পাখি এক্সপ্রেস
১. >> মানুষ সিংহের প্রশংসা করে, কিন্তু আসলে গাধাকেই পছন্দ করে।
২. >> পুঁজিবাদের ঈশ্বরের নাম টাকা; আর মন্দিরের নাম ব্যাংক।
৩. >> সুন্দর মনের থেকে সুন্দর শরীর অনেক আকর্ষনীয়।
৪. >> শামসুর রাহমানকে একটি অভিনেত্রীর সাথে টিভিতে দেখা গেলো। শামসুর রাহমান বোঝেন না কার সংগে পর্দায় যেতে হয়, আর কার সংগে শয্যায় যেতে হয়।
৫.>> আগে কারো সাথে পরিচয় হলে জানতে ইচ্ছে হতো সে কী পাশ? এখন কারো সাথে পরিচয় হলে জানতে ইচ্ছে করে সে কী ফেল?
৬. >> শ্রদ্ধা হচ্ছে শক্তিমান কারো সাহায্যে স্বার্থোদ্ধারের বিনিময়ে পরিশোধিত পারিশ্রমিক।
৭. >> আজকাল আমার সাথে কেউ একমত হলে নিজের সম্বন্ধে গভীর সন্দেহ জাগে। মনে হয় আমি সম্ভবত সত্যভ্রষ্ট হয়েছি, বা নিম্নমাঝারি হয়ে গেছি।
৮. >> আগে কাননবালারা আসতো পতিতালয় থেকে, এখন আসে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
৯. >> জনপ্রিয়তা হচ্ছে নেমে যাওয়ার সিঁড়ি।
অনেকেই আজকাল অনেকেই জনপ্রিয়তার পথে নেমে যাচ্ছে।
১০. >> উন্নতি হচ্ছে ওপরের দিকে পতন। আজকাল অনেকেরই ওপরের দিকে পতন হচ্ছে।
১১. >> আমাদের অঞ্চলে সৌন্দর্য অশ্লীল; অসৌন্দর্য শ্লীল। রূপসীর সামান্য নগ্ন বাহু দেখে ওরা হৈ চৈ করে, কিন্তু পথে পথে ভিখিরিনির উলঙ্গ দেহ দেখে একটুও বিচলিত হয় না।
১২. >> একটি স্থাপত্যকর্ম সম্পর্কে আমার কোন আপত্তি নেই; এবং তার কোন সংস্কারও আমি অনুধাবন করি না। স্থাপত্যকর্মটি হচ্ছে নারীদেহ।
১৩. >> পরমাত্মীয়ের মৃত্যুর শোকের মধ্যেও মানুষ কিছুটা সুখ বোধ করে। কারণ সে নিজে বেঁচে আছে।
১৪. >> প্রতিটি দগ্ধ গ্রন্থ সভ্যতাকে নতুন আলো দেয়।
১৫. >> বাঙলার প্রধান ও গৌণ লেখকদের মধ্যে পার্থক্য এখানে যে, প্রধানেরা পশ্চিম থেকে প্রচুর ঋণ করেন; আর গৌণরা আবর্তিত হন নিজেদের মৌলিক মূর্খতার মধ্যে।
১৬. >> মহামতি সলোমনের নাকি তিনশো পত্নী আর সাত হাজার উপপত্নী ছিলো। আমার মাত্র একটি পত্নী। তবু সলোমনের চরিত্র সম্পর্কে কারো কোনো আপত্তি নেই, কিন্তু আমার চরিত্র নিয়ে সবাই উদ্বিগ্ন।
১৭. >> বাঙালি যখন সত্য কথা বলে তখন বুঝতে হবে পেছনে কোন অসৎ উদ্দেশ্য আছে।
১৮. >> অধিকাংশ রূপসীর হাসির সৌন্দর্য মাংসপেশীর কৃতিত্বমাত্র, তা হৃদয়ের প্রকাশ নয়।
১৯. >> পাকিস্তানীদের আমি অবিশ্বাস করি, এমনকি যখন তারা গোলাপ নিয়ে আসে, তখনও।
উপরের প্রবচন গুলোসহ ১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্রদের দ্বারা প্রকাশিত “অরুণিমা” পত্রিকার প্রথম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যায় “প্রবচনগুচ্ছ” নামের লেখায় হুমায়ুন আজাদের ২৫টি প্রবচন প্রকাশিত হয়। এগুলো আসলে উনার বিভিন্ন লেখা থেকে উত্তোলিত। এরপর এসব নিয়ে তখনকার মিডিয়া বেশ কয়েকদিন খুব গরম ছিলো।
শুরু হয় "দৈনিক সংবাদে" প্রকাশিত কথাশিল্পী সৈয়দ শামসুল হকের বিবৃতি প্রকাশের মধ্য দিয়ে। তিনি বলেন – “ড. আজাদ নারী জাতির প্রতি অসম্মান প্রকাশ করেছেন এবং তিনি স্ব-বিরোধী। কিন্তু এর কিছুদিন পরই "সাপ্তাহিক তারকালোক" এ এর ব্যবচ্ছেদ করা হয়। পত্রিকার স্-নামে প্রকাশিত এক লেখায় সৈয়দ সাহেবের বক্তব্যের সমালোচনা করে বলা হয় – “বিষয়টি বিস্মিত করেছে অনেককে; ‘খেলারাম খেলে যা’ কিংবা ‘বৈশাখে রচিত পঙতিমালা’র লেখক এসব কথা বলেছেন। আর স্ব-বিরোধিতা? –একজন তরুন কবির বরাত দিয়ে লেখা হয় – ‘সৈয়দ শামসুল হক সাম্প্রতিক সরকার বিরোধী আন্দোলনের সারিতে থাকেন, কিন্তু অন্তরালে তিনি এ সরকারের সাথে সংশ্রবও রাখেন।
এ সরকারের কয়েকটি প্রচার চিত্রের নির্মাতাও তিনি। পাশাপাশি অপসংস্কৃতির কথাও তার মুখে শোভা পায় না। কারণ অপ-চলচ্চিত্রের সংগেও তিনি জড়িত। কাজেই স্ব-বিরোধিতার অভিযোগ তাঁর মুখে সাজে না। “
কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে, কবি শামসুর রাহমানকে নিয়ে এতো তীর্যক কথা বলার পরও তিনি কিন্তু এ বিষয়ে অপ্রিয় কোন কথা বলেননি।
বরং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভাইস চ্যান্সেলরের করা “ড. আজাদকে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করানো উচিত” মন্তব্যের খুব কঠিন সমালোচনা করেন। তিনি বলেন- “এ প্রবচনগুলো নিয়ে হৈ চৈ করার মতো কিছু নেই। ইতিবাচকভাবে দেখলে এক অর্থ মনে হবে, আর নেতিবাচকভাবে দেখলে ভিন্ন অর্থ দাঁড়াবে। প্রবচনগুচ্ছ প্রকাশের কারণে হুমায়ুন আজাদের বিরুদ্ধে যেসব তৎপরতা চালানো হচ্ছে, তা অনভিপ্রেত। এগুলো লেখকের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর এ বিষয়ে যে মন্তব্য করেছেন, তা আপত্তিকর। “ আবার সৈয়দ শামসুল হকের মন্তব্যের সমালোচনা করে বলেন –“লেখক হিসেবে তার অবস্থানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়নি। “
পরে এ বিষয়ে ড. হুমায়ুন আজাদ সাপ্তাহিক তারকালোকে এক সাক্ষাতকার দেন। সাক্ষাতকারে তিনি সৈয়দ শামসুল হককে “একজন রুগ্ন বুর্জোয়া ও লোলুপ লুম্পেন” হিসেবে আখ্যায়িত করেন। এবং সৈয়দ শামসুল হককে যৌনগ্রাফার উল্লেখ করে বলেন- “ তিনি তার রচনায় আত্মহত্যা করেছেন।
“ এর আগেও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে কিছু মন্তব্য করলে নজরুল ভক্তের (এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে নজরুল ব্যবসায়ীদের) গাত্রদাহ শুরু হয়। নজরুলকে নিয়ে মন্তব্যের কারণ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে উত্তর দেন এভাবে –“আমি কখনোই নজরুলকে প্রতিক্রিয়াশীল বলিনি, এটা রটানো হয়েছে। নজরুলের গুরুত্ব আমি অস্বীকার করি না, কিন্তু আমি চাইনা নজরুলকে নিয়ে ব্যবসা করতে। আমি নজরুলকে ঠিকমতো দেখে নিতে চাই। কিন্তু আমার সমালোচনাকারীরা তা চান না।
“ আর লেখকদের স্বাধীনতার প্রশ্নে বললেন –“প্রতি মূহুর্তে যদি রাষ্ট্র, দল, গোত্র, বিশ্বাস ও আরো অনেক কিছুর কথা ভেবে লিখতে হয়, কোনো একটি শব্দ বা বাক্য লিখে রক্ত হিম হয়ে যায়, চোখের সামনে মিছিল, ছুরি, পত্রিকায় অশালীন আক্রমন ভাসতে থাকে, তাহলে লেখকের পক্ষে লেখা কঠিন। “
আসলেই, সে “কঠিন”ই শেষে জাতীয় দুর্যোগ হলো এবং আমরা হুমায়ুন আজাদকে হারালাম।
(টাইপ করার ভয়ে পুরো সাক্ষাতকার দিইনি )
তথ্য সূত্র :
সাপ্তাহিক তারকালোক
১-১৪ জুলাই ১৯৮৯ সংখ্যা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।