আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠন ছাত্রলীগ সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে খুন, হত্যা, ধর্ষণ, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, ভর্তি বাণিজ্য, চাকরি বাণিজ্য, শিক্ষক ও ছাত্রী লাঞ্ছনা, নিজ গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ, আধিপত্য বিস্তারে দখলবাজীর জন্য সন্ত্রাস ও নৈরাজ্য সৃষ্টি করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে কলুষিত করেছে। তাদের অব্যাহত সন্ত্রাসের কারণে বন্ধ হয়ে গেছে দেশের অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। তাদের হিংস্রতার শিকার হয়ে প্রাণ দিতে হয়েছে অনেক মেধাবী সম্ভাবনাময় তরুণ ছাত্রকে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যমের ভূমিকায় অবতীর্ণ ছাত্রলীগ মানেই সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিকট আতংক। এই ক্ষেত্রে তাদের সন্ত্রাসী কর্মকান্ড শিক্ষক, ছাত্রী, সাংবাদিক, পুলিশ, পথচারী এমনকি নিজ গোত্রীয় কাউকেই ছাড় দেয়নি।
কুপিয়ে হত্যা থেকে শুরু করে রগ কাটা, গুলি, ইট দিয়ে থেতলানো কোন কিছুই বাদ যায়নি তাদের সন্ত্রাসী স্টাইলের আইটেমে। গত দুই মাসের বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত সচিত্র প্রতিবেদন তারই ভয়াবহতা প্রমাণ করে।
আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই সারা দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগ শুরু করে তাদের সন্ত্রাসের তান্ডবলীলা। প্রথম দিকে ক্যাম্পাসগুলো দখলে নেয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠা ছাত্রলীগ বিরোধী দলের ছাত্র সংগঠনের নেতা কর্মীদের উপর ঢালাও আক্রমণ শুরু করে। অল্প দিনের মধ্যে জড়িয়ে পরে নিজেদের মধ্যে গ্রুপিং সংঘর্ষে।
ভর্তি বাণিজ্য, টেন্ডারবাজির পর দৃষ্টি দেয় চাকরি বাণিজ্যে। এভাবে শুরু হয় পকেট ভারীর কাজ। ফলে আধিপত্য বিস্তারের ঘটনায় নিজ সংগঠনের মধ্যে শুরু হয় চরম অস্থিরতা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পুরোমাত্রায় নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে ছাত্রলীগ। তাদের নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয় খোদ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা।
এমনকি ছাত্রলীগের বেপরোয়া সন্ত্রাসী কর্মকান্ড থামাতে না পেরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক নেতৃত্বে থাকবেন না বলে গত ৪ এপ্রিল'০৯ আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর জরুরি বৈঠকে ঘোষণা দেন। কিন্তু তাতেও ন্যূনতম বোধোদয় হয়নি সোনার ছেলেদের(!)। তাদের অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষে পুলিশের ভূমিকা হয় নীরব দর্শক। আর অন্য সংঘঠনের সাথে ছাত্রলীগের সংঘর্ষের সময় পুলিশ হয় ছাত্রলীগের সাহায্যকারী। ক্ষমতায় আসার পর পরই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলো নিয়ন্ত্রণে নিতে ছাত্রলীগ প্রকাশ্য দিবালোকে ১৩মার্চ ০৯ কুপিয়ে খুন করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবির সেক্রেটারি শরীফুজ্জামান নোমানীকে।
এর পর রাজশাহী পলিটেকনিকে ছাত্রমৈত্রিকে কোণঠাসা করতে তাদের সহ সভাপতি সানিকে। নিহত সানির বাবা মা দু জনই মহানগর আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা। এর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র আবু বকরের মর্মান্তিক মৃত্যুর মাধ্যমে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসের কারণে বলির পাঠা হবার সংখ্যার সূত্রপাত হয়। এর পর একে একে তার তালিকা দীর্ঘ হতে থাকে। ৮ফেব্রুয়ারী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ ও শিবিরের মধ্যে সংঘর্ষের পর ছাত্রলীগ কর্মী ফারুক হোসেন নিহত হবার জের ধরে রাবি ক্যাম্পাসে শিক্ষা কার্যক্রম মুখ থুবড়ে পরে।
ছাত্রলীগের অব্যাহত সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের কারণে শিক্ষক শিক্ষার্থী অভিভাবকসহ সকলে অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে পড়ে। হাজার হাজার শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন ব্যাহত হচ্ছে। এই ঘটনার প্রতিশোধ নিতে শাহীন নামের এক ছাত্রশিবির নেতাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। একই ঘটনার বদলা নিতে সরকার সারাদেশে জামায়াত শিবিরের নেতা কর্মীদের উপর চড়াও হয়। যার ফলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে মহিউদ্দিন নামে আরো একজন শিবির কর্মীকে জীবন দিতে হয়।
এভাবে সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কার্যক্রমে খুন, হত্যা মারামারি স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়। গড়ে প্রতিদিন ৩টি উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের দলীয় কোন্দলে সাধারণ শিক্ষার্থী হামলার শিকার হতে থাকে। দেশজুড়ে বাড়তে থাকে শিক্ষাঙ্গনে ছাত্রলীগের সহিংসতা। এপ্রিল ও মে মাসে তা চূড়ান্ত পর্যায়ে উঠে। পত্রিকার পাতা খোলার প্রয়োজন হয় না।
পত্রিকা হাতে নিলেই শিরোনামে চোখে পড়ে ছাত্রলীগের দু'গ্রুপে সংঘর্ষে হতাহত ও ভাংচুরের ছবি। সবচেয়ে বেশী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। বিশেষ করে ঢাকা, জাহাঙ্গীর নগর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে এসব ঘটনা ছাত্রলীগের রুটিন ওয়ার্কে পরিণত হয়। গত ৭মে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ শামসুজ্জোহা হল পরিদর্শনে গিয়ে ছাত্রলীগ কর্মীদের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছেন হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক মর্তুজা খালেদ। এ সময় প্রভোস্টের কক্ষকসহ তিনটি অফিসকক্ষ ভাঙচুর করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।
গত ৩মে বরিশাল পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ছাত্রলীগের দু'গ্রুপের সংঘর্ষে পুরো ক্যাম্পাস রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। এসময় উভয় গ্রুপের দুই নেতার পায়ের রগ কেটে দেয়া হয়। এছাড়া সংঘর্ষে আরো ৮ জন গুরুতর আহত হয়। এসময় প্রতিপক্ষ গ্রুপের নেতা নজরুলের পায়ের রগ কেটে দেয় সভাপতি আব্দুর রাজ্জাক গ্রুপের ক্যাডাররা। উভয় গ্রুপের সংঘর্ষে ৯ জন আহত হবার খবর পাওয়া যায়।
একই দিন সবুজ নামের এক কর্মীকে জবাই করে দেবার মত গলায় কুপিয়ে জখম করা হয়। এই নৃশংসতা দেখে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে চরম ভীতি সঞ্চার হয়। প্রায় ৩ ঘণ্টা ধরে উভয় গ্রুপের সংঘর্ষ চলার পর পুলিশ আসে। ছাত্রলীগের নৃশংসতা থেকে রক্ষা পায়নি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কর্মকর্তাসহ সাধারণ পথচারীরাও। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপে সংঘর্ষ নিত্যনৈমিতিক ব্যাপারে পরিণত হয়।
গত মে মাসে সেখানে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের কয়েকদফা সংঘর্ষে এক শিক্ষিকা ও ছয় ছাত্রীসহ উভয় পক্ষের অন্তত ২০ জন আহত হয়ে। দফায় দফায় এ সংঘর্ষে ক্যাম্পাস রণক্ষেত্রে পরিণত হয় কয়েকবার।
আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে কয়েকবার ক্যাম্পাসে মারাত্মক জখমের ঘটনা ঘটে। ৫মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। তিন দফা সংঘর্ষে অন্তত ১৬ জন আহত হয়।
আহতরা হলেন, এনামুল (মার্কেটিং ৩য় বর্ষ), জিয়াউর রহমান (লোকপ্রশাসন ৩য় বর্ষ), রহমতউল্লাহ (ইসলামের ইতিহাস ১ম বর্ষ), ওয়ারেজ (ইসলামের ইতিহাস ১ম বর্ষ), মনির (ইসলামিক স্টাডিজ ২য় বর্ষ), শাহিন (রাষ্ট্রবিজ্ঞান ৪র্থ বর্ষ), এনামুল (মনোবিজ্ঞান ২য় বর্ষ), ফারুক, নিটোল, বিপ্লব, ইকবাল, নুর মোহাম্মদ, মিথুন, সবুজ ও মনির।
গত ১৩ এপ্রিল খুলনা প্রযুক্তি ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের হাতে লাঞ্ছিত হবার ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কল্যাণ পরিষদের পরিচালকসহ ৬ জন প্রভোস্ট এবং ১০ সহকারী প্রভোস্ট পদত্যাগ করেন। এই ঘটনায় দায়ী ছাত্রলীগ কুয়েট শাখার সভাপতি আহসান উল্লাহ ভুঁইয়া মেহেদী ও সাধারণ সম্পাদক মিনহাজ মাহমুদকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার এবং ঘটনা তদন্তে দুই সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়।
ছাত্রলীগের হামলা থেকে বাদ যায়নি থানা
গত ১৯ এপিল পিরোজপুরের নেছারাবাদ (স্বরূপকাঠি) থানায় ছাত্রলীগ কর্মীরা হামলা চালালে ১৫ পুলিশসহ অর্ধশতাধিক আহত হয়। হামলা প্রতিরোধে পুলিশ ২০ রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছোঁড়ে এবং ব্যাপক লাঠিচার্জ করে।
উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম রিপনের নির্দেশে এ হামলা হয়। রিপনসহ ৯ জনকে পুলিশ গ্রেফতার করে।
ছাত্রলীগের অবরোধে অচল থাকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
২০ এপ্রিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বাসে আগুন লাগিয়ে দেয় ছাত্রলীগ। ছাত্র আসাদ হত্যাকান্ডের ঘটনায় ছাত্রলীগের লাগাতার অবরোধ ডাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে। ডাকা অবরোধে বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন ক্লাস ও পরীক্ষা অনুষ্ঠিত না হওয়ায় অনেকদিন অচল হয়ে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়।
অবরোধের সমর্থনে ছাত্রলীগ কর্মীরা সকালে একটি শিক্ষক বহনকারী বাসে আগুন ধরিয়ে দেয়। কর্মসূচির ১৪ তম দিনে নগরীতে ৬টি তরী ভাংচুর করে ছাত্রলীগ কর্মীরা। পুলিশ এসময় ২ ছাত্রলীগ কর্মীকে আটক করে।
২২এপ্রিল রাজশাহী প্রযুক্তি ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে ৫ ছাত্র আহত হয়। ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের দুই গ্রপপের আধিপত্য বিত্মারকে কেন্দ্র করে রুয়েটের সেলিম হলে গভীর রাতে এই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
গুরুতর আহত চারজনকে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আহতরা হচ্ছে যন্ত্রকৌশল বিভাগের ৪র্থ বর্ষের ছাত্র হৃদয় (২৩), পুরকৌশল বিভাগের ছাত্র ৪র্থ বর্ষের শুভ বসাক (২২) ও ২য় বর্ষের ছাত্র নিক্কন (২২) ও কম্পিউটার বিভাগের ৩য় বর্ষের ছাত্র শামীম খান (২২)।
২৫এপ্রিল বঙ্গবন্ধু মেডিক্যালে বিশৃক্মখলা সৃষ্টির জন্য ৪ ছাত্রলীগ কর্মী গ্রেফতার করা হয়। অপরাধে জড়িত থাকার দায়ে পাঁচজনকে ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়। বহিস্কৃতরা হলেন -ব্যবস্থাপনা বিভাগ ১ম বর্ষের হুমায়ুন আহমেদ, বিশ্ব ধর্মতত্ত্ব বিভাগ ১ম বর্ষের আমিনুল ইসলাম, দর্শন ১ম বর্ষের শাহরিয়ার মামুন রঞ্জু ও রমজান আলী, সমাজবিজ্ঞান ১ম বর্ষের শিমুল।
২৪ এপ্রিল বগুড়া সরকারি আযিযুল হক কলেজে ডিগ্রী প্রথম বর্ষে নিজেদের মনোনীত ছাত্র ভর্তির ক্ষেত্রে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে কয়েক দফা সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে দুই গ্রুপের আটজন আহত হয়।
একই দিন বিকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্যসেন ও জিয়া হলের ছাত্রলীগ কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষে ১০ জন আহত হয়। আহতরা হলেন, জিয়া হলের নুরুল হুদা, নুরুল ইসলাম, আল আমিন এবং সূর্যসেন হলের রাশেদুল, সুমন, মোবারক, হাফিজ, নজরুল, নকিব ও সুমন।
গত ৫মে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রনেতার মোটর সাইকেলের কাগজপত্র দেখতে চাওয়ায় পুলিশের এএসআই সাইফুর রহমানকে পিটিয়ে আহত করে ছাত্রলীগ।
প্রধানমন্ত্রীর পিঠটান
ছাত্রলীগের লাগামহীন সন্ত্রাসী কর্মকান্ড সামাল দিতে না পেরে খোদ প্রধানমন্ত্রী ছাত্রলীগের সাংগঠনিক পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর পর আওয়ামী লীগের সেকেন্ড ম্যান সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম গত ১০ এপ্রিল সিলেটের এক অনুষ্ঠানে বলেন ছাত্রলীগের টেন্ডারবাজি গুন্ডামি বরদাস্ত করা হবে না।
৫ মে দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় এক উপ সম্পাদকীয়তে বলা হয় সরকারের ভাবমুর্তি ক্ষুণ্ণ করতে ও এই সরকারকে ক্ষমতা থেকে নামাতে ছাত্রলীগ একাই যথেষ্ট। ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের ধারাবাহিক বেপরোয়া অপরাধমূলক কর্মকান্ডে মহাজোট সরকারের সাফল্য ম্লান হতে চলেছে। সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে বারবার হুশিয়ারি ও হুমকি-ধামকি দেয়ার পরও থামছে না সরকারি দলের একসময়কার এ সহযোগী ও অঙ্গ সংগঠনের কিছু নেতাকর্মীর বেপরোয়া উন্মত্ততা। বরং টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, অস্ত্রবাজি, ছাত্রী উত্ত্যক্ত, প্রশাসন জিম্মি করে অন্যায় সুবিধা আদায় চলছে বিরামহীনভাবে।
তাদের আধিপত্য বিস্তারের লড়াই, সহিংস আন্দোলন, অবরোধসহ নানাবিধ আইন-শৃংখলাবিরোধী কর্মকান্ড নিত্যদিনের ঘটনায় রূপ নিয়েছে।
ছাত্রলীগের এসব বেপরোয়া কর্মকান্ডে পুলিশ ও আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সরকারি প্রশাসন রীতিমতো অসহায়। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে সরকারের বিরুদ্ধে এখন ছাত্রলীগই যথেষ্ট। মূলত আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকেই ছাত্রলীগের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা বেপরোয়া হয়ে পড়েন। এপ্রিল মাসে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদে দেখা যায়, ঢাকা, চট্টগ্রাম, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারাদেশে টেন্ডারবাজি, ছাত্রী নির্যাতন ও ইভটিজিংসহ অন্তত শতাধিক ঘটনা ঘটিয়েছে ছাত্রলীগ।
সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রকৃত ঘটনার সংখ্যা আরও বেশি। ছাত্রলীগের ন্যক্কারজনক উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে বৈশাখবরণকে সামনে রেখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্ধশত ছাত্রীর বস্ত্রহরণ ও নির্যাতনের ঘটনা। ২৬ এপ্রিল ঢাকার তেজগাঁও পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের চারতলায় আটকে রেখে এক ছাত্রীকে দু'নেতা নিপীড়ন করার ঘটনা। যে কারণে ওই ছাত্রী বিবস্ত্র অবস্থায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকেন। জ্ঞান ফেরার পর ওই ছাত্রী কর্তৃপক্ষের কাছে নালিশ করেন।
ওই ঘটনায় ২৭ এপ্রিল অমিত ও মোবারক নামের দু'জনকে ছাত্রলীগ থেকে আজীবন বহিষ্কার করা হয়। ২৮ মার্চ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি দখল করে নেন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি কামরুল হাসান রিপন। পরে তিনি নিজের পছন্দের ব্যক্তিদের সমন্বয়ে কমিটি গঠন করে দেন। শুধু তাই নয়, এই রিপন বিগত দু'বছর ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় শীর্ষ নেতাদের আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে এখনও বহাল তবিয়তে রয়েছেন। তারই নেতৃত্বে ৩ মে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ফি কমানোর আন্দোলন স্তব্ধ করতে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের ওপর হামলা করা হয়।
২৩ এপ্রিল ধামরাইয়ে থানা চত্বর থেকে টাকাসহ যুবক অপহরণ, আসামি ছিনতাই, একই দিন মানিকগঞ্জে ব্যবসায়ীকে জিম্মি করে টাকা আদায়, কনসার্টের টিকিট না পেয়ে চট্টগ্রামে বেসরকারি মোবাইল অপারেটর আয়োজিত কনসার্ট পন্ড করে দেয়ার ঘটনা ঘটিয়েছে ছাত্রলীগ। রুয়েটে ও ঢাকা মেডিকেলে দু'গ্রুপে সংঘর্ষ এবং তেল-গ্যাস রক্ষা কমিটির পদযাত্রায় হামলা করে ছাত্রলীগ ২২ এপ্রিল। তার আগের দিন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে লাগাতার অবরোধের নামে ট্রেন চালককে অপহরণ, জামালপুরে গ্রেফতারের এক ঘণ্টার মধ্যে হত্যা মামলার সন্দেহজনক আসামিকে ছাড়িয়ে নেয়া, পটুয়াখালী শহরে স্বামী পরিত্যক্তা মহিলাকে ৬/৭ জনে মিলে গণধর্ষণকালে একজনের হাতেনাতে আটক হওয়ার ঘটনা ঘটে। একই দিন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে দু'গ্রুপের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধসহ ২০ জন আহত হয়। ভিসির পদত্যাগের দাবিতে চার মাস পর খুললেও চট্টগ্রামের ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয় চালাতে দিচ্ছে না ছাত্রলীগের ক্যাডাররা।
মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি টেন্ডার ছাত্রলীগ না পাওয়ার কারণে গত ডিসেম্বরে আন্দোলনে নামে। তখন উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দিতে হয়। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ডায়নিং রুম দখল করে জুয়া ও গাঁজার আসর বসায় এ দলের কিছু ক্যাডার। এভাবে টঙ্গীতে কলেজ অধ্যক্ষকে মারধর, ফরম পূরণে সুবিধা না পেয়ে রংপুর কারমাইকেলে ভাংচুর ও অধ্যক্ষকে ঘেরাও, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জসীমউদ্দীন হলের সভাপতি জীবনের কনসার্ট বাণিজ্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শেখ রাসেলের নামে ক্রিকেট প্রতিযোগিতা আহবান করে স্পন্সর বাণিজ্য, গাজীপুর, দিনাজপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে টেন্ডারবাজি ও চাপাতি হামলাসহ নানা ঘটনা গত মাসেই ঘটেছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই সাংবাদিক সালমান ও রেজাকে ছাত্রলীগের ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি রিপন গ্রুপের ক্যাডাররা কারওয়ান বাজারে হামলা করে।
আর কেন্দ্রীয় সভাপতি রিপনের ক্যাডাররা সংবাদ প্রকাশের দায়ে শাহবাগে আরও দুই সাংবাদিককে পিটিয়েছে ৪ এপ্রিল। ৩ এপ্রিল ছাত্রী লাঞ্ছনাকারী কাওসারকে ধরে ১০ মিনিটের মধ্যেই মুক্তি দিতে হয়েছে পুলিশকে। ঢাবির ঘটনায় ১৬ জন এবং বরিশালের ঘটনায় ১৫ জন আহত হয়। এর আগের ছাত্রলীগ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং পাবনায় সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। গত ২১জুন রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজে অধ্যক্ষের কক্ষে ভাংচুর ও হামলা চালায় ছাত্রলীগ।
এই ঘটনায় ছাত্রলীগ রামেক শাখার ৫ জন নেতাকে ২১জুন আটক করে পুলিশ। দিন যতই যাচ্ছে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের তালিকা ততোই দীর্ঘ হচ্ছে। অবশেষে সরকারকে সাধু সাবধানের কায়দায় ছাত্রলীগ সাবধান ইঙ্গিত করে বর্তমান সরকারের থিংক ট্যাংক বলে পরিচিত ৫ বরেণ্য শিক্ষাবিদ জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলাম ও অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ২১ এপ্রিল যৌথ বিবৃতিতে ছাত্রলীগের সঙ্গে সম্পর্কোচ্ছেদের পরামর্শ পর্যন্ত দিয়েছেন। তারা ছাত্র ও তরুণ সমাজকে অপরাজনীতি থেকে দূরে রাখা এবং শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার পরিবেশের জন্য ছাত্রলীগের সঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ যোগাযোগ ছিন্ন করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আহবান জানান। ছাত্রলীগের সন্ত্রাসের কারণে বন্ধ হয়ে গেছে দেশের অনেক উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
অনেক শিক্ষার্থী ভয়ে লেখা পড়া ছেড়ে দিয়েছে। পুলিশী গ্রেফতারের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন অনেক বিরোধী দলের নেতা কর্মী। সন্ত্রাস মারামারির কারণে অনেক সাধারণ শিক্ষার্থী নিয়মিত ক্লাসে আসছে না। ফলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনেক কম দেখা যাচ্ছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।