেস্টিংস স্থাপিত কলকাতা মাদ্রাসার সেই পুরাতন নেসাব অনুযায়ী পরিচালিত অগণিত মাদ্রাসা। মধ্যখানে আছে দরিদ্র পাঠশালা এবং সাধারণের জন্যে পরিচালিত স্কুল-কলেজ প্রভৃতি।
শীর্ষস্থানে আছে বিশ্ববিদ্যালয় যার মধ্যে স্বাধীন জাতির বাস্তব প্রয়োজনে উপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা অনুপস্থিত। এক কথায় বলা চলে, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় চলছে প্রায় নৈরাজ্য এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বিদ্যমান প্রায় শূন্যতা। দেশের শতকরা ৯০ জন গ্রামবাসী কিশোরদের প্রসঙ্গ উত্থাপনের আবশ্যকতা নেই। ওরা আগেও যেমন অবহেলিত ছিল আজও তেমনি অবহেলিত। ওদের আদর্শ গ্রাম্য মাতব্বর প্রধান।
মাতব্বর প্রধানেরা টাউট শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত এবং বিরল ব্যতিক্রম ব্যতিরেকে প্রায় সবাই শহরের বিত্তবানদের আদর্শে অনুপ্রাণিত অর্থাৎ যে কোনও উপায়ে আপন সহায় সম্পত্তি ও প্রভাব প্রতিপত্তি বৃদ্ধি করার কার্যে লিপ্ত।
তাই বলছিলাম, কিশোর সমাজ সম্বন্ধে কিছু লেখার আগে ওদের বাপ-চাচা-মা-খালাদের সম্বন্ধেই লিখতে হয়। আশা করি আমার হিতাকাঙ্ক্ষী বন্ধুটি আমার অপারগতার জন্য ক্ষমা করবেন।
(১৯৮৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত লেখাটির পুনর্মুদ্রণ)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।