আমি পার্থিব বাস্তবতায় অস্থির, অপার্থিব স্বপ্নপায়ী কেউ একজন . . .
ই-বুলেটিনে ছাপা হওয়া একটা আর্টিক্যাল নিয়ে বেশ হইচই হয় ইউ.এস.এ-তে। ওখানকার ক্রেতারা অভিযুক্ত সুপার মলগুলো থেকে কেনা-কাটা বয়কট-ও করে বেশ কিছুদিনের জন্য। তবে আসল অভিযুক্ত সম্প্রদায়ের থেকে কোনরকম প্রতিবাদ না হওয়ায় বিষয়টা খুব তাড়াতাড়ি ঢাকা পড়ে যায়। আমি হুট করে পড়ে ফেলায় লেখার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলাম। পাঠকদের দায়িত্ব-কর্তব্য কি বিবেকের জাগরণ সব তাঁদের উপর ছেড়ে দিচ্ছি।
আমার কর্তব্য শুধুই জানানো। আমার সীমিত সামর্থে এর চে' বেশি আমি যা করেছি তা হলো গ্রুপ জয়েন করেছি আর ওদের নানা কার্যক্রমে যতটুকু সম্ভব সাহায্য করেছি। আপনারা নিজ নিজ সামর্থ্ বুঝে কাজের সীমা নিজেরাই নির্ধারন করে নেবেন। আর কিছু না করতে সাড়া পেলে এ লেখার অর্ধেক পড়ে ট্যাব বন্ধ করে হাই তুলতে তুলতে কাজে ফিরে যাবেন...
প্রথমে কিছু তথ্য দেই যা আর্টিক্যাল বিশ্লেষণে সাহায্য করবে:
**Wal-Mart - পৃথিবীর সবচে' বড় মুনাফাপায়ী এ্যমেরিকান প্রতিষ্ঠান। শেষ বর্ষের মুনাফা = $৬২.৫৪ বিলিয়ন যা ১০টি থাইল্যান্ডের জাতীয় উপার্জনের সমান (বাংলাদেশের সাথে তুলনাযোগ্য না হওয়ায় ইনকাম বা উপার্জনের ফিগারটা দেয়া হয় নি)
মার্কেটিং ট্যাগলাইন বা ক্রেতাদের আকর্ষণী বিজ্ঞাপন ম্যসেজ : "Everyday Low Pricing" - "প্রতিদিন সাশ্রয়ী মূল্য"।
***ASDA - Wal-Mart-এর ব্রিটিশ সাবসিডিয়ারি। শেষ বর্ষের মুনাফা = $৪০৮.২১ বিলিয়ন
মার্কেটিং ট্যাগলাইন বা ক্রেতাদের আকর্ষণী বিজ্ঞাপন ম্যসেজ : "Britain's Lowest Priced Super Market" - "ব্রিটেইনের সবচে' কম মূল্যপ্রদানকারী সুপারমার্কেট"
এবার প্রসঙ্গে ফিরে আসি:
ব্রিটেইন বা এ্যমেরিকান ক্রেতারা যুগে যুগে হতবাক হয়ে যান ASDA বা Wal-Mart-এর নিম্নমূল্যে! এতো কম মূল্যে কিভাবে তারা এতো ভাল জিনিস দেয় তা তারা কিছুতেই বুঝে পায় না! তারা বুঝে নেন যে কোম্পানি কাস্টোমারদের প্রতি কতোটা উৎসর্গিত! বাংলাদেশের কিছু সাপ্লায়ার ASDA বা Wal-Mart-এর বিশাল একটা অর্ডার পায়। শেষ ক্রিসমাসে এ দু'টা কোম্পানির সেলস্ বিশালমাত্রায় লাভ করলো বিশেষকরে গার্মেন্টস সেক্টরে। লাভের অঙ্ক এতোটাই বেশি যে ASDA বা Wal-Mart বিশাল ডিসকাউন্ট বা ফ্রি পণ্য বিতরণের আহ্বান জানালো ক্রিসমাস সিজনের পর। ঠিক তখন বাংলাদেশে প্রতিবাদের ঝড় উঠলো গার্মেন্টস কর্মীদের মাঝে।
সব গার্মেন্টস কর্মী এক হয়ে বিক্ষোভের ঝড় তোলেন। এক ওয়েস্টার্ন রিপোর্টার বাংলাদেশ কর্মীদের থেকে পুরো স্টোরীটা কাভার করেন এবং ই-বুলেটিনে ছেপে দেন। তিনি বাংলাদেশকে উদাহরন টেনে দেখান তৃতীয় বিশ্বকে শোষনের চরম পর্যায়টা।
বাংলাদেশ থেকে প্রায় দশ মিলিয়ন পাউন্ড বা ডলারের পণ্য যায় কোম্পানিগুলোতে। বিশ্বায়ন বা গ্লোবালাইজেশনের ভয়াবহ একটা দিক হচ্ছে মানবসম্পদ ব্যবহারে খরচ বাঁচানো।
বাংলাদেশী কর্মী বিশ্বের সবচে' সস্তা মানবসম্পদ যা কর্পোরেট কোম্পানী একেবারেই মন-মতো ব্যবহার করতে পারে। কোন ধরনের ইথিক্যাল বা মূল্যবোধের আইন এ দেশের সরকার কড়াভাবে মানেন না যেটা পশ্চিমা দেশগুলোতে বেআইনী মানা হয় এবং কোম্পানীগুলোর আশংকাজনক পরিমাণের ডলার গুণতে হয় ভুল সংশোধনে। ASDA বা Wal-Mart কোম্পানীর মানবসম্পদ ব্যবহার বা নিয়োগে ETI (Ethical Trading Initiative) BASE CODE কড়াভাবে ব্যবহার করে থাকে যেটা যেকোন পশ্চিমা দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এই কোডের ব্যবহারের জন্য তারা প্রশংসিত-ও হয়েছে পশ্চিমা সরকারের কাছে। এই কোডের বিধিগুলো এমন -
১. যেকোন কর্মী নিজের চাকুরীর কাজের সীমা সম্বন্ধে চাকুরীর আগেই অবগত থাকবেন।
২. শ্রমিক লীগ বা শ্রমিকদের জোটবদ্ধ সংস্থা থাকবে এবং তাদের দাবী-দাওয়া কোম্পানী শুনতে বাধ্য থাকবে।
৩. কাজের পরিবেশ নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত হবে।
৪. শিশুশ্রম নিষিদ্ধ।
৫. ন্যয়সঙ্গত ও সঠিক পারিশ্রমিক প্রদানে কোম্পানী বাধ্য থাকবে।
৬. কাজের সময় অতিরিক্ত মাত্রার হবে না :
- সপ্তাহে ৪৮ ঘন্টার বেশি কাজ করবে না কর্মী
- ৭ দিনে একদিন বন্ধ থাকবে
- ওভারটাইম স্বেচ্ছায় করবে কর্মীরা এবং তা সপ্তাহে ১২ ঘন্টার বেশি
হবে না
- ওভারটাইমের পারিশ্রমিক সাধারণ পারিশ্রমিক থেকে অবশ্যই বেশি হবে
- কোম্পানী জোড়পূর্বক ওভারটাইম জারী করতে পারবে না।
৭. কোন ধরনের পক্ষপাতিত্ব বা ডিসক্রিমিনেশন বেআইনী।
৮. কোন ধরনের ব্যবহার যা কর্মীদের সম্মান লঙ্ঘন করতে পারে তা বেআইনী।
ASDA বা Wal-Mart-এর নির্দেশ আছে বিশেষত মেয়েদের (বয়স ১১-২০) কর্মী নিয়োগ করানোয় এবং তাদের কার্যঘন্টা নির্ধারনে। বাংলাদেশের গার্মেন্টস কর্মীদের প্রতিদিনের টার্গেট (তারা ক' ঘন্টায় কতোগুলো কাপড় শেষ করবে) ঠিক করে দেয় তাদের সুপার্ভাইজার। প্রতিজন মেয়ে সপ্তাহে ৮০ ঘন্টা কাজ করে থাকে (পাঠক একটু কোডের সাথে আমার এখনের বলা পয়েন্টগুলো মিলিয়ে নিন দেখে নিতে যে তারা সত্যি কতোটা বিবেকবান!)।
টার্গেট শেষ না হওয়া পর্যন্ত যেকোনো মেয়ে ফ্যাক্টরিতে কাজ করতে বাধ্য। ওভারটাইম বা ঘড়ির কাটা সুপারভাইজারের আঙুলের ইশারায় চলে। ওভারটাইম বলে কিছু নাই, কাজ শেষ করতে পারলে বাড়ি যাবা। ... এবং ওভারটাইমের কোন আলাদা মজুরী-ই নাই। সপ্তাহে কোনদিন-ই তাদের ছুটি নাই।
সাপ্তাহিক ছুটি বলে কোন শব্দের সাথে তাদের পরিচিতি নেই। তারা জানায়, সুপারভাইজার বা ম্যনেজমেন্ট তাদের মজুরীর হিসাব জানেন, তারা ওসবে কথা বলার সাহস পায় না আর তর্কে গেলে সেদিনের মজুরী-ও তারা পায় না। বাংলাদেশের একজন গার্মেন্টস কর্মীর মাসিক মজুরী $৭ বা ৪২০ টাকা। সেটাকে $৮ বা ৪৮০ টাকা করার জন্য তারা জীবনটা দিতে বাকি রাখে। মাঝে-মধ্যে মালিকের মানসিক-শারীরিক সব চাহিদা মেটানোর পর তাদের সর্বোচ্চ $১০ বা ৬০০ টাকা দেয়া হয়।
তাতেই তারা মুখ বুঁজে চলে। ফ্যাক্টরী থেকে যেকোন ধরনের শ্রমিক সংঘ বা শ্রমিক জোট না করতে দেয়ার বিষয়ে উপর থেকে কঠিন নিষেধাজ্ঞা আছে। এ ধরনের কিছু হলে ASDA বা Wal-Mart সাপ্লায়ার বদলে ফেলবে। বেশিরভাগ কর্মী-ই মেয়ে, বয়স ১১ থেকে ২০ এর মধ্য হতে হয় যারা গ্রাম থেকে শহরে আসে, যাদের সমাজে সম্মান বা মাথা উঁচু করার অধিকার নেই, যারা লীগে সামিল হতে ভীত এবং যাদের শরীর যখন-তখন যেমন-তেমন ভোগের উপযোগী। এমন নাহলে সে বা তারা নিয়োগ পায় না ফ্যাক্টরীতে।
এছাড়াও বিদেশী বা দেশী জরীপকর্মী বা সাপ্লায়ারের চর আসলে কর্মীদের যা শেখানো হয় তাই তারা টিয়াপাখির মতো আউড়ে যায়। কোনো কর্মীর জন্য কোন ডিল বানচাল হয়ে গেলে তাকে চরম পর্যায়ের শারীরিক নির্যাতন সহ্য করতে হয়। নামমাত্র মূল্যে একেকটা কাপড় তৈরী করে তা চড়া দামে বিক্রী করা হয়। কিন্তু পশ্চিমা জনপদের কাছে তাও তা নামমাত্র দাম। কারন তাদের উপার্জন অনেক বেশি আর নামমাত্র উৎপাদন ব্যয়ের কারনে দাম যা-ই রাখা হোক কোম্পানির লাভ হবেই হবে।
সেজন্যেই তাদের পক্ষে এতোটা কমদামে পণ্য সরবরাহ সম্ভব হয়। রিপোর্টার বলেন যে, প্রতিটা কাপড়ের দামের ১% পায় গার্মেন্টস সাপ্লায়ার আর সেই ১%-এর ০.২% পায় একজন কর্মী। বাকি ৯৯% যায় কোম্পানীর লভ্যংশে।
রিপোর্টার একজন গার্মেন্টস কর্মী সেলিনা-র সাক্ষাৎকার নেন। যেটা The National Labor Committee-র জার্নালে ছাপা হয়।
সেলিনা তার ১১ বছর বয়স থেকে গার্মেন্টস কর্মী ছিলেন এবং প্রচন্ড নিপীরনের শিকার হয়ে এই বিক্ষোভে অংশ নিয়েছেন।
সেলিনা
বয়স : ৩১
"আমি চট্টগ্রামের এক সেলাই কারখানায় ঢুকি যেটা শুধুমাত্র Wal-Mart-এর অর্ডার নিতো। আত্মিয়ের কাছ থেকে খুব ভাল কারখানা শুনে ১১ বছর বয়সে এখানে কাজ নেই। আমার নিয়মিত কাজের সময় ছিল ভোর ৭.৩০ থেকে রাত ১০টা- প্রায় ১৪ ঘন্টার একেকদিনের শিফট। কিন্তু জুন থেকে অগাস্টে কাজের চাপ বেশি থাকায় সুপার্ভাইজারের চাপে রাত তিনটা পর্যন্ত কাজ করতে হতো।
আমরা রাতে ফ্যাক্টরীর মেঝেতেই ঘুমাতাম আবার ভোর থেকে উঠে কাজ শুরু করতাম। প্রথম চারমাসে আমি দু'দিন বন্ধ পেয়েছিলাম। আমার কাজ ছিল Wal-Mart-এর লেবেল যেখানে সেলাই হবে তার জায়গাটা চক দিয়ে এঁকে দেয়া আর লেবেল-টা আঁটকে দেয়া। আমার পরের জন সেলাই করে দিতো। আমার সুপার্ভাইজার টার্গেট দিতো ঘন্টায় ২০০ লেবেল বানানোর।
প্রতি ১৮ সেকেন্ডে একটা লেবেল গুণতো সে আর প্রতিদিন ২,৬০০টা লেবেল। প্রতি ৩০টা লেবেলের জন্য আমি পেতাম এক সেন্ট বা ৬০ পয়সা, ঘন্টায় ৪ টাকা ২ পয়সা আর সপ্তাহে ১৬০ টাকার কিছু বেশি। সেজন্যে আমাকে সারাক্ষণ কাজের তাড়া খেতে হতো সুপার্ভাইজারের থেকে। আমরা ১৩-১৪ ঘন্টার মধ্যে ৩ বারের বেশি টয়লেট ব্যবহারের অনুমতি পেতাম না। সুপার্ভাইজারের ব্যবহার ছিল খুব খারাপ।
তখন আমার ১৩ বছর, অসুস্থ থাকায় টার্গেট পূরণ করতে পারি নি। সুপারভাইজার সব মেয়ের সামনে আমাকে চুল ধরে টেনে মেঝেতে শুইয়ে দিলো, ক্রমাগত মারলো কিছুক্ষণ তারপর আমি একেবারে কাঁপতে থাকলে আমার শরীরের উপর উঠে এসে চিৎকার বললো আমি আর আমার মা বেশ্যার জাত আমাদের ভাল কাজ করে অভ্যাস নেই। এরপর আমাকে সে ২০-৩০ মিনিট কানে-চুলে ধরে পুরো ফ্যাক্টরী ঘুরালো আর যাচ্ছে-তাই গালি-গালাজ শুনলাম আমি। সেদিন সারারাত ব্যথায় আর অপমানে ঘুম হয় নি। আমার শরীরের প্রতিটা অংশ মানুষটা যেমন-তেমনভাবে ব্যবহার করেছে।
কিচ্ছু বলতে পারি নি। পানি খেতে চেয়েছি, এনে দিয়েছে নোংরা গন্ধওয়ালা পানি। এতোসবের পর-ও আমাদের বয়স ২৫-৩০ হওয়ার আগেই ফ্যাক্টরী আমাদের বদলে নতুন-তাজা ১১-১২ বছরের মেয়ে নিয়ে নেয়। আমাদের অতিরিক্ত খাটুনিতে আমরা যখন-ই টার্গেট ধরতে পারি না তখন-ই বের করে দেয় কোম্পানী। "
সেলিনার মতো অনেক অনেক মেয়ে ক্রমাগত পিষে যাচ্ছে জঘন্য কর্পোরেট দালালদের মেশিনে।
আর্টিক্যালগুলো প্রকাশ পাওয়ার পর একজন বাঙালী-ও তাদের স্বর উঁচু করেন নি। আমরা তৃতীয় বিশ্ব কি "বানানা রিপাবলিকান" (পশ্চিমারা ব্যঙ্গার্থকভাবে তৃতীয় বিশ্ব অন্তর্গত দেশগুলোকে "বানানা রিপাবলিকান" বলে থাকে) সিটিজেনদের মানুষ হিসেবে না আছে কোন মূল্য আর না আছে কোন চাহিদা। আসলে এসব প্রচন্ড নিগৃহীত মানুষের পাশে দাড়াবার মতো শক্ত মেরুদন্ড বা কঠিন বিবেক আমাদের কারো নেই। মানুষগুলো- বিশেষ করে মেয়েগুলোর শ্রম পিষে পশ্চিমা কোম্পানীগুলো মিলিয়ন কামিয়ে নিচ্ছে আর রক্তচোষা মেয়েগুলো তাদের জীবনের সবটুকু শক্তি ব্যয়ের পর হালকা প্রতিবাদের ঝান্ডা উঠিয়ে উল্টো শাস্তি পাচ্ছে।
তারপর-ও আমাদের শিল্পপতিরা যখন গার্মেন্টস কর্মীদের বিক্ষোভে বিরক্ত হয়ে তাদের গালি-গালাজ করেন তখন ভেবে দেখেন না যে বিক্ষোভ একদিনে তৈরী হয় নি।
একসময় অত্যাচার সহ্য করতে করতে এই "নিচু" জাতের মানুষগুলোর দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায়। নিরুপায় হয়েই তাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর প্রয়োজন পড়ে যায় যে তারাও মানুষ!
সোর্স :
VBulletin27 Winter 2006 Publications
http://www.labourbehindthelabel.org/ : এখানে নানা ধরনের কার্যক্রমে অংশ নিতে পারবেন অথবা মতামত দিতে পারবেন
সেলিনার আর্টিক্যাল : http://www.nlcnet.org/news/Selinas_Story.pdf
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।