আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

তালাক

শুদ্ধতার আগুনে যেন সতত পুড়ি

সম্পর্কের চেয়ে জীবনে টাকা-পয়সাটাই জরুরি। মান-মর্যাদা আসলে ফাঁপা আর অসার বিষয়। এটা তেমন কোনো কাজে আসে না। খাদ্য-বস্ত্র-আশ্রয়ের ব্যবস্থা যা করতে পারে না, তার অস্তিত্ব নিয়ে মাথা ঘামানোর কিছুই নেই। অথচ এত কিছু থাকতে কোনো কোনো মানুষ এই অর্থহীন বিষয়টাকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে।

আর তা করতে গিয়েই দীর্ঘ সতের বছর পর আমিনা এই একটি বিষয়ই খুব ভালভাবে অনুভব করতে পারছে। আর তা হলো টাকা। হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে ওঠা মানুষের মতোই ভাবনাটি তার মনের কোনো এক গহিনে জন্ম নিয়ে পঙ্গপালের মতোই দ্রুত ছড়িয়ে যেতে থাকে মস্তিষ্কের কোষে কোষে। অথচ প্রায় কয়লার মতো দেখতে ফোরকানের সঙ্গে মতের বিরুদ্ধে বিয়ে হওয়ার আগ মুহূর্তে বাবা শামসুল হক শিকদার বলে উঠেছিলেন, মা, আল্লা আল্লা কর। এহানে তর বিয়া হইলে থাকবি রাজরানীর মতন।

বাবার বড় মুখ করে বলা কথাগুলোর কোনো রকম প্রতিফলন দেখতে পায়নি নিজের জীবনে। মা রোশনারার ভাষ্য মতে অনেক কৌশলে ছুটিয়ে আনা পাত্র সম্পর্কিত নানা কল্পিত ঠাট-বাট আর প্রচলিত গাল-গল্পের সবই যেন অন্ধকারের দিকে ধাবিত হচ্ছিল দিনদিন। আর ক্রমশ ম্রিয়মাণ অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে ছাড়া যেন আর কিছুই করবার ছিল না আমিনার। এবং শেষ পর্যন্ত সব স্বপ্নে-আশা-ভরসার কংকালের ওপর দাঁড়িয়ে মেরুদণ্ড সোজা করতে চেষ্টা করেছিল সে। কিন্তু কোনো একটি ভুল পদক্ষেপ বা অসময়ের অসতর্কতার কুফল হিসেবেই আজ তাকে ছুটে আসতে হয়েছে সব আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে বিমুখ হয়ে।

একটি সুষ্ঠু উপায় করে দেবে এমন একটি আশ্বাস দিয়ে তাকে অফিসে আসতে বলেছিল হেলাল চেয়ারম্যান। আর চেয়ারম্যানের আসবার অপেক্ষায় সে বিগত এক সপ্তাহ ধরে প্রতিদিন আজানের শব্দের সঙ্গে সঙ্গে উঠে পরে প্রাত্যহিক ক্রিয়া-কর্মের পরেই ব্যস্ত হয়ে ওঠে ছেলে-মেয়ের মুখে কিছু একটা তুলে দেবার আয়োজনে। তারপরই সে প্রায় নির্জন পথ ধরে হেঁটে আসে গোবিন্দপুর ইউনিয়ন পরিষদের অফিসে। ততক্ষণে নানা প্রয়োজনে লোকজন আসতে আরম্ভ করে দেয় দু একজন করে। অফিসের পাকা উঁচু বারান্দায় পা ঝুলিয়ে বসে অপেক্ষায় অপেক্ষায় তার সময় কাটে আর বিক্ষিপ্ত মনের আনাচে কানাচে বিতাড়িত সংসারের নানা ঘটনা রোমন্থনের বিরতিতে উপস্থিত লোকজনের কাউকে কখনো বা সরাসরি হেলাল চেয়ারম্যানের সহকারীকে জিজ্ঞেস করে জানতে চায় তার আসবার সম্ভাব্য সময়।

কিন্তু কেউই নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারে না কিছু। কেউ কেউ এও জানায় চেয়ারম্যানকে গত সপ্তাহে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে রাতের অন্ধকারে। কেউ বা জানায় মানুষটা খারাপ মানুষদের সঙ্গে মিশে গিয়ে কোনো দুষ্কর্ম করতে গিয়ে মারা গেছে ক্রস ফায়ারে। সব মানুষের জীবনেই কিছু না কিছু স্বপ্ন থাকে। কিন্তু আশৈশব লালিত স্বপ্নগুলো যখন দেয়ালের গায়ে লেগে থাকা আলগা বালির মতো কঠিন সময়ের উত্তাপে বিযুক্ত হতে থাকে তখন কোনো কিছুর ওপরই বিশ্বাস বা ভরসা রাখার দুঃসাহস হয় না।

একটি স্বপ্ন বা চাওয়া আংশিক পূরণ হতে গিয়েও কখনো দেখা গেছে খসে পড়া শুকনো পাতাদের মতোই হাওয়ার দাপটে উলটে পালটে চলে যায় নাগালের বাইরে। মোটামুটি খ্যাতিমান কোনো টিভি অভিনেতার এক তুতো ভাইয়ের সঙ্গে বিয়েটা হতে হতেও এক সময় ভেঙে গিয়েছিল তুচ্ছ কারণে। তখন থেকেই বলতে গেলে বিয়ের সম্ভাব্যতার প্রতি তার কোনো রকম ঔৎসুক্য ছিল না। কিন্তু ভাইয়ের কাঁধের বোঝা হয়ে থেকে ভাই-পো ভাই-ঝিদের আয়ার মতো কাল কাটিয়েও বিন্দুমাত্র সহানুভূতি অর্জন করতে পারেনি ভ্রাতৃজায়ার। দিনদিন তিক্ত থেকে তিক্ত হচ্ছিল জীবনের যাবতীয় অভিজ্ঞতার।

এক সময় বেশ শক্ত-পোক্ত সিদ্ধান্তই নিয়ে নিয়েছিল যে, নিজের হাতেই সমাপ্তি টানবে জীবনের। নিজের ভার নিজের কাছেই হয়ে উঠেছিল অসহ্য। প্রাচুর্যে ভরা জীবনের আশ্বাস দিয়ে প্রবাসী আর তুতো ভাইয়েরা লুটেপুটে প্রায় নিঃশেষ করে দিয়েও আর খানিকটা চেখে দেখতে ফিরে এসেছে বারবার। যদিও বোনেরা দিনরাত সতর্ক থেকেছে গোপনীয়তা যাতে কিছুতেই লঙ্ঘিত না হয়। কিন্তু পরের ছেলের কাছে কতক্ষণই বা গোপন রাখা যায় অন্যায় সৃষ্ট দাবানলের উত্তাপ কিংবা ধোঁয়া? শেষাবধি গোপন তো রইল না কিছুই।

বরঞ্চ তাদের হামবড়া ভাব আর অসার বুলি জীবনের কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিস্থিতি এমন হয়ে দাঁড়াবে তার কিঞ্চিৎ যদি ঘুণাক্ষরেও অনুমান করতে পারতো তাহলে কারো কোনো আশ্বাস বা ভরসার প্রতি নির্ভর করতো না বিন্দুমাত্র। বিষ খেয়ে বিষ হজম তাকে কখনোই করতে হয় নি স্বামীর সংসারে। খাওয়া-পরা তো চলতোই। আর খানিকটা রঙ চড়ানোর প্রত্যাশাই তার জীবনে কাল হয়ে দাঁড়ালো শেষ পর্যন্ত।

অথচ আগুনের দিকে ঠেলে দিতে দিতেও বোনেরা বলেছিল, মাসে মাসে এমন দশ-বিশ হাজার ট্যাকা দিয়া তর মতন এক-দেড়টা মানুষ পালতে কোনো গণা-বাছি করতে হইবো নাকি? কিন্তু কথা শুনে লোকটা সত্যি সত্যিই বেঁকে বসেছিল। অবশেষে গৃহ ছাড়া। দুঃসময়ে বোনেরা নানা অজুহাত দেখিয়ে সরে গেছে ধীরে ধীরে। ঘরের আসবাব গয়না গোপনে বেচে দিয়ে শহরের মাটি কামড়ে পড়ে থাকতে চেষ্টা করছিল আর অপেক্ষায় দিন গুনছিল, মানুষটার সঙ্গে যদি একটিবার দেখা হতো, তাহলে যে করেই হোক চেষ্টা করতো সুদিনের সন্ধান যদি পাওয়া যায়। কিন্তু কোথায় বা কতদূর সেই সুদিনের রেলগাড়ি তার সন্ধান জানা ছিল না তার।

সময় মতো বেতন পরিশোধ করতে না পারার কারণে স্কুল থেকে নাম কাটা গেছে বড় ছেলেটার। ছোটগুলো পরীক্ষাতেও বসতে পারেনি। জীবন সত্যিই জটিল। এখানে কারো পা হড়কে গেলে টেনে তুলবার মানুষ তেমন একটা নেই। আর নিজের দোষে যদি ঘর ভাঙে সে ঘরের ছাউনি মেলেনা সহজে।

তাই হয়তো ছোট-বড় সব শ্রেণীতেই ন্যায়-অন্যায়ের বাছ-বিচার না করে একটা প্রাণপণ চেষ্টা থাকে সংসারটাকে টিকিয়ে রাখতে। কিন্তু সে কী করেছে। পেছনের দিকে তাকালে ইচ্ছে হয় আধলা ইট দিয়ে আঘাত করে নিজের মাথাটিকেই দুভাগ করে দিতে। মাসে মাসে বিশ হাজার টাকার আশ্বাস দিলেও রেহানাকে বলেছিল আমিনা, তোরা না হয় কয়দিন চালাইলি আমারে। কিন্তু পরের পোলার লগে বিশ্বাস কী যে, এত কথা হুইন্যাও আমারে তোলা তোলা করবো? পরের পোলাগরে সব সময় ফাটা বাঁশে আটকাইয়া রাখন লাগে! বলে, বড় বোন রেহানা ফের বলে উঠেছিল, দেখস না আমারটারে দিনরাইত কেমনে চিপি, রাও করতে হুনছস? -তগো জামাইরা তো বিচি ছাড়া! খানিকটা রুক্ষ কণ্ঠেই বলে উঠেছিল আমিনা, নাইলে এত চোপা কইরাও বাদশাহি করতাছস! আরে বুঝলি না? বলে হেসে উঠেছিল মেজ বোন নাইমা।

তারপর দু হাতে একটি বিশেষ ভঙ্গি করে আবার বলে উঠেছিল সে, ব্যাডারা এইটা পাইলেই সব ভুইল্যা যায়! কিন্তু সব মানুষ যে এক রকম নয় তা কে বোঝাবে তাদের? টাকার পেছনে ছুটতে থাকা মানুষের লাজ-লজ্জা, বোধ-বিবেচনা আর নৈতিকতা খুব একটা থাকে বলে মনে হয় না। যে কারণে সংসার কুরুক্ষেত্র হয়ে থাকলেও বিছানায় গিয়ে তারা বদলে যায় অনায়াসে। অন্যদিকে স্বামীদের অতীত বা বাইরের জীবন যেমন জানে না তার অন্যান্য বোনেরা, সেদিক দিয়ে তার মানুষটা বলা যায় ভিন্ন রকম। মেয়েদের মতোই পেটে কথা রাখতে পারে না। গোপন বলতে গেলে কিছুই ছিল না লোকটার।

সে সব ঘটনাবলীর ভেতর নারী সংক্রান্ত ব্যাপার-স্যাপারও ছিল। আর সেগুলোকে ব্রহ্মাস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে গিয়ে একবার বলে উঠেছিল, বিয়ার আগে তো তোমার বুড়িগো লগেই সমন্ধ আছিলো। চরিত্রে জোর পাও কেমনে? এমন কথা শুনলে ছেলেরা কিছুটা হলেও থমকে যায়, কেউ কেউ রেগে ওঠে আরো। তখনই আরো ভালো মতো তাদের শায়েস্তা করা যায়। অথচ আমিনার ক্ষেত্রে ঘটেছিল একেবারেই উলটো ঘটনা।

নিজেই ফাঁদে পড়ে গিয়েছিল সে। আসলে তার জীবনের এ অন্ধকার পর্যায়ের সূত্রপাত বলতে গেলে তখনই। লোকটি নিজের অপকর্মের কথা শুনে মোটেও ক্ষেপে ওঠেনি। বরং শান্ত স্বরে বলে উঠেছিল, মানুষ তার বদমাশি আর পাপ গোপন রাখে। যেমন তুই খালাতো ভাইয়ের লগে এদিক ওদিক দৌড় পাইরা সতী থাকনের বড়াই করস।

তর ভইনেরা ঢোল পিডাইয়া মানুষেরে জানান দেয় তর তাহাজ্জদ পড়নের কথা। আরে নষ্ট মাইয়া মানুষ, এইডা কি জানস না যে, মক্কায়ও বেশ্যা আছে, তারাও হজ করে বছর বছর? লোকটি এক চড়ে যদি তার কোনো একটি কান ফাটিয়ে দিতো বা গালের চামড়া তুলে ফেলতো তারপরও অতটা অবাক হতো না। যে কথা কেউ জানবার কথা ছিল না তা লোকটির কানে যায় কীভাবে? এমন কথা তার ভাই বোনেরাও জানবার কথা নয়। কিন্তু ভেতরে ভেতরে সে টের পেয়ে গিয়েছিল যে, সংসারটাকে আর কিছু দিয়েই রক্ষা করতে পারবে না। তারপরই লোকটি বলে উঠেছিল, তোর থাইক্যা দৌলদিয়ার বেশ্যারাও অনেক ভালা মনে করি।

তারা জানে যে, তারা বেশ্যা। আর তুই জানস না তুই কতডা খারাপ তাগো থাইক্যা! ভেতরে ভেতরে কেঁপে উঠেছিল আমিনা। লোকটা কাদের সঙ্গে তাকে তুলনা করে আরো হীন বানিয়ে দিতে চেষ্টা করছে, ভাবতেই মাথার ভেতরে যেন আগুন ধরে গিয়েছিল তার। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই চিৎকার করে উঠেছিল, ওই নডি মাগির পুত, কথাডা কইলি কি তুই শুয়োরের বাচ্চা! নিজের কণ্ঠস্বরই নিজের কানে বিশ্রী শোনাচ্ছিল আমিনার। আরে বদমাইশ মাইয়া মানুষ, একটা বেশ্যা দিনরাইত কাস্টমার বিছনায় তুইল্যা ট্যাকা-পয়সা কামাই করে।

তারপরে মাথায় কাপড় দিয়া জায়নামাজে বইলেও হেই কথা কারুরে জানায় না, সতী সাজনের চেষ্টা করে না নিজের কর্ম লুকাইয়া রাইখ্যা। কিন্তু তুই সবই করছস! ফোরকান যতটা শান্তস্বরে কথা বলে, সে তুলনায় আমিনার কণ্ঠ আরো উচ্চকিত হয়। বলে, আমি কি চোদাইছি খালাতো ভাইয়েগো লগে, নাকি প্যাট বানাইয়া কোনোখানে খালাস কইরা আইছি? -তরে দিয়া সবই সম্ভব। নাইলে এত বড় একটা ঘটনা তুই চাইপ্যা যাইতে পারতি না। জামাইর কাছে যদি কথাই লুকাইতে পারলি, তাইলে অন্যের লগে চোদানের বাকি রাখলি কী আর? আমি যহন কামে বাইর হই, তহন তোর খালাতো ভাইয়েরা কি তোর উকুন বাইছা দিতে আইয়া বইয়া থাকে, নাকি তর ছিঁড়া ক্যাঁথা সিলাই করতে বয়? আমি ঘরে থাকন অবস্থায় তো দেখলাম না কেউ ফুসি দিয়া দেখতে আইছে কোনোদিন! সে কথা শুনে ভেতরে ভেতরে স্তব্ধ হয়ে বসেছিল আমিনা।

মনে মনে যা নিয়ে শঙ্কিত ছিল তার সব কিছুই লোকটি টেনে তুলেছিল শেকড়-বাকড় সহ। অথচ এ নিয়ে তাকে তেমন একটা যন্ত্রণা দেয়নি। সে ভেবে নিয়েছিল ট্রাক নিয়ে জেলায় জেলায় জেলায় ঘুরে বেড়ানো লোকটির কোনো মনোযোগই নেই সংসারের প্রতি। আর এখন দেখা যাচ্ছে ঘরের একটি সুচের প্রতিও যেন তার সমান দৃষ্টি আছে। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে আসন্ন সংসার বিচ্ছিন্ন দিনগুলো আরো অন্ধকারে বিলীন হয়ে যেতে দেখলেও মুখে মুখে হার স্বীকারের মতো বা নিশ্চুপ থাকার মতো দুঃসাহস হয় না তার।

জিতে যাবার লক্ষ্যে সে যত কিছুই বলুক, বোনেরা যতই সাহস দিক না কেন এক দু মাসের যোগান দেবার সামর্থ্য তাদেরও থাকবার সম্ভাবনা নেই। পরের ছেলের পকেট কাটতে গিয়ে নিজের সংসার উজাড় করে দিতে চাইবে না কোনো মেয়েই। সে কথা সে নিজেও বোঝে। তবু স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের দৃঢ়তার চেয়ে অন্ন-বস্ত্রের অনিশ্চয়তাই যেন পাগল করে দিচ্ছিল তাকে। তবু কখন যে নিজের অজান্তে কথার আগে ছিটকে পড়া থুতুর মতো বের হয়ে এসেছিল, মনে করছস তোর ভাত ছাড়া আমার দিন চলবো না? এহনও কোমর ব্যাকাইলে তোর মতন কত ব্যাডা দৌড় পাইরা আইবো! -যা! যে তরে ভাত খাওয়ায় তার ভাতই খা! আমিও তরে বাইন তালাক দিলাম! যেই মুখে তুই আমারে এত বড় বড় কথা কইলি হেই মুখ আমি আর দেখুম না।

বলতে বলতে সত্যিই মুখ ফিরিয়ে বের হয়ে গিয়েছিল ফোরকান । হঠাৎ বাইন তালাকের কথা শুনতে পেয়ে তাড়া খাওয়া কুকুরের মতো রাস্তায় গিয়ে ছিটকে পড়ে কেঁদে উঠেছিল আমিনা। হাত-পা নেড়ে লোকজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে আরো জোরে জানান দিয়েছিল, আমারে বাইন তালাক দিছে গো! যদিও পথচারী বা আশপাশের ঘর-বাড়ির লোকজনের সহানুভূতি তেমন একটা পায়নি। তবু ছুটা কাজের বুয়া পাশ কাটিয়ে আরেক বাড়ির কাজে যেতে যেতে বলে উঠেছিল, ব্যাডা মানুষের মাথা গরম হইলে কতবারই তালাক দেয়। এই তালাক হয় না।

রতনের মাকে তেমন একটা ভালোমতো না জানলেও তার কথাগুলো শুনে পায়ের নিচে যেন মাটির অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছিল আমিনা। খানিকটা আশাও যেন জেগে উঠেছিল সংসারের চৌহদ্দিতে ফিরে যাবার। আর সে ভরসাতেই ঘরের যাবতীয় মালামাল নিয়ে বাপের বাড়ি গিয়ে উঠেছিল কদিনের জন্যে। কিন্তু দিনের পর দিন পার হয়ে যেতে থাকলেও ফোরকানের মাঝে তার প্রতি প্রসন্ন হয়ে উঠবার কোনো লক্ষণ ফুটে উঠতে দেখা যায়নি। আশা আর সাহস জুগিয়ে চলা কুটিল বোনেরা একে একে দূরে সরে গেছে নানা অজুহাতে।

এমন কি সুদীর্ঘকাল শ্বশুর বাড়ির লোকজনদের প্রতি অবজ্ঞা অবহেলার পরিণতি হিসেবে তাদের কারো কাছ থেকেও কোনো আশ্বাস পাওয়া যায়নি। এদিকে চেয়ারম্যান কথা দিয়েছিল দুজনের মাঝে কোনো রকম আপস করিয়ে দিতে না পারলেও যাতে তার খাওয়া-পরার অভাবটা চলে যায় তার জন্যে কিছুটা হলেও আর্থিক অনুদানের ব্যবস্থা করে দেবে খোর-পোষ হিসেবে। কিন্তু যেভাবে চেয়ারম্যানের অনুপস্থিতির হার বেড়ে চলেছে এখানেও কোনো সম্ভাবনার আলো সহসা ফুটবে বলে মন থেকে কোনো রকম সায় পায় না। ইউনিয়ন পরিষদ অফিসের সামনের বারান্দায় সেই সকাল থেকেই বসে আছে সে। এপর্যন্ত এক ফোঁটা পানি পর্যন্ত পড়েনি তার পেটে।

অথচ বেলা প্রায় মাথা বরাবর উঠে গেছে। চেয়ারম্যান আদৌ আসবে কি না সে কথাও বলতে পারছে না অল্প বয়স্ক সহকারী ছেলেটি। তবু বাড়ি ফিরে যাবার আগে শেষবারের মতো সে জানতে চায়, চ্যাহেরম্যান সাবের খবর পাইলেন কোনো? -না। ফোন করছিলাম কয়েকবার। বলতে বলতে ছেলেটি হাতের কাগজগুলো ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে।

তারপর আমিনার দিকে তাকিয়ে আবার জানায়, ধরলো না। মনে কয় ফোন হারাইয়া ফালাইছে নাইলে চুরি হইয়া গেছে। সঙ্গে সঙ্গেই আরো বিমর্ষ হয়ে ওঠে আমিনার পাংশু মুখ। একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালে সহকারী ছেলেটি বলে, যাইবেন গা? -আর কত বইয়া থাকুম? -একটা কাজ করতে পারেন। আপনের জামাইরে তালাকের নোটিশ দেন! তিনমাসের মইধ্যে হ্যায় আপনের খোঁজ-খবর না করলে দুইজনের ছাড়াছাড়ি নয়তো ব্যাডার এক বছরের জেল হইবো।

আবার জরিমানাও হইতে পারে দশ হাজার ট্যাকা। কথা শুনে আমিনার হাই ওঠে। হাই চাপতে চাপতে বলে, আইচ্ছা বাপ-মার লগে বুইঝ্যা দেখি। তারপরই বারান্দা থেকে দু ধাপ সিঁড়ি টপকে নেমে আসে সে। শরীরে আঁচলটা ভালো মতো জড়াতে জড়াতে পথের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে তার মনের ভেতর পাক খেতে থাকে যে, তালাক হোক বা না হোক, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক থাকুক আর না থাকুক দরকার খেয়ে-পরে বেঁচে থাকা।

জীবন নিয়ে বাঁচতে হলে সম্পর্কের চেয়েও জরুরি টাকা-পয়সা।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।