আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পবিত্র কোরবানীর শুদ্ধতা নিয়ে রীট ও আদালত



গতকাল ব্লগপাড়া ব্যস্ত ছিল কোন এক বিশ্ব শান্তি পরিষদের প্রেসিডেন্ট দেব নারায়ণ মহেশ্বরের "কোরবানী শুদ্ধ করার আবেদন" জানিয়ে হাইকোর্টে রিট নিয়ে। এ প্রসঙ্গে সব পত্রিকার রিপোর্টই গুরুত্ত্বপুর্ণ তথ্যগুলোকে অবহেলায় উহ্য রেখে রিপোর্ট ছেপেছিল। আর ব্লগ ব্যস্ত ছিল কোরান শরিফে কী আছে তার ব্যাখ্যা তরজমা আর অনুবাদ নিয়ে তর্ক-বিতর্কে। আইনী দিক থেকে প্রসঙ্গটা কোথাও আলোচনা হতে দেখিনি। কোন ধর্ম-সামাজিক তর্কবিতর্ক আদালতের বিষয় নয়।

ওকে আদালতের বিষয় না বানিয়ে বরং সামাজিক দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় সামাজিকভাবে নিরসিত হতে দেয়াই উত্তম ও বুদ্ধিমানের। ঐ আদালত রিট পিটিশন শুনানির জন্য কী বিবেচনাতে গ্রহণ করেছে তা স্পষ্ট করে রিপোর্ট থেকে জানা যায় না। তবে রিপোর্টগুলো দেখে মনে হয়েছে আদালত রিট পিটিশন শুনানির জন্য গ্রহণের তারিখ দিয়েছে অথবা গ্রহণ করতে যাচ্ছে। আদালতের রিট পিটিশন (Writ Petition) শুনার জন্য গ্রহণ করাটা হবে খারাপ উদাহরণ, বিপদজনক লক্ষণ। ১।

সুপ্রিম কোর্টে সবার আগে পিটিশনারকে অর্থাৎ দেব নারায়ণ মহেশ্বর বা তার উকিলকে অবশ্যই পিটিশন দাখিলের কাগজে প্রমাণ করার মত পয়েন্ট লিখে (এফিডেবিট বা সাক্ষ্য দিয়ে) আবেদন জানাতে হবে যে কেন তিনি ঘটনার কারণে সংক্ষুব্ধ (aggrieved), সংশ্লিষ্টতায় ক্ষতিগ্রস্থ ইত্যাদি হয়েছেন। বাংলায় আমরা যেমন কোন ঘটনার বর্ণনা শুনার পরে বলি, তাতে আপনার কী, আপনি কীভাবে এতে সংশ্লিষ্ট ও ক্ষতিগ্রস্হ বোধ করছেন, সো হোয়াট – সেরকম। সংক্ষুব্ধ প্রমাণ করার মত পয়েন্ট (আইনের পেশাগত ভাষায় Locus Standi) সেখানে না থাকলে (যা বিচারককে কনভিন্স করতে পারে) ঐ রিট পিটিশন বিচারক শুনানির জন্য দিন তারিখ দেবার আগেই খারিজ করে দেবেন। ২। রিপোর্টগুলো থেকে আমরা জানতে পারি নাই আবেদনকারী বা পিটিশনারের এফিডেবিটে সংক্ষুব্ধ হবার কারণ ও কীভাবে তিনি সংক্ষুব্ধ হবার মত একটা পার্টি – তা দাবি করে ঠিক কী লিখেছেন।

৩। তবে আদালতের রিট পিটিশন শুনানির জন্য গ্রহণ করার অর্থ হবেঃ কালকে কেউ কাফের কী না, কাদিয়ানিরা অমুসলমান কী না, কোন পোষাক অ-ইসলামিক কী না ইত্যাদি থেকে শুরু করে ইসলাম-অ-ইসলাম বিষয়ক যত সামাজিক তর্ক আছে এখন থেকে সব কিছুতে ফতোয়া দেবার কেন্দ্র হয়ে দাঁড়াবে সুপ্রিম কোর্ট। এরপর শুধু তাই না, ঐ ফতোয়াকে কেন্দ্র করে এর ভিতর দিয়ে আমাদের পুরা সমাজ কয়েক ভাগে বিভক্ত হয়ে একে অপরের বিরুদ্ধে তলোয়ার নিয়ে এক ছদ্ম “ধর্মযুদ্ধ” লড়তে শুরু করবে। অনুমিত এই ঘটনার পর ঘটনাক্রমে কেউ কেউ যারা বেঁচে যাবেন এবার তাঁরাও মরবেন সিভিল আদালতের রায়ে মৃত্যদন্ডে; কারণ অভিযোগ হবে, সত্যিকার একদম আক্ষরিক অর্থেই এরা সমাজে দাঙ্গাহাঙ্গামা, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছেন, মানুষ হত্যার কারণ ঘটিয়েছেন। উদাহরণ হিসাবে, আবুল আলা মওদুদীকে সিভিল সুপ্রিম কোর্ট কেন মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করেছিল আমরা মনে করে দেখতে পারি।

এই আদালত আমাদের সকলের জন্য সেই বিপদ ডেকে আনতে পারে। ৩। আমাদের সমাজে আমরা বহু বিষয়ে তর্ক-বিতর্ক করি যার অনেকটাই অমীমাংসেয় থেকে যায়। কিন্তু সমাজ থেমে থাকে না। চলার পথে লম্বা সময় পারি দিয়ে সেসব বিতর্কের অনেকগুলোই নিজ গুণে, কারণে নতুন বাস্তবতায় কন্ডিশনে নিজ নিরসিত হয়ে যায়।

কারণ দেখা যাবে হয়ত সে তর্কের বাস্তবতাই আর নাই ফলে প্রয়োজনও আর অনুভত থাকে না। শুধু তর্ক-বিতর্কেরই অনুভব বাস্তবতা লোপ পায় তা নয়। সেই সাথে ঐ তর্ক-বিতর্কের যে ভিত্তি যার উপর বিচারের মাপকাঠি তৈরি করতাম, শানানো যুক্তি বের করতাম আমাদের সেই সামাজিক বিচারবোধ, মুল্যবোধের মধ্যেও বদল ঘটে, যদিও তা খুবই ধীর গতির। কনষ্টিটিউশনাল আদালতের বিচারের বিপরীতে এর সবগুলোই সামাজিক বিচার গোত্রের। সামাজিক বিচার আর কোর্ট, কনষ্টিটিউশনের বিচার এক নয়।

সামাজিক বিচারের কোন কনষ্টিটিউশন বা মুল আইন বলতে কিছু নাই, দীর্ঘদিন ধরে চালু রেওয়াজ, প্রথা আছে, থাকে। সামাজিক বিচারের ইস্যু তাই কোন কোর্ট, কনষ্টিটিউশনের ইস্যু নয়। যা কনষ্টিটিউশনের ইস্যু নয় যেটাকে আমরা লিগ্যাল ইস্যু নয় বলি তাতে সুপ্রিম কোর্টের বা ওর বিচারকের কোন এক্তিয়ার নাই, কাজও নয়। যেমন, সমাজে কে কাকে সালাম দিবে, কীভাবে দিবে, কোন শব্দগুলো বলবে, বডি ল্যাঙ্গুয়েজ কেমন প্রকাশ করবে, সরাসরি নাম ধরে ডাকবে কী না – এসব সমাজের রীতিনীতি, ধর্মীয় সাংস্কৃতিক মুল্যবোধ ইত্যাদি দিয়ে এর ভিত্তিতে ঠিক হয়। যেটা বলছিলাম এই ভিত্তি আবার চিরন্তন কিছু নয়।

খুব ধীরে ধীরে প্রায় অলক্ষ্যে এই ভিত্তিগুলোর বদল ঘটে। কনষ্টিটিউশন, আইন আদালত এগুলোতে বুদ্ধিমানের (wisdom) মত হস্তক্ষেপ না করে সামাজিক ইস্যু মনে করে সামাজিক নিরসনের উপর ছেড়ে রাখে। ঠিকই – কিন্তু একটা বেড়া বা সীমানাও টেনে দিয়ে রাখে। যা পার হয়ে গেলে বুদ্ধিমান বিচারক আদালত আইনের কর্তৃত্ত্বের দন্ড নিয়ে হাজির হয়ে যায় যেন শেষ বিচারে কনষ্টিটিউশনের সীমায় কর্তৃত্ত্বে সবকিছু থাকে, ঘটে। যেমন, কেউ কাউকে ঠিকমত সালাম দেয়নি কেন সমাজে এনিয়ে বেয়াদবি বা অবেয়াদবির মীমাংসা করতে গিয়ে কেউ যদি কারও মাথা ফাটিয়ে দেয় এবং ঘটনা আদালতে যায় তবে আদালত কেবল মাথা ফাটিয়ে দেবার ঘটনা আমলে নিয়ে ফৌজদারী বিচার শুরু করবে।

ঘটনায় বেয়াদবি ঘটেছে কী ঘটে নাই এটা সেখানে বিচার্য বিষয়ই হবে না। সামাজিক সালিস বিচার সমাজে ঘটতে দিতে বুদ্ধিমান আদালত আপত্তি করে না; বরং সমাজের অঙ্গ মনে করে। কিন্তু ফতোয়া দিয়ে কাউকে দন্ড দেয়া, দোররা মারার চেষ্টায় সীমাভঙ্গ অতিক্রম করার ঘটনায় আদালত আগিয়ে আসে; আসতেই হয়। মুল কারণ, আদালত বাদে অন্যের হাতে এই দন্ড দেয়ার কর্তৃত্ত্ব থাকা মানে কনষ্টিটিউশন, আইন আদালত বিচারকের সর্বময় কর্তৃত্ত্বকে চ্যালেঞ্জ করা, অনাকাঙ্খিত ভাগ বসানো। তবে সারকথা, যেটা সামাজিকভাবে নিরসিত হবার বিষয় একে কোন বুদ্ধিমান আদালত নিজের বিচার্য বিষয় করে না।

রায় দিয়ে সেটার প্রিম্যাচুয়র বেবীর মত টেনে হিঁচড়ে সমাধান বের করতে যায় না। ৪। আলোচ্য আদালতের বিচারকের ব্যক্তিগত ভাবে যতটা পরহেজগার ধার্মিকই হোন না কেন চেয়ারের কর্তব্য, সীমা, সমস্যা, দূরদৃষ্টির কথা ভুলে গেলে তিনি আমাদের সমাজকে গভীর সমস্যায় টেনে নামিয়ে ফেলতে পারেন। নয়াদিগন্তের রিপোর্টে দেখলাম বিচারক নাকি মন্তব্য করেছেন “বিষয়টি অত্যন্ত সিরিয়াস”। কোরান শরিফে কী আছে তার ব্যাখ্যা তরজমা আর অনুবাদ নিয়ে বিচারকের ব্যক্তিগত কৌতুহল আগ্রহ থাকতেই পারে, তা স্বাভাবিকও।

জানা বিষয়কে কেউ অজানা বলে দাবি করে ফেললে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তা বলে বসা আদালতে সে কৌতুহল আগ্রহ প্রকাশ করতে হবে এটা বুদ্ধিমানের কাজ না, বিপদজনকও বটে। ৫। বিভিন্ন পত্রিকার কোর্ট রিপোর্টারদেরও পেশাগত ব্রীফিং-জনিত সমস্যা আছে - এই ঘটনায় সেটা দেখা গিয়েছে। কোন পত্রিকাই ঘটনায় আদালতের কোন দিকটা ফোকাস করবে সে বিচারে বিবেচনায় রিপোর্ট কেঊ করতে পারেননি; ফলে কারই লেখা কোর্ট রিপোর্ট হয়ে উঠেনি ।

বরং নিজ দলীয় লাইন দৃষ্টিকোণ থেকে আধা আধা বর্ণনা টেনে তাতে এক নিউজ ট্রিটমেন্ট হতে দেখা গিয়েছে। অনেকে অবশ্য মজা হিসাবে নিয়েছে, যেন ভালই হয়েছে ধর্মের নাকানিচুবানি দেখা যাবে গ্যালারিতে বসে। কেউ কেউ এটাকে "কোরআন শুদ্ধতা দাবি" মানে করে উস্কানি দিতে চেয়েছে। অথচ সবচেয়ে গুরুত্ত্বপূর্ণ ছিল, আদালত কী শুনানির জন্য তারিখ দিয়েছে, আনুষ্ঠানিক শুনানি শুরু করেছে – কী ভিত্তিতে? আদালত মামলাটাকে কীভাবে দেখছে ওর অভিপ্রায় অভিমুখ কী - কেউই স্পষ্ট করে ফোকাস করতে পারেনি। ৬।

ব্লগে কেউ কেউ হিন্দু মহেশ্বরের কোরআনের শরীফে আগ্রহ - সেদিক থেকে বিষয়টাকে দেখতে চেয়েছেন। এভাবে দেখাটাকে এড়ানো সম্ভব ছিল হয়ত ভাল ছিল যদি আমরা বুদ্ধি বিবেচনা খাটিয়ে প্রশ্ন করতে বা খুজতে যেতে পারতাম এই মামলায় মহেশ্বর Locus Standi বা নিজেকে সংক্ষুব্ধ প্রমাণ করার জন্য কী দাবি করেছেন। ওখান থেকে জানা যেত মহেশ্বরের নিজেই সামাজিক সমস্যা তৈরি করছেন না কী আমরা কারও পাতা ফাঁদে পা দিচ্ছি। আমাদের শুভবুদ্ধির উদয় হোক!

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.