ডুবোজ্বর
০১.
আমি কারো সামনে ছবি আঁকতে পারতাম না। ফলত ক্লাস ছেড়ে সবাই বাইরে গেলে, টিফিন আওয়ারে ছবি আঁকা ধরতাম। এতোক্ষণ হয় অন্যদের বিরক্ত করতাম, নাহয় বাইরে বাইরে ঘুরতাম। এখন কেউ না থাকলেও ছবি আঁকতে পারি না। আমি ছবি আঁকা ভুলে গেছি।
তবে মনে মনে সারাক্ষণ ছবি আঁকি। শরতের শাদা শাদা মেঘের গায়ে ওয়াটার কালার। তখন আমার কাছে শুধু একটাই রঙ থাকে কোবাল্ট-ব্লু। আকাশের পাশে আরেকটা আকাশ আঁকার চেষ্টা। অবশ্য শরতের আকাশ ঠিক কোবাল্ট ব্লু নয়, অনেকটা ফ্রেঞ্চ আল্ট্রামেরিন।
০২.
প্রতিদিন কে এসে দিবসকে হত্যা করে? একটি বই দেখে আমার টেবিলকে মনে পড়ে। সেইসব বছর মনে পড়ে, যেখানে পাঠকেরা সমবেত হয়েছিলো। টারমাইট ভেঙে পড়ছে যখন তারা দেখছিলো। এবং পরবর্তী দৃষ্টিপাত যে ছেড়ে চলে গিয়েছিলো-- তা ভবিষ্যতের পিছনে গিয়েছিলো।
০৩.
দীর্ঘ দৃষ্টিপাত একটি উজ্জ্বল বলয় তৈরি করে।
কারণ কেউ যদি দেখা করতে যেতে চায় রাস্তায় বসন্তকালে-- গ্রীষ্মকাল আসে শহরের সৌন্দর্যে এবং পরিশেষে ম্যাগনোলিয়া! একটি গাছে গ্রীষ্মকাল বজ্রপাত থেকে তৈরি করে এই ফুল।
ঝড় আমার সবচেয়ে প্রিয়।
০৪.
বন্দনার গান গীত হলে সন্ধ্যা আসে। শিরীষের গাছের পাতায় ঝুলে থাকে সূর্যের নিঃশ্বাস। পাতা ঘুমায় তন্দ্রার একটু পরে।
আমি ভাবি একটি নৌকো, ক্ষুদ্র এবং যথেষ্ট বড়-- ভাঙে না। এইটা কী প্রকারের নৌকো জানে না মাঝিও। আমার অনেকদিন আগে একটি নৌকোয় উঠে ভেসে যাওয়ার কথা মনে পড়ে। আমি কি মৃত্যুর দিকে যাচ্ছিলাম?
আমার হাতে ছিলো একটা কাগজের প্লেন।
০৫.
জ্ঞানীরা মনে করেন বাবুইপাখি কেবল তালগাছেই বাসা বুনে।
কথা ঠিক নয়। আমাদের বাড়িতে সারি সারি নারিকেল গাছে ঝুলে আছে বাবুই পাখির নীড়। একটা দুইটা পড়ে গেলে আমি ঝুলিয়ে রাখতাম আমার অন্ধকার ঘরের ভিতর। সকাল বেলা আলো আঁধারিততে বেড়ার ফাঁক গলে বাবুই আসতো না, আসতো চড়ুই।
আমার জানলাবিহীন ঘরে বাতাস আসতো ভাঙাবেড়ার ফাঁক গলে, এই বাতাসের নাম দিয়েছিলাম চড়ুই-হাওয়া।
০৬.
আমি কাজের চিরন্তনতা অনুভব করি না। একটি গাছে কোনো একজন সাহায্যের জন্যে আমাকে ডাক দেয়ে। আমি সেই ঋতুটি পর্যন্ত যাই এবং তাকে সমূলে ভেঙে ফেলি। তারপর একটি লাইন লিখে সমস্ত রাত্রি কাজ করি। আমি অন্য একটি বাতিঘরে, অন্যান্য কামরায় অনেকে প্রথম দিন ছিলো।
সঠিক মুহূর্তে আমি কিছু জিনিশের কথা ভাবি। যেমন, ম্যানিলার আঁশ।
০৭.
সাঁঝবাতির রূপকথা এসে আমাকে বললো, তুই মর, মরে বৃক্ষ হ...। আমি প্রতি সন্ধ্যায় একবার করে মরে যাওয়ার কথা ভাবি। আর নিজেকে অসহায় মনে হয়।
মরতে পারি না। জীবনের প্রতি লোভ আর মরতে নাপারার কষ্ট ভয়ানক যন্ত্রণা হয়ে চারপাশে ঘূর্ণি তৈরি করে। যেমন, অমিত ছেলেটা অপ্টিমিস্ট। সারাদিন রোদে রোদে ঘুরে শহরের দেয়ালে শূন্যতা এঁকে দিতে পারে, আমি তাও পারি না। অপ্টিমিস্ট শব্দের সঠিক বাঙলা কী হবে ভাবছি, মাথায় আসছে না।
ইচ্ছাবাদী টাইপ কিছু হতে পারে।
০৮.
স্বাতী, অনেকদিন ধরে তোমাকে দেখতে অনেক মন চাইছে। তোমাকে মনে পড়ে, তুমি একবার দেখা দিয়ে হারিয়ে গেলে আমি ছবি আঁকা ভুলে গিয়ে হয়ে যাই অন্ধ-শামুক। আমার মুখ আর কেউ দেখে না। তুমি এলোমেলো বলেছিলে বলেই আজো এলোমেলো হয়ে থাকি রাস্তায়।
কখনো যদি জানলা খোলো দেখবে আমগাছটির গায়ে সবুজাভ ছত্রাক হয়ে তাকিয়ে আছি তোমার জানলায়। তোমার জানলায় অর্থহীন রোদ আমার ভালো লাগে না। বাতাসে অষুধের গন্ধ। তুমি কি বাতাসে কিটোকোনাজল মিশিয়ে দিয়েছো? তাতে কী!
স্বাতী, আমি হলুদ হবো। বাদামি আর কালো হবো।
তারপরও আমগাছের গায়ে চিহ্ন হয়ে রাতের মৃত্যু কামনা করবো।
তুমি বসে আছো যে অন্ধকারে-- আমি সেই অন্ধকার। আমি নিজেকে ভালোবাসি।
০৯.
ছোটোবেলায় মনে হতো আমাদের বাড়ি থেকে সমুদ্রের শব্দ শোনা যায়। আমরা একেকটা এলুমিনিয়ামের গ্লাস কানে চেপে ধরতাম, আর সমুদ্র ডাকতো আয় আয় আয়... তখন গ্লাসের মাধ্যমেই সমুদ্রের সাথে আমাদের টেলিযোগাযোগ।
সমুদ্রে যখন গেলাম, সৈকতে দাঁড়ালাম যখন ঢেউ এসে পায়ের তলা থেকে টেনে নিয়ে গেলো বালি-- পড়ে গেলাম। পরের বার আর পড়লাম না, এটাকে একধরনের খেলা মনে হলো। এরপর যতোবার সমুদ্রে গেছি ঢেউয়ের ফণায় লাফ দিয়েছি, একটা ঢেউ টেনে নিয়ে গেলে আরেকটা ঢেউ ঠেলে দিতো চরে। আমি সাঁতার পারি না-- তবু সমুদ্রে ভয় পেতাম না। এখন পাই কিনা জানি না।
অনেকদিন সমুদ্রে যাওয়া হয় না।
১০.
ইদানীং খুব পাগল পাগল লাগে নিজেকে। হঠাৎ করে বদ্ধপাগল টাইপ কিছু হয়ে গিয়ে রাস্তায় নেমে গেলে কেউ জানতেও পারবে না। আমি কখনো কাছ থেকে জিরাফ দেখি নি। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিতে দেখেছি।
আমি আর অসীম একবার জিরাফ দেখার জন্যে চিড়িয়াখানায় গিয়েছিলাম। গিয়ে জানতে পারলাম রোববারে চিড়িয়াখানা ছুটি। চিড়িয়ারা বিদেশ থেকে এসে বন্দী হয়ে আছে এই কারণে বোধহয় তাদের ছুটিও বিদেশী নিয়মে। সানডে ছুটির দিন। যাইহোক আমরা বাঁশবাগানে দুইজোড়া প্রেম দেখে ফিরে এলাম।
তারপর একদিন রাতে স্বপ্নে দেখলাম, আমি একটি জিরাফ কাঁধে নিয়ে কোথাও যাচ্ছি। জিরাফটি চোখ বন্ধ করে হাসছে। জিরাফের হাসি সুন্দর, জিরাফের গ্রীবার মতো।
১১.
স্বাতী একদিন তার কানের একটি দুল খুঁজে পাচ্ছিলো না। অনেক খোঁজাখুঁজির পর।
তার এ্যাকুরিয়ামের ভিতর সোনালি একটি মাছের কানকোয় দুলটি সে আবিষ্কার করলো। সে ভাবলো মাছটিকে জিজ্ঞেস করবে কিনা। মাছটি তার দিকে তাকিয়ে বুদ বুদ ছাড়লো পানিতে। স্বাতী আর কিছু জিজ্ঞেস করলো না, একটা দুল পরে অফিসে চলে গেলো।
স্বাতী, একটা দুল পরার দরকার কি? ওটা আমার কাছে দুইটাকার খামে ভরে পাঠিয়ে দাও।
অনেক দিন কোনো চিঠি পাই না খামভর্তি।
১২.
অস্তিত্বই অস্তিত্বের প্রমাণ। মহাত্মা দেকার্ত যেমন বলেন, 'কজিতো আর্গু সাম'।
আমার মনে হয়, অস্তিত্ব উর্ধ্ব কিংবা নিম্নমুখী নয়, অস্তিত্ব অন্তর্মুখী-- প্রথমে আত্মা এবং পরে পরম চিদাত্মার দিকে পরিণত হয়। আর বিশ্বাস হলো ওর ত্বকজাত পরিমণ্ডল যা বোধগম্য আকারকে দৃশ্যসকাশ করে।
এইসব কথা মধ্যে যখন মাথার ভিতর ঘুরে নিজেকে আরো অসহায় লাগে। আর বজ্রপাত থেকে যে ফুল কুসুমিত হয়, তার নাম মনে মনে ভাবি ম্যাগনোলিয়া নয়।
১৩.
ম্যানিলা গাছের আঁশ থেকে ফাঁসির দড়ি তৈরি হয়। এই দড়ি শক্ত কিন্তু নরোম। গলায় দাগ পড়ে না।
এটা আসে ফরাসি দেশ থেকে। কিন্তু সবখানে পাওয়া যায় না। কেবল জেলখানায় আসে। সবখানে পাওয়া গেলে ভালো হতো।
ভাবছি, এইবার বাড়ি গিয়ে একটি ম্যানিলাগাছ লাগাবো।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।