আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ঐশীদের ঈশ্বর কারা?

বাংলাদেশে মানুষ দুই প্রকার। ১ যারা শাহবাগে এসেছে। ২ যারা শাহবাগে আসেনি...।

কথা হলো একটি বাচ্চা মেয়ে(!) নিজে অথবা বন্ধুদের সহায়তায় তার বাবা-মাকে হত্যা করেছে। খুব আশ্চর্য ঠেকছে, একটি সন্তান কীভাবে বাবা-মাকে হত্যা করে! এখানে দোষী হচ্ছে সন্তান, যে কি না এভাবে-ওইভাবে বিপথগামী হয়েছে।

বাবা-মা সিম্পলি নির্দোষ। বাবারা কতো ভালো, মায়েরা কত্তো ভালো; প্রসঙ্গক্রমে এই কথাই তো উঠে আসছে, স্বাভাবিক। কঠিন ঠেকলেও এখন নিকট অতীতে ঢু মারতে হবে ঢাকার মিরপুরে। পরকীয়ার সুবিধার্থে সুস্থ সবল এবং নেশা করে না এমন একজন মা সন্তানকে হত্যা করলো। এবার জুরাইন যাওয়া যাক, মা দুই সন্তানকে নিয়ে একই সাথে একই সময়ে এবং একই কারণে আত্মহত্যা করলো।

এবার পুরান ঢাকা, বড়ো এক অভিনেতার পরিবারে এক ভাই আরেক ভাইকে হত্যা করলো। মনে পড়ে? হয়তো ভুলে গেছি, আমরা আসলে ভুলেই যাই, এটাই আমরা; the power of we. ঐশীকে আমরা দুষছি, সে নেশা করতো এবং বেপরোয়া জীবনে অভ্যস্থ ছিল। তার বাবা-মাকে দুষছি, তারা মেয়েটার মন বুঝতে পারেনি, যথার্থভাবে মানুষ করতে পারেনি, সময়োচিত পদক্ষেপ নিতে পারেনি। নেশা ও নেশাজাতীয় দ্রব্যকে দুষছি। টিন প্রজন্ম গোল্লায় যাচ্ছে, সমাজব্যবস্থা তাদেরকে শুধরাতে পারছে না; এমন অনেক নীতিবাক্য আওড়াচ্ছি, ভালো তো, ভালো না? আসলে আমরা পারি, সর্টকাটে, সহজ পন্থায় আমরা অনেক কিছুই পারি।

অ্যারেস্ট পারি, রিমান্ড পারি, প্রেস কনফারেন্স পারি, সাংবাদিকতা পারি, কলামগিরি পারি, মনোবিজ্ঞান পারি, মানবাধিকার পারি, ব্লগিং-টুইট-স্ট্যাটাসিপনা পারি, পারি না কেবল ঐশীদের ঈশ্বর খুঁজে বের করতে। নেশা করতো বলে আজ ঐশী ভয়ঙ্কর, নেশা ভয়ঙ্কর, ইয়াবা ভয়ঙ্কর। তাইলে মিরপুরের মা কেন ভয়ঙ্কর হলো, তিনি তো নেশা করতেন না, জুরাইনের সেই মা ও সন্তানেরাও না। তাইলে নেশার দোষ কেন দেই, নেশাদ্রব্যের দোষ কেনই বা দেই? প্রশ্ন অবশ্যই আসবে। কিন্তু জবাব এত্তো সোজা না, কঠিন।

যতো কঠিনই হোক, জবাবগুলো আমাদেরকে বের করতে হবে। আর যদি জবাবগুলো বের করতে না পারি, সমস্যার জায়গাগুলো চিহ্নিত করতে না পারি, তাইলে আমাদেরকে হিসেব কষে দিনাতিপাত করতে হবে; প্রায় প্রতিটি পরিবারেই মা আছেন, সন্তান আছে, একজন অপরজনের বিরুদ্ধে যে কোনো সময় দাঁড়িয়ে যেতে পারে...। সাধারণ কোনো প্রাণিহত্যাকে আমরা অনেকে মহাপাপ জ্ঞান করে থাকি, অথচ মানুষ হত্যা চলছে অনবরত। ঐশীবিষয়ক কথাবার্তার একদম প্রাথমিক স্তরে দাঁড়িয়ে যদি বলি নেশাদ্রব্য ইয়াবার কথা, সেটা উপশমের না হলেও জবাবদিহির জায়গাটা সহজেই পরিষ্কার হবে। মাদকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে বিরাটকায় প্রতিষ্ঠান আছে।

বর্ডারে বিজিবি আছে। স্বাভাবিক মন্দ কাজ ঠেকানোর জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আছে। তারপরও কীভাবে ইয়াবা দেশে ঢুকছে, বাজারজাত হচ্ছে, সেবন চলছে? দেশে ইয়াবার অনুপ্রবেশের জন্য দেশের সকল গেটওয়েতে দায়িত্বরতদের জবাবদিহি অনিবার্য নয় কি? শুধু ইয়াবা কেন, সব বিদেশি নেশাদ্রব্যের ব্যাপারে একই কথা খাটে। আমি একটা জিনিস ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি, সম্ভব বলেই বিশ্বাস করি, রাষ্ট্রের সদিচ্ছা থাকলে দেশে এক পিস ইয়াবার অনুপ্রবেশও সম্ভব নয়। যেহেতু মিলিয়ন মিলিয়ন পিস ইয়াবা ঢুকছে, সেহেতু ধরে নিবো রাষ্ট্রের সদিচ্ছা নেই।

বুঝলাম, নেশাদ্রব্যের অনুপ্রবেশের ব্যাপারে রাষ্ট্র সেভাবে মাথা ঘামায় না, তার অনেক কাজ; বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস, ফ্লাইওভার, সেতু, উন্নয়ন, পিতার আদর্শ, স্বামীর আদর্শ, বিশ্বশান্তি ইত্যাদি নিয়ে সে ব্যস্ত। অন্যদিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং জনপ্রতিনিধির বেতনভাতা জীবনযাপনের জন্য যথেষ্ট নয়। গরীব রাষ্ট্র, তাদের সব আহ্লাদ পূর্ণ করতে পারে না। চাকরির পাশাপাশি ঘনিষ্ঠজনদের দিয়ে স্বাভাবিক বাণিজ্য করে জীবনের ব্যয়গুলোকে আঞ্জাম দেওয়ার মতো ধৈর্য এবং সুনীতি তাদের নেই। তাই তারা মাদকের অনুপ্রবেশ ঘটায়, বাজারজাতে সহায়তা করে, খদ্দের বানায়।

বিনিময়ে পঞ্চাশ বছরের আয় তিন বছরেই জুটে যায়। হয়ে যায় অনেক গাড়ি, বাড়ি এবং নারীও। কিন্তু এমন আয় দিয়ে কি সন্তান মানুষ করা সম্ভব? অবশ্যই না! নিজে মানুষ হওয়া সম্ভব? প্রশ্নই ওঠে না! তাইলে রাষ্ট্রের কী হবে? এই মানুষ, এই সন্তান, এই বাবা-মা, এই পরিবার, এই সমাজ; এইসব নিয়েই তো রাষ্ট্র! ছোট বেলায় শুনতাম, আটচল্লিশ হাজার গ্রাম বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে। এখন প্রশ্ন, আটচল্লিশ হাজার গ্রামে মাদক পৌঁছলেও কি বাংলাদেশ বাঁচবে? দেশের এমন কোনো গ্রাম আছে, যে গ্রামে ইয়াবা-ফেনসিডিল পাওয়া যায় না? না, এমন মহাপবিত্র গ্রাম একটিও নেই। দেশের যে গ্রামে বিদ্যুৎ নেই, সেই গ্রামেও পৌঁছে গেছে ইয়াবা-ফেনসিডিল।

দেশের যে গ্রামে গ্যাস নেই, সেই গ্রামেও পৌঁছে গেছে ইয়াবা-ফেনসিডিল। দেশের যে গ্রামে সাপ্লায়ের পানি নেই, সেই গ্রামেও পৌঁছে গেছে ইয়াবা-ফেনসিডিল। এটা রাষ্ট্রের ব্যর্থতা নয়, কৃতিত্বও বটে! কারণ, রাষ্ট্রের সদয় সম্মতি ও তৎপরতা ব্যতীত আটচল্লিশ হাজার গ্রামে আদর্শলিপি পৌঁছানোও সম্ভব নয়। যে বা যারাই হোক, অফিসিয়াল অথবা সিভিল হোক, এতো বড়ো জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সম্ভব নয়। কারণ বিশাল বিনিয়োগের বিনিময়ে তাদের কেউ কেউ চাকরি পায়, জনপ্রতিনিধি হয় এবং এইসব বিনিয়োগের রিটার্নের জন্য তাদের বেঁচে থাকতে হয়।

তাছাড়া এদের শোধরানোর মতো বয়স ও মানসিকতা কোনোটাই নেই। তবে তাদের জাগতিক প্রয়োজনগুলোকে নিয়ে রাষ্ট্রকে নতুন করে ভাবতে হবে। প্রয়োজনের পরিমিতিবোধ তাদেরকে শেখাতে হবে। আর সুনীতি বলতে একটা ব্যাপার আছে, তবে রাষ্ট্র কোনোভাবে এর শিক্ষক হওয়ার সুযোগ নিতে পারে না। কারণ সুনীতি শিখতে হয় ছোটবেলায়, বাবা-মার কাছে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে, মক্তবে, কখনো জীবনভর।

সুনীতির একটা প্রাতিষ্ঠানিক ভাবান্তর হচ্ছে সুশিক্ষা। এই সুশিক্ষার পথ ধরেই ন্যায় সম্ভব। কিন্তু আমরা ‘দাদার হাতে কলম ছিল...’ পড়তে পড়তে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। চকলেট আর সাবানের মতো নিষ্প্রাণভাবে চলছে বিদ্যা ও বিদ্যালয়, বিদ্যার আদান-প্রদান। মুখস্ত পড়া, পরীক্ষায় পাস এবং সার্টিফিকেট; এসবেই আটকে আছে বিদ্যার দৌড়।

সুশিক্ষার কাগুজে উপস্থিতি আছে, প্রয়োগিক বাধ্যবাধকতা নেই। শিক্ষক হয়ে উঠেছে বিদ্যালয়ের কর্মচারী, ছাত্র হয়ে উঠেছে বিদ্যালয়ের কাস্টমার। ...দীর্ঘ সময় এভাবে চলতে থাকলে শিক্ষাব্যবস্থা মুখ থুবড়ে পড়বে, স্বাভাবিক। আর এই শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্কটই মাদক ও মারামারির সুযোগ করে দেয় বিদ্যালয়ে, ক্যাম্পাসে। অবশেষে শিক্ষক পুঁজির জন্য পড়ায়, ছাত্রও পুঁজির জন্য পড়ে, পুঁজি প্রতিষ্ঠার জন্যই অনবরত দাঁড়িয়ে যায় মহা-মহান বিদ্যালয়, বিদ্যাবাণিজ্য, বিদ্যার দোকান, দোকানদার।

ভুলুণ্ঠিত হয় সুনীতি, মানুষ হয়ে ওঠে কেবলই মানুষের মতো। মানুষ মানুষের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোটাই অন্যায়, বিবাদগুলো অন্যায়, যুদ্ধগুলোও অন্যায়; চেনা হোক, অচেনা হোক। মার বিরুদ্ধে সন্তান এবং সন্তানের বিরুদ্ধে মা, ভাইয়ের বিরুদ্ধে ভাই, এসব তো আরও বিপজ্জনক। ধর্মীয় রীতি আছে, রাষ্ট্রের আইন আছে, সামাজিক কাঠামো আছে, তারপরও কেন রক্তপাত? যারা মার্কসকে মানে তারা পুঁজির কথা বলবে, আর যারা মার্কসকে মানে না তাদেরকেও পুঁজির অপরাধগুলো নিয়ে ভাবা দরকার। ঐশীর হাতে বাবা-মা খুন হয়েছেন, এখানে পুঁজির দোষটা কোথায়? নির্দিষ্ট করে না বললেও দোষটা পুঁজিরই, কোকাকোলা এবং পেপসিরই, সামগ্রিক অর্থে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলোই এর জন্য দায়ী।

এই বহুজাতিকওয়ালারা আমাদেরকে মানুষ মারতে বলে নাই, নষ্ট হতে বলে নাই। শুধু আমাদের ভেতরে ৩টি জিনিস ফুলিয়ে তুলছে: ১. লোভ ২. ফুটানিগিরি ৩. রোমাঞ্চ। না তো, বহুজাতিকওয়ালারা তো বরঞ্চ মাকে ভালবাসতে বলে, গিফট দিতে বলে, মোবাইল কিনে দিতে বলে। তাহলে তাদের দোষ দিচ্ছি কেনো? এমন সহজপন্থায় তাদের দোষ দেওয়া যায় না, তবে কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করা যায়। আধুনিক বহুজাতিকওয়ালাদের আগমনপূর্ব সময়ে কি কোনো মা সন্তানকে হত্যা করেছে? কোনো সন্তান মাকে হত্যা করেছে? আগে কি সন্তানেরা মাকে সন্তুষ্ট করেনি, মা কি সন্তানকে মানুষ করেনি? এমন সহজতরভাবে এবং নানান আঙ্গিক থেকেই প্রশ্ন উত্থাপন করা যেতে পারে।

কোম্পানিগুলো মাকে যেমন ভালোবাসতে বলে, বন্ধুদেরও ভালোবাসতে বলে। বন্ধু ছাড়া লাইফ ইম্পসিবল, এটা বলে, কিছু কথা রাতের জন্য, এটাও বলে। মোদ্দা কথা, কথা বলিয়েই ছাড়বে। আমাদের যখন কথা বলার অভ্যাস ছিল না, প্রয়োজন ছাড়া কথা বলতাম না, তখন তারা সারারাত বিনে পয়সায় কথা বলার সুযোগ করে দিয়ে আমাদের কথা বলার অভ্যাসটা বানিয়েই ছাড়লো। এই কথা বলাই আমাদের তারুণ্যকে বললো; চলো বহুদূর, মেয়েদেরকে পৌঁছে দিল অনেক বন্ধুর খপ্পড়ে, গৃহবধূ ও স্বামীদের পৌঁছে দিল পরকীয়ায়।

পারিবারিক সদাই-এ সাধারণত কোক-পেপসি-কেএফসি থাকে না (উচ্চবিত্তের কথা অবিবেচ্য)। এইসব বেচতে হলে ছেলে-মেয়ে-বধূদেরকে বাইরে নিতে হবে। বাইরের রঙিন উত্তাপের খবর ঘরেই পৌঁছে দিচ্ছে তারা, তাই ঘরে বসে থাকা দায়। বাইরে গেলে মানুষ কোক খাবে, পেপসি খাবে, কথা বলবে, ইউনিলিভার মাখবে সারা শরীরে। এভাবেই ছোট ছোট জায়গা থেকে মাল্টিন্যাশনাল আমাদেরকে নিয়ে যায় ধ্বংসের দিকে।

যেসব বিষয়াদি মানুষের প্রয়োজনের মধ্যে পড়ে না, সেইসবই হচ্ছে বহুজাতিকদের প্রধান পণ্য। অপ্রয়োজনীয় হলেও তারা মানুষকে গ্রহণ করিয়েই ছাড়বে। এ জন্য যদি মানুষকে ঘর থেকে বের করতে হয়, সেটা তারা করবেই। অনেক সম্পর্কেও যদি মানুষকে জড়াতে হয়, সেটাও তারা করে ছাড়বে। এই প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে অবশেষে যদি মানুষ নষ্ট হয়, এতে তাদের কিছুই যায় আসে না।

তারা তো কেবল রিটার্ন চায়। তাদের এসব কাণ্ড যদি আমাদের কাছে ক্ষতিকর মনে না হয়, তবে সামাজিক ও পারিবারিক হত্যার কারণ খুঁজে লাভ নেই। অবক্ষয়গুলোকেও অনবরত শক্তিশালী হতে বাধা দেওয়ার কারণ নেই। মনে রাখা দরকার, সন্তানকে মাদক কিনে দেওয়া আর আর মাদকের টাকায় সন্তানকে ক্যাডবেরি কিনে দেওয়া একই ব্যাপার। নিজের সন্তান আর পরের সন্তানকে সমান চোখে না দেখলেও মানবিক দৃষ্টির সমতায় দেখলে দেশের সন্তানেরা ভালো থাকবে।

অন্তত প্রজন্মের দিকে তাকিয়ে, মেধামাতৃক বাংলাদেশকে টিকিয়ে রাখতে যদি ঘুরে দাঁড়াতে চাই, তবে আমাদেরকে ভেবে নিতে হবে; মানুষ যে কারণে মানুষ, সেই কারণগুলো ক্ষয়ে গেলে মানুষ আর মানুষ থাকে না, সন্তানও থাকে না সন্তান, হয়ে ওঠে ঐশী। তাই আমাদেরকে অবশ্যই ঐশীদের ঈশ্বরকে চিনে রাখা দরকার, এটাই হয়তো আপাত-কল্যাণ। ঐশিদের ঈশ্বর কারা?

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।