আমাদের সমাজে অতি প্রাচীনকাল হইতেই বাংলা সাহিত্যে সাধারন অর্থে নরনারীর প্রেম মানেই বিবাহ পূর্ব প্রণয়ঘটিত ব্যাপার স্যাপার। দুটি বালকবালিকা বা তরুণতরুণী চোখাচোখি কানাকানি করিবে বা লুকাইয়া চুরাইয়া লুকোচুরি করিবে তাহাই একসময় ছিলো মহাপ্রেমের কাব্য বা লাইলী মজনু, শিরি-ফরহাদ টাইপ প্রেম।
আবার ইদানিং কালের মুরুব্বীদের ভাষায় অতি নির্লজ্জভাবে প্রকাশ্যে গলাগলি করিয়া,চলিয়া ফিরিয়া বা পার্কে বসিয়া একে অন্যকে চড়লাথি গালিগালাজ করিয়াও ভাব-ভালোবাসার আদানপ্রদানকেও ও প্রেম বলিয়াই আখ্যায়িত করা হয় বা অতি আধুনিক ভাষায় বলা যায় বন্ধুত্ব।
তবে আমাদের অপূর্বের ব্যাপারখানা যারপরনাই ভিন্ন। বিবাহ-দিবসের শুভদৃষ্টির শুভলগ্নটির আগ মুহুর্ত পর্যন্ত; চিরকুমার ও চিরনিস্পাপ হৃদয়ের অধিকারী নিস্কন্টক অপূর্বের মনোমাঝে যে চিরদিনের অচেনা অজানা এক বালিকার প্রথম মুখচ্ছবি-দর্শনে এমন লাইলী মজনু টাইপ প্রেম উদ্ভুত হইতে পারে তাহা তাহার নিজের কাছেই ছিলো অতীব অজ্ঞাত!।
(বাহ! কি দারুন দেখতে! চোখ দুটো টানাটানা .........প্রথম দর্শনে অপূর্বের অপূর্ব প্রেম)
বিবাহ অনুষ্ঠানের আয়োজনস্থল বিখ্যাত দরবার মহল। যথারীতি কাজী সাহেবের দীর্ঘ্য বক্তৃতা ও মহামূল্যবান উপদেশবাণী শেষে পাত্র পাত্রী দুজনেই যখন কবুল বলিয়া আলহামদুলিল্লাহ সহযোগে বিনি-সূতা-মাল্য বন্ধনে আবদ্ধ হইলেন
ও
যথারীতি ভুরিভোজন ও ইত্যাদির পর মহিলাদিগের নানা আচার অনুষ্ঠান শেষে বিশাল একখানি ফুলপাতা চিত্রিত চাদর সদৃশ বস্ত্রে নববধু ও নতুনবরের মস্তকদ্বয় একত্রে আচ্ছাদিত করিয়া,ভেতরে একখানি আয়না প্রবিষ্ঠ করাইয়া শুভদৃষ্টির ব্যবস্থা করা হইলো এবং যখন শ্যালক শ্যালিকা কর্তৃক নতুনজামাতার কাছে জানিতে চাওয়া হইলো বধু এর রুপ কেমন দেখিতেছেন?
ঠিক সে সময় আয়নার মাঝে দুই চোখ ট্যারা করিয়া ও ভয়াল দর্শন মুখবিকৃতি করিয়া নববধু যেরুপ চেহারা ধারন করিলেন তাহা দেখিয়া নতুন বরের ভীমরি খাইবার দশা। আৎকাইয়া উঠিয়া পড়িমড়ি ছুটিয়াই পালাইতেন। কিন্তু ততক্ষনে নববধু তাহার বাহূ চাপিয়া ধরিয়া মিটিমিটি হাসিতেছেন।
ক্ষনিকের মাঝে সেই পেত্নী সদৃশ্য বালিকা ভোজ বাজীর মত উবিয়া গিয়া কেমনে এমন পরীর মত ফুটফুটে স্নিগ্ধ কোমল রুপ ধারন করিলো তাহা বুঝিতে না বুঝিতেই বাহির হইতে শ্যালক-শ্যালিকাগনের ঝংকার উঠিলো " কি ব্যাপার বধু এর রুপ দেখিয়া কি মূর্ছা গেলেন? হেন তেন নানা বাক্যে অপূর্বের তখন দিশাহারা অবস্থা!
যাহাই হৌক সেই ঝংকৃত সন্মিলিত নারী কন্ঠের কলকাকলীর মাঝে অপূর্বের মাথা ঝিমঝিম করিতে লাগিলো।
সে বাক্যহরা বসিয়া রহিলো। সকল ছাপিয়া নববধুর অতিমিষ্ট মুখখানিই বুঝি মনে মনে জপিতে লাগিলো। হৃদয়-মাঝে ব্যাকগ্রাউন্ড সঙ্গীত বাজিতে লাগিলো।
Click This Link
এই রাত তোমার আমার......শুধু দুজনে
বাসর রাত। এইদিনটিকে ঘিরিয়া কত স্বপ্ন-জ্বাল এতদিন রচনা করিয়াছে সে।
আহা! কতরকম চলৎচিত্র রুপ নিয়া তাহা এতদিন মনোমাঝে ফল্গুধারার মত বহিয়া গিয়াছে। আজ এই মাহেন্দ্রক্ষণে অপুর হৃদয়ে শুধুই এক ঝলক দেখা তাহার বালিকাবধুর মুখখানি বুঝি তাহার স্বপ্নকুমারী ঐশ্বরিয়া রয় এর সৌন্দর্য্যকেও হার মানাইয়া মধুর আবেশ ছড়াইতেছে। !
বেশ খানিকটা রাত করিয়া, বন্ধুবান্ধব দ্বারা পরিবৃত হইয়া অপূর্ব যখন বাসর ঘরের দিকে অগ্রসর হইলো এবং বন্ধুবান্ধবরা যখন সহাস্যে তাহাকে বধুর ঘরের দিকে ঠেলিয়া দিয়া ঘরের কপাট বাহির হইতে রুদ্ধ করিয়া দিলো।
অপূর্বের মাঝে এক অদ্ভুত শিহরণ খেলিয়া গেলো। মনোমাঝে আবারও ব্যাকগ্রাউন্ড সঙ্গীত।
Click This Link
সে ক্ষণে ক্ষনে প্রতি পদক্ষেপে অজানা পুলকে পুলকিত হইয়া লাল নীল হলুদ ও বেগুনী বর্ণ ধারন করিয়া ফুলশজ্জার দিকে অগ্রসর হ্ইতে লাগিলো। এখানে উল্লেখ্য অপূর্ব কিন্চিৎ লাজুক প্রকৃতির ছেলে। লজ্জা যে শুধু রমণীরই ভুষন নহে সকলেরই তাহা নিশ্চয় জানা আছে। যাহাই হৌক, বাসর শজ্জার কাছে উপস্থিত হইয়া অপূর্বের হৃদয়খানি খান খান হইয়া ভাঙা কাঁচের ন্যায় ভাঙিয়া পড়িলো। ।
লতাগুল্মে ও পত্র-ফুল্লে সজ্জিত বাসর শজ্জাখানির মাঝে কুসুম- রতন-চন্দনে জড়াইয়া একরাশ যুঁইফুলের মত তাহার বালিকা বঁধুটি পড়িয়া রহিয়াছে। সেজবাঁতির স্নিগ্ধ আলোয় তাহাকে দেখাইতেছে যেন এক ঘুমন্ত রাজকন্যর ন্যায়। সোনার কাঁঠি রুপারকাঁঠী অদল বদল করিয়া দিলেই বুঝি কন্যা চোখ মেলিয়া জাগিয়া উঠিবে।
কিন্তু হায়! কন্যা জরিচুমকি খচিত পাশবালিশখানি জড়াইয়া সেজবাঁতির নীলাভ আলোয় কুসুম শজ্জায় অপরূপা মনমোহীনির ন্যায় ঘোর নিদ্রায় নিদ্রিত। অপূর্বের বুক চিরিয়া শুধুমাত্র একটি সুদীর্ঘ্শ্বাসই বাহির হইলো।
কোনোমতে মনের দুঃখ বুকে চাপিয়া সে শজ্জার এক প্রান্তে গুটিশুটি মারিয়া শুইয়া পড়িলো।
কর্ণকুহরে আবারও আজীবনের বয়ে চলা প্রিয় সঙ্গীত
Click This Link
নিদ্রাদেবী বুঝি আজ অপূর দুঃখে অপূকে ছাড়িয়া কোনো দূরদেশে পাড়ি জমাইয়াছিলো। কিন্তু কিছুক্ষণের মাঝেই খুকখুক, পুনরায় দু সেকেন্ডের মাঝে খুকখুক সহযোগে খিকখিক শব্দে অপূর্বের চক্ষুদুইটি গোল গোল আকৃতি ধারন করিয়া সেই আধো আলো ছায়াতেও ছানাবড়ার ন্যায় প্রজ্জলিত হইতে লাগিলো।
শজ্জার উপর উঠিয়া বসিয়া সেই অপরূপা রাজকুমারী তাহার দিকে চাহিয়া ততক্ষণে হাসিতে ভাঙিয়া পড়িয়াছে। তাহার এরুপ ফ্যালফ্যাল করিয়া ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া চাহনী দেখিয়া নববধু কপট ধমকের সূরে বলিয়া উঠিলো " এমন রাত কি কেউ ঘুমিয়ে কাটায়?"
পরক্ষনেই তিনি তাহার বহূদিনের যে মনোবাসনা পোষন করিলেন তাহা শুনিয়া অপুর আরেক দফা ভিমরী খাইবার যোগাড়।
বধুর বহুদিনের বাসনা তিনি নাকি বাসররাতিতে নতুন জামাই এর সহিত জ্যোস্নাস্নান করিবেন। আর সৌভাগ্যবসত আজ পূর্ণিমা। কাজেই তাহাকে এখন ছাদে লইয়া যাইতে হইবে। বধুর আবদার শুনিয়া অপূর্বের আক্কেল গুড়ুম।
বহু কষ্টে এত রাত্রীতে ফ্লাট বাড়ির ছাদে গমন অসম্ভব রকম দুরহ ব্যপার বুঝাইবার পর
বধুকে আপাতত ঘরের লাগোয়া ব্যালকোনীতেই জ্যোস্না স্নান করিয়া লইতে রাজী করানো গেলো।
এই ঘুমঘুম চাঁদ ঝিকিমিকি তারা এই মাধবীরাত! আসেনি বুঝি আর জীবনে আমার
সেই মায়াবিনী অম্লমধুর রাত্রীরে যখন তাহারা দরজা খুলিয়া রুমের লাগোয়া ছোট একরত্তি বারান্দাখানিতে আসিয়া দাড়াইলো। স্তব্ধ বিধুর মাঝ রাত্রীরে তখন আকাশ ভাঙিয়া জ্যোস্না নামিয়াছে। চাঁদের আলোর ছোট বারান্দাখানি ভাসিয়া যাইতেছিলো। বারান্দার কোনে টবে লাগানো হাস্না-হেনা ফুলের সুমিষ্ট গন্ধে মাঝ রাত্রীর বাতাস মাতাল।
অপূর্ব বধুর হাতখানি ধরিয়া বারান্দায় এককোনে ঝুলানো দোলনাখানিতে বসাইলো।
বধুর মুখপানে চাহিয়া সে ভুলিয়া গেলো এই পৃথিবীর দুঃখ ও কষ্টের যত কথা। এ জীবনে না পাওয়া শত বেদনার ব্যাথা।
Click This Link
অপূর্ব মায়াময় ভূবনবিদারী সেই চন্দ্রালোকে বালিকা বধুটি তাহার দিকে চাহিয়া মিটিমিটি হাসিতেছিলো। তাহাকে দেখাইতে ছিলো অপরূপা এক রহস্যময়ী রাজকন্যার ন্যায়। অপূর্ব মনে মনে বিধাতার উদ্দেশ্যেই বুঝি অস্ফুটে কহিলো, এ জীবনে আসলেই আর তাহার চাহিবার কিছু নাই।
(চলিবেক)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।