ডুবোজ্বর আমার ভাঙাপথের রাঙা ধুলায় পড়েছে কার পায়ের চিহ্ন... রবিনাথ এই গান যখনি গেয়ে উঠলেন একদিন নিঃসঙ্গ নির্জন দুপুরবেলা— পৃথিবীর কোথাও যেখানে দূর হতে দেখা যায় যুগল তালগাছ ডানা মেলে আকাশের হতে চায়, কিন্তু মাটি তাদের ছাড়ে না, ভালোবাসায় বুকে বিঁধিয়ে রাখে শিকড়বাকড় স্বর্ণালিপদাবলি— তার অনতিদূরে মাঠের বুক চিরে চরে কোথাও চলে যাওয়া একটি পথের নাম হয়ে যায় ভাঙাপথ।
এই পথ আমাকে চিনিয়েছিলো ঈষিকা। ঈষিকা মানে তুলি। এই তুলিতে জলরঙে আঁকা হয় গভীর শ্রাবণ। ঈষিকার মাথায় বর্ষাতি, আমার মাথায় আকাশ, আকাশে ঝিরিঝির শ্রাবণ।
আমাদের নগ্নপায়ে কাদার আলতা আমরা আলতোপায়ে হেঁটে মাখিয়ে দিই সবুজ ঘাসে ঘাসে। আর ঈষিকার কণ্ঠে সেই গান, আমার ভাঙাপথের রাঙা ধুলায়...
কীর্তনিয়া আসে এই পথে। সে ঘাস রোদ ধূলি পথের দুপাশে বিস্তৃত ফসলের ক্ষেত তার সাথে কথা বলে। বৃষ্টি হলে ভিজে যায়। তার পরনে পিনন, অথবা শাড়ি, কচুপাতা রঙ হতে পারে।
তার জন্মদিন ছিলো বলে সে একা হতে চেয়েছিলো। রোদের সাথে ভাঙা পথে একা হতে গিয়ে সে বৃষ্টির সাথে একা হয়ে গেলো।
আর পাহাড়ি মেয়েটা বোনের কাছে এসে এই পথে একা একা হারিয়ে যেতে বসেছিলো কোনোদিন সন্ধ্যায়। তার টেবিলে তখনো উপুর করা ছিলো গ্যালিলিওর তিন অংকের বই। কেউ তাকে ছুঁড়ে দিয়েছিলো কোনোদিন সে-ও এক ভর সন্ধ্যায় বকুলবনের পথে।
ঝরো ঝরো বরিষে বারিধারা, হায় পাথবাসী, হায় পথহারা... রবিনাথের এই গান কণ্ঠে ধরে সৌরভ পথবাসী এইপথে হেঁটে হয়ে যায় কবি ও সুন্দর। তাকেও আচ্ছন্ন করেছিলো ভয়ানক শূন্যতা। সে-ও এক আকাশের মায়া ছিলো চোখের তারায়। এই পথে এসে কতো প্রেমিক কবি ও শূন্য হয়ে গেলো আমি কেমন করে জানবো!
এই পথের কোনো নাম ছিলো না। আমি এই পথের নাম দিলাম ভাঙাপথ।
এই পথ কখনো কুকুরের মতো হেঁটে চলে গেছে মালশ্রীসন্ধ্যায় দিগন্তের দিকে। ওখানে পাড়াটির নাম বউধাবাড়ি।
একদিন ঝড়ের রাতে অনেক অনেকদিন আগে এক বউ যাচ্ছিলো শশুরবাড়ি, বিয়ের পর তো শশুরবাড়ি যাবেই। পাল্কি চলছে, পাল্কি চলছে, পাল্কি চলছে। বউ কাঁপছে কান্নায় থরোথর, বউটি কাঁপছে ঝড়ের টানে।
পাল্কি চলছে মেঘের পাল্কি, পাল্কি চলছে ঝড়ের পাল্কি... বউটির হাতে বিষের শিশি, সিঁথির ভাঙাপথে সিঁদুরের লাল। প্রিয়তম পুরুষটি এসে তাকে নিয়ে দূরে কোথাও চলে যাবে— ভাবে বউটি, না হলে এই বিষ ধারণ করে সে নীলপারিজাত হয়ে ঝড়ের হাওয়া হয়ে উড়ে চলে যাবে কোথাও। ভয়ানকশব্দে বিজলি চমকায়, কাছেই বজ্রপাত। তারপর অন্ধকার, প্রবল ঝড়ের তোড়ে বেহারা সব উড়ে যায়। পাল্কির চতুষ্কোণ ধসে পড়ে।
ভোরবেলা বউটাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। ঝড়ে এলোমেলো পাড়াজুড়ে সাড়া পড়ে যায়। সবাই ভাবে বউটা বুঝি পালিয়েই গেলো। সেই থেকে পাড়ার নাম বউধাবাড়ি।
আমি সেই বউধাবাড়ির পথের নাম দিলাম রবিনাথের গান থেকে।
সত্যি কথা এই যে, এখন ওইপথের নাম ভাঙাপথ। সবাই ভাঙাপথ নামেই চেনে, রিক্শাঅলা, প্রেমিকপ্রেমিকা, ছাত্রছাত্রী, টোকাইবালক, কবিগণ আর পাগল সবাই ভাঙাপথে কোনো না কোনো কাজে যায়, দেখে ধানের ক্ষেতে হাওয়গুলি হয়ে যায় সমুদ্র আর উর্মিমালা ভেঙে ভেঙে পড়ে পথিকের পায়ের কাছে। দেখে সরীসৃপের মতো চক্রাকারে আসে আসে শাটলট্রেন।
আমি কোনো কোনোদিন একাই চলে যেতাম নিঃসঙ্গ দুপুরবেলা। আমাকে কেউ দেখতে পেতো না কেননা ভাঙাপথ আর আমি মিলে তখন একাকার।
আমি আর ধূলিকণা একদিন গিয়ে সন্ধ্যাবধি মনখারাপ করে বসেছিলাম। আমরা দুজনে মিলে আসলে সেদিন একটা কবিতা লিখেছিলাম।
এই পথ কোথায় আপনাকে বললেই চিনবেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম গেট দিয়ে ঢুকে হাতের বামপাশে প্রথম যে রাস্তাটা নীপবন ছেড়ে ফরেস্ট্রির দিকে চলে গেছে— সেই রাস্তা ধরে যেতে হবে; ফরেস্ট্রি গেটের একটু আগে হাতের বামপাশে নামলেই ভাঙপথ। দূরে দেখা যায় জোড়া তালগাছ।
আরো দূরে ইটখোলা, ধোঁয়াউঠা বড় উচা দুই চুল্লিকে মনে হয় চুরুট। আপনি যদি কখনো যেতে চান বুক পকেট খালি রাখবেন। কেননা বুক পকেটে করে আপনাকে ভাঙাপথ থেকে আনতে হবে রৌদ্রমাখা রাঙাধূলির গন্ধ আর দুপুরের শূন্যতায় কাতর ঘুঘুপাখির ডাক।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।