গল্পকথক..
স্বর্গ থেকেই তাদের পরিচয়। মর্ত্যে নেমে পরিণয়। লোভ এবং স্মৃতি্বিলোপ।
আর কয়েকটা ডলার বেশি রোজগারের নিমিত্তে আপনি সবকিছু ভুলে যেতে পারেন ! গতকালের বন্ধু ভোল পাল্টে আজ আপনার শত্রু ! একসময় যারা আপনার ওপর চোখ রাঙ্গিয়ে এক ধরনের আত্নপ্রসাদ লাভ করতো, এখন তারাই আপনার চোখের ভাষা বোঝার প্রাণান্ত চেষ্টা করছে !
শুধু ক্রিকেটকে অনুসরন করলেই আচরনের এসব ভেলকিবাজি বুঝে ফেলা সম্ভব। তিনকাঠির খেলাটির ২২ গজে গত কয়েকবছর ধরে কত ব্যাটসম্যানই তো এলেন-গেলেন, কিন্তু লোভ এবং স্মৃতিবিলোপ নটআউটই থেকে গেল!
সাম্প্রতিক সময়ে খেলাটির 'তিন জমিদার'-এর উত্থাপিত সিদ্ধান্তগুলো ঝিঁ ঝিঁ পোকার প্রাণসংহারের সমতুল্য।
মোদ্দা কথা হলো-'হারাধনের দশটি ছেলে। সাতটি তার বউ হাতে করে এনেছে। আর তাই বাকি তিন ছেলেই এখন হারাধনের বংশ রক্ষার গুরু দায়িত্ব হাতে নেবে। '
ভারত-অষ্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ড চাইলে বছরে কয়েক দফা সফরসূচী নির্ধারিত করবে নিজেদের মধ্যে। কিন্তু বাংলাদেশ, জিম্বাবুয়ে এমনকি ওয়েষ্টইন্ডিজের মতো সৎ ভাইদের প্রতি তারা ফিরেও চাইবে না।
প্রস্তাবিত নথি অনুযায়ী পারফম্যান্সের নিক্তিতে সৎ ভাইদের প্রমোশন-রেলিগেশন নির্ধারিত হবে। ইংল্যান্ড-ভারত-অষ্ট্রেলিয়া চিরস্থায়ী ভাবে থেকে যাবে ছড়ি ঘোরানোর দায়িত্বে। কারণ আইসিসির সিংহভাগ আয়ের উৎস এ তিনটি দেশের ফুঁলে-ফেঁপে ওঠা ক্রিকেট বাজার। বাংলার শেষ নবাব বেঁচে থাকলে হয়তো ডুকরে কেঁদে বলতেন-'আবদার না মিটিয়ে উপায় নাই..গোলাম হোসেন.....উপায় নাই....।
ভেলকিটা কিন্তু ম্যাচ পাতানোর চেয়েও বেশিকিছু ! দুটি সারণীতে ছয়টি করে দল পারফর্ম করবে।
তারমধ্যে প্রতি বছরই দুটি করে দলের উত্থান-পতন ঘটবে। অর্থাৎ,শীর্ষস্থানকে কায়দা করে জন্মগত অধিকার হিসেবে দাখিল করা ওই তিন জমিদারের জন্য বাকি দুটি দল দ্বিতীয় এবং তৃতীয় স্থান দখল করেও এড়াতে পারবে না অবনমনের ফাঁদ ।
বাইবেলের ওল্ড টেষ্টামেন্টের প্রথম কান্ডে বর্ণিত পৃথীবি সৃজনের অর্ন্তনিহিত উপাদানগুলোর মধ্যে 'অজ্ঞতা' এবং 'ঔদ্ধত্য'র কথাও বলা হয়েছে। তাই সভ্যতার নিয়মেই তিনকাঠির এই তিন জমিদারের মস্তিস্কপ্রসূত চিন্তা-চেতনায় যে শব্দদুটোর অত্যধিক প্রভাব থাকবে,তা খুবই স্বাভাবিক। ওদের 'ঔদ্ধত্য'র নহরধারার শেকড় প্রোথিত কাড়ি কাড়ি অর্থে।
ষ্টার স্পোর্টস, চ্যানেল নাইন, স্কাই স্পোর্টসের মতো ডাকাবুকো গণমাধ্যমগুলোর সঙ্গে স্বাক্ষর করা লোভনীয় অংকের চুক্তিপত্রই তিন জমিদারের 'ঔদ্ধত্য'র জঠর। বিপরীতে অজ্ঞতার জন্ম হয়েছে খেলাটির প্রতি দিনকে দিন ভালবাসার খরা থেকে। প্রতিটি খেলাতেই একটা বৃত্ত থাকে। তা মেনেই দলগুলো একটা নির্দিষ্ট সময় ধরে সফলতা লাভ করে থাকে। ইতিহাসের পাতায় ঝুলে থাকা এ প্রমানটাই তিন জমিদারকে গদি স্থায়ীকরণের জন্য প্ররোচিত করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় ফুটবল লিগে 'গ্রিন বে প্যাকার্স' নামে একটি ক্লাব প্রতিদ্বন্দিতা্ করে থাকে। ১৯৬৮ সালের আগে তারা আসরটির শিরোপা জিতেছে মোট ১৩বার। কিন্তু তারপর আরেকটি 'সুপারবোউল' জয়ের জন্য তাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে দীর্ঘ তিনযুগ !
'ইয়াংকি'দের ক-অক্ষর-গোমাংস ফুটবল ভুলে বিশ্বের সবচেয়ে সফল ক্লাবটির খেরোখাতায় তাকালেও সেই একই বৃত্তপূরনই চোখে পড়ে। চ্যাম্পিয়ন্স লিগে তারা সর্বোচ্চ নয়বারের চ্যাম্পিয়ন। এরমধ্যে ১৯৫৬-৬০ সাল পর্যন্ত টানা শিরোপা জিতেছে 'লস ব্লাঙ্কোস'দের চাঁদের হাট ! তারপরও ইউরোপিয়ান ক্লাব ফুটবলের মুকুট নির্ধারনী আসরটিতে রিয়ালকে একটা দীর্ঘ সময়ব্যাপি শিরোপা খরায় ভুগতে হয়েছে।
সেটা ১৯৬৬ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত। কিন্তু পরবর্তি পাঁচ বছরের মধ্যে রিয়াল শিরোপা জিতেছে তিনবার। এখন প্রায় এক যুগ ধরে কাড়ি কাড়ি অর্থ খরচ করেও 'লা ডেসিমা'র (১০ম) সন্ধান করতে পারছে না ফ্লোরেন্তিনো পেরেজের 'লস গ্যালাকটিকোস' (নক্ষত্রপুঞ্জ)।
চর্মগোলক থেকে এবার নজর ফেরান চামড়া আয়তাকার ২২ গজ কেন্দ্রিক গোলাকার বিশ্বে । শুরু অবধি এখানেও চলছে বৃত্তপূরনের লীলাখেলা।
আশির দশকে নিউজিল্যান্ডকে তাদের ঘরের মাঠে কেউ হারাতে পারেনি। ওয়েষ্ট ইন্ডিজ তখন প্রতিপক্ষকে পরাজিত করতো হেসে-খেলে। আর, পাকিস্তান ছিল দ্বিতীয় সেরা টেষ্ট দল !
মতান্তর থাকলেও ক্রিকেটের জন্মদাতা হিসেবে নিজেদের দাবী করা ইংলিশরা কিন্তু ওই দশকে স্রেফ খাবি খেয়েছে। তাদের জয়-পরাজয়ের পরিসংখ্যান ২০-৩৯। পরের দশকে ২৬-৩৯।
ভারতের ক্ষেত্রে আশির দশকের পরিসংখ্যানটা রীতিমতো ভয়াবহ-৮১ টেষ্ট খেলে ১১ জয়,২১ টেষ্টে হার। অষ্ট্রেলিয়ানরা ছিল বেশ কৌশলী। ভারতকে নিজেদের ঘরে নেমতন্ন জানিয়ে তারা লেলিয়ে দিন ১৩ জন (আম্পায়ার সহ) অষ্ট্রেলিয়ানকে ! ফলাফল - বেশিরভাগ টেষ্টেরই নিষ্পত্তি হয়েছে আড়াই দিনে ! কিন্তু মহাকালের নিয়ম এবং স্বার্থের পাকচক্রে ভুলে এখন সেই ভারতই রাধা হয়ে ঝুলে পড়েছে 'ক্যাঙ্গারু-কৃঞ্চ'দের গলায়। অনুঘটক হিসেবে বড়ায়ির দায়িত্ব সেরেছে চিরকালের বিশ্বাসঘাতক ইংল্যান্ড।
অথচ ২০১০-১১ মৌসুমেও ভারতীয় ক্রিকেট সাদা পোশাকে নাকানি-চুবানি খেয়েছে।
কিন্তু কাদায় থেকেও অপরকে লাথি মারতে তিল পরিমান দ্বিধা-বোধ করেনি শ্রীনিবাসন এন্ড কোং। এ কূপমুন্ডকতার মর্ম কি তারা কখনো বুঝতে পারবে ? একজন ভারতীয় নাগরিক যখন বাংলাদেশে এসে শোনে- কি..দাদা, সময়টা ভাল যাচ্ছে তাই না ? মীর জাফরদের জন্ম কোথায়...জানেন তো ?
এই দায় কে নেবে ? শ্রীনিবাসনের অমাত্যরাজি নাকি ওই বেচারা ভারতীয় ?
১৯৭৬-৭৭ মৌসুমের আগ পর্যন্ত ভারতে কখনো পুর্ণ শক্তির দল পাঠায়নি ইংলিশরা। অষ্ট্রেলিয়াও কৃপা করে ১৯৬৯-৭০ মৌসুম এবং ১৯৯৬ সালে দল পাঠায় ভারতে। যারমধ্যে ১৯৯৬ সালের সফরে টেষ্ট ম্যাচ ছিল মাত্র একটি ! কিন্তু পকেটে টাকা জমলে চারপাশের সবকিছুই পাল্টে যায়। ভারতীয় অর্থনীতি গা ঝেড়ে উঠে দাঁড়ানোর সঙ্গে নাঁক উঁচু অসিরাও ভোল পাল্টে হয়ে পড়ে বন্ধু।
অথচ অসিদের জায়গায় এখন ওয়েষ্ট ইন্ডিজের থাকার কথা ছিল। একটা সময় ছিল যখন, প্রতিটি টেষ্ট খেলুড়ে দেশের কাছেই ওয়েষ্ট ইন্ডিজ সফর ছিল এক প্রকার শাস্তি ! কথিত আছে, ক্যারিবিয়ান 'পেস কোয়ার্ট্রেটে'র মুখোমুখি হওয়ার ভয়ে তখন ভারতের অনেক ডাকাবুকো তারকাই সেচ্ছায় নাম প্রত্যাহার করে নিতেন। ক্যারিবিয়ানদের ধারাটা ছিল ব্যতিক্রমি। 'থ্রি ডব্লিউ' (উইকস,ওয়ালকট,ওরেল) তো বটেই কানহাই, সোবার্স, ভিভদের মতো তারকাদের ভারত সফরে পাঠাত ক্যারিবিয়ানরা। ওদের দেখেই তো ক্রিকেটের রস আস্বাদন করতে শিখল ভারতের দুটি প্রজন্ম।
কিন্তু বিনিময়ে কি পেল ওয়েষ্ট ইন্ডিজ ? অর্ধচন্দ্র বলবেন নাকি শুভংকরের ফাঁকি ?
বাইবেলে বর্ণিত একটি নীতিবাক্যের উল্টো পথে হেঁটে তাই বলতে হচ্ছে-মুখে কুঁলুপ এটে কদাচিৎ কোনকিছু অর্জন করা যায়। কিন্তু ক্রিকেটের বাইরে খেলাধূলার বাকি বিশ্বে 'লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড' শব্দটার অন্তত পোশাকি ব্যবহার হয়ে থাকে। বিশ্বচ্যাম্পিয়ন স্পেনের কথাই ধরুন, এই দশকে মোট ৪৯টি আর্ন্তজাতিক ম্যাচ খেলেছে 'লা রোজা'রা। তারমধ্যে বিশ্বকাপ এবং ইউরোর মতো টুর্নামেন্ট মিলিয়ে তারা খেলেছে মোট ১৮টি ম্যাচ । সে তুলনায় অ্যান্ডোরা কিন্তু বিশ্বকাপ তো দুরের কথা ইউরোতেও খেলার যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনা।
তারপরও ওই একই সময়ে ২৫টি আর্ন্তজাতিক ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়েছে অ্যান্ডোরা। অথচ এ সময়ের মধ্যে স্পেন কখনোই ইংল্যান্ড, ইতালি, ব্রাজিল কিংবা জার্মানির মতো দলের বিপক্ষে প্রীতি ম্যাচে মাঠে নামার বিলাসিতা দেখায়নি।
কোন খেলাধূলাই 'পারফেক্ট' নয়। কিন্তু ক্রিকেটের মতো এতটা ভুল পথে হাঁটছে না আর কোন খেলাই। আয়ারল্যান্ড এবং আফগানিস্তান ধীরে ধীরে উঠে আসছে।
তাই এখনই সময় দরজা বন্ধ না করে উন্মুক্ত করে দেয়ার। কারণ গুপ্তসংঘ কোন ভবিষ্যত নয়। ওটা শুধু লোভ এবং জোচ্চুরি চরিতার্থ করার নীল-নকশামাত্র। তাই এখন থেকেই সচেতন না হলে..ক্রিকেট আর পম্পেই নগরীর মধ্যে কোন পার্থক্য থাকবে না !
(লিখেই ছেড়ে দিলাম। হয়তো একটু অগোছাল হয়েছে।
লেখাটা কাউকে কষ্ট দিয়ে থাকলে নিজগুনে ক্ষমা করে দেবেন। )
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।