ডুবোজ্বর
তাহাদের একটি গ্রাম আছে নদীর পাশে পাশে। গ্রামের নাম আছে চন্দ্রচুড়ি। তাহাদের একটি নদী আছে গ্রামের পাশে পাশে। নদীর নাম আছে কঙ্কচোখি। আমি তাহাদের চিনি আঁতুড়ঘরে।
তাহারাও আমাকে চেনে ভোরের বেলা। তাহাদের মানে তাহার। তাহারও একটি নাম আছে রিমিঝিম রিমিঝিম...
তাহাদের পাখি, তাহাদের বকুলবনে পাতার ছায়া আর পুষ্পগন্ধ হাওয়া আছে। আছে রোদ, ঘাস আর ঘাসফড়িং। তারা ঘাসফড়িং কে বলতো শয়তানের ঘোড়া।
নারিকেল পাতার ঘড়ি আর চশমা এখন এক একটা ঘাসফড়িং হয়ে উড়ে বেড়ায়। কাগজের নৌকো আছে উঠানে বাঁধা-- বৃষ্টির প্রতীক্ষায়। সবি আছে ডালপালা, পুঁইয়ের বিচি, শিমের পাতায় সবুজ রঙধনু, বটফলের জীবনী আছে বটপাতার ফাঁকে...
কেবল একটি মেয়ে হারিয়ে গেছে শাদা শাদা মেঘের কোজাগর পাপিয়া।
সে গাঁয়ের ধারে বনে বনে সারাদিন। সে পাতার ফাঁকে আকাশ দেখতো, উল্টো করে দূরবীণ।
সে মনে করতো পাতার ফাঁকে সকল আকাশ ভাঙা কাচের টুকরো নয় কেবল, এরা এক একটা পেইন্টিং। সে ছবির ভিতর খুঁজে বেড়াতো উড়ার ডানা ও পেখম।
সে একদিন এলো নিমফুল অরণ্য। মাঝখানে সিঁথি তার লিথিময় বিস্মৃতি।
বললাম তাকে, পাতার ফাঁকে যে আকাশ তুমি দেখো ছবি-- ওটা আমার আঁকা।
সে আশ্চর্য সবুজ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকতো।
তার কাছে সবকিছুই বিস্ময়। তার কাছে সব কিছুই দীপ্র কৌতূহল।
সে একটু পর পর বড় বড় চোখ করে জিজ্ঞেস করতো, আত্তা! এতা কী, ওতা কী?... ইত্যাদি। যেনো যা কিছু সুন্দর এবং ইন্দ্রিয়ের গ্রহণযোগ্য-- সব তাকে জানতে হবে।
সে যে ইশ্কুলে পড়তো-- সেই ইশ্কুলের পাশে একটা পাগল থাকতো। আমরা কেউ তার নাম জানতাম না। তাকে সবাই ডাকতো ওগ্গাটিঁয়া নামে। কারণ কারও সাথে দেখা হলেই সে বলতো, ওগ্গাটিঁয়া। মানে সে একটাকা চাইতো।
মেয়েটি অনেকদূরের একটি গাঁয়ে অন্য একটা ইশ্কুলে চলে যাওয়ার পর একদিন আমার কাছে একটা চিঠি পাঠালো বিজলির ডাকঘরে। চিঠিতে লেখা, ওগ্গাটিঁয়া কেমন আছে?
জানালাম, ভালো নেই। এখন খুব অসুখ।
মেয়ে! ঝুমঝুম! কেউ জানে না কিছুই, তুমিও জানো তা, তোমার ও¹াটিঁয়া কচুপাতার বনে অবিশ্রাম বৃষ্টি হতে গিয়ে একটা কানাকুয়া পাখি হয়ে হারিয়ে গেছে সুদূরের বনে।
একদিন আমি তাকে বললাম, আমি চোখের ছুরিতে দৃশ্যগুলি চিরে চিরে দেখি...
সে তখন শাদারাত্রির রূপকথা।
অবাক সুন্দর চোখে আমাকে চিরে দেখে। তারপর চলে যায়, কাউকে কিছু না বলে। অনেক দূর গাঁয়ে ইশ্কুল বাসে বসে জানলার কাচের ভিতর দিয়ে সে ইদানীং বাইরের দৃশ্যগুলি চিরে চিরে দেখে হয়তো। অথবা দৃশ্যরাই তাকে চিরে চলে আসমুদ্র সুন্দর।
সে একদিন ঝুমঝুম বৃষ্টির ভিতর ছাতা মাথায় আমার সামনে এসে দাঁড়ালো।
আমি তখন আষাঢ়ের বৃষ্টিতে ভিজে এক দীর্ঘ জলাশয়, আমার রঙ গাঢ় পান্না। সে এসে আমার সামনে দাঁড়ালো, আমি তাকে বললাম, ছাতা কালো, বিচ্ছিরি দেখতে...
আর তখনই একটা ঝড় এলো হু হু করে। সে ঝড়ের হাতে ছাতাটা দিয়ে আমাকে বললো, আচ্ছা, তুমি কি শিরোনামহীনের বর্ষা গানটা শুনেছো?
হ্যাঁ তো!
ওটা আমার প্রিয়, অনেক প্রিয়... কেনো জানো?
বলো শুনি।
ওটাতে যে সরোদ বাজে-- মনে হয় সত্যিই বর্ষা...
হুম! তুমি কি জানো?
কী!
আমিই সেই সরোদের অবিশ্রান্ত স্বরলিপি।
একদিন সে সমস্ত শাদা আর শাদা হয়ে গেলো।
যেনো শরতের মেঘ আর কাশবন। যেনো জানলার শাদা পর্দার শাদা শাদা ছায়ানৃত্য। তাকে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া গেলো না। বিজলির ডাকঘরে ডাকবাকশো শূন্যতার যমজবোন হয়ে পড়ে রয়। খামের ভিতর জমা হয় ঝড়ের নিঃশ্বাস।
আমার একটা দোয়েলপাখি ছিলো। আমার নিজের মা তাকে একদিন পেট থেকে বের করেছিলো। উনিশবছর খাঁচার ভিতর স্বপ্না›ধ জ্বরের ভিতর থেকে থেকে একদিন যখন খাঁচা ছিঁড়ে উড়ে চলে গেলো। সেদিন আমার গভীর কষ্টের ভিতর আনন্দ এসে হচ্ছিলো স্বপ্নময় মাছ। সেদিনও সে এসেছিলো।
এসে বললো, জানো, পাখিটার সাথে আমার মিল আছে দুটি।
কী কী?
একটা বয়সে, অন্যটা...
অন্যটা কী?
না, অন্যটা কী তোমাকে বলবো না একদিনও...
তাকে আমি অনেকদিন খুঁজেছি। শাক আর আলুর কাছে গিয়ে জানতে চেয়েছি তার খোঁজ। তারা বলেছে, তুমি জলের কাছে যাও। জলের কাছে গেলাম।
জল বললো, আমার রঙের কাছে শুধাও।
সে বুঝি জলরঙ ছবি হয়ে গেছে!
আমি ঠিক করেছি তার জন্যে তেরোটা পদ্য লিখবো। সে জানবে না কিছুই; তারপরও।
তেরোটা পদ্যের রঙ হবে তেরো রকম-- নিমফুল, বকুল, বেলি, বেলপাতা, জোছনা, রোদ্দুর, জল, কাজল, অশ্রু, রাত্রি, সন্ধ্যা, জোনাক এবং শালবন।
তেরোটা পদ্যের সুর বইবেন তেরোজন ধ্রুপদ-- ইমন, আশাবরী, বিলাবল, দেবগিরি, চন্দ্রকান্ত, পটমঞ্জরী, ঝিঁঝিঁট, মেঘমল্লার, বেহাগ, সাজগিরি, ছায়ানট, ভূপালী এবং বারিষ।
কেউ জানবে না।
আমার নাম আছে চন্দ্রচুড়ি। আর এই আমিই আছি তাহাদের গ্রাম। পূর্বে আমি কখনো ছিলাম নীলাভ সিলিকন। এখন কেবলই আমি নীল।
আকাশের কপালে ঝাপসা টিপ হয়ে আছি বাদলরাতের দুর্বিষহ পূর্ণিমায়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।