আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

লোভের ভবন, লাশের লাথি

বুলবুল ভাই প্রথম বললেন ১২ জন। সকালের মিটিং তখন শুরু মাত্র। আমেরিকান সেন্টারে বাংলাদেশ মানবাধিকার রিপোর্ট নিয়ে আলোচনা। আলোচনা এগোয়, আর এই সংখ্যা বাড়তে থাকে। মার্কিন রাষ্ট্রদূত বললেন, এটা অনেক বাড়বে।

অনেক মানে কত? কত লোক মারা গেছেন আসলে সাভারে ধসে পড়া ভবনে? কেউ এখনো জানে না তা।
আঠারো দলের হরতাল সেদিন। হরতাল বলেই হয়তো তখনো ঘুম ভাঙেনি নেতাদের। প্রখর রোদে সেন্টারের বাইরে এসে রিকশা ডাকি। সিদ্ধান্ত নিই, আজ কিছুতেই টেলিভিশন দেখব না আমি।

এর আগে তাজরীনে দুর্ঘটনার সংবাদ দেখে পোড়া মাংসের গন্ধ লেগে ছিল নাকে। এই গন্ধ কি শত শত শ্রমিকের, নাকি রাষ্ট্রের পোড়া মাংসের! সেদিন সারা দিন এমন কত কিছু ভাবি আমি। রাতে খ্যাপাটে হয়ে যা ইচ্ছা বলে বসি টক শোতে! ভাবি, তাজরীনের মালিকের বিচার তো হবে এবার অন্তত! কী বিচার—কারাদণ্ড, নাকি স্রেফ জরিমানা? ভালো হতো পোড়া মাংসের বদলে পোড়া মাংসের শাস্তি হলে! সভ্য জগতে এগুলো বলা যায় না, লেখা যায় না! কিন্তু কিছু একটা শাস্তি তো চাওয়া যায়। কোনো একটা শাস্তি তো দেওয়া যায়!
তাজরীনের মালিক শাস্তি পাননি। তাঁকে গ্রেপ্তারও হতে হয়নি।

সরকার, বিজিএমইএ আর মালিকপক্ষ জোর গলায় ষড়যন্ত্র, মধ্যপর্যায়ের ম্যানেজমেন্টের ব্যর্থতা, শ্রমিকদের হুড়োহুড়ি করে বের হওয়ার বোকামি আরও কী কী যেন বলল! দোষ পড়ল কঙ্কাল হওয়া শ্রমিকের, চাকরি বাঁচাতে মালিকের চাবি দিয়ে কলাপসিবল গেট বন্ধ করা কর্মচারীর, মালিকের চোখ রাঙানোর ভয়ে নিরাপত্তার মিথ্যা আশ্বাস দেওয়া সুপারভাইজারদের। সবাই-ই দোষী কোনো না কোনোভাবে, কেবল শত মানুষকে পুড়িয়ে মারা কারখানার মালিক বাদে।
স্পেকট্রামেও তা-ই হয়েছিল। স্পেকট্রামের মালিক ছিলেন তখনকার ক্ষমতাসীন বিএনপির নেতার জামাতা। কিন্তু তাজরীনের মালিক কি কারও জামাতা ছিলেন? ছিলেন।

তাজরীনের মালিকেরা হলেন এই রাষ্ট্রের জামাতা! এই জামাতারা মন্ত্রী-সাংসদ পালেন, শ্রমিকের রক্তচোষা মুনাফার ভাগ দেন প্রশাসন, পুলিশ আর বিচারালয়ে, ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের জন্য চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা রাখেন নানাভাবে। এঁরাই তো রাষ্ট্র, এঁদের বিচার করবে কে! এই রাষ্ট্রে বিরোধী দল, সরকারের সমালোচক আর ছিঁচকে অপরাধী ছাড়া কারও বিচার নেই। স্পেকট্রাম আর তাজরীনের মালিকেরা আশ্চর্যজনকভাবে এর একটিও হন না কখনো। তাঁদের বিচার হয় না কোনো দিনও!

দুই.
কাজেই আমি ঠিক সিদ্ধান্তই নিই। সাভারের রানা প্লাজায় লাশের ছবি দেখে আর হতবিহ্বল হব না আমি! কিন্তু চাইলেই তো তা হয় না।

এই শহরে লাখ লাখ গরিব মানুষ। সন্ধ্যায় বাসার গেটে তাদের ভিড়ে এসে শুনি, তখন পর্যন্ত মারা গেছেন ৪০ জন। দারোয়ান আর রিকশাচালকেরা এসব বলাবলি করেন, কিছু একটা শোনার আশায় একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন! আমি দুর্বল গলায় জিগ্যেস করি, কতজন ছিলেন সেখানে? ভিড়ের মধ্য থেকে একজন জানান, আটতলা বিল্ডিং ছিল সাভারে, লোক ছিল কয়েক হাজার! কয়েক হাজার মানুষের ওপর ভবন ধসে পড়েছে! এঁদের একজনও বাঁচবেন কীভাবে তাহলে!
চেনা দারোয়ান প্রশ্ন করেন, এগুলোর বিচার নাই, স্যার! আমি উত্তর দিই না। যেন এই অপরাধ আমারই। এই ভার বুকে নিয়ে ফিরে আসি আমাদের নিশ্চিত অট্টালিকায়! কিন্তু পরদিন ভোরে প্রথম আলো দেখে আমার ভেতর বোবা কান্নায় ঠেলে ওঠে এই প্রশ্ন।

এগুলোর বিচার নেই! বিচার নেই? কিছু একটা অমোঘ নিয়তির মতো টেলিভিশনের সামনে নিয়ে আসে আমাকে।
লোভ আর পাপের ভবন ধসে পড়েছে—ধ্বংস, ধুলা আর অন্ধকার ভেদ করে জুম করা ক্যামেরায় কান্নার শব্দ! কংক্রিট, রড, মেশিন কিংবা বয়লারের পাইপের ভারে থেঁতলে থাকা মানুষের কান্না! যাঁদের কান্না থেমে গেছে, মরে গিয়ে এই নিষ্ঠুর রাষ্ট্রের পাষাণ ভার থেকে বেঁচে গেছেন তাঁরা! কিন্তু যাঁরা বেচে আছেন? হাত, পা, চোখ আর অনেকটা হূদয় হারিয়ে, স্বজন বা সহকর্মীর সারি সারি লাশের ভার বহন করে, বিকট পতন, আর্তনাদ আর ভয়াল স্মৃতির আতঙ্ক নিয়ে, কেমন করে বেঁচে থাকবেন তাঁরা?

তিন.
এই রাষ্ট্র অবশ্য শোক পালন করেছে তাঁদের জন্য! এই রাষ্ট্র দুর্বৃত্তকে ডোবার ভেতর মৃত্যুপুরী বানানোর অনুমতি দেয়, লাঠি তাড়া দিয়ে সেখানে কাজ করতে বাধ্য করা দুর্বৃত্তকে নেতা বানায়, এই রাষ্ট্রের কর্মকর্তা ফাটল ধরা বিল্ডিংকে নিরাপদ ঘোষণা করে গণহত্যার আয়োজন করেন, এই রাষ্ট্র শ্রমিকের লাশের পাহাড়ে গড়া অট্টালিকায় থাকা দুর্বৃত্তদের রক্ষা করে। লাশের গন্ধ ঠেলে সরিয়ে দিতে এই রাষ্ট্রই আবার শোক দিবস পালন করছে তাঁদের জন্য!
লাশের সংখ্যা কয়েক শ, আহত আরও বেশি। দল আর মঞ্চরা রক্ত সংগ্রহ করছে। প্রধানমন্ত্রী আর মন্ত্রী উদ্ধারকাজের নির্দেশ দিচ্ছেন।

বিরোধী দলের নেতা অকুস্থলে ছুটে গেছেন। কোনো একটা প্রশাসন ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে। লাশের আত্মীয়কে ১০ হাজার; লাশ হতে যাঁরা পারেননি, তাঁদের পাঁচ হাজার। বেশ কিছু তদন্ত কমিটি হচ্ছে। হাইকোর্ট দায়ী ব্যক্তিদের হাজির করার নির্দেশ দিয়েছেন।

সেটি দেখেই কিনা জানি না, স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ভবনের মালিককে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিচ্ছেন। বিজিএমইএ দোষী গার্মেন্টের সদস্যপদ সাময়িকভাবে স্থগিত করেছে! গার্মেন্টসের নারীদের শোকে কোনো একটা নারী সমাবেশও হবে হয়তো কখনো। এই সভ্য-ভব্য কর্মকাণ্ডের কোলাজ তবু কেন অর্থহীন ঠেকে? কেন বারবার সব ছাপিয়ে ওঠে সামান্য এক লাশের ছবি!
সাভারের ধ্বংসস্তূপ তার পুরো শরীর থেঁতলে দিয়েছে। রক্তের চিকন রেখা, আরও উজ্জ্বল লাল সালোয়ার কিংবা কামিজের প্রায় পুরোটা ঢেকে দিয়েছে কংক্রিট। শুধু তাঁর নূপুর পরা পা আর রক্তের ছোপরঞ্জিত পায়ের পাতা ধেয়ে আসে ক্যামেরার দিকে! আমারই বোন বা আমারই সন্তানের বয়সী কোনো এক কিশোরীর শরীর, স্বপ্ন আর স্পন্দন থেঁতলে দিয়েছি আমরা লোভের ভবনের ভারে।

তার নিশ্চল পা তাই ধ্বংস ঠেলে বের হওয়া এক মোক্ষম লাথিই যেন! এই লাথি আমাদের সবার জন্য।

চার.
‘জ্ঞানী’ কথা বলার সময় আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী খ্যাপাটেভাবে তাঁর মুখ আর গলার চামড়া টানতে থাকেন। রানা প্লাজা হত্যাকাণ্ডের পর তাঁর টানাটানির অভ্যাস বেড়েছে। তিনি আমাদের জানান, সেদিনের হরতাল-সমর্থক কিছু ব্যক্তি রানা প্লাজার পিলার ধরে নাড়াচাড়া করার কারণে তা ধসে পড়েছে! তিনি হয়তো এখনো জানেন না, সেদিন ভবনমালিক যুবলীগের নেতা লোক জড়ো করেছিলেন হরতালবিরোধী মিছিল করার জন্য। তিনি হয়তো জানেন না, আগের দিনই ফাটল ধরা এই ভবন ঝুঁকিপূর্ণ বলে ঘোষণা করেছিল শিল্পাঞ্চল পুলিশ।

তিনি হয়তো জানেন না, শুধু নাড়াচাড়া করলে বিশাল বিল্ডিং ধসে পড়ে না। যদি তা-ই হতো, এ দেশের অনেক মন্ত্রী, ব্যবসায়ী আর বড়লোকের ভবন নিয়ে নাড়াচাড়া করতে ছুটে আসত তাজরীন, স্পেকট্রাম, হল-মার্ক, শেয়ার মার্কেট কিংবা ফুলপুর-রামপালের বহু মানুষ!
এমন নাড়াচাড়া হবে না এ দেশে। বরং রানা প্লাজার ঘটনাই ঘটবে আরও। ধরা পড়লেও বিচারের দুর্বল হাত ছিঁড়ে বের হয়ে আসবে রানার মতো পশুরা। জনসভা বা মিছিলের লোক সাপ্লাই দিয়ে, ক্ষমতাধরদের চাঁদা কিংবা ঘুষ দিয়ে, ক্ষমতাহীনদের খুন করে কিংবা খুনের ভয় দেখিয়ে তারাই করবে রাজত্ব।

রানা প্লাজার ঘটনা তাই অবশ্যই আরও ঘটবে। অবশ্যই আবারও রানাদের লোভের ভবনে পুড়ে অঙ্গার হয়ে বা থেঁতলে পড়ে মারা যাবে ভুখা-নাঙ্গা গরিব মানুষ।
যত দিন তা হবে, লাশের লাথিই প্রাপ্য আমাদের।
 আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ।

সোর্স: http://www.prothom-alo.com     দেখা হয়েছে ১০ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.